১৩৭তম অধ্যায়
দীর্ঘসূত্রীর বিপদ—শকুলমৎস্য-বৃত্তান্ত
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! যে ব্যক্তি ভবিষ্যৎ বিবেচনা করিয়া কাৰ্য্য করে, তাহাকে অনাগতবিধাতা, যে ব্যক্তি হঠাৎ কোন কাৰ্য্য উপস্থিত হইলে স্বীয় বুদ্ধিবলে তৎক্ষণাৎ তাহা সংসাধন করিতে পারে, তাহাকে প্রত্যুৎপন্নমতি এবং যে ব্যক্তি কোন কাৰ্য্য উপস্থিত হইলে তাহা সম্পাদনে সত্বর না হইয়া উহা আজি না হয় কালি করিব বিবেচনা করিয়া আলস্যে কালক্ষেপ করে, তাহাকে দীর্ঘসূত্রী কহে। এই জগতে অনাগতবিধাতা ও প্রত্যুৎপন্নমতি এই উভয় ব্যক্তিই সুখলাভ করিতে পারেন, কিন্তু দীর্ঘসূত্রীকে অচিরাৎ বিনষ্ট হইতে হয়। এক্ষণে আমি এই বিষয়ে একটি উৎকৃষ্ট উপাখ্যান কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। কোন এক মৎস্যসমাকীর্ণ স্বল্পজলবিশিষ্ট জলাশয়ে তিনটি শকুল[শাল–শৌল গজাল প্রভৃতি]মৎস্য বাস করিত। তন্মধ্যে একটি অনাগতবিধাতা, একটি প্রত্যুৎপন্নমতি ও একটি দীর্ঘসূত্রী। একদা মৎস্যজীবিগণ মৎস্য ধরিবার মানসে চতুর্দ্দিক হইতে সেই ক্ষুদ্র জলাশয়ের জল নিঃস্রাবিত করিতে লাগিল। তখন সেই দীর্ঘদর্শী শকুলমৎস্য জলাশয়কে ক্রমে ক্রমে শুষ্ক হইতে দেখিয়া স্বীয় মিত্রদ্বয়কে কহিল, “দেখ, এক্ষণে এই জলাশয়ের জলজন্তুর বিপদ্কাল সমুপস্থিত হইয়াছে; অতএব চল, আমরা আমাদের নির্গমনের পথ নষ্ট না হইতেই অবিলম্বে অন্য জলাশয়ে প্রস্থান করি। যে ব্যক্তি নীতি প্রভাবে অনুপস্থিত [ভাবী—যাহা পরে ঘটিতে পারে] বিপদের প্রতিবিধান করে, তাহাকে কোন কালেই বিপদগ্রস্ত হইতে হয় না; অতএব চল, আমরা বিপদ উপস্থিত হইবার পূৰ্বেই পলায়ন করি।’ তখন দীর্ঘসুত্রী কহিল, ‘মিত্র! তুমি যাহা কহিলে, যথার্থ বটে, কিন্তু আমার মতে কোন কাৰ্য্যেই ত্বরান্বিত হওয়া উচিত নহে।’ ঐ সময় প্রত্যুৎপন্নমতিও অনাগতবিধাতাকে সম্বোধন করিয়া কহিল, ‘ভাই! আমি ভবিষ্যৎ বিবেচনা করিয়া কোন কাৰ্য্য করি না, কিন্তু কোন কাৰ্য্য উপস্থিত হইলে তৎক্ষণাৎ তাহা সম্পাদন করিতে পারি।’ দীর্ঘসূত্রী ও প্রত্যুৎপন্নমতি এই কথা কহিলে অনাগতবিধাতা তাহাদিগের তৎক্ষণাৎ পলায়নের মত নাই বুঝিতে পারিয়া স্বয়ং অবিলম্বে স্রোতোদ্বারা এক গভীর জলাশয়ে প্রস্থান করিল।
“কিয়ৎক্ষণ পরে সেই ক্ষুদ্র জলাশয় হইতে সমুদয় জল নিঃসৃত হইলে মৎস্যজীবী ধীবরগণ [জেলেরা] বিবিধ উপায়দ্বারা মৎস্যসমুদয়কে রুদ্ধ করিতে লাগিল। ঐ সময় দীর্ঘসূত্রী ও প্রত্যুৎপন্নমতি অন্যান্য মৎস্যগণের ন্যায় অবরুদ্ধ হইল। অনন্তর ধীবরগণ রজ্জুদ্বারা মৎস্যদিগকে গ্রথিত করিতে আরম্ভ করিলে প্রত্যুৎপন্নমতি সেই গ্রথিত মৎস্যগণের মধ্যে প্রবেশপূৰ্ব্বক গ্রহণরজ্জু দংশন করিয়া [মাছগাঁথা] অবস্থান করিতে লাগিল। তখন ধীবরগণ সমুদয় মৎস্য গ্রথিত হইয়াছে বিবেচনা করিয়া তাহাদিগকে বিপুল জলে প্রক্ষালন করিতে লাগিল। ঐ অবসরে প্রত্যুৎপন্নমতি সেই গ্রহণরজ্জু পরিত্যাগপূৰ্ব্বক উপস্থিত বিপদ হইতে মুক্ত হইল। কিন্তু হীনবুদ্ধি দীর্ঘসূত্রী পলায়নের কোন উপায় স্থির করিতে না পারিয়া বিচেতন ও বিকলেন্দ্রিয় হইয়া প্রাণ পরিত্যাগ করিল!
“হে ধৰ্ম্মরাজ! এইরূপে যে ব্যক্তি মোহপ্রযুক্ত উপস্থিত বিপদ বিবেচনা করিতে না পারে, তাহাকে দীর্ঘসূত্রী মৎস্যের ন্যায় অচিরাৎ বিনষ্ট হইতে হয়; আর যে ব্যক্তি আপনাকে কাৰ্য্যনিপুণ বোধ করিয়া অগ্রে বিপদের প্রতিবিধান না করে, প্রত্যুৎপন্নমতি মৎস্যের ন্যায় তাহার জীবন সংশয়াপন্ন হইয়া উঠে। আর যে ব্যক্তি বিপদ উপস্থিত না হইতে হইতেই তাহার উপায় উদ্ভাবন করিতে পারে, সে অনাগতবিধাতা মৎস্যের ন্যায় নির্ব্বিঘ্নে কালহরণ করিতে সমর্থ হয়। অবহিতচিত্তে দেশের এবং কলা [৩০ কাষ্ঠা], কাষ্ঠা [১৮ নিমেষ—১৮ বার চক্ষুর পলক পড়িতে যত সময়], মুহূৰ্ত্ত[দিবসের ১৫ ভাগের এক ভাগ—প্রায় দুই দণ্ড-৪৮ মিনিট], দিবা, রাত্রি, ক্ষণ, মাস, পক্ষ, ঋতু, কল্প ও সংবৎসর প্রভৃতি কালের সূক্ষ্মতা অবগত হওয়া নিতান্ত আবশ্যক। মহর্ষিগণ ধর্ম্মার্থশাস্ত্র ও মোক্ষশাস্ত্রে দেশ ও কালকেই প্রধান এবং মানবগণের অভীষ্টপ্রদ বলিয়া নির্দেশ করিয়া গিয়াছেন। অতএব যে ব্যক্তি সুচারুরূপে দেশকাল বিচার করিয়া কাৰ্য্য করিতে পারে, সে অনায়াসে উৎকৃষ্ট ফলভোগে সমর্থ হয়।”