১২. হ্রদের তীরে

হ্রদের তীরে অনেকগুলো ছোট বড় পাথর সাজানো। নিকি আর ত্রিপি পাথরগুলোর পাশ দিয়ে গুনতে গুনতে হেঁটে যায়। নিকি গোনা শেষ করে বলল, আঠারটা।

নিকির কথা শুনে ত্রিপি হি হি করে হাসল। নিকি বলল, কী হলো তুমি হাসছ কেন?

তুমি এমন করে বলছ যেন তুমি জান না যে এখানে আঠারটি পাথর। আছে। যেন তুমি গুনে আবিস্কার করেছ এখানে আঠারটি পাথর!

জানি তাতে কী হয়েছে? জানা থাকলে কী গোনা যায় না? একবার গোনা যায়!

ত্রিপি মাথা নাড়ল, বলল, সেটা ঠিক। জানা থাকলেও একশবরি গোনা যায়।

এখন আমরা আঠার নম্বর পাথরটি হ্রদের পানিতে ফেলে দেব, তখন। এখানে পাথর হবে সতেরটি! তার মানে–

তার মানে আর সতেরদিন পর পাহাড়ের গহ্বর থেকে ঘুম ভেঙে মানুষেরা বের হয়ে আসবে?

নিকি হাত কঁকুনি দিয়ে বলল, ঠিক বলেছ! তারপর সে নিচু হয়ে ভারি পাথরটা গড়িয়ে গড়িয়ে হ্রদের দিকে নিয়ে যায়। হ্রদের তীর থেকে সেটাকে ধাক্কা দিতেই পাথরটা ঝপাং করে পানিতে পড়ে হারিয়ে গেল।

ফ্লিকাসের সাথে তারা যখন পাহাড়ের গহ্বরে গিয়েছিল তখন তারা জেনে এসেছিল যে সেখান থেকে তেত্রিশদিন পর মানুষদের প্রথম ব্যাচটি জেগে উঠবে। তারা তাদের এলাকায় ফিরে এসে তেত্রিশটা নানা আকারের ছোট-বড় পাথর সাজিয়ে রেখেছে। প্রত্যেক দিন ভোরবেলা ঘুম ভাঙার পর দুজন হেঁটে হেঁটে হ্রদের তীরে আসে, তারপর একটা পাথরকে গড়িয়ে গড়িয়ে হ্রদের পানিতে ফেলে দিয়ে আসে। যার অর্থ তাদের অপেক্ষার দিন আরো একটি কমেছে।

নিকি পাথরগুলোর চারপাশে ঘুরে এসে বলল, আর মাত্র সতের দিন। তারপর আমাদের সাথে থাকবে আরো শত শত মানুষ।

ত্রিপি মাথা নাড়ল, শত শত সত্যিকার মানুষ।

আমাদের দেখে তারা কী বলবে বলে মনে হয়?

মনে হয় একটু অবাক হবে।

নিকি বলল, আমাদের সেদিন সুন্দর কাপড় পরে থাকা উচিত। ক্রিনিটি বলেছে সভ্য মানুষেরা সুন্দর কাপড় পরে।

আমরা কোথায় পাব সুন্দর কাপড়?

ক্রিনিটিকে বলব তৈরি করে দিতে।

ত্রিপি মাথা নাড়ল, বলল, শুধু সুন্দর করে কাপড় পরলেই হবে না। আমাদের সুন্দর করে কথাও বলতে হবে। সুন্দর করে ব্যবহার করতে হবে।

হ্যাঁ। ক্রিনিটি বলেছে আমরা যখন তাদের সাথে খেতে বসব তখন গপগপ করে খেলে হবে না। একটু একটু করে খেতে হবে। সভ্য মানুষেরা একটু একটু করে খায়।

ত্রিপি বলল, আমাদের নক কেটে ছোট করতে হবে। শুধু অসভ্য মানুষের। বড় বড় নখ হয়।

হ্যাঁ। চুলগুলো ভালো করে ধুয়ে আঁচড়াতে হবে। সভ্য মানুষের কখনো উশখো-খুশকো চুল থাকে না।

