১২. সুরতিয়া

সুরতিয়া!

কিরীটীর ডাকে সুরতিয়া ওর মুখের দিকে তাকাল। ফ্যাকাশে বিবৰ্ণ মুখ।

সুরতিয়া!

বাবুজী!

তুমি তো ভূপৎ সিংয়ের স্ত্রী, তাই না?

কথাটা শুনে হঠাৎ যেন চমকে ওঠে সুরতিয়া, কয়েকটা মুহুর্ত কোন জবাব দিতে পারে না। তারপর ধীরে ধীরে নিঃশব্দে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল।

শোন সুরতিয়া, আমি তোমার অনেক কথাই জানি—

সুরতিয়ার দুচোখের দৃষ্টিতে যেন একটা অজানিত আশঙ্কা ঘনিয়ে ওঠে। নিঃশব্দে চেয়ে থাকে ও।

কিরীটী আবার বলে, তোমাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করছি, তার ঠিক ঠিক জবাব দাও। জবাব না দিলে জানবে যাকে তুমি বাঁচাবার চেষ্টা করছ, তাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।

সুরতিয়া তথাপি নীরব।

রাজাবাবুর সঙ্গে তোমার খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল, সত্যি কিনা?

সুরতিয়া নীরব। নিঃশব্দে সে কেবল চেয়ে আছে কিরীটীর মুখের দিকে।

আমি জানি ছিল—কিরীটী বলতে থাকে, আর সে ঘনিষ্ঠতার কথা রাণীমা জানত, তাই না?

সুরতিয়া পূর্ববৎ নীরব।

এবার বল ওই সুধন্য কে?

আ—আমি জানি না বাবুজী!

জান—বল কে?

আ-আমি জানি না।

তুমি বলতে চাও তুমি জান না কেন রাণীমা অমন করে সুধন্য এসে তাঁর সামনে দাঁড়ালেই তাকে টাকা দিতেন?

রাণীমা ওকে পেয়ার করতেন, তাই—

কিরীটী হেসে ফেলে, কি বললে পেয়ার!

হ্যাঁ

মিথ্যে কথা—ঝুট। উসসে রাণীমাকো বহুৎ নফরৎ থি।

নেহি বাবুজি-নেহি, সাচমুচ—রাণীমা—

শোন সুরতিয়া, তুমি যাই বল আমি জানি রাণীমা ঐ সুধন্যকে দুচক্ষে একেবারে দেখতে পারত না-বল, সত্যি কথা বল— রাণীমা কেন সুধন্যকে আমন করে টাকা দিতেন বল?

বিশ্বাস করুন, বাবুজী, আমি জানি না।

আমি কিন্তু জানি কেন রাণীমা ওকে টাকা দিতেন!

আ—আপনি জানেন? গলার স্বরে যেন একটা চাপা আতঙ্ক ফুটে ওঠে স্পষ্ট হয়ে সুরতিয়ার হঠাৎ।

তুমি বলছ রাণীমা সুধন্যকে পেয়ার করত—কিন্তু কেন? কি সম্পর্ক ছিল সুধন্যর সঙ্গে রাণীমার? কে ও রাণীমার?

কেউ না।

তবে?

কিন্তু বাবুজী—

যাক সেকথা, এবার সত্যি করে বল তো, সিঁড়ি দিয়ে কোট গায়ে যে লোকটা ওপরে উঠছিল, সে কে?

তাকে আমি চিনতে পারিনি।

আবার মিথ্যে কথা বলছি, তাকে তুমি চিনতে পেরেছ।

না, না, আমি চিনতে পারিনি।

তোমার কথা আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। ঠিক আছে, এই ঘরেই তুমি থাক। কোথাওঃ যে ও না যেন।

কিরীটী কথাগুলো বলে মধ্যবর্তী দরজাপথে পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকল।

চৌবেজী তখন জবানবন্দি নিচ্ছেন এক এক করে ঘরে যারা উপস্থিত ছিল।

 

জগদীন্দ্র ও মণীন্দ্ৰ চিত্রাঙ্গদা দেবীর আকস্মিক মৃত্যুতে যেন কেমন মুহ্যমান হয়ে গিয়েছিল। তারা যেন কিছু ভাল করে ভাবতেও পারছিল না।

তারা তাদের জবানবন্দিতে বলেছে, সন্ধ্যা থেকেই তারা গানের আসরে গিয়ে বসেছিল। এবং বাগানে গেস্টদের জন্য যে খাবার ব্যবস্থা হয়েছিল, সেখানেই কয়েকজন পরিচিত স্থানীয় ভদ্রলোকের সঙ্গে খেয়ে নিয়েছিল। খাবার জন্য বাড়ির মধ্যে পর্যন্ত আসেনি। গানের আসর ছেড়ে তারা একবারের জন্যও উঠে আসেনি। কিছুই তারা জানে না-কিছুই তারা বলতে পারে না।

আর জয়ন্ত কিরীটীর কাছে যা বলেছিল, চৌবেজীর প্রশ্নের জবাবেও তাই বলেছে— অর্থাৎ পুনরাবৃত্তি করেছে।

বাইরে গানের আসর। তখনো পুরোদমে চলেছে। রাতও প্রায় পৌনে দুটো হল।

কিরীটী মণীন্দ্রর দিকে তাকিয়ে তাকে এবার প্রশ্ন করে, কয়েকটা কথা আপনাকে আমি জিজ্ঞাসা করতে চাই মণীন্দ্রবাবু!

মণীন্দ্র কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।

আজ সন্ধ্যার সময় আপনি আপনার বড়মার ঘরে এসেছিলেন, না?

হ্যাঁ

কি কথা হয়েছিল। আপনার চিত্রাঙ্গদা দেবীর সঙ্গে?

এমন বিশেষ কিছু না—

কিন্তু আমি যতদূর জানি, আপনাদের পরস্পরের মধ্যে বেশ কথা কাটাকাটি হয়েছিল এবং তিনি উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন। তেমন বিশেষ কিছুই যদি না হবে, তো

হ্যাঁ-স্বাতীর বিয়ের ব্যাপার নিয়ে আমাদের মধ্যে একটু কথা