১৩৫তম অধ্যায়
লোকসেরায় দস্যুদোষশোধন—কায়ব্যব্যাধবার্ত্তা
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! পরস্বাপহারী দস্যুও অন্যান্য ধর্ম্মে বিভূষিত হইলে পরলোকে নরকগামী হয় না, এই বিষয়ে এক প্রাচীন ইতিহাস কীৰ্ত্তিত আছে, শ্রবণ কর। পূৰ্ব্বে কায়ব্যনামে এক নিষাদ দস্যুত্বনিবন্ধন সিদ্ধিলাভ করিয়াছিল। ঐ নিষাদ ক্ষত্রিয়ের ঔরসে নিষাদীর গর্ভে জন্মপরিগ্রহ করে। সে সতত ক্ষত্রিয়ধর্ম্মে নিরত, বুদ্ধিমান বিজ্ঞানসম্পন্ন, অনৃশংস, ব্রাহ্মণপ্রিয়, গুরুপূজক ও মহাবলপরাক্রান্ত ছিল; নিষাদগণের মধ্যে বিজ্ঞ ও মৃগবিজ্ঞানে [বন্যহরিণের অনুসন্ধানাদিজ্ঞানে] সম্যক অভিজ্ঞ ছিল; ঐ নিষাদ প্রতিদিন প্রাতে ও সায়ংকালে অরণ্যমধ্যে মৃগদিগের ক্রোধ উত্তেজিত করিত। দেশকালের বিষয় তাহার কিছুই অবিদিত ছিল না। সে নিরন্তর পর্ব্বতে পরিভ্রমণ ও একাকী বহুসংখ্যক সেনা পরাজয় করিত। সকল ধৰ্ম্মেই তাহার বিলক্ষণ অভিজ্ঞতা জন্মিয়াছিল। সে প্রতিদিন মধু, মাংস, ফল, মূল ও অন্যান্য নানাবিধ খাদ্যদ্রব্য আহরণপূৰ্ব্বক বৃদ্ধ, অন্ধ, বধির পিতামাতার শুশ্রুষা করিত; মান্য ব্যক্তিদিগকে কদাচ অবমাননা করিত না; অরণ্যবাসী প্রব্রজিত [সন্ন্যাসী] ব্রাহ্মণগণের পূজা করা তাহার নিত্যকৰ্ম্ম ছিল। সে প্রতিদিন মৃগবধ করিয়া তাহাদিগের নিমিত্ত লইয়া যাইত। যাঁহারা লোকভয়ে দস্যুর নিকট মাংস গ্রহণ করিতে সম্মত হইতেন না, সে প্রাতঃকালে অজ্ঞাতসারে তাঁহাদিগের গৃহে তাহা রাখিয়া যাইত।
ধর্ম্মপ্রভাবে কায়ব্যব্যাধের নেতৃত্ব—ধর্ম্মপ্রচার
“একদা নির্দ্দয় নিয়মহীন বহুসংখ্যক দস্যু তাহাকে গ্রামণী [গ্রাম্যলোকের নেতা-পরিচালক] করিবার মানসে কহিল, ‘হে বীর! তুমি দেশ, কাল ও মুহূর্ত্ত সমুদয়ই অবগত আছ। তোমার তুল্য প্রজ্ঞাবান্ দৃঢ়ব্রতপরায়ণ লোক প্রায়ই দৃষ্টিগোচর হয় না; অতএব এক্ষণে তুমি আমাদের সকলের মতানুসারে প্রধান গ্রামণীর পদ গ্রহণ কর। তুমি আমাদিগকে যেরূপ আদেশ করিবে, আমরা তদনুসারেই কাৰ্য্য করিব। এক্ষণে তুমি পিতামাতার ন্যায় ন্যায়ানুসারে আমাদিগকে প্রতিপালন কর।