নিকি আর ত্রিপি সভ্য মানুষের আর কী কী থাকতে হয় কী কী থাকতে হয় সেগুলো আলোচনা করতে করতে দের বালুবেলায় হাঁটতে থাকে। একটা গাছের উঁচু ডালে তখন মিক্কু বসে নিকি আর ত্রিপির দিকে তাকিয়েছিল। তার হাতে একটা রসালো ফল, সেটা কামড়ে কামড়ে খেতে খেতে অস্পষ্ট একটা শব্দ করল। নিকি আর ত্রিপি তখনো শুনতে পায় নি, কিন্তু মিক্কু শুনতে পেয়েছে। অনেক দূর থেকে একটা বাইভার্বাল আসছে।

নিকি আর ত্রিপি যখন হ্রদের এককোণায় একটা বড় গাছের গুঁড়ির কাছে এসে পৌঁচেছে তখন তারা বাইভার্বালের চাপা গর্জনটি শুনতে পেল, তারা অবাক হয়ে আকাশের দিকে তাকায় আর ঠিক তখন দেখতে পায় কুচকুচে কালো একটা বাইভার্বাল আকাশ দিয়ে উড়ে আসছে। বাইভার্বালটি অতিকায়। একটা পাখির মতো তাদের মাথার উপর দিয়ে একবার উড়ে যায় তারপর গর্জন করে ধূলো উড়িয়ে কাছাকাছি নেমে আসে।

নিকি আর ত্রিপি বিস্ফারিত চোখে বাইভার্বালটির দিকে তাকিয়ে থাকে, অবাক হয়ে দেখে তার দরজা খুলে সোনালি চুল আর নীল চোখের একজন। মানুষ নেমে আসছে। মানুষটি সুদর্শন এবং হাতে একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। মানুষটি তাদের দিকে কয়েকপা হেঁটে এসে থেমে গেল, জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ নিকি? ত্রিপি?

নিকি আর ত্রিপি দুজনেই মানুষটিকে চিনতে পারল, মানুষটি ফ্লিকস। যে মানুষটিকে তারা বিস্ফোরক দিয়ে মাত্র কিছুদিন আগে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল।

ফ্লিকাস হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি অবহেলার ভঙ্গিতে হাত বদল করে বলল, মনে আছে নিকি তোমাকে বলেছিলাম, তোমাকে খুঁজে বের করতে যদি আমাকে নরকেও যেতে হয় আমি সেখানে যাব? আমি এসেছি।

নিকি বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, কিন্তু-কিন্তু–

আমি বুঝতে পারছি, তুমি কী জানতে চাইছ! তুমি জানতে চাইছ আমাকে বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেবার পরেও আমি কিভাবে ফিরে এসেছি। তাই না?

নিকি মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ।

তুমি ভুলে গিয়েছিলে আমি হচ্ছি পঞ্চম মাত্রার রোবট। পঞ্চম মাত্রার রোবট পৃথিবীর সবচেয়ে বড় যান্ত্রিক আবিষ্কার। প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় উদাহরণ। কেউ এতো বড় একটা জিনিস মাত্র একটি তৈরি করে না। কমপক্ষে দুটি তৈরি করে। তাই পৃথিবীতে ফ্লিকাস একজন ছিল না, ছিল দুজন। তুমি যখন প্রথমজনকে বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিলে তখন তার কপোট্রনের সকল তথ্য দ্বিতীয় ফ্লিকাসের কপোট্রনে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। তাই ফ্লিকাসের শরীরটা ধ্বংস হয়েছে কিন্তু ফ্লিকাস ধ্বংস হয় নি। বুঝেছ?

নিকি হতচকিতের ভাবে মাথা নাড়ল, বলল, বুঝেছি।

ফ্লিকাস হ্রদের নরম বালুবেলায় অন্যমনস্কভাবে কয়েক পা হেঁটে গাছের বড় একটা খুঁড়িতে বসে। একধরনের বিষঃ গলায় বলে, বুঝলে নিকি আর ত্রিপি। আমি খুব নিঃসঙ্গ প্রাণী। আমি জানি তোমরা আমাকে প্রাণী হিসেবে মেনে নেবে না, তোমরা বলবে আমি একটা যন্ত্র। কিন্তু আমি আসলে একটা প্রাণী। সত্যিকারের প্রাণী থেকেও আমি বেশি প্রাণী বুঝেছ?

