সুজাতা বা বামদেব কাউকেই ঘুণাক্ষরেও সেরাত্রের অভিযানের কথা বিনয় ইচ্ছা করেই জানাল না এবং তারপর পর পর দুটো দিন সারাটা দুপুর বিনয় একা একা বাড়ির পিছনে জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে ঘুরে বেড়াল।
কিন্তু সেরাত্রের সেই কাঁটাঝোপের কোন হদিসই পেল না। কোথায় গিয়ে যে সে পথ হারিয়েছিল বুঝতেই পারল না। জঙ্গলের মধ্যে কিছুটা অগ্রসর হবার পর ফণীমনসা ও নানা জাতীয় বন্যগুল্ম কাঁটাঝোপ এমন দুর্ভেদ্য প্রাচীর তুলে দাড়িয়ে আছে যে তার মধ্যেই প্রবেশ করা একপ্রকার দুঃসাধ্য।
শুধু তাই নয়, রত্নমঞ্জিলের একটা ভগ্নাংশ যেটা গত ভূমিকম্পের সময় ধ্বসে গিয়েছিল, সেটাও ঐ জঙ্গলের মধ্যেই যেন ঢাকা পড়ে গিয়েছে। ভগ্ন দালান ও জঙ্গল দুটোতে মিলে জায়গাটা অগম্য ভয়াবহ করে রেখেছে। যত বিষধর সাপের আডিডা সেখানে এখন।
যাই হোক বার বার ব্যর্থ হলেও বিনয় দমল না। অফিস থেকে কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে এল। পরের দিন কলকাতায় গিয়ে। তারপর ঐ জঙ্গল ও ভগ্ন ধ্বংসাবশেষ দালানের আশেপাশে সে ঘুরে বেড়াতে লাগল। যেমন করে যে উপায়েই হোক সেই রাত্রের রহস্যময়ী নারীকে খুঁজে বের করতেই হবে।
সেই মজা জঙ্গলাকীর্ণ দিঘিটার আশেপাশেও কম ঘোরাঘুরি করেনি বিনয়। সেই দাড়িগোফ শোভিত মুখখানার দেখাও আর মেলেনি যেমন তেমনি মেলেনি সেই তেমনি দেখা রহস্যময়ীর।
এদিকে দিনসাতেক হয়ে গেল কিরীটী রায়ের দেখা মিলল না।
এমনি করে আরো দুটো দিন কেটে গেল।
সেদিন সকালে সবে দোতলার বারান্দায় চায়ের আডডাটা জমে উঠেছে, এমন সময় মনোহর এসে বললে কে একজন ভদ্রলোক দেখা করতে চান কর্তবাবুর সঙ্গে। বিশেষ জরুরী প্রয়োজন, ভদ্রলোক নাকি কলকাতা থেকে আসছেন।
বামদেব বিস্মিত হলেন। কলকাতা থেকে এত দূরে কে আবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এল!
বললেন, যা, উপরেই পাঠিয়ে দে।
মনোহর চলে গেল এবং কিছুক্ষণ পরেই সিঁড়িতে জুতোর শব্দ শোনা গেল।
আর কেউ নয়। আগন্তুক স্বয়ং পিয়ারী।
পরিধানে দামী মুগার সুট। মাথার চুল থেকে পায়ের দামী গ্লেসকীডের জুতোটি পর্যন্ত চকচকে ঝকঝকে পালিস করা হাতে মার্কোভিচের টিন।
মুখে একটা আলগোছে ধরা জ্বলন্ত সিগারেট।
যদি আমার ভুল না হয়ে থাকে আপনিই-বোধ হয় মিঃ অধিকারী?
হ্যাঁ আপনি?
গুড মর্নিং!
