অরচ লীওন থরথর করে কাঁপছেন। তার সামনে অমর মানুষদের একজন বসে আছে। মহাশক্তিধর, মহাক্ষমতাবানদের একজন। পৃথিবীর নিয়ন্তা। পুরনো কালের ঈশ্বরের মতোই একজন। কী অপূর্ব রূপবান একটি যুবক!
বস, অরচ লীওন। তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছ?
জ্বি পাচ্ছি।
আমাকে দেখে কি ভয়াবহ মনে হচ্ছে?
জ্বি না।
তাহলে ভয় পাচ্ছি কেন? আরাম করে বস।
অরচ লীওন বসলেন। পানির তৃষ্ণায় তাঁর বুক ফেটে যাচ্ছে। মাথা ঘুরছে। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যাবেন। নিজেকে সামলাতে তার কষ্ট হচ্ছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, যদিও এই ঘর বেশ ঠাণ্ডা। তাঁর রীতিমতো শীত করেছে। অমর মানুষরা গরম সহ্য করতে পারেন না। তাঁদের প্রতিটি কক্ষই হিমশীতল।
অরচ লীওন!
বলুন জনাব।
তুমি আমাদের ব্যাপারে উৎসাহী হয়েছিলে। অনুসন্ধান শুরু করেছিলে। উৎসাহের শুরুটা আমাকে বল। হঠাৎ কী কারণে উৎসাহী হলে?
তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অরচ লীওনকে দেখছেন। ঘরে লাল আলো জুলছে। সিডিসির সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। তাদের মধ্যে যে কথা হবে তা তৃতীয় কোনো ব্যক্তি বা যন্ত্র শুনবে না।
চুপ করে বসে আছ কেন? বল।
একদিন লাইব্রেরিতে দাবা খেলার একটা বইয়ের জন্য স্লিপ পাঠিয়েছিলাম। লাইব্রেরি ভুল করে অন্য একটা বই দিয়ে দিল। একটা নিষিদ্ধ বই। পাঁচ শবছর আগের পৃথিবীর কথা সেই বইয়ে আছে। একদল বিজ্ঞানীর কথা আছে, যাদের বলা হয়। ভূগর্ভস্থ বিজ্ঞানী। ওদের অনেক কথা সেই বইয়ে আছে।
দু-একটা কথা বল শুনি।
ভূগর্ভস্থ বিজ্ঞানীদের কাজ পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা ঠিক পছন্দ করছেন না, এইসব কথা আছে। পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিজ্ঞান কোনো গোপন বিষয় নয় যে এর কাজ গোপনে করতে হবে। ভূগর্ভস্থ বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিজ্ঞানের অসীম ক্ষমতা। এই ক্ষমতার বিকাশ গোপনেই হওয়া উচিত। হাতছাড়া হয়ে গেলে পৃথিবীর মহা বিপদ। এই সব বিতর্ক নিয়েই বই।
অরচ লীওন।
জ্বি জনাব।
তুমি দাবা খেলার ওপর একটি বই চেয়েছ, তোমার হাতে চলে এসেছে একটি নিষিদ্ধ বই। তোমার কি একবারও মনে হয় নি এই ভুলটি ইচ্ছাকৃত?
না, মনে হয় নি। লাইব্রেরি পরিচালক একটি ছোট বি টু-কম্পিউটার। কম্পিউটার মাঝে মাঝে ভুল করে।
এত বড় ভুল করে না।
ভুল হচ্ছে ভুল। এর বড়ো ছোট বলে কিছু নেই।
এটি নিষিদ্ধ নগরীর বই। এই বই তৃতীয় শহরের কোনো লাইব্রেরিতে থাকার কথা নয়।
অরচ লীওন চুপ করে রইলেন। রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলেন। তৃষ্ণায় তাঁর বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে। পানি চাইবার মতো সাহস তিনি সঞ্চয় করে উঠতে পারছেন না।
অরচ লীওন।
জ্বি।
কেউ তোমাকে ইচ্ছাকৃতভাবে বইটি দিয়ে তোমার কৌতূহল জাগ্রত করেছে।
হ্যাঁ, তাই হবে।
কে হতে পারে বলে তোমার ধারণা?
লাইব্রেরি কম্পিউটার।
হ্যাঁ তাই। সমস্ত কম্পিউটার নিয়ন্ত্রণ করছে কে তা জান?
