১৩০. কৃপ-কৃপীর জন্মবৃত্তান্ত, কুরুকুমারগণের আচার্য্যপদে কৃপের বরণ, প্রধান আচার্য্যপদে দ্রোণের বরণ, দ্রোণাচার্য্যের জন্মাদিবৃত্তান্ত, পরশুরামের নিকট দ্রোণের অমোঘ অস্ত্রলাভ
ত্রিংশদদ্বিশততম অধ্যায়।
জনমেজয় কহিলেন, হে ব্ৰহ্মন্! আচাৰ্য কৃপ কিরূপে শরস্তম্ব হইতে জন্মগ্রহণ করিলেন এবং কিরূপেই বা অস্ত্র সমুদায় প্রাপ্ত হইলেন, অনুগ্রহ করিয়া তৎসমুদায় বর্ণন করুন।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! মহর্ষি গৌতমের গৌতম বলিয়া এক পুত্র জন্মেন। তিনি শরের সহিত জন্মিয়াছিলেন, এজন্য তাহার নাম শরদ্বান্ হইয়াছিল। ঐ পুত্র বেদাধ্যয়ন অপেক্ষা ধনুর্বিদ্যাভ্যাসে অধিকতর অভিলাষী ও যত্নবান ছিলেন। যেমন ব্রহ্মচারিগণ তপোনুষ্ঠান দ্বারা বেদাধ্যয়ন করিতেন, তিনি সেইরূপ তপস্যাচরণ করিয়া সমস্ত অন্ত্রলাভ করিয়াছিলেন। তিনি ধনুৰ্বেদানুশীলনে ও কঠোর তপোনুষ্ঠানে এরূপ যত্নশালী ছিলেন যে, দেবরাজ ইন্দ্র তদ্দর্শনে সাতিশয় ত্রাসিত হইয়া জানপদীনাম্নী দেবকন্যাকে আহ্বান করিয়া তাহার তপস্যার বিঘ্ন জন্মাইতে আদেশ প্রদান করিলেন। জানপদী দেবরাজের আদেশানুসারে ধনুর্বাণধারী শরদ্বানের পরম রমণায় আশ্রমে উপস্থিত হইয়া তাহার লোভ জন্মাইবার নিমিত্ত হারভাব প্রকাশ করিতে লাগিল। অলৌকিক রূপলাবণ্যসম্পন্ন। একমাত্রবসন সেই ললনাকে নিরীক্ষণ করিবামাত্র মহাত্মা শরদ্বানের নয়নদ্বয় বিকসিত হইয়া উঠিল, হস্ত হইতে ধনুর্বাণ ভূতলে পতিত হইল এবং কাতচালিত কদলীপত্রের ন্যায় সর্বাঙ্গ কপিতে লাগিল। এই অসাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন তপন্থী উক্তপ্রকারে কুসুমশাহত হইয়াও স্বীয় তপঃপ্রভাবে ধৈৰ্য্যাবলম্বন করিয়া রহিলেন, কিন্তু দুঃসহ মদনবিকারপ্রভাবে তাঁহার রেতঃস্খলন হইল, তিনি তাহা জানিতে পারিলেন না। তিনি সেই তপোন্তরায়ভূত। অপ্সরার সমিধান পরিত্যাগ করিবার মানসে যেমন আশ্রম হইতে প্রস্থান করিতেছিলেন, অমনি তাহার স্থালিত রেতঃ শরস্তম্বে নিপতিত হইল। বীৰ্য্য পতিত হইবামাত্র দুই খণ্ডে বিভক্ত হইল এবং তাহাতে এক পুত্র ও এক কন্যা জন্মিল। এই সময়ে মহারাজ শান্তনু বনে মৃগয়া করিতে গিয়াছিলেন। তাঁহার এক সৈনিকপুরুষ যদৃচ্ছাক্রমে ঐ স্থানে উপস্থিত হইয়া সেই সদ্যোজাত বিপ্রমিথুনকে দেখিতে পাইল। তথায় ধনুঃশর ও কৃষ্ণাজিন পতিত দেখিয়া কোন