গুড মর্নিং! স্বাগত সম্ভাষণ জানালেন বামদেব পিয়ারীকে, যদিচ তাকে চিনতে পারলেন না।
বামদেব যে পিয়ারীকে চিনতে পারবেন না সে তো জানা কথাই, কারণ ইতিপূর্বে কখনো তো তাকে তিনি দেখেননি।
বিনা আহ্বানেই একটা খালি চেয়ার টেনে বসতে বসতে পিয়ারী বললে, আমি আপনার পরিচিত নই। মিঃ অধিকারী, আপনি আমাকে তাই চিনতে পারছেন না।
না–
আমি আসছি। কলকাতা থেকে বিশেষ একটা কাজে আপনার কাছে। আমার নাম পিয়ারীলাল দেশমুখ। পিয়ারী বলেই লোকে আমায় জানে।
কিন্তু কাজটা কি বলুল তো?
এই রত্নমঞ্জিল আপনার কাছ থেকে আমি কিনতে চাই।
বামদেব সত্যিই এবারে চমকে উঠলেন।
আবার রত্নমঞ্চিলের নতুন ক্ৰেতা!
বিনয়ও বিস্মিত দৃষ্টি তুলে নতুন করে আবার পিয়ারীর দিকে তাকাল। আবার একজন ক্ৰেতা!
কিন্তু বাড়ি তো ইতিপূর্বেই বায়না নেওয়া হয়ে গিয়েছে মিঃ পিয়ারী! বললেন বামদেব।
মৃদু হাসলে পিয়ারী।
বায়না নেওয়া হয়ে গেছে? তা যাক না!
কি বলছেন আপনি?
ঠিকই বলছি। বায়না আমন হয়ই। নাকচ করতে কতক্ষণ লাগবে মশাই!
বিনয়ও অবাক হয়েছে যেন কথাটা শুনে।
নাকচ করব?
হ্যাঁ, সব সংবাদই আমি নিয়ে এসেছি। পঞ্চান্ন হাজার টাকা দর হয়েছে তো। আশি হাজার টাকা দাম আপনাকে আমি দেব। ঐ সঙ্গে বায়নার টাকাও দেব। বলুন, isn’t a fair offer! বক্তব্যের শেষে বিশেষ করে ঐ শেষ কটি কথার ওপর জোর দিয়ে পিয়ারী বামদেবের মুখের দিকে তাকিয়ে হাতের অর্ধনিঃশেষিত জ্বলন্ত সিগারেটটা তর্জনী মধ্যমা ও বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের সাহায্যে বারান্দার বাইরে নিক্ষেপ করে টিন হতে আর একটি সিগারেট বের করে অগ্নিসংযোগ করল।
বামদেব ভাবছিলেন, পঞ্চান্ন হাজার থেকে একেবারে আশি হাজার!
লোভনীয় টোপ বটে নিঃসন্দেহে।
ভেবে দেখুন। মিঃ অধিকারী, আপনি যদি আমার terms-এ agree করেন তো এখুনি বায়না, বাবদ ষাট হাজার আমি অগ্রিম দিতে প্রস্তুত। বলতে বলতে পিয়ারী আলতোভাবে ধীরে ধীরে মুখের ধোঁয়া ছাড়তে লাগল।
টাকাটা যেন পিয়ারীর কাছে কিছুই নয়।
বামদেব নিশ্চুপ।
পিয়ারীই আবার কথা বলে, আমি অত্যন্ত সোজা এবং এক কথার মানুষ। বিজনেস যা করি। তার মধ্যেও গোলমাল রাখতে ভালবাসি না।
পার্শ্বে উপবিষ্ট বিনয় বুঝতে পেরেছিল বামদেবের কোথায় দ্বিধা হচ্ছে। লোভনীয় টাকার পরিমাণে শুধু বামদেব কেন, যে কোন মানুষের পক্ষেই এক্ষেত্রে লোভ সামলানো দুষ্কর।
বিশেষ করে এই জীর্ণ বাড়িটার—যার ন্যায্য দাম পচিশ-ত্রিশ হাজারের কখনই বেশী হতেই পারে না। সেক্ষেত্রে আশি হাজার টাকা একটা স্বপ্নাতীত ব্যাপার। শুধু তাই নয়, এ বাড়ির দাম আশি হাজার দিতে যে উদ্যত তার কাছ হতে এক লক্ষ টাকা পাওয়াও দুঃসাধ্য হবে না।
তাছাড়া আশি হাজার টাকা যখন বাড়িটার দাম উঠেছে, এর আসল মূল্যও নিশ্চয়ই তার চেয়ে বেশীই হবে। নচেৎ এই জীর্ণ একটা বাড়ির জন্য কোন পাগলও এত টাকা দিতে যেত না।
কিন্তু মিঃ পিয়ারী, তা তো হবার নয়! পরিষ্কার কণ্ঠে এবারে বিনয়ই জবাব দিল।
বিনয়ের কথা শুনে বঙ্কিম দৃষ্টিতে তাকাল পিয়ারী এবারে বিনয়ের মুখের দিকে।
আপনি?
