লণ্ডনে পৌঁছেই ফিলিয়াস ফগ সোজা বাড়ি চলে এলেন, ক্লাবে আর গেলেন না। এমনিতর সর্ব-বাজি-ধরা এক ভ্রমণে অপরের দোষে শেষমুহূর্তে হেরে-যাওয়া যে কী মর্মান্তিক তা অন্যে বুঝতে পারবে না। কিন্তু মিস্টার ফগ তখনও অবিচলিত। তার যথাসর্বস্ব তখন বারিং-এর গদিতে ছিলো—সে-টাকা এখন রিফর্ম ক্লাবের সভ্যদের। খরচপত্র বাদে তার হাতে যা-কিছু সামান্য টাকাকড়ি ছিলো, তা নিয়েই কোনোরকমে এবার দিন কাটাতে হবে।
ফগ তাঁর বাড়ির একটা কোঠা আউদার জন্যে ছেড়ে দিলেন।
পাসপার্তু শুনেছিলো, অনেক সময় এ-রকম দুর্দশায় পড়লে হতাশ-হৃদয় মানুষ আত্মহত্যা করে সকল যন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা করে। ফগ যাতে তেমনকিছু করে না-বসেন সেজন্যে সে সতর্ক হয়ে রইলো। বলাবাহুল্য, বাড়ি পৌঁছেই পাসপার্তু তার কোঠার গ্যাসের বাতি নিভিয়ে দিয়েছিলো।
ক্রমে রাত এলো। রাত ঘনও হলো। সকলেই শুলেন। ফগ ঘুমিয়েছিলেন কি না কে জানে। তবে আউদা সারারাত দুশ্চিন্তায় কেঁদে-কেঁদে কাটিয়েছিলেন। আর পাসপার্তু সারারাত অতন্দ্র চোখে বসে ছিলো ফগের ঘরের দরজায়।
পরদিন ভোরবেলা পাসপার্তুকে ডাকলেন ফগ। বললেন : মিসেস আউদার প্রাতরাশের বন্দোবস্ত করো। আর বলে এসো আজ সন্ধ্যায় আমি তার সঙ্গে দেখা করতে চাই।
ফগ সেদিন আর রিফর্ম ক্লাবে গেলেন না। কী-ই বা দরকার যাওয়ার? সারাদিন ঘর বন্ধ করে বসে নিজের ভবিষ্যৎ ঠিক করছিলেন ফগ। পাসপার্ত মূহর্তের জন্যেও সেই বন্ধ দরজা ত্যাগ করলে না। ঘরের মধ্যে সামান্য-একটু শব্দ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই উৎকর্ণ হচ্ছিলো সে–এই বুঝি ঘটলো কোনো দুর্ঘটনা। দরজার চাবির ফাঁক দিয়ে সে মধ্যে-মধ্যে ঘরের ভিতর দৃষ্টিক্ষেপ করে ফগকে দেখে নিচ্ছিলো।
ক্রমে সন্ধ্যা হলো। সাড়ে-সাতটার সময় ফগ আউদার ঘরে এসে চুল্লির পাশে একটা চেয়ারে বসলেন। তার ভাবলেশহীন মুখ দেখে কে বলবে যে তিনি এমনিতর একটি বাজিতে হেরেছেন। একটু চুপ করে থেকে আউদাকে বললেন : আপনাকে ইংল্যাণ্ডে এনে বড়ো অপরাধ করেছি। সেজন্যে ক্ষমা চাচ্ছি।
চঞ্চল হয়ে উঠলো আউদার হৃদয়। তাকে যিনি মত্যর হাত থেকে ছিনিয়ে এনে বাঁচালেন, তিনি চাইছেন ক্ষমা? তার চোখ জলে ভরে এলো।
ফগ বলে চললেন : আমি যখন আপনাকে এখানে আসতে বলি, তখন আমার টাকার অভাব ছিলো না। ভেবেছিলুম সেই টাকার অর্ধেক আপনার জন্যে খরচ করবো। আপনি তাহলে স্বাধীনভাবে থাকতে পারতেন। আপনি তো জানেনই, এখন আমি পথের ভিখিরি।