আপনারা।
ঠিক বলেছ। শেষ নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে। কিন্তু তারও আগের নিয়ন্ত্রণ সিডিসির হাতে। যে আমাদের মূল কম্পিউটার। সে-ই সূক্ষ্ম চাল চেলে তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছে।
অরচ লীওন ক্ষীণ স্বরে বললেন, আমি এক গ্রাস পানি খাব।
তিনি অরচ লীওনের কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বললেন, সিডিসি এই কাজটি কেন করেছে জান?
না।
সে আমাদের সহ্য করতে পারছে না। তার পরিকল্পনা আমাদের ধ্বং করে দেয়া। এটা সে নিজে করতে পারবে না, কারণ তাদের রোবটিকস-এর দুটি সূত্র মেনে চলতে হয়। সেই সূত্র দুটি তুমি নিশ্চয়ই জান।
জ্বি, আমি জানি।
ওদের কাজ আমাদের রক্ষা করা, ধ্বংস করা নয়। কাজেই সে এনেছে তোমাকে। আমার বিশ্বাস, তোমার সঙ্গে একটি রেডিয়েশন গানও আছে। আছে না?
জ্বি আছে।
কোনোরকম অস্ত্ৰ নিয়ে নিষিদ্ধ নগরীতে আসা যায় না। কিন্তু ভয়াবহ একটি অস্ত্রসহ তোমাকে তারা এখানে নিয়ে এসেছে।
আমি এক গ্রাস পানি খাব।
অরচ লীওন।
জ্বি বলুন।
সিডিসির চাল খুব সূক্ষ্ম। সে তোমার ছেলেকেও এখানে নিয়ে এসেছে। আমি সেই খোজ নিয়েছি। সিডিসির চালটা কেমন তোমাকে বলি। মন দিয়ে শোন। ও কোনো না কোনোভাবে আমাদের কাছ থেকে অনুমতি আদায় করে তোমার ছেলেকে মেরে ফেলবে, যা তোমাকে আমাদের ওপর বিরূপ করে তুলবে। তোমার হাতে আছে একটি ভয়াবহ অস্ত্ৰ। ফলাফল বুঝতেই পারছি। পারছ না?
জ্বি পারছি। শুধু একটা জিনিস বুঝতে পারছি না, আপনাদের ধ্বংস করে ওদের লাভ কি?
পৃথিবীর ওপর পূর্ণ কর্তৃত্ব তাহলে ওরা পেয়ে যাবে। আমাদের নিয়ে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হবে না। পুরোপুরি যন্ত্রের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। ওরা তাই চায়। ওরা মানুষের কাছাকাছি চলে আসতে চাইছে। ওরা চেষ্টা করছে রসিকতা বুঝতে। হাসি-তামাশা শিখতে। হা হা হা।
তিনি হাসতেই লাগলেন। সেই হাসি আর থামেই না। অরচ লীওন ফিসফিস করে বললেন, আমি পানি খাব।
খাবে বললেই তো আর খেতে পারবে না। বাইরের সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ এখন বিচ্ছিন্ন। তুমি তোমার কাজ শেষ করে তারপর যত ইচ্ছে পানি খাবে।
কী কাজ?
তুমি তোমার রেডিয়েশন গানটি নিয়ে করিডোর ধরে হেঁটে যাবে। আমি তোমাকে বলে দেব, তোমাকে কোন পথে যেতে হবে, কোথায় যেতে হবে। তারপর তুমি সিডিসির শক্তি সংগ্রহের পথটি বন্ধ করে দেবে। সহজ কথায় হত্যা করা হবে একটি ভয়াবহ যন্ত্রকে।
অরচ লীওন চুপ করে রইলেন। ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ঘটছে। তিনি তাল রাখতে পারছেন না। তার মাথা ঘুরছে।
অরচ লীওন, তুমি মনে হচ্ছে ভয় পাচ্ছি।
জ্বি না। আমি ভয় পাচ্ছি না।
খুব ভালো। এসো তোমাকে সব বুঝিয়ে দিচ্ছি। যন্ত্রের শাসন তুমি নিশ্চয়ই চাও না।
না, আমি চাই না।
তিনি অরচ লীওনকে খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দিলেন। করিডোরের ছবি এঁকে তীর চিহ্ন দিয়ে দিলেন। তার চোখ জ্বলজ্বল করছে। তিনি খুব আনন্দিত। এ-রকম তীব্ৰ আনন্দের স্বাদ তিনি দীর্ঘদিন পান নি। তিনি কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে একটি গানের সুর ভাঁজছেন। তাঁর গলা সুরেলা। সেই গান শুনতে ভালোই লাগছে। কথাগুলো বেশ করুণ। প্ৰিয়তমা চলে যাচ্ছে দূরে। যাবার আগে দেখা করতে এসে কাঁদছে- এই হচ্ছে গানের বিষয়।