আমার আত্মীয়। জবাব দিলেন বামদেব।
ওঃ, কিন্তু কেন সম্ভব নয় বলুন তো?
শুনলেন তো একটু আগেই মেসোমশাইয়ের কাছে, এ বাড়ি বিক্রয়ের জন্য বায়না নেওয়া হয়ে গিয়েছে।
বললাম তো সে আর এমন একটা কঠিন ব্যাপার কি! ছেড়ে দিন না ব্যাপারটা আমার হাতেই, আমিই সব settle করে নেব। বাকি যা সামলাবার আমিই সামলাব।
না, তা আর হয় না মিঃ পিয়ারী। আমরা অত্যন্ত দুঃখিত, ক্ষমা করবেন। জবাব দিল আবার বিনয়ই।
অতঃপর পিয়ারী নিঃশব্দে কিছুক্ষণ ধুমপান করে।
তাহলে আমার অফারটা আপনারা নিচ্ছেন না!
দুঃখিত। বললে বিনয়।
মিঃ অধিকারী, আপনারও কি তাই মত? পিয়ারী বামদেবের দিকে তাকিয়ে এবারে প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ মিঃ পিয়ারী, ক্ষমা করবেন।
আচ্ছা তাহলে চলি। তবে একটা কথা যাবার আগে বলে যাই, আমার offerটা accept করলে ভালই করতেন।
পিয়ারী ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে চেয়ার ছেড়ে।
পিয়ারীর কথার সুরাটাই যেন বিনয়ের ভাল লাগল না। সেও অনুরুপ কণ্ঠস্বরে বলে ওঠে, কেন বলুন তো!
না, তাই বললাম–
আপনি যেন মনে হচ্ছে, আমাদের একটু থ্রেটেন করছেন মিঃ পিয়ারী!
যদি তাই মনে করেন মিস্টার তাই!
তাহলে আপনি জেনে যান দশ লক্ষ টাকা দিলেও এ বাড়ি আপনি পাবেন না।
তাই বুঝি! আচ্ছা-সোজা হয়ে দাঁড়ায় পিয়ারী।
হ্যাঁ, আপনি যেতে পারেন।
পিয়ারীর চোখের তারা দুটো বিনয়ের চোখের ওপরে স্থিরনিবদ্ধ। এবং সে দৃষ্টিতে কৌতুক ও ব্যঙ্গ যেন অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে।
তাহলে দশ লক্ষ পেলেও দেবেন না?
না।
তাহলে আপনিও শুনে রাখুন, আমিও পিয়ারীলাল। নামটার সঙ্গে হয়তো আপনাদের সঠিক পরিচয় নেই। Wel, I accept your challenge! হয় এ বাড়ি আমার হবে, আশি হাজারে নয় পঞ্চান্ন হাজারেই, অন্যথায় এ বাড়ি কেউ পাবে না। আপনাদেরও ভোগে আসবে না এ বাড়ি।
এই মুহুর্তে আপনি এখান হতে চলে যান!
বিনয়ের সমস্ত শরীর রাগে কাঁপছে তখন।
যাব বৈকি-আচ্ছা bye bye, আবার দেখা হবে। বলে দ্বিতীয় কোন বাক্যব্যয় না করে পিয়ারী জুতোর মচমচ শব্দ তুলে সিঁড়ির দরজার দিকে এগিয়ে গেল। এবং পিয়ারীর ক্রমআপম্রিয়মাণ দেহটা সিঁড়ির পথে মিলিয়ে গেল।
বামদেব বিনয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল দেখছি। এই এক বাড়ি নিয়ে! মিথ্যে তুমি লোকটাকে চটাতে গেলে কেন বিনয়!