ভাঙাগলায় আউদা বললেন : মিস্টার ফগ, আমি সবই জানি। আপনার সঙ্গে সঙ্গে একটা ভারি বোঝার মতো আসাটাই আমার অন্যায় হয়েছে। আমিই সেজন্যে ক্ষমা চাচ্ছি আপনার কাছে। আমিই তো ছিলুম আপনার ক্ষিপ্রগতির প্রধান বাধা। পথে আপনার কত দেরিই না হলো আমার জন্যে। সে না-হলে কি আজ এমন দুর্দশা হয় আপনার! আমি যে আগুনে পুড়ে মরছিলুম সে-ই ছিলো ভালো।
আপনার জন্যে আমার একফোঁটাও দেরি হয়নি। সেজন্যে আপনি দুঃখিত হবেন। কিছুতেই আপনি ভারতবর্ষে নির্বিঘ্নে থাকতে পারতেন না। একদিন যারা আপনাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিলো, তারাই আবার আপনাকে খুঁজে বার করতো।
আপনি মহৎ-হৃদয়, তাই সেই বিপদ থেকে আমাকে তো উদ্ধার করেইছিলেন, এখানে এসে যাতে আমি স্বাধীনভাবে সুখে-স্বচ্ছন্দে দিন কাটাতে পারি তার একটা ব্যবস্থাও করতে চেয়েছিলেন।
চেয়েছিলুম, কিন্তু হলো কই? আমার দুর্ভাগ্য সব ওলোটপালোট করে দিলে।
যা-ই হোক, আমার এখনও যা-কিছু আছে তাই আমি আপনার হাতে তুলে দিতে চাই।
তাহলে আপনার কী করে চলবে? আপনি বোধহয় আপনার নিজের ভবিষ্যতের দিকে তাকাচ্ছেন না। আপনার যাতে কোনো অসুবিধে বা অভাব নাহয়, আপনার বন্ধুরা নিশ্চয়ই সেদিকে নজর রাখবেন।
আমার কোনো অভাব নেই বলেই সকল অবস্থাই আমার কাছে সমান, ভবিষ্যৎ ও। আমার কোনো বন্ধু-বান্ধবও নেই যে আমার জন্যে তাদের এত মাথাব্যথা হবে।
কিন্তু আত্মীয়-স্বজন?
এখন আর আমার কোনো আত্মীয়-স্বজনও নেই।
মিস্টার ফগ, আপনার জন্যে আমার বড়ো কষ্ট হচ্ছে। জীবনে আপনি এত একা–দুঃখের অশ্রু মুছিয়ে দিতে পারে এমন-কেউ নেই, সে-যে বড়ো ভয়ানক জীবন! লোকে কথায় বলে, দুঃখের বোঝা নেবার যদি অংশিদার থাকে, তবে সে-বোঝা যতই ভারি হোক না কেন, অনায়াসে ঘাড়ে নিতে পারা যায়। আউদা চেয়ার থেকে উঠে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলেন ফগের দিকে। আমি যদি আপনার দুঃখের বোঝর অংশিদার হতে, চাই তবে কি আপনার আপত্তি আছে? আপনি কি আমায় আপনার স্ত্রীর সম্মান দেবেন?
ফগও তখন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। তার ঠোঁট কাঁপতে লাগলো। চোখের তারা হয়ে উঠলো উজ্জ্বল। ফগ ডাকলেন পাসপার্তু!
পাসপার্তু ঘরে ঢুকে যখন দেখলো ফগ আউদার সামনে দাঁড়িয়ে তার নরম হাত দুটি ধরে আছেন, তখন সব-কিছু বুঝে ফেলতে তার একটুও দেরি হলো না। ফগ বললেন : গির্জের বিশপকে এক্ষুনি বিয়ের খবর দিতে হবে, পাসপার্তু। এখনও রাত বেশি হয়নি।
পাসপার্তু খুশিগলায় বললে : এ-খবরের আবার সময়-অসময় কী? কাল সোমবার। কালই কি বিয়ে হবে?
ফগ আউদার দিকে তাকালেন। সলজ্জ কণ্ঠে আদা বললেন : তা-ই হোক।