১২. স্কাউটশিপটি গর্জন করতে করতে

স্কাউটশিপটি গর্জন করতে করতে নিচে নামতে থাকে। যতদূর দেখা যায় বিস্তৃত লালাভ একটি গ্রহ, লালচে মেঘ, নিচে প্রবলবেগে ধূলিঝড় বয়ে যাচ্ছে।

স্কাউটশিপটির তীব্র ঝাকুনি সহ্য করতে করতে নীহা বলল, মঙ্গল গ্রহ সৌরজগতের চতুর্থ গ্রহ এর ভর পৃথিবীর দশভাগের এক ভাগ, ব্যাসার্ধ পৃথিবীর অর্ধেক। তাই এখানে আমাদের ওজন হবে সত্যিকার ওজনের মাত্র তিনভাগের এক ভাগ।

টুরান বলল, যতক্ষণ মঙ্গলগ্রহে থাকব সারাক্ষণ আমাদের বায়ুনিরোধক পোশাক পরে থাকতে হবে। সেটি অত্যন্ত বিশেষ ধরনের পোশাক, তার ওজন দিয়ে আমাদের ওজন একটু বাড়ানো হবে, তারপরেও আমাদের সবসময়ই নিজেদের হালকা মনে হবে।

নীহা মনিটরে কিছু তথ্য দেখে বলল, মঙ্গলগ্রহের বায়ুমণ্ডল খুবই হালকা, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মাত্র একশ ভাগের এক ভাগ। বাতাসের পঁচানব্বই ভাগই কার্বনডাই অক্সাইড! তিন ভাগ নাইট্রোজেন।

সুহা জানতে চাইল, অক্সিজেন? অক্সিজেন নেই?

খুবই কম। এক হাজার ভাগের এক ভাগের মতো।

টুরান বলল, আমাদের পোশাকে সেই অক্সিজেন আর নাইট্রোজেন আলাদা করে নিঃশ্বাস নেবার জন্যে দেয়া হবে।

টর জিজ্ঞেস করল, পানি আছে?

প্রচুর পানি, কিন্তু সেগুলো দুই মেরুতে জমা আছে। বরফ হিসেবে।

ইহিতা বলল, কিছু মাথা খারাপ বিজ্ঞানী মেরু অঞ্চলের বরফ গলিয়ে পানির প্রবাহ তৈরি করে এখানে প্রাণের বিকাশ ঘটাতে চেয়েছিল।

সুহা জানতে চাইল, প্রাণের বিকাশ হয়েছিল?

ইহিতা মাথা নেড়ে বলল, পরিষ্কার করে কেউ বলতে পারে না। এটা হচ্ছে পৃথিবীর অন্ধকার জগতের সময়ের ঘটনা। সারা পৃথিবী তখন নানারকম দেশে ভাগ হয়েছিল। কেউ গরিব কেউ বড়লোক। শক্তি বলতে তেল গ্যাস-এক দেশ তেল গ্যাসের জন্যে আরেক দেশ দখল করে ফেলত। সেই সময় পৃথিবীতে কোনো নিয়ম নীতি ছিল না, যার জোর সে পৃথিবী শাসন করত। সেই সময়ে উন্নত দেশের কিছু মাথাখারাপ বিজ্ঞানী মঙ্গলগ্রহের উপযোগী প্রাণ তৈরি করার চেষ্টা করেছিল। কেউ বলে পেরেছিল, কেউ বলে পারে নি।

নীহা জানতে চাইল, তুমি এতো কিছু কেমন করে জান?

কৌতূহল।

স্কাউটশিপটা একটা ঝড়ো হাওয়ার মাঝে আটকা পড়ে যায়, ভয়ানক ঝাকুনি হতে থাকে। ভেতরের সবাই সিটের সামনে ব্র্যাকেটগুলো ধরে তাল সামলানোর চেষ্টা করে। টর একটা কুৎসিত গালি দিয়ে বলল, মঙ্গলগ্রহ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলে হয়।

শুধু ক্লদ আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, তার কাছে মনে হচ্ছে পুরো ব্যাপারটাই হচ্ছে একটা খেলা।

স্কাউটশিপটা পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে শেষ পর্যন্ত থেমে গেল। টুরান বুকের ভেতর আটকে থাকা একটা নিঃশ্বাস বের করে দিয়ে বলল, সবাই ঠিক আছ?