ফ্লিকাস অস্ত্রটি হাত বদল করে বলল, আমাকে ডিজাইন করতে পাঁচ বছর সময় লেগেছে। যখন দেখেছে পৃথিবীতে আর মানুষ নেই, তখন পৃথিবীর দায়িত্ব নেবার জন্যে আমাদের প্রজন্মকে ডিজাইন করা হয়েছে। মানুষের যে সীমাবদ্ধতা ছিল আমাদের সেই সীমাবদ্ধতা নেই। সেই সীমাবদ্ধতা কি জান?

নিকি মাথা নাড়ল, বলল, না।

মানুষের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে তাদের অযৌক্তিক ভালোবাসা। যেখানে ভালোবাসার কারণে তাদের ক্ষতি হতে পারে সেখানেও তারা ভালোবাসে। মানুষ মানুষকে ভালোবাসে, যন্ত্রকে ভালোবাসে। বনের পশুকে ভালোবাসে, কীট পতঙ্গকে ভালোবাসে এমনকি গাছের পাতাকেও ভালোবাসে।

নিকি জিজ্ঞেস করল, তোমরা কাউকে ভালোবাস না?

ফ্লিকাস কঠিন চোখে নির্কির দিকে তাকাল, বলল, অবশ্যই ভালোবাসি। আমাদের কপোট্রনের তুলনায় তোমাদের মস্তিষ্ক হচ্ছে একটা ছেলেমানুষি খেলনা। তোমাদের যেটুকু ভালোবাসার ক্ষমতা, আমাদের ভালোবাসা তার থেকে হাজার গুণ বেশি। কিন্তু আমাদের ভেতর অপ্রয়োজনীয়, ক্ষতিকর ভালোবাসা নেই।

নিকি কোনো কথা বলল না। ফ্লিকাস কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, শুধু ভালোবাসা নয়—আমাদের কপোট্রনে অনেক নতুন নতুন অনুভূতি আছে যেটা তোমাদের নেই।

নিকি জিজ্ঞেস করল, সেগুলো কী?

তোমাদের বললে তোমরা সেগুলো বুঝবে না।

কেন বুঝব না?

তুমি কী একটা পিঁপড়াকে বিশুদ্ধ সিম্ফোনিশুনতে কেমন লাগে সেটি বোঝাতে পারবে?

নিকি মাথা নাড়ল।বলল, না।

এটাও সেরকম।

নিকি বলল, ও।

আমি জানি তোমরা বাচ্চা মানুষ, আমার কথা বুঝবে না। তবু বলি-আমার কেন জানি কথা বলতে ইচ্ছে করছে। যেমন মনে করো ভালবাসা এবং ঘৃণা। তোমাদের কাছে দুটি ভিন্ন ব্যাপার তাই না?

নিকি অনিশ্চিতের মতো বলল, হ্যাঁ।

যেটাকে তুমি ভালোবাম সেটাকে তুমি ঘৃণা করতে পার না। কিন্তু আমরা পারি। আমরা কোনোকিছুকে ভালোবাসতে পারি। কোনোকিছুকে ঘৃণা করতে পারি। আবার কোনোকিছুকে একই সাথে ঘৃণা করতে পারি ভালোবাসতে পারি। দুটিই সমান সমান। দুটিই তিব্র।

ত্রিপি জানতে চাইল, সেটার নাম কী?

তোমাদের ভাষায় এর কোনো নাম নেই, আমরা বলি রিভাল। রিভালের মতো আরেকটা অনুভুতির নাম হচ্ছে যিগ্ধা।

যিগ্ধা সেটা কী?

