১৩৬তম অধ্যায়
দুৰ্য্যোধনের প্রতি পুনরায় ভীষ্মের উপদেশ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, এ দিকে মহারথ ভীষ্ম ও দ্রোণ কুন্তীর বাক্য শ্রবণ করিয়া অতি অবাধ্য দুৰ্য্যোধনকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে রাজন! কুন্তী কেশবের সন্নিধানে যে উদারার্থযুক্ত বাক্য কহিলেন, তাহা শ্রবণ করিলে তদ্বিষয়ে বাসুদেবেরও বিলক্ষণ সম্মতি আছে। পাণ্ডবগণ অবশ্যই তদনুসারে কর্ম্ম করিবেন। তাহারা রাজ্যব্যতিরেকে কখনই ক্ষান্ত হইবেন না। তুমি যে সভামধ্যে পাণ্ডবগণকে ও দ্রৌপদীকে ক্লেশিত করিয়াছিলে, তাহারা তৎকালে ধর্ম্মবন্ধনে বদ্ধ ছিলেন বলিয়াই তাহা সহ্য করিয়াছেন। রাজা যুধিষ্ঠির যখন কৃতাস্ত্ৰ [অস্ত্রবিদ্যায় সিদ্ধ] অর্জ্জুন, কৃতনিশ্চয়ই [দৃঢ়প্ৰতিজ্ঞ] ভীমসেন, গাণ্ডীব, তূণীরদ্বয়, রথ, ধ্বজ, বলবীৰ্য্যসমন্বিত নকুল ও সহদেব এবং বাসুদেবকে সহায়প্রাপ্ত হইয়াছেন, তখন তিনি তোমাকে ক্ষমা করিবেন না। ধীমান ধনঞ্জয় বিরাটনগরে আমাদিগের সকলকে যেরূপ পরাজিত করিয়াছিলেন, তাহা স্বয়ং প্রত্যক্ষ করিয়াছ। তিনি অতি ভীষণাকর্ম্ম নিবাতকবচগণকে রৌদ্রাস্ত্ৰে দগ্ধ করিয়াছিলেন। অধিক কি, তিনি যে ঘোষযাত্ৰাসময়ে তোমাকে ও কর্ণপ্রভৃতি এইসকল যোদ্ধগণকে মুক্ত করিয়াছিলেন, তাহাই তাহার সামর্থ্যের যথেষ্ট দৃষ্টান্ত।
“হে ভারতশ্রেষ্ঠ! তুমি নিজ ভ্রাতা পাণ্ডবৰ্গণের সহিত সন্ধি করিয়া যমদণ্ডের অন্তর্গত [আসন্নমৃত্যু] এই পৃথিবীকে রক্ষা কর। তোমাদের জ্যেষ্ঠভ্রাতা যুধিষ্ঠির পরমধাৰ্মিক, স্নেহবান, মধুরবাক ও দূরদর্শী, তুমি মনোমালিন্য দূরীকৃত করিয়া সেই পুরোষোত্তমের সন্নিধানে গমন কর। তুমি শরাসন ও ভ্রূকুটিভঙ্গী পরিত্যাগ করিয়া যুধিষ্ঠিরের নয়নপথের [স্নেহদৃষ্টির] আতিথ্য গ্ৰহণ কর; তাহা হইলেই আমাদিগের কুলের শান্তি হইবে। তুমি পূর্ব্বের ন্যায় অমাত্যসমভিব্যাহারে তাহার সমীপে গমন এবং তাহাকে আলিঙ্গন ও অভিবাদন কর; তিনিও তোমাকে সৌহৃদ্যপূর্ব্বক পাণিদ্বারা প্রতিগ্রহণ করুন। সিংহস্কন্ধ, বৃত্তায়ত[স্থূল ও দীর্ঘ]বাহু, যোদ্ধৃপ্রধান ভীমসেনও বাহুযুগলদ্বারা তোমাকে আলিঙ্গন করুন। কম্বু[গাডু]সদৃশ গ্ৰীবাসম্পন্ন কমললোচন ধনঞ্জয় তোমাকে অভিবাদন করুন। অপ্রতিমরূপসম্পন্ন নকুল ও সহদেব গুরুর ন্যায় তোমাকে পূজা করুন এবং দাশার্হপ্রভৃতি ভূপতিগণ সকলে আনন্দাশ্রু বিসর্জ্জন করুন। হে রাজন! তুমি অভিমান পরিত্যাগপূর্ব্বক ভ্রাতৃগণের সহিত মিলিত হইয়া অখণ্ড ভূমণ্ডলে আধিপত্য কর। সমাগত পার্থিবগণ আনন্দ সহকারে পরস্পর আলিঙ্গন করিয়া বিদায় গ্ৰহণ করুন।
“হে রাজেন্দ্ৰ! সুহৃদগণের নিষেধবাক্য [যুদ্ধবিরতির উপদেশ] শ্রবণ কর; যুদ্ধে প্রয়োজন নাই। যুদ্ধে কেবল ক্ষত্ৰিয়গণের বিনাশই দৃষ্টিগোচর হইয়া থাকে। ভাবী ক্ষত্ৰিয়বিনাশের চিহ্নস্বরূপ নানাবিধ উৎপাত দৃষ্টিগোচর হইতেছে-গ্ৰহগণ প্রতিকূল এবং মৃগ ও পক্ষিগণ নিদারুণ হইয়াছে। বিশেষতঃ, আমাদিগের নিবেশনে [পুরে-আবাসে] নানাপ্রকার দুর্নিমিত্ত [অমঙ্গল] ঘটিতেছে; সেনাগণের মধ্যে প্ৰদীপ্ত উল্কাসকল নিপতিত হইতেছে। বাহনগণ অপ্ৰহৃষ্ট হইয়া যেন রোদন করিতেছে; গৃধ্ৰগণ সৈন্যদিগের চতুর্দ্দিকে পরিভ্রমণ করিতেছে; নগর ও রাজভবনের তাদৃশী শোভা নাই; দিক প্রজ্বলিত হইতেছে; শিবাগণ অশিব [অশুভকরী] নিৰ্ঘোষ [শব্দ] করিয়া সেই দিকের অভিমুখেই গমন করিতেছে।
“অতএব হে কুরুশ্রেষ্ঠ! পিতা, মাতা ও এইসকল হিতৈষীদিগের বাক্য শ্রবণ কর। যুদ্ধ ও সন্ধি উভয়ই তোমার আয়ত্ত; যদি তুমি সুহৃদগণের বাক্য শ্রবণ না কর, তাহা হইলে সেনাগণকে পার্থবাণে নিপীড়িত দেখিয়া তোমাকে অনুতাপ করিতে হইবে। যদি আমাদিগের এই বাক্য অগ্রাহ্য কর, তাহা হইলে হৃদয়শোষক [মর্ম্মঘাতী] ভীমসেনের মহানাদ ও গাণ্ডীবের ভীষণ ধ্বনি শ্ৰবণ করিয়া পরিশেষে আমাদের বাক্য স্মরণ করিতে হইবে।”