সেটা নির্ভর করে ঠিক থাকা বলতে কী বোঝায় তার ওপর। নীহা বলল, বেঁচে আছি।

আপাতত বেঁচে থাকা মানেই হচ্ছে ঠিক থাকা।

ইহিতা বলল, কেউ একজন স্কাউটশিপের লগটা পড়ে বলবে আমরা এখন কোথায়। কী করব?

পঁচিশ ডিগ্রি অক্ষাংশ যেটা এখন গ্রীষ্মকাল। তাপমাত্রা শূন্যের নিচে পাঁচ ডিগ্রি, যেটা এখানকার হিসেবে বেশ গরম।

টুরান বলল, খুব কাছাকাছি মানুষের একটা আশ্রয়স্থল থাকার কথা, যে জন্যে স্কাউটশিপটা এখানে থেমেছে।

হ্যাঁ। মনিটরে সেটা দেখতে পাচ্ছি। এখানে কেউ নেই, আমরা মনে হয় আশ্রয় নিতে পারব।

নীহা বাইরে তাকিয়ে বলল, আমাদের স্কাউটশিপটা রীতিমতো একটা ধুলার ঝড় তৈরি করেছে। ধুলাটুকু সরে গেলে মনে হয় সূর্যটাকে দেখতে পাব। আকারে ছোট দেখাবে।

ইহিতা বলল, আকার নিয়ে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না, সূর্যটাকে দেখলে অন্তত মনে হবে পরিচিত কিছু একটা দেখছি!

স্কাউটশিপের জানালা দিয়ে সবাই বাইরে তাকিয়েছিল, ধুলো সরে গেলে তারা বিস্তীর্ণ প্রান্তর দেখতে পেল। যতদূর চোখ যায় লাল পাথরে ঢাকা, ঘোলাটে লাল আকাশে একটি লালচে সূর্য। রুক্ষ পাথুরে প্রান্তর দেখে মন খারাপ হয়ে যায়।

রুহান বলল, আমরা এই ছোট স্কাউটশিপে বেশিক্ষণ থাকতে পারব না। মানুষের ক্যাম্পে আশ্রয় নিতে হবে।

নীহা বলল, তাহলে দেরি না করে চল রওনা দিই।

রওনা দেয়ার আগে অনেক প্রস্তুতি নিতে হবে। আমাদের সবার দীর্ঘ সময়ের জন্যে স্পেসস্যুট পরে নিতে হবে।

ইহিতা বলল, অন্তত স্কাউটশিপে স্পেসস্যুটগুলো দেয়ার জন্যে ট্রিনিটিকে একটা ধন্যবাদ দিতে হয়।

টর বলল, ট্রিনিটির নাম কেউ মুখে আনবে না। আমি নিজের হাতে একদিন ট্রিনিটিকে খুন করব।

ট্রিনিটি নিয়ে আরো আলাপ শুরু হয়ে যাবার উপক্রম হতে চলছিল কিন্তু তখন ক্লদ চিৎকার করে বলল, আমি স্কাউটশিপে থাকতে চাই না। আমি বের হতে চাই।

রুহান বলল, শুধু তুমি নও। ক্লদ আমরা সবাই বের হতে চাই।

তাহলে আমরা কেন বের হচ্ছি না?