কোনো কোনো মানুষের মাঝে সেটা থাকে। মানুষ সেটাকে মনে করে অপরাধ। আমাদের কাছে সেটা অপরাধ না। এটা আমাদের জন্যে খুবই স্বাভাবিক একটা অনুভূতি।

নিকি কিংবা ত্রিপি কোনো কথা বলল না। ফিকামএকটু চুপ করে থেকে বলল, এই অনুভূতিটা হচ্ছে অন্য কাউকে যন্ত্রণা দিয়ে আনন্দ পাওয়া। আমাদের ভেতর সেটা আছে। আমাদের যখন প্রয়োজন হয় তখন আমরা অন্যকে যন্ত্রণা দিতে পারি, দিয়ে তীব্র আনন্দ পেতে পারি। আমি এখানে এসেছি যিগ্ধা উপভোগ করতে।

নিকি এবং ত্রিপি শিউরে উঠল, কিন্তু কিছু বলল না, ফ্লিকাসের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ফ্লিকাস কাঠের গুঁড়ি থেকে এসে কয়েক পাহদের দিকে এগিয়ে যায় কিছুক্ষণ হ্রদের পানির দিকে তাকিয়ে থাকে তারপর আবার নিকি আর ত্রিপির দিকে ফিরে আসে। কিছুক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়ে, আস্তে আস্তে নরম, প্রায় বিষণ্ণ গলায় বলল, নিকি তুমি একজন অসাধারণ মানবশিশু। আমার মনে একজন পঞ্চম মাত্রার রোবটকে তুমি হত্যা করেছ! আমাদের ইতিহাসে সবসময় তোমার নাম লেখা থাকবে। তুমি যে নিষ্ঠুরতায় আমাকে হত্যা করেছ আমাকে তার সমান নিষ্ঠুরতায় তোমাকে হত্যা করতে হবে। যতোক্ষণ সেটা না করব পঞ্চম মাত্রার রোবটদের সম্মান ফিরে আসবে না। ফ্লিকাস নিকির দিকে তাকিয়ে বলল, নিকি! সারা পৃথিবীতে কী কেউ আছে যে তোমাকে আর তোমার এই বান্ধবীকে এখন রক্ষা করতে পারবে?

নিকি কোনো কথা বলল না। ফ্লিকাস বলল, নেই! পাহাড়ের গহরের মানুষগুলো জেগে উঠবে সতের দিন পর। আমি তাদের ঘুমন্ত অবস্থায় ধ্বংস। করতে পারি নি, কিন্তু জেগে ওঠার পর ধ্বংস করব! সেই মানুষগুলো তোমাদের রক্ষা করতে আসতে পারবে না। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যে মানুষগুলো আছে তাদের মতো অসহায় জীব এই সৃষ্টিজগতে নেই! তাদের। অনেকে বড় হয়েছে বনের পশুর মতো, তাদের কোনো অনুভূতি নেই, কোনো ভাষা নেই। আমি খুঁজে বের করে তাদের একজন একজন করে হত্যা করব। এখন তারা হয়তো কেউ কেউ বেঁচে আছে কিন্তু তারা তোমাদের বাঁচানোর জন্যে আসতে পারবে না। তাহলে এই মুহূর্তে তোমাদের কে বাঁচাতে আসবে? কে?

ক্রিনিটি।

হ্যাঁ। ক্রিনিটি। ফ্লিকাস মাথা নাড়ল। তোমাদের গলায় যে মাদুলি ঝোলানো আছে সেটি আসলে একটি পঞ্চম মাত্রার ট্রাকিওশান। সে যেই মুহূর্তে জানতে পেরেছে আমি এসেছি সেই মুহূর্তে কিছু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে ছুটে আসছে। তার ভেতরে কোনো অনুভূতি নেই। সে তৃতীয় মাত্রায় তুচ্ছ একটা রোবট। তার ভেতরে ভালোবাসা নেই, স্নেহ মমতা নেই, রিভাল নেই যিগ্ধা নেই। আছে শুধু কিছু বাঁধাধরা নিয়ম। সেই নিয়ম পালন করার জন্যে সে ছুটে আসছে। আমি ইচ্ছে করলে এই মুহূর্তে তাকে বিকল করে বনের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারি। কিন্তু আমি তাকে আসতে দিয়েছি। কেন তাকে আমি আসতে দিয়েছি তোমরা জান?