কি বলছেন। আপনি মেসোমশাই, কোথাকার কে না কে, আমাদের বাড়িতে এসে চোখ রাঙিয়ে যাবে!
চটাচটি না করলেই হত। উপকার না করে করুক, অপকার করতে কতক্ষণ?
আপনি দেখছি ভয় পেয়ে গিয়েছেন মেসোমশাই!
ভয় নয় বিনয়, মিথ্যে ঝামেলায় লাভ কি?
তাই বলে ভয় দেখিয়ে যাবে?
কিন্তু বাবা এখানে আর নয়, চল আজই কলকাতায় ফিরে যাওয়া যাক!
না মেসোমশাই, এখন কলকাতায় যাওয়া হবে না।
কেন?
তবে শুনুন অনেক কথা আছে আমার বলবার।
আবার কি কথা!
শুনুন। এ কদিন আমি চুপ করে বসে থাকিনি।
অতঃপর সংক্ষেপে গত দ্বিপ্রহর ও রাত্রির সমস্ত কাহিনী একে একে বলে গেল বিনয়। বামদেব সব কথা শুনে তো নির্বাক।
ইতিমধ্যে পিয়ারীর সঙ্গে যখন বিনয়ের কথাবার্ত হয়, বিনয়ের কণ্ঠস্বরে আকৃষ্ট হয়ে সুজাতাও একসময় সকলের পশ্চাতে এসে দাঁড়িয়েছিল। সেও সমস্ত কথা শুনে বিস্ময়ে একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়।
বিনয় বলে, নিশ্চয়ই এ বাড়ির পিছনে কোন জটিল রহস্য আছে, এখন তো বুঝতে পারছেন। এবং অন্যেও জানতে পেরেছে, তাই এ বাড়ি নিয়ে হাঙ্গামা শুরু হয়েছে। নচেৎ আপনিই বলুন না, এমন কেউ কি পাগল আছে যে এ বাড়ি আশি হাজার টাকা দিয়ে কিনতে চাইবে! নিশ্চয়ই এর মূল্য অনেক বেশী। কাজেই সমস্ত ব্যাপারটা ভালভাবে না জেনে এ বাড়ি কিছুতেই হাতছাড়া করা চলবে না। এবং সব ব্যাপারের একটা মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত এ স্থানও আমাদের ত্যাগ করা উচিতও হবে না।
বামদেব কিছুক্ষণ গুম হয়ে রইলেন।
অবশেষে বললেন, এ যে বড় চিন্তার কথা হল বিনয়!
চিন্তার কথা তো নিশ্চয়ই, কিন্তু বিচলিত হবার কি আছে! দেখাই যাক না কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়!
বিনয় ঠিকই বলেছে। বাবা, এ বাড়ি আমাদের কিছুতেই বিক্রি করা চলবে না।
সুজাতার কথায় বিনয় ও বামদেব দুজনেই একসঙ্গে ফিরে তাকাল।
সুজাতা আবার বলে, বেটাকে গলাধাক্কা দিয়ে হাঁকিয়ে দিলে না কেন বিনয়! বেটার কি সাহস!
না মা না, ওসব কী চরিত্রের লোক কে জানে!
বাবা, তুমি দেখছি ভয়েই গেলে। যার যা খুশি তাই করলেই হল! দেশে আইন নেই আদালত নেই! প্রতিবাদ জানায় সুজাতা।
আপনি মিথ্যে ভাবছেন মেসোমশাই। এই ধরনের কুকুর সায়েস্তা করবার জন্য আমারও মুগুর জানা আছে। আবার যদি এখানে ও পা দেয়, সেই ব্যবস্থাই করব।
বিনয় আশ্বাস দেবার চেষ্টা করে বামদেবকে, কিন্তু বুঝতে পারে বামদেবের মনের চিন্তা তাতে দূর হয়নি, তিনি প্রত্যুত্তরে কোন কথাই বলেন না।
নিঃশব্দে উঠে বামদেব তাঁর ঘরের দিকে চলে যান।
বিনয় নিজেও চিন্তিত হয়নি তা নয়। কিন্তু তার চিন্তাধারাটা অন্য পথে। সে ভাবছিল এই রত্নমঞ্জিলকে কেন্দ্র করে ক্ৰমে যে একটা রহস্য ঘনিয়ে উঠছে তারই কথা।
সেই বাঁকড়া চুলদাড়িগোঁফওয়ালা লোকটা, চকিতে দিঘির ধারে দেখা দিয়েই যে জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল, কে সে লোকটা!
