১৩৩তম অধ্যায়
বলে ধনসংগ্ৰহ—বুদ্ধিতে রক্ষাবিধান
ভীষ্ম কহিলেন, “হে ধৰ্ম্মরাজ! স্বরাজ্য ও পররাজ্য হইতে অর্থ সংগ্রহ করিয়া কোষ পূরণ করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। কোষদ্বারাই ধর্ম্ম ও রাজ্য পরিবর্দ্ধিত হয়। অতএব কোষসংগ্রহ করিয়া বিবেচনাপূৰ্ব্বক ব্যয় করা রাজাদের প্রধান ধৰ্ম্ম। কোন সচ্চরিত্রতা বা কোন নৃশংসতাদ্বারা কখনই কোষসংগ্রহ হইবার সম্ভাবনা নাই, সুতরাং মধ্যম বৃত্তি অবলম্বন করিয়াই কোষসংগ্রহ করা আবশ্যক। বল না থাকিলে কোষ রক্ষা হয় না, কোষরক্ষা না হইলেও বল থাকিবার সম্ভাবনা নাই। বলহীন ব্যক্তি রাজ্যরক্ষা করিতে পারে না এবং রাজ্যহীন ব্যক্তিকে অচিরাৎ শ্রীভ্রষ্ট হইতে হয়। উচ্চপদে অবস্থানপূর্ব্বক শ্রীবিহীন হওয়া মৃত্যুতুল্য বলিয়া পরিগণিত হইয়া থাকে। অতএব কোষ, বল ও মিত্র পরিবর্দ্ধিত করা নরপতিদিগের অবশ্য কর্ত্তব্য। রাজা কোষহীন হইলে সকলেই তাঁহাকে অবজ্ঞা করে। তখন আর কেহই তাঁহার নিকট অল্পলাভে পরিতুষ্ট হইয়া তাঁহার কার্য্যে উৎসাহ প্রকাশ করে না। লক্ষ্মী থাকিলে রাজার সম্মানের পরিসীমা থাকে না। আবরণদ্বারা যেমন স্ত্রীলোকের গুহ্যদেশ সমাবৃত হয়, তদ্রূপ সম্পদদ্বারা ভূপতির পাপসকল আচ্ছাদিত হইয়া থাকে। যে নরপতির পূর্ব্বাপকারীরা তাঁহার সম্পদদর্শনে অনুতাপিত হইয়া শালাবৃকের ন্যায় গূঢ়ভাবে তাঁহাকে নিধন করিবার মানসে আশ্রয় করে, তাঁহার কখনই সুখলাভের সম্ভাবনা নাই। সতত উদ্যত হওয়াই নরপতিদিগের নিতান্ত আবশ্যক, নত হওয়া কদাপি বিধেয় নহে। উদ্যমই প্রধান পুরুষকার। বরং ভগ্ন হওয়া উচিত, তথাপি কাহারও নিকট নত হওয়া বিধেয় নহে। বরং বনে গমন করিয়া মৃগগণের সহিত বিচরণ করিবে, তথাপি মৰ্য্যাদাশূন্য দস্যুপ্রায় অমাত্যগণের সহিত ভাল ব্যবহার করিবে না। অতি ভীষণ অকাৰ্য্যসাধনসময়ে দস্যুগণের নিকট হইতে অসংখ্য সৈন্য লাভ করা যায়। রাজা এককালে নিয়মহীন হইলে তাঁহার নিকট অন্যান্য লোকের কথা দুরে থাকুক, নিতান্ত নির্দ্দয় দস্যুগণও শঙ্কিত হয়। অতএব লোকমনোহারী নিয়ম সংস্থাপন করা অবশ্য কর্ত্তব্য। অতি তুচ্ছ বিষয়েও নিয়ম থাকিলে উহা সাধারণের সমাদৃত হইয়া থাকে। নাস্তিকগণ ইহলোক-পরলোকের ভয় করে না, অতএব তাহাদিগের প্রতি বিশ্বাস করা যুক্তিযুক্ত নহে। দস্যুগণ অন্যান্য সদাচারে নিরত হইয়া পরধন অপহরণ করিলেও উহা অহিংসা বলিয়া পরিগণিত হইয়া থাকে। দেখ, দস্যুগণ দয়ালু হইলে তাহাদের দয়াপ্রভাবে অসংখ্য জীব পরিক্ষিত হয়। উহারা সমরপরাঙ্মুখ ব্যক্তির বধসাধন, কৃতঘ্নতা, ব্রহ্মস্ব অপহরণ, লোকের এককালে নিধনতাসম্পাদন, কন্যাপহরণ ও পরদারাভিমর্ষণে নিতান্ত পরাঙ্মুখ। আবার যাহারা দস্যুগণের বিশ্বাসের নিমিত্ত উহাদিগের সহিত সন্ধিসংস্থাপন করে, তাহারা নিশ্চয়ই উহাদের বিশ্বাসোৎপাদনপূৰ্ব্বক সমস্ত জ্ঞাত হইয়া পরিশেষে উহাদিগের সমুদয় ধন ও সন্তানাদি নিঃশেষিত করিতে পারে। অতএব দস্যুগণকে এককালে সম্পত্তিহীন না করিয়া তাহাদিগকে আপনার বশীভূত করাই কর্ত্তব্য। আপনাকে বলবান্ বিবেচনা করিয়া তাহাদের সহিত নৃশংস ব্যবহার করা কদাপি বিধেয় নহে। যে রাজা প্রজাগণের নির্দ্ধনতা-সম্পাদন করেন, তাঁহাকে অচিরাৎ নিৰ্দ্ধন হইতে হয়; আর যিনি তাহাদের সম্পত্তি রক্ষা করিয়া তাহাদের নিকট কর গ্রহণ করেন, তিনি যাবজ্জীবন, রাজ্যভোগ করিতে পারেন, সন্দেহ নাই।”