নিকি আর ত্রিপি মাথা নাড়ল, বলল, না জানি না।

আমি তাকে আসতে দিয়েছি কারণ, আমি চাই সে এখানে থাকুক। যখন আমি তোমাদের হত্যা করি তখন সে এই পুরো দৃশ্যটা দেখুক। তার কপোট্রনে সেটা জমা থাকুক, সেখান থেকে পৃথিবীর সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ুক। বুঝেছ?

নিকি আর ত্রিপি মাথা নেড়ে বলল, তারা বুঝেছে।

ফ্লিকাস তার হাতের স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রটির ম্যাগাজিনটা একবার খুলে আবার লাগিয়ে পরীক্ষা করল। তার লেজার সংঙ্কেতটি একবার জ্বালিয়ে দেখল তারপর বলল, বুঝেছ নিকি, তুমি আমাদের অনেক বড় ক্ষতি করেছ। এতোটুকু একজন মানুষ হয়ে পঞ্চম মাত্রার রোবটের এতো বড় ক্ষতি করা সম্ভব আমি বিশ্বাস করি নি। কিন্তু আমাকে বিশ্বাস করতে হয়েছে। পাহাড়ের গহ্বরের মানুষগুলো জেগে ওঠার আগেই আমার মেরে ফেলার কথা ছিলতোমার জন্য পারি নি। এতো ছোট বাচ্চা মাইক্রো মডিউল আর বিস্ফোরকের পার্থক্যটুকু জানে সেটি আমাদের জানা ছিল না।

এখন মানুষগুলোকে মারতে হবে গহ্বর থেকে বের হবার সময়। কাজটি কঠিন নয় কিন্তু কাজটি পরিচ্ছনও নয়। আমরা অপরিচ্ছন্ন কাজ করতে চাই না–তোমার জন্যে করতে হচ্ছে। শুধুমাত্র তোমার জন্যে।

ফ্লিকাস একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, শুধু যে গহবরের ভেতরের মানুষগুলোকে মারতে দাও নি তা নয়, তুমি আমাকেও ধ্বংস করেছ! ওরে মূখ। মানবশিশু, তুমি জান তুমি কত বড় ক্ষতি করেছ? জানার কথা নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিজ্ঞান প্রযুক্তির আবিষ্কারটি তুমি এভাবে ধ্বংস করে দিলে? কেন?

নিকি বলল, তুমি কেন সব মানুষকে হত্যা কর?

বিবর্তনের কারণে একসময় মানুষ পৃথিবীর দায়িত্ব নিয়েছিল। এখন মানুষ নেই, এখন আমাদের পৃথিবীর দায়িত্ব নিতে হবে। যে দুই চারজন মানুষ আছে তারা একধরনের যন্ত্রণা—তাই আমরা তাদের হত্যা করছি। এটা হচ্ছে। প্রকৃতির নিয়ম। যে সবল সে টিকে থাকবে, তার টিকে থাকার জন্যে অন্যদের। সরে যেতে হবে। এটাই বিবর্তন।

ঠিক এরকম সময় বনের ভেতর থেকে ছুটতে ছুটতে ক্ৰিনিটি এসে হাজির হলো, তার হাতের অস্ত্রটি দোলাতে দোলাতে বলল, না, না তুমি কিছুতেই নিকি আর ত্রিপির ক্ষতি করতে পারবে না।

ফ্লিকাস একধরনের কৌতুকের ভঙ্গি করে বলল, আমি তাদের ক্ষতি করব, তাদের পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেব।

ক্রিনিটি দুই হাত বিস্তৃত করে বলল, না, তুমি সেটা করতে পারবে না। আমি তোমাকে সেটা করতে দেব না।

ফ্লিকাস হা হা করে হাসল, বলল, তৃতীয় মাত্রার একটি রোবট পঞ্চম মাত্রার একটি রবোটকে হুমকি দিচ্ছে? পৃথিবীতে এর চাইতে বড় রসিকতা কি কিছু হতে পারে?