আর কেই বা সেই রাত্রের মধুকণ্ঠী পথ-প্রদর্শিকা! কেন সে তার পরিচয় দিল না? আর কেই বা সেই দুর্বাসা মুনি যার কথায় সেই মেয়েটিকেও শঙ্কিত বলে মনে হল! সেরাত্রে জানালা হতে দেখা সেই লাল আলো, সর্বশেষে এ বাড়ির পুরাতন ভৃত্য মনোহরের সন্দিগ্ধ আচরণ—সব কিছু যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। এই রত্নমঞ্জিলের সঙ্গে সব কিছুর নিশ্চয়ই একটা সম্পর্ক আছে।
সম্পর্কই যদি না থাকবে তো ওরা—ঐ বিচিত্রের দল এখানে এসে ভিড় জমিয়েছে কেন? কেনই বা রহস্যজনক ওদের গতিবিধি? আর বিশেষ করে রত্নঞ্জিলের সঙ্গে যদি ওদের কোন সম্পর্কই না থাকবে তো এখানেই বা ওরা কেন?
তারপর এই পিয়ারী!
কোথা হতে ঘটল এর আবির্ভাব? এ কি কোন সম্পূর্ণ তৃতীয় পক্ষ, না পূর্বের দলেরই কোন একজন?
আশি হাজার টাকা। আশি হাজার টাকায় লোকটা এই রত্নমঞ্জিল কিনতে চায়!
কি ভাবছ বিনয়?
সুজাতার প্রশ্নে বিনয়ের চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল।
অ্যাঁ! কিছু বলছিলে সুজাতা?
বলছিলাম মুখ বুজে বসে আছ কেন?
এক কাপ চা হলে ভাল হত।
তা না হয়। আনছি, কিন্তু–
ভয় নেই। সুজাতা। ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক, এ ব্যাপারে যখন একবার জড়িয়েছি নিজেকে, এর শেষ না দেখে ছাড়ছি না।
কিন্তু যাই বল, ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং হয়ে উঠল দেখছি। সকৌতুকে বলে সুজাতা কথাটা।
হুঁ? গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দেয় বিনয় মাত্র একটি শব্দে।
কিন্তু তোমার কি মনে হয় বল তো বিনয়? বাড়িটার মধ্যে কোন গুপ্তধনটন নেই তো?
ব্যাপার দেখে সেই রকমই তো মনে হয় সুজাতা।
ভারী মজা হয়, না? যদি এই বাড়ির কোথাও ঘড়া ঘড়া যক্ষের ধন পাওয়া যায়!
যখের ধন থাক আর না থাক, মজা তো শুরু হয়েই গিয়েছে। কিন্তু চা কই!