“তখন কায়ব্য তাহাদিগের বাক্য স্বীকার করিয়া তাহাদিগকে কহিল, ‘প্রতিবাসিগণ! তোমরা স্ত্রী, ভীরু, শিশু, তাপস ও যুদ্ধে অপ্রবৃত্ত ব্যক্তির বিনাশসাধন এবং বলপূর্ব্বক স্ত্রীলোককে গ্রহণ করিও না। সকল প্রাণীমধ্যে স্ত্রীলোককে বিনাশ করা অতি গর্হিত কাৰ্য্য; অতএব তদ্বিষয়ে যেন কোন মতেই তোমাদিগের বুদ্ধি প্রধাবিত না হয়। প্রতিনিয়ত ব্রাহ্মণগণের মঙ্গল চিন্তা ও তাঁহাদিগের হিতানুষ্ঠানার্থ যুদ্ধ করা কর্ত্তব্য। কদাচ সত্যের অপলাপ করিও না। দেবতা, অতিথি ও পিতৃগণের পূজা এবং বিবাহাদি সৎকার্য্যের বিঘ্নানুষ্ঠান করা শ্রেয়স্কর নহে। সকল প্রাণীগণের মধ্যে ব্রাহ্মণই মোক্ষলাভের উপযুক্ত; অতএব সৰ্ব্বস্বান্ত করিয়া তাঁহাদিগের পূজা করা কর্ত্তব্য। ব্রাহ্মণেরা রোষাবিষ্ট হইয়া যাহার অমঙ্গল চিন্তা করেন, ত্রিভুবনমধ্যে তাহাকে কেহই রক্ষা করিতে সমর্থ হয় না। যে ব্যক্তি ব্রাহ্মণের নিন্দা করে, তাহাকে সূর্য্যোদয়ে অন্ধকারের ন্যায় অবশ্যই বিনাশ লাভ করিতে হয়। আমরা এই স্থানে অবস্থান করিয়াই সমস্ত বিষয়ের ফললাভে অভিলাষ করিব। যাহারা আমাদিগের অভিলষিত ফলপ্রদানে পরাঙ্মুখ হইবে, তাহাদিগের সহিত যুদ্ধ করাই আমাদের কর্ত্তব্য। দুষ্ট ব্যক্তিদিগকে শাসন করিবার নিমিত্তই দণ্ডের সৃষ্টি হইয়াছে; নিরপরাধ লোকের বধসাধনের নিমিত্ত উহার সৃষ্টি হয় নাই। যাহারা শিষ্ট ব্যক্তিদিগকে নিপীড়িত করে, তাহাদিগকেই বধ করা উচিত। যাহারা রাজ্যোপরোধ করিয়া জীবিকা নির্ব্বাহ করে, তাহাদিগকে কুণপনিহত কৃমির [মৃতদেহের উদরস্থ দুঃখদ কৃমির-মানুষ মরিবামাত্র উদরস্থ কৃমি আপনা-আপনি মরিয়া যায়।] ন্যায় বিনষ্ট হইতে হয়। হে প্রতিবাসিগণ! পরস্পাপহারী দস্যু হইয়া এইরূপ নিয়মানুসারে জীবিকা নির্ব্বাহ করিলে অবিলম্বে সিদ্ধিলাভে সমর্থ হওয়া যায়।
“কায়ব্য এইরূপ উপদেশ প্রদান করিলে তত্রত্য সমুদয় দস্যুই তাহার বাক্যানুসারে কার্য্যানুসারে কার্য্যানুষ্ঠানপূৰ্ব্বক পাপ হইতে বিরত হইয়া দিন দিন উন্নতি লাভ করিতে লাগিল। জ্ঞানবান কায়ব্যও সাধুগণের হিতানুষ্ঠান ও দস্যুগণের পাপনিবারণ প্রভৃতি উৎকৃষ্ট কাৰ্য্যদ্বারা মহতী সিদ্ধি লাভ করিল। হে ধৰ্ম্মরাজ! যে ব্যক্তি প্রতিনিয়ত এই কায়ব্যচরিত চিন্তা করিবে, তাহার বন্যজন্তু ও অন্যান্য প্রাণী হইতে কিছুমাত্র ভয় থাকিবে না। সে বনমধ্যে গমন করিয়াও রাজার ন্যায় অবস্থান করিতে সমর্থ হয়।”