টুরান নরম গলায় বলল, স্পেসস্যুটটা পরেই আমরা বের হব। একটু সময় দাও।

দেখা গেল একটু সময় দিয়ে হল না। সাতজন মানুষের স্পেসস্যুট পরতে বেশ খানিকক্ষণ সময় লেগে গেল। সবচেয়ে ঝামেলা হলো ক্লদকে স্পেসস্যুট পরাতে। নুট এমনিতে কোনো কথা বলে না কিন্তু ক্লদকে স্পেসস্যুটে পরানোর সময় সে তাকে সাহায্য করল। স্পেসস্যুট পরার পর স্বচ্ছ নিওপলিমারের একটা আবরণ তাদের শরীরটাকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলল। মাথায় একটা হেলমেট, সেই হেলমেটের সাথে যোগাযোগ মডিউলে একে অন্যের সাথে কথা বলার ব্যবস্থা। পিঠে অক্সিজেন সিলিন্ডার। বায়ুমণ্ডল থেকে যেটুকু অক্সিজেন পাওয়া সম্ভব সেটাকেই সংগ্রহ করে ক্রমাগত সিলিন্ডারে ভরে দেয়ার একটা পাম্প কাজ করে যাচ্ছে।

স্কাউটশিপ থেকে বের হওয়ার মুহূর্তটি ছিল সবচেয়ে অনিশ্চিত মুহূর্ত। নিরাপত্তার জন্যে সবাইকে হাতে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বের হতে হবে। কেউ মুখ ফুটে বলছে না কিন্তু সবাই জানে তাদের ভেতর যে দুজন রবোমানব তারা হাতে আগ্নেয়াস্ত্রটি নিয়েই সেটা ঘুরিয়ে অন্য সবাইকে শেষ করে দিতে পারে। যারা মানুষ তারা জানে না এখানে কোন দুজন রবোমানব, কিন্তু যারা রবোমানব তারা খুব ভালো করে জানে এখানে কারা মানুষ।

সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে হাতে নিয়ে নামছে, কেউ কাউকে বিশ্বাস করছে না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে আছে। তীব্র উত্তেজনাটুকু কমিয়ে দিল ক্লদ, সে বলল, আমাকে? আমাকে অস্ত্র দেবে না?

সুহা বলল, বাবা, এটা খেলনা না। এটা সত্যিকারের অস্ত্র।

আমি জানি এটা খেলনা না। আমি খুব সাবধানে ধরে রাখব।

উঁহু। বড় না হওয়া পর্যন্ত হাতে অস্ত্র নেয়া নিষেধ।

টুরান তার দিকে একটা ডিটেক্টর এগিয়ে দিয়ে বলল, তুমি বরং এটা নিতে পার।

এটা কী?

এটা তেজস্ক্রিয়তা মাপার একটা ডিটেক্টর। মঙ্গল গ্রহে পৃথিবী থেকে অনেক তেজস্ক্রিয়তা ফেলা হয়েছে। আমরা যেন ভুল করে কোনো তেজস্ক্রিয় জায়গায় চলে না যাই সেজন্যে এটা আমাদের সাথে রাখতে হবে। আশপাশে তেজস্ক্রিয় কিছু থাকলেই এটা কট কট শব্দ করবে।

হাতে সত্যিকারের একটা অস্ত্র নিতে না পারার দুঃখটা ক্লদের খানিকটা হলেও ঘুচে গেল। সে ডিটেক্টরটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারদিকে দেখতে থাকে কোথাও কোনো তেজস্ক্রিয় পদার্থ পাওয়া যায় কি না।

স্কাউটশিপের গোল দরজা বন্ধ করে সাতজনের দলটা হাঁটতে শুরু করে। স্পেসস্যুটের ভেতর বাতাসের তাপ, চাপ, জলীয় বাষ্পের পরিমাণ নির্দিষ্ট করে রাখার পরও তারা বাইরের হিমশীতল পরিবেশটুকু অনুভব করে। একধরনের ঝড়ো বাতাস বইছে, মাঝে মাঝেই চারদিকে ধূলায় ধূসর হয়ে যাচ্ছিল তার মাঝে তারা সারি বেঁধে সামনে এগিয়ে যেতে থাকে। স্পেসস্যুটের পোশাকে নানা ধরনের ভারী যন্ত্রপাতি তারপরেও তাদের নিজেদের অনেক হালকা মনে হয়, প্রতিটি পদক্ষেপ দেবার সময় তারা খানিকটা উপরে ওঠে যায়। যদিও তারা হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে কিন্তু দেখে মনে হয় লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে।

কতোক্ষণ গিয়েছে জানে না তখন হঠাৎ করে ক্লদের আনন্দধ্বনি শোনা গেল, পেয়েছি! পেয়েছি!

