১৩৩. অর্জুনের অস্ত্রশিক্ষা-সফলতা
ত্রয়স্ত্রিংশধিকশততম অধ্যায়।
বৈশম্পায়ন কহিলেন,-মহারাজ! অনন্তর দ্রোণ হাস্যমুখে অর্জুনকে কহিলেন, বৎস! এইবারে তোমাকেই এই লক্ষ্য বিদ্ধ করিতে হইবে, অতএব ধনুকে গুণ রোপণপূর্বক মুহূর্তকাল অপেক্ষা কর। আমার বাক্যাবসান না হইতে হইতে তুমি এই লক্ষ্যে অস্ত্ৰক্ষেপ কর। অর্জুন গুরুবাক্যানুসারে শাসনে শরসন্ধানপূর্বক অগ্রশাখাস্থ পক্ষীকে লক্ষ্য করিয়া রহিলেন। তখন দ্রোণ মুহূর্তকালমধ্যে পূর্বোক্ত প্রকারে অর্জুনকে জিজ্ঞাসা করিলেন, বৎস! বৃক্ষকে, বৃক্ষ পক্ষীকে, আমাকে বা ভ্রাতৃগণকে নিরীক্ষণ করিতেছ? তাহা শুনিয়া অর্জুন প্রত্যুত্তর করিলেন, ভগবন্! আমি বৃক্ষ বা আপনাকে নিরীক্ষণ করিতেছি না, কেবল শকুন্তকে অবলোকন করিতেছি। অনন্তর দ্রোণ প্রীতমনে পুনর্বার জিজ্ঞাসিলেন বৎস! শকুন্তকে সম্যক্রূপে নিরীক্ষণ করিতেছ? অর্জুন প্রত্যুত্তর করিলেন, “না, আমি শকুন্তের অবশিষ্ট কলেবর কিছুই অবলোকন করিতেছি না, কেবল উহার মস্তকটি দেখিতেছি। তখন দ্রোণাচাৰ্য অর্জনের এইরূপ বাকচাতুরী দর্শনে সন্তুষ্ট হইয়া কহিলেন, বৎস! তবে লক্ষ্য বেধ কর; এই কপ্পা বলিবামাত্র অর্জুন কিছুমাত্র বিবেচনা না করিয়া লক্ষ্যে অস্ত্ৰক্ষেপ করিলেন এবং বৃক্ষশিখরস্থিত পক্ষী অর্জুনের খুরধার অস্ত্র দ্বারা ছিন্নমস্তক হইয়া ভূতলে নিপতিত হইল। তাদৃশ অসাধারণ কর্ম সমাধানান্তে দ্রোণ অর্জুনকে আলিঙ্গন করিয়া দ্রুপদরাজকে সংগ্রামে পরাজিত করিয়াছি বলিয়া মানিলেন।
কিয়ৎকাল অতীত হইলে একদা শিষ্যগণ সমভিব্যাহারে দ্রোণ স্নান ভাগীরথীর উপকূলে গমন করিলেন। তথায় সমুপস্থিত হইয়া অবগাহনপূর্বক স্নান করিতেছেন, এই অবসরে এক ভয়ঙ্কর কুম্ভীর কালপ্রেরিত হইয়া দ্রোণের জঙ্দেশ গ্রহণ করিল। তিনি স্বীৰ্যপ্রভাবে কুম্ভীর হস্ত হইতে জঙ্ঘা মমাচন করিয়া আত্মরক্ষা করিতে পারিতেন, কিন্তু তিনি তাহা না করিয়া পরীক্ষার্থে শিষ্যদিগকে সসম্রমে আদেশ করিলেন, হে শিষ্যগণ! তোমরা কুম্ভীর বিনাশ করিয়া আমাকে পরিত্রাণ কর। তাহার আদেশ প্রাপ্তিমাত্রেই অর্জুন দুর্নিবার ও খুরধার পাঁচটি শর দ্বারা জলমগ্ন কুম্ভীরকে প্রহার করিলেন এবং অন্যান্য সমস্ত রাজকুমার ইতিকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া যথাস্থানে চিত্রাপিতের ন্যায় দণ্ডায়মান রহিলেন। তখন দ্রোণাচাৰ্য অর্জুনকে কৃতকাৰ্য দেখিয়া অতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন এবং শিষ্যমণ্ডলীমধ্যে তাঁহাকেই সর্বোৎকৃষ্ট বিবেচনা করিলেন।
কুম্ভীর অর্জুনের শরপ্রহারে খণ্ডকলেবর হইয়া দ্রোণের জঙ্ঘা পরিত্যাগপূর্বক পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইল। অনন্তর ভারদ্বাজ দ্রোণ, মহারথ অর্জুনকে কহিলেন, হে মহাবাহে! আমি প্রয়োগ ও সংহার সহিত ব্রহ্মশিরাঃ নামে এই অনিবাৰ্য অস্ত্রপ্রদান করিতেছি, তুমি গ্রহণ কর, কিন্তু বৎস! মনুষ্যের প্রতি ইহা কদাচ প্ৰয়োগ করিও না; কারণ, অল্পতেজস্ক মনুষ্যে নিক্ষিপ্ত হইলে ইহা নিশ্চয়ই এই চরাচর বিশ্বকে ভস্মসাৎ করিবে। এই অস্ত্র সামান্য অস্ত্র নহে; অতএব সাবধানে এই অস্ত্র ধারণ কর। দেখিও, আমি যাহা কহিলাম, সে তাহার অন্যথা না হয়। হে বীর!। যদি কোন অমানুষ শত্রু সংগ্রামে সহসা তোমাকে আক্রমণ করে, তাহার সংহার্থে তৎকালে তুমি এই ব্রহ্মশিরা অস্ত্র প্রয়োগ করিবে। অর্জুন তাহাই হইবে বলিয়া তাহার বাক্য স্বীকার করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে দিব্যাস্ত্র গ্রহণ করিলেন। তখন আচার্য্য দ্রোণ পুনর্বার কহিলেন, বৎস! এই জীবলোকে তোমার তুল্য ধনুর্দ্ধর আর কেহই জম্মিবে না।