ক্রিনিটি বলল, নিকির মা আমার হাতে নিকিকে তুলে দিয়েছিল, আমাকে বলেছিল তাকে দেখে শুনে রাখতে–

ফ্লিকাস তার হাতের অস্ত্রটি ক্রিনিটির দিকে তাক করে ট্রিগার টেনে ধরে, প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণের শব্দে ক্রিনিটির যন্ত্রসহ হাতটি ভস্মিভূত হয়ে উড়ে যায়। বিস্ফোরণের ঝাঁপটায় ক্রিনিটি বালুবেলায় হুঁমড়ি খেয়ে পড়ল। নিকি আর ত্রিপি ক্রিনিটির কাছে ছুটে যাচ্ছিল তখন ফ্লিকাসের যন্ত্রটি আবার গর্জে উঠে এবং সাথে সাথে ক্রিনিটি মাটিতে আছড়ে পড়ল। তার পায়ের পাতা উড়ে গিয়ে সেখান থেকে পোড় তার টিউব আর যন্ত্রপাতি বের হয়ে এসেছে। ক্রিনিটি মাটি থেকে ওঠার চেষ্টা করতে করতে একবার নিকির দিকে তাকাল, বলল, নিকি, আমি মনে হয় তোমাকে উদ্ধার করতে পারব না।

ফ্লিকাস মাথা নাড়ল, বলল, না। তুমি পারবে না। আমি ইচ্ছে করলেই তোমার পুরো সিস্টেম বিকল করে দিতে পারি কিন্তু করি নি। আমি চাই তুমি পরের দৃশ্যটি দেখ।

নিকি ক্রিনিটির কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তোমার ব্যথা লাগছে ক্রিনিটি?

না আমার ব্যথা লাগছে না। আমার ব্যথা লাগার ক্ষমতা নেই। শুধু আমার সার্কিটে চাপ পড়ছে তাই সেটা জোর করে চালু করে রাখতে হচ্ছে। কতোক্ষণ রাখতে পারব আমি জানি না।

নিকির চোখে হঠাৎ পানি এসে গেল, সে ক্রিনিটির শরীরে হাত বুলিয়ে বলল, আমি দুঃখিত ক্রিনিটি। আমি খুবই দুঃখিত। আমার জন্যে তোমার এতো কষ্ট হচ্ছে—

ঠিক তখন কঁ কঁ করে ডাকতে ডাকতে কিকি মাথার উপর দিয়ে উড়ে যায়। নিকি উপরে তাকাল বলল, কিকি আমাদের খুব বিপদ। খুব বড় বিপদ। এই লোকটা ক্রিনিটিকে মেরে ফেলছে।

কিকি কঁ কঁ করে ডাকতে ডাকতে বনভূমির দিকে উড়ে গেল।

ফ্লিকাস মুখে একধরনের কৌতুকের হাসি নিয়ে পুরো দৃশ্যটি দেখছিল, সে এবারে হা হা করে হেসে বলল, চমৎকার একটি নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে! তৃতীয়। মাত্রার একটি রোবট আহত এবং তার জন্যে সমবেদনায় মানবশিশুর চোখে অশ্রুজল! শুধু তাই নয়, সে এই দুঃখের কাহিনীটা বলছে কালো কুৎসিত একটা পাখিকে।  ফ্লিকাস হাসতে হাসতে হঠাৎ হাসি থামিয়ে ফেলে, দেখতে দেখতে তার মুখ কঠিন হয়ে ওঠে, সে হিংস্র চোখে নিকির দিকে তাকিয়ে বলল, নিকি, বলো এই পৃথিবীটা কার? রোবটের না মানুষের? তোমার না আমার?

আমার।

যদি তোমার হয় তাহলে কে তোমাকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে?

নিকি কোনো কথা বলল না, স্থির চোখে ফ্লিকাসের দিকে তাকিয়ে রইল। ফ্লিকাস খুব ধীরে ধীরে তার অস্ত্রটি উপরে তুলে ধরে সেটি নিকির বুকের দিকে তাক করে হিস হিস করে বলল, কে তোমাকে রক্ষা করবে নিকি? ত্রিপি? কে তোমাদের রক্ষা করবে?