আনছি। আবার হঠাৎ উধাও হয়ে না। কিন্তু। তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে বিনয়।
ভয় নেই, চা পান না করে পাদমেকং ন গচ্ছামি! নিৰ্ভয়ে চা তৈরী করে আন।
লঘুপদে সুজাতা চলে গেল।
ব্যাপারটা যেমন আকস্মিক তেমনি অতর্কিতভাবেই ঘটে গেল। লোকটা যে আচম্কা অমনি করে হঠাৎ উঠ, ছুটে পালিয়ে যাবে আদপেই তা সে ভাবেনি, ভাবতে পারেনি।
ছট্টুলাল হঠাৎ উঠে এক দৌড়ে বাইরের অন্ধকারে অদৃশ্য হওয়ায় প্রথমটায় একটু হক্চকিয়ে যায়নি যে তা নয়, কিন্তু পরিস্থিতিটা হৃদয়ঙ্গম করে ছট্টুলালের পিছু পিছু বাইরে ছুটে আসতেও সে দেরি করে না।
কিন্তু ঘনান্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে কোন পথে যে সে পালাল বুঝতে পারা গেল না।
এই কুটীরে আসবার পথ তিন-চারটে আছে। অবশ্য জঙ্গলের ভিতর দিয়ে দিয়ে কিন্তু সেও এক গোলকধাঁধার ব্যাপার।
ভাল করে না জানা থাকলে জঙ্গলের মধ্যে পথভ্রান্ত হওয়া কিছুই বিচিত্র নয়। সেই ভেবেই সে অগ্রসর হল ছট্টুলালের খোঁজে।
জঙ্গলের মধ্যে পূর্বে কোন রাস্তাই ছিল না। কষ্টেসৃষ্টে চলবার মত পথ সে নিজেই করে নিয়েছিল এবং সেই পথ ধরে চলাচল করলেও তাকে ঠিক পথ বলা চলে না। এবং পূর্ব হতে না জানা থাকলে সে পথ ধরে যে যাতাযাত করা চলতে পারে কারুরই বিশ্বাস হবে না।
অন্ধকারে শ্বাপদের চোখের মত যেন লোকটার অনুসন্ধানী চোখের তারা দুটো জ্বলছে। হাতের নিশ্চিন্ত মুঠোর মধ্যে এসে সে পালিয়ে গেল।
তার এখানে গোপন অবস্থিতি সম্পর্কে একবার জানাজানি হয়ে গেলে এখানে তার আর আত্মগোপন করে থাকা সুবিধে হবে না। লোকটার আসল পরিচয় জানা হল না।
কে এবং কোন দলের লোক তাই বা কে জানে? কি উদ্দেশ্যে যে রত্নমঞ্জিলের আশেপাশে আজি ক’দিন ধরে চোরের মত উঁকিঝুকি দিয়ে বেড়াচ্ছিল তাই বা কে জানে!
না, লোকটা সম্পর্কে আমন শৈথিল্য প্রকাশ করা আদপেই উচিত হয়নি।
ঐ শৈথিল্যের সুযোগেই ও পালাতে পারল।
আপসোসে নিজের হাত নিজেরই যেন চিবোতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তীর তুণ থেকে বের হয়ে গিয়েছে, আর উপায় নেই।
হঠাৎ একটা খসখস শব্দ শুনে ও থমকে দাঁডায়।
শ্বাস বন্ধ করে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকে। অন্ধকারে ও বুঝতে পারে অস্পষ্ট একটা ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে।
কাছাকাছি আসতেই বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে ছায়ামূর্তিকে জাপটে ধরতেই নারীকণ্ঠে ভয়চকিত সাড়া এল, কে?
আক্রমণকারীর বজ্ৰবন্ধনও সঙ্গে সঙ্গে শিথিল হয়ে যায়। বিস্ময়-বিহ্বল কণ্ঠে বলে ওঠে, কে, বাণী!
হ্যাঁ।
এত রাত্রে এই জঙ্গলের মধ্যে তুমি কি করছিলে? ঘুমোওনি?
না, বাবা। ঘুম আসছিল না দেখে বাইরে একটু—
কতবার না তোমায় নিষেধ করে দিয়েছি বাণী, একা একা এমনি করে অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে বের হবে না!
দিনরাত ঐ খুপরির মধ্যে কোন মানুষ বন্দী থাকতে পারে নাকি? বাণীর কণ্ঠে সুস্পষ্ট একটা অভিমানের সুর।
খুব পারবে। যাও ঘরে যাও।
বাণী কিন্তু নড়ে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
কই গেলে না? যাও!
বাণী তথাপি নিরুত্তর এবং নিশ্চল।
বজ্ৰকণ্ঠে এবার ডাক এল, বাণী!
তারপরই এগিয়ে এসে বাণীর একখানা হাত বজমুষ্টিতে চেপে ধরে ও হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে চলে।-অবাধ্য মেয়ে! চল হাত-পা বেঁধে তোমাকে এরপর থেকে আমি ঘরের মধ্যে আটকে রেখে দেব!