১৩৮তম অধ্যায়
পুনঃ পুনঃ ভীম কর্ণসমর-কৌরবপরাজয়
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! বোধ করি, এক্ষণে আমারই সেই মহতী দুর্নীতির পরিণাম সমুপস্থিত হইয়াছে। আমি পূর্ব্বে যাহা হইয়াছে, তাহার নিমিত্ত চিন্তা করা নিতান্ত অনাবশ্যক, এই মনে করিয়া বিগত বিষয়ে উপেক্ষা প্রদর্শন করিতাম; কিন্তু এক্ষণে তাহার প্রতিবিধানের নিমিত্ত নিতান্ত ব্যগ্র হইয়াছি। যাহা হউক, এক্ষণে আমি ধৈৰ্য্যাবলম্বন করিয়াছি; তুমি আমার দুর্নীতিনিবন্ধন যে মহান্ বীরক্ষয় সমুপস্থিত হইয়াছে, তব্ত্তান্ত বর্ণন কর।”
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ। অনন্তর মহাবলপরাক্রান্ত কর্ণ ও ভীম উভয়ে বারিধারাবর্ষী মেঘের ন্যায় শরধারা বর্ষণ করিতে লাগিলেন। ভীমনামাঙ্কিত সুবর্ণপুঙ্খ শাণিত শরসমুদয় কর্ণের জীবন ভেদ করিয়াই যেন তাঁহার শরীরমধ্যে প্রবেশ করিল। কর্ণনির্মুক্ত ময়ূরপুচ্ছলাঞ্ছিত অসংখ্য শরও বৃকোদরকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। ঐ মহাবীরদ্বয়ের শরসমুদয় চতুর্দ্দিকে নিপতিত হওয়াতে কৌরবপক্ষীয় সৈন্যগণ সংক্ষুব্ধসমুদ্রের ন্যায় ছিন্নভিন্ন হইয়া পড়িল। মহাবীর ভীমসেন স্বীয় শরাসননির্মুক্ত আশীবিষসদৃশ ভীষণ শরনিকরে কৌরবসৈন্যসমুদয়কে বিনাশ, করিতে লাগিলেন। বায়ুভগ্ন বনস্পতিসমুদয়ের ন্যায় তীক্ষ্ণশরনিপাতিত অসংখ্য হস্তী, অশ্ব ও মনুষ্যগণে সমরভূমি সমাকীর্ণ হইল। সহস্র সহস্র কৌরবসৈন্য ভীমের শরে গাঢ়বিদ্ধ হইয়া, ‘একি আশ্চর্য্য ব্যাপার!’ এই বলিতে বলিতে সকলে পলায়ন করিতে লাগিল। মহাবীর কর্ণও ঐ সময় বিমোহিতপ্রায় হইয়া স্বপক্ষ অসংখ্য কৌরবসৈন্য সংহার করিলেন। হতাবশিষ্ট সিন্ধু, সৌবীর ও কৌরবসৈন্যসমুদয় মহাবীর কর্ণ ও ভীমসেনের শরে উৎসারিত ও অশ্বগজবিহীন হইয়া তাঁহাদিগকে পরিত্যাগপূর্ব্বক চতুর্দ্দিকে পলায়নে প্রবৃত্ত হইল এবং কহিতে লাগিল, নিশ্চয়ই বোধ হইতেছে, দেবতারা পাণ্ডবের নিমিত্ত আমাদিগকে মুগ্ধ করিতেছেন, নতুবা কর্ণ ও ভীমসেনের শরে আমাদিগেরই বলক্ষয় হইবে কেন? হে মহারাজ! আপনার সেই ভয়ার্ত্ত সেনাসমুদয় এই বলিতে বলিতে সেই বীরদ্বয়ের শরনিপাতের পথ পরিত্যাগপূর্ব্বক দূরে গমন করিয়া সমরদর্শনার্থ দণ্ডায়মান রহিল।
“ঐ সময় অসংখ্য হস্তী, অশ্ব ও মনুষ্যগণের রুধিরে সমরাঙ্গনে শূরগণের হর্ষবর্দ্ধন, ভীরুগণের ত্রাসজনক এক ভীষণ রুধিরনদী প্রবাহিত হইল। নিহত অসংখ্য মনুষ্য, হস্তী, অশ্ব ও তাঁহাদিগের অলঙ্কার এবং রাশি রাশি অনুকর্ষ, পতাকা, রথভূষণ, চক্র, অক্ষ ও কূবরবিহীন রথ, গভীরনিঃস্বন সুবর্ণচিত্রিত শরাসন, সুবৰ্ণপুঙ্খ বাণ, নির্মোকমুক্ত পন্নগসদৃশ প্রাস, তোমর, খড়্গ ও পরশু, সুবর্ণময় গদা, মুষল ও পট্টিশ এবং বিবিধাকার হীরক, শক্তি, পরিঘ ও বিচিত্র শতঘীতে সমরাঙ্গন পরিব্যাপ্ত হইল। শরনিকরসংছিন্ন রাশি রাশি অঙ্গদ, হার, কুণ্ডল, মুকুট, বলয়, অঙ্গুলিবেষ্টন, চূড়ামণি ও উষ্ণীষ, স্বর্ণালঙ্কার, তনুত্রাণ, তলত্র, গ্রৈবেয়, বস্ত্র, ছত্র, ব্যজন এবং অসংখ্য হস্তী, অশ্ব ও নরগণের কলেবর ইতস্ততঃ নিপতিত থাকাতে সমরভূমি গ্রহসমুদয়সমাকীর্ণ আকাশমণ্ডলের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। সংগ্রামদর্শনার্থ সমাগত সিদ্ধ ও চারণগণ সেই মহাবীরদ্বয়ের অচিন্ত্যনীয় ও অমানুষিক কাৰ্য্যদর্শনে সাতিশয় বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন। হুতাশন যেমন বায়ুসহায় হইয়া কমধ্যে বিচরণপূর্ব্বক উহা অনায়াসে দগ্ধ করে, তদ্রূপ মহাবীর ভীমসেন কর্ণসমভিব্যাহারে সৈন্যমধ্যে বিচরণপূর্ব্বক তাহাদিগকে বিনষ্ট করিতে লাগিলেন। গজদ্বয় যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া যেমন নলবন বিমর্দ্দন করে, তদ্রূপ মহাবীর কর্ণ ও ভীমসেন পরস্পর সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়া কৌরবপক্ষীয় অসংখ্য রথ, ধ্বজ, হস্তী, অশ্ব ও মনুষ্যদিগকে মর্পিত করিলেন। হে মহারাজ! এইরূপে মহাবীর ভীম ও কর্ণ অসংখ্য সৈন্য বিমর্পিত করিতে লাগিলেন।”