নিকি কোনো কথা বলল না। ফ্লিকাস শীতল গলায় বলল, আমার কথার উত্তর দাও, যদি এই পৃথিবীটা তোমার হয় তাহলে এই পৃথিবীর কে তোমাকে রক্ষা করতে আসবে? কে?

খুব ধীরে ধীরে নিকির মুখে হাসি ফুটে উঠল, সে নিচু গলায় বলল, আমার বন্ধুরা।

ফ্লিকাস অবাক হয়ে বলল, তোমার বন্ধুরা? তারা কোথায়?

আসছে। তারা আসছে।

কোথা থেকে আসছে?

তাকিয়ে দেখ।

ফ্লিকাস তাকাল, দেখল বনভূমির উপর থেকে পাখি উড়ে আসছে। একটি দুটি পাখি নয়, হাজার হাজার পাখি লক্ষ লক্ষ পাখি। তাদের লাল চোখ। ধারালো ঠোঁট। তারা তাদের শক্তিশালী পাখা বাতাসে ঝাঁপটা দিতে দিতে উড়ে আসছে। তারা স্থির নিশ্চিত জানে তাদের কী করতে হবে। তাদের ভেতরে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই।

ফ্লিকাস হতবুদ্ধির মতো তার অস্ত্রটি পাখিদের দিকে তুলে ধরল, একবার ট্রিগার টেনে ধরার জন্যে দুর্বল ভাবে চেষ্টা করল, কিন্তু তার আগেই লক্ষ লক্ষ পাখি ফ্লিকাসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাদের তীক্ষ্ণ ধারালো ঠোঁট দিয়ে তারা ফ্লিকাসের চোখে, মুখে, দেহে আঘাতের পর আঘাত করতে শুরু করেছে।

ফ্লিকাস একটা আর্তনাদ করে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল হাজার, হাজার, লক্ষ, লক্ষ পাখি তাকে ঘিরে রইল, আঘাতের পর আঘাত করে তাকে মাটি থেকে উঠতে দিল না। ফ্লিকাসের কাতর আর্তনাদ পাখিদের তীক্ষ্ণ চিৎকারে চাপা পড়ে গেল।

পাখিগুলো যখন উড়ে গেল তখন নিকি আর ত্রিপি এগিয়ে যায়। ছিন্নভিন্ন কিছু দুমড়ে মুচড়ে থাকা ধাতব যন্ত্রপাতির অবশিষ্টাংশ ছাড়া আর কিছু নেই। নিকি ভয়ে ভয়ে এদিক-সেদিক তাকাল, তার মনে হলো হঠাৎ করে ফ্লিকাসের ছিন্ন মাথা বুঝি খলখল করে হেসে উঠবে। কিন্তু কেউ খলখল করে হেসে উঠল না।

নিকি ত্রিপির দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। ত্রিপি তাকে জাপটে ধরে বলল, নিকি আমরা বেঁচে গেছি।

হ্যাঁ। পৃথিবীতে আমরা থাকব।

তাদের মাথার উপর দিয়ে কিকি ক ক শব্দ করে উড়ে গিয়ে আবার ফিরে এসে তার ঘাড়ের ওপর বসল। নিকি আদর করে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, কিকি যখন সব মানুষেরা আসবে তখন আমি তাদের বলব তোমাকে আর তোমার পাখির দলকে মেডেল দিতে।

কিকি বলল, কঁ কঁ। নিকি মাথা নাড়ল, বলল, না বোকা। মেডেল খাবার জিনিস না।

 

কিকি উড়ে যাবার পর নিকি ক্রিনিটির কাছে গিয়ে বসে, তার দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে যাওয়া হাত পায়ে হাত বুলিয়ে বলল, ক্রিনিটি তুমি কোনো চিন্তা করো না। আমি আর ত্রিপি গিয়ে বাইভার্বালটি নিয়ে আসছি। তোমাকে নিয়ে যাব। তোমাকে আবার আমরা নতুনের মতো করে ফেলব।