১৩১তম অধ্যায়
আপদ্ধর্ম্মপাধ্যায়—সন্ধি-বিগ্রহের ক্ষেত্র নির্ণয়
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! যে রাজা কোষাদিসংগ্রহে পরাঙ্মুখ, দীর্ঘসূত্র [অলস-বহু সময় ব্যয়ে কাৰ্য্যসাধনকারী] ও বন্ধুবান্ধব বিয়োগভয়ে সংগ্রামে বিমুখ হয়েন, যাঁহার মন্ত্রণা ব্যক্ত হইয়া পড়ে, শত্রুগণ একত্র হইয়া যাঁহার রাজ্য বিভাগপূর্ব্বক গ্রহণ করে, যাঁহার নির্দ্ধনতা ও মিত্রবলের অভাববশতঃ মন্ত্রিগণ শত্ৰুদিগের বশীভূত হয় এবং যিনি পরসৈন্যের প্রভাবে অভিভূত ও বলবান শত্ৰুকর্ত্তৃক ব্যাকুলিত হয়েন, তাঁহার যাহা কৰ্ত্তব্য, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! আক্রমণকারী শত্রু যদি পবিত্রচিত্ত হয় ও ধর্ম্মানুসারে জয়লাভের বাসনা করে, তাহা হইলে তাহার সহিত অবিলম্বে সন্ধিস্থাপন করিয়া ক্রমে ক্রমে আপনার গ্রামনগরাদি উদ্ধার করা রাজার ধর্ম্ম। আর শত্রু যদি মহাবলপরাক্রান্ত হয় ও অধর্ম্মানুসারে জয়লাভের চেষ্টা করে, তাহা হইলে ভূপতি তাহাকে কতিপয় গ্রাম প্রদান করিয়া তাহার সহিত সন্ধি করিবেন অথবা রাজধানী ও অন্যান্য সমুদয় সম্পত্তি পরিত্যাগ করিয়া আপদ হইতে মুক্ত হইবেন। রাজা যে কোন প্রকারে হউক, জীবিত থাকিতে পারিলে পুনরায় পূৰ্ব্বের ন্যায় সম্পত্তিশালী হইতে পারেন। অতএব কোষ ও বল পরিত্যাগ করিলে যে আপদ হইতে উত্তীর্ণ হওয়া যায়, সেই আপদে আত্মপরিত্যাগ করা নিতান্ত মূঢ়তার কার্য্য। যদি অন্তঃপুরিকা[পুরনারী]গণও শত্ৰুদিগের হস্তগত হয়, তথাপি তাহাদিগের প্রতি দয়া না করিয়া আত্মরক্ষা করাই অবশ্য কর্ত্তব্য।”
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! রাজার অমাত্য প্রভৃতি ক্রুদ্ধ, রাজ্য ও দুর্গাদি শত্রুকর্ত্তৃক আক্রান্ত, কোষ পরিক্ষীত এবং মন্ত্র প্রকাশিত হইলে তাহার কি কর্ত্তব্য?”
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! শত্রু ধার্ম্মিক হইলে তাহার সহিত শীঘ্র সন্ধিস্থাপন ও অধার্ম্মিক হইলে তাহার প্রতি শীঘ্র পরাক্রম প্রকাশ করা রাজাদিগের কর্ত্তব্য। ফলতঃ ভূপালগণ শত্রুকর্ত্তৃক আক্রান্ত হইলে হয় উপায়দ্বারা অচিরাৎ তাহাকে নিরস্ত করিবেন, নচেৎ অবিলম্বে তাহার সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়া ধৰ্ম্মযুদ্ধে কলেবর পরিত্যাগপূৰ্ব্বক পরলোকে সদ্গতি লাভ করিবেন। অনুরক্ত, হৃষ্ট ও সচেষ্ট সৈন্য অল্পমাত্র হইলেও তাহাদিগকে লইয়া সমুদয় পৃথিবী জয় করিতে পারা যায়। নরপতি সংগ্রামে নিহত হইলে স্বর্গারোহণপুৰ্ব্বক ইন্দ্রের সালোক্য এবং শত্রুগণকে নিপাতিত করিতে পারিলে পৃথিবীর আধিপত্য লাভ করিতে পারেন; অতএব যুদ্ধে ভীত হওয়া তাঁহার কদাপি বিধেয় নহে। যুদ্ধসময় সমুপস্থিত হইলে সমরপরিত্যাগের বাসনা না করিয়া বুদ্ধি-কৌশলে শত্রুর বিশ্বাস উৎপাদন ও বিনয় অবলম্বনপূৰ্ব্বক যুদ্ধ করাই রাজাদিগের উচিত। আর যখন তাঁহারা স্বপক্ষীয়দিগের ক্রোধবশতঃ শত্ৰুদিগের সহিত যুদ্ধ বা সন্ধিস্থাপন করিতে নিতান্ত অসমর্থ হইবেন, তখন দুর্গ হইতে প্রথমতঃ পলায়নপূর্ব্বক পরিশেষে ক্রমে ক্রমে সন্ধিদ্বারা আপনার সৈন্যগণকে সান্ত্বনা করিয়া মন্ত্রবলে পুনৰ্ব্বার স্বীয় রাজ্য অধিকার করিবেন।”