ইহিতা জানতে চাইল, কী পেয়েছ?

তেজস্ক্রিয়তা।

টুরান অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কোথায় তেজস্ক্রিয়তা পেয়েছ?

এই তো আমার ডিটেক্টরে। এই দেখ কট কট শব্দ করছে।

সবাই অবাক হয়ে শুনল সত্যিই ডিটেক্টরটা কট কট শব্দ করছে। নীহা ভয় পাওয়া গলায় বলল,  আমরা কি ভুল করে কোনো তেজস্ক্রিয় এলাকায় চলে এসেছি?

টুরান মাথা নাড়ল, বলল, না। আমি নিশ্চিতভাবে পরীক্ষা করে দেখেছি। আশপাশে কোনো তেজস্ক্রিয়তা নেই।

তাহলে এখন কোথা থেকে আসছে?

ইহিতা উপরের দিকে তাকাল, বলল, হয়তো বাতাসে ভেসে আসছে?

টুরান ডিটেক্টরের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, না এটা উপর থেকে আসছে। এটা নিচে থেকে আসছে।

হঠাৎ করে ডিটেক্টরের শব্দ বেড়ে যেতে শুরু করে। সাথে সাথে তারা পায়ের নিচে একটা কম্পন অনুভব করে।

মাটির নিচে দিয়ে কিছু একটা তাদের দিকে আসছে। সবাই তাদের অস্ত্র হাতে তুলে নিল।

কম্পনের সাথে সাথে এবার তারা সামনে পাথরের মাঝে কিছু একটা নড়ে যেতে দেখল। মাটির নিচে দিয়ে কিছু একটা তাদের দিকে এগিয়ে আসছে।

সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে, তাদের মনে হতে থাকে যে কোনো মুহূর্তে পাথর ভেদ করে কিছু একটা ভয়ংকর চিৎকার করে বের হয়ে আসবে, কিন্তু কিছু বের হলো না। তাদের পায়ের নিচে দিয়ে সেটা ধীরে ধীরে দূরে সরে গেল। ডিটেক্টরে তেজস্ক্রিয়তার শব্দটা কমতে কমতে এক সময় মিলিয়ে গেল।

সুহা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, এটা কী?

ইহিতা বলল, কোনো একটা প্রাণী।

মঙ্গলগ্রহে প্রাণী আছে?

আগে ছিল না। মনে হচ্ছে এখন আছে।

কাছে এলে তেজস্ক্রিয়তা বেড়ে যায় কেন?

নিশ্চয়ই শক্তি পায় তেজস্ক্রিয়তা থেকে। এটা যেহেতু তেজস্ক্রিয় পদার্থের ভাগাড়, শক্তিটাও এখান থেকে পাবে সেটাই তো স্বাভাবিক।

কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? তেজস্ক্রিয়তার শক্তি অনুপরমাণুকে ছিন্নভিন্ন। করে দিতে পারে। এই প্রাণীর দেহ তাহলে কী দিয়ে তৈরি?

এটা নিশ্চয়ই আমাদের পরিচিত প্রাণীর মতো না। অন্যরকম।

কীভাবে অন্যরকম?

জানি না। হয়তো প্রাণী আর যন্ত্রের একটা হাইব্রিড।

টুরান বলল, এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে চল অগ্রসর হই। চার দেওয়াল আর ছাদের নিচে থাকলে মনে হয় একটু ভরসা পাব।

হ্যাঁ চল।

সবাই আবার অগ্রসর হতে থাকে। ক্লদ জিজ্ঞেস করল, মঙ্গল গ্রহের প্রাণীটা দেখতে কেমন হবে?

সুহা বলল, আমি জানি না। জানতেও চাই না। সেটা যেন আমরা কোনোদিন জানতে না পারি।

ক্লদ বলল, আমি কিন্তু জানতে চাই।

কেউ তার কথার উত্তর দিল না। সবার জীবনই যদি একটা শিশুর জীবনের মতো সহজ সরল হত তাহলে মন্দ হত না!