ধনুর্বেদপারগ ব্রাহ্মণের অপত্যযুগল বিবেচনায়, মহারাজকে আনিয়া দেখাইলে অবশ্য ইহাদের গত্যন্তর হইতে পারে, স্থির করিয়া সে রাজাকে আনিয়া দেখাইল। রাজা সেই সদ্যোজাত মিথুন দর্শনে যৎপরোনান্তি অনুকম্পাপরতন্ত্র হইয়া তাহাদিগকে গ্রহণ করিলেন এবং ইহারা আমার সন্তান হইল বলিয়া শরদানের অপত্যদ্বয়কে আপন গৃহে আনয়নপূর্বক অপত্যনির্বিশেষে প্রতিপালন করিতে লাগিলেন। মহারাজ শান্তনু কৃপা করিয়া তাহাদিগকে প্রতিপালন করিয়াছেন বলিয়া পুত্রটির নাম কৃপ ও কন্যাটির নাম কৃপী রাখিলেন।
এদিকে মহাত্মা শরদ্বান্ আশ্ৰমান্তর নির্মাণ করিয়া তথায় ধনুৰ্বেদানুশীলন ও কঠোর তপোনুষ্ঠানদ্বারা একজন অদ্বিতীয় ধনুর্দ্ধর হইয়া উঠিলেন। তিনি একদা তপোবলে কৃপকৃপীর জন্মবৃত্তান্ত ওতাহারা যথায় যেরূপ বর্ধিত হইতেছে তৎসমস্ত জানিতে পারিলেন। তখন তিনি রাজভবনে আগমনপূর্বক স্বীয় পুত্র কৃপকে তাঁহার গোত্রাদি বলিয়া দিলেন এবং তাঁহাকে চতুর্বিধ ধনুর্বেদ ও বিবিধ শাস্ত্র সম্পূর্ণরূপে অধ্যয়ন করাইয়া স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন। এইরূপে কৃপ অতি অল্প দিনের মধ্যেই এক জন উৎকৃষ্ট ধনুৰ্বেদাধ্যাপক হইয়া উঠিলেন। ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণ, পাণ্ডবেরা, যাদবসকল, বৃষ্ণিবর্গ ও নানা দিদেশাগত অন্যান্য ভূপতি সমস্ত তাঁহার নিকটে আসিয়া ধনুর্বেদ অধ্যয়ন করিতে লাগিলেন।
মহাত্মা ভীষ্ম বিশেষরূপ বিনয়াধান ও শিক্ষা প্রদান করিবার নিমিত্ত এক জন বুদ্ধিমান নানাশস্ত্রসম্পন্ন দেবতুল্য সত্ত্বশালী অধ্যাপকের হন্তে পৌদিগকে সমর্পণ করিবার মানস করিলেন। পরে বেদবো ধীমান্ভরদ্বাজনদান দ্রোণাচাৰ্য্যকে স্বভবনে আনয়নপূর্বক পাদ্য অৰ্যাদি দ্বারা তাহার যথোচিত সৎকার করিলেন এবং শিক্ষাপ্রদানার্থ, পৌত্রদিগকে তাহার হস্তে সমৰ্পণ করিয়া দিলেন। অস্ত্রবিদ্যাবিশারদ মহাভাগ দ্রোণাচাৰ্য ভীষ্মের সাতিশয় আস্থা দর্শনে পরম পরিতুষ্ট হইয়া কুমাবগণকে শিষ্যরূপে পরিগ্রহ করিলেন এবং সাতিশয় যত্ন ও দৃঢ়তর মনোযোগ সহকারে তাহাদিগকে বিশেষরূপে ধনুর্বেদ অধ্যয়ন করাইতে লাগিলেন। ছাত্রেরা সকলেই বুদ্ধিমান, অচিরকালমধ্যেই সর্বশাস্ত্রবিশারদ ও অপরিমিততেজস্বী হইয়া উঠিলেন।
জনমেজয় কহিলেন,—হে ব্ৰহ্মন্! ধনুর্বেদপারগ দ্রোণাচাৰ্য কি প্রকারে জন্মগ্রহণ করিলেন; কি প্রকারে অস্ত্রবিদ্যায় সুনিপুণ হইলেন; কি নিমিত্ত কুরুদিগের নিকটে আগমন করিয়াছিলেন। তিনি কাহার পুত্র এবং অশ্বত্থামা নামে তাহার সর্বাবিং পুত্রই বা কি প্রকারে জন্মগ্রহণ করিলেন; এই সকল শ্রবণ করিতে আমার নিতান্ত অভিলাষ হইয়াছে। অনুগ্রহ প্রদর্শন করিয়া সবিশেষ কীর্তন করুন।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! ভারতবর্ষের উত্তর সীমায় পৃথিবীর মানদণ্ডস্বরূপ হিমালয়নামে পৰ্বত আছে; তথা হইতে ভগবতী ভাগীরথী নির্গত হইতেছেন। পূর্বকালে সেই স্থানে দৃঢ়ব্রত মহর্ষি, ভরদ্বাজ তপস্য। করিতেন। তিনি যজ্ঞদীক্ষিত হইয়া একদা মহর্ষিগণ সমভিব্যাহারে গঙ্গায় প্রাতঃস্নান করিতে গিয়াছিলেন। সেই সময়ে অপ্সরোহগ্রগণ্য ঘৃতাচী স্নান করিয়া তীরে উঠিতেছিল। দৈবাৎ বায়ুবেগে তাহার গাত্রবসন উড্ডীন হইল। মহর্ষি সেই সুরূপা নবযৌবনা মদদৃপ্ত অপ্সরাকে বিবসনা দেখিয়া কামশরে জর্জরিতকলেবর হইলেন। দুর্জয় কুসুমায়ুধের দুঃসহ প্রভাবে তপোধনের রেতঃ স্থলিত হইল। তিনি সেই রেতঃ এক দ্রোণ অর্থাৎ কলসের মধ্যে রাখিলেন। কিয়দ্দিন পরে সেই বীৰ্য্য এক পুত্ররূপে পরিণত হইল। মহর্ষি ভরদ্বাজ, দ্রোণমধ্যে জাত বলিয়া ঐ পুত্রের নাম দ্রোণ রাখিলেন। দ্রোণ ক্রমে ক্রমে সমস্ত বেদ ও বেদাঙ্গ অধ্যয়ন করিতে লাগিলেন। পূর্বে প্রতাপশালী অস্ত্রবিদের অগ্রগণ্য মহাত্মা ভরদ্বাজ অগ্নিসম্ভূত অগ্নিবেশনামা তপোধনকে এক আগ্নেয় অস্ত্র দিয়াছিলেন। এক্ষণে ঐ তপোন সেই আগ্নেয় অস্ত্র গুরুপুত্র দ্রোণকে প্রদান করিলেন।
পৃষতনামা নরপতি মহর্ষি ভরদ্বাজের পরম সখা ছিলেন; তাঁহারও দ্রুপদ নামে এক সন্তান জন্মে। দ্রুপদ প্রতিদিন ভরদ্বাজের আশ্রমে গমন করিয়া দ্রোণের সহিত একত্র ক্রীড়া ও অধ্যয়ন করিতেন। কিয়দ্দিনানন্তর নৃপতি পৃষত পরলোকপ্রাপ্ত হইলে মহাবাহু দ্রুপদ সমুদায় উত্তরপাঞ্চলের অধিপতি হইয়া রাজ্যশাসন করিতে লাগিলেন। মহর্ষি ভরদ্বাজও কলেবর পরিত্যাগ করিয়া স্বর্গরোহণ করিলে মহাত্মা দ্রোণ সেই পৈত্রিক আশ্রমে থাকিয়া তপস্য। করিতে লাগিলেন। তিনি ক্রমে ক্রমে সমস্ত বেদ ও বেদাঙ্গ অধ্যয়ন করিলেন। তপোনুষ্ঠান দ্বারা তাঁহার সমস্ত পাপ ধ্বংস হইয়া গেল। কিয়দ্দিন পরে দ্রোণ মহাশয় পিতৃনিয়োগানুসারে পুত্রলাভাকাঙ্গায় শরদ্বানের কন্যা কৃপীকে বিবাহ করিলেন। এই কামিনী দমগুণযুক্তা, অগ্নিহোত্রনিরতা ও ধর্মপরায়ণা ছিলেন। ইহার গর্ভে দ্রোণাচার্যের অশ্বত্থামা নামে পুত্র জন্মে। ঐ পুত্র জামাত্র উচ্চৈঃশ্রবা অশ্বের ন্যায় ধ্বনি করি। ঐ ধ্বনি শ্রবণানন্তর এই দৈববাণী হইল, “এই পুত্র জন্মিবামাত্র অশ্বষের ন্যায় গভীরধ্বনি দ্বারা দিগন্ত সকল প্রতিধ্বনিত করিল, অতএব ইহার নাম অশ্বত্থামা হইবে।” মহাত্মা দ্রোণ পুত্রলাভে পরম পরিতুষ্ট হইলেন।
ঐ সময়ে অরাতিতপন সর্বজ্ঞানসম্পন্ন সৰ্বাবিং মহাত্মা জমদগ্নিনন্দন পরশুরাম ব্রাহ্মণদিগকে সর্বস্ব প্রদান করিতে কৃতসংকল্প হইয়াছিলেন। দ্রোণ উহা অবগত হইয়া রামের নিকট হইতে ধনুর্বেদ, দিব্যাস্ত্র সমুদায় ও নীতিশাস্ত্র গ্রহণ করিতে সাতিশয় সমুৎসুক হইলেন। অনন্তর তিনি ব্রতচারী তপোনিষ্ঠ শিষ্যগণে পরিবৃত হইয়া মহেন্দ্ৰ পৰ্বতে গমনপূর্বক দেখিলেন যে, শত্রুতাপী জমদগ্নিকুমার এককালে সংসারমুখে জলাঞ্জলি দিয়া তত্ৰত্য বনে অবস্থিতিপূর্বক কালযাপন করিতেছেন। তখন ভবদ্বাজ শিষ্যগণ সমভিব্যাহারে তাহার সমীপে গমনপূর্বক তাহার পাদন কক্সিলেন এবং কহিলেন, হে মহাত্মন! আমি মহর্ষি অঙ্গিরার কুলে সমুৎপন্ন ভরদ্বাজের পুত্র, অযোনিসস্তুত, আমার নাম দ্রোণ; আমি ধনাকাঙ্গায় আপনার নিকট আসিয়াছি। দ্রোণের বাক্যাসানে ক্ষত্রিয়কুলকালান্তক ভগবান্ পরশুরাম তাহাকে সাদর সম্ভাষণে স্বাগত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়া কহিলেন, হে দ্বিজোত্তম! তোমাকে কি ধন প্রদান করিতে হইবে? দ্রোণ কহিলেন, “ভগবন্! আমাকে বিবিধ অনন্ত ধন প্রদান করুন। রাম কহিলেন,—হে তপোধন! আমার যাবতীয় হিরণ্য ও অন্যান্য ধন ছিল, সমস্তই ব্রাহ্মণদিগকে প্রদান করিয়াছি, এই সসাগরা পৃথী স্ববাহুবলে জয় করিয়া মহর্ষি কশ্যপকে দিয়াছি; এক্ষণে কেবল আমার শরীর ও বিবিধ মহাহঁ অস্ত্রশস্ত্রমাত্র অবশিষ্ট আছে, ইহার মধ্যে তোমার যাহা ইচ্ছা হয় শীঘ্র প্রার্থনা কর, তাহাই প্রদান করিব। তখন দ্রোণ কহিলেন, হে বিপুলব্রত ভৃগুনন্দন। যদি প্রসন্ন হইয়া থাকেন তবে প্রয়োগ, সংহার সমবেত আপনার অস্ত্র সমুদায় আমাকে প্রদান করুন। পরশুরাম “তথাস্তু” বলিয়া দ্রোণকে সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র ও রহস্যসমবেত ধনুর্বেদ প্রদান করিলেন। দ্বিজসত্তম দ্রোণ এইরূপে পরশুরামের নিকট হইতে অস্ত্রশস্ত্র গ্রহণ করিয়া পরম প্রীতমনে প্রিয়সখা দ্রুপদ সমীপে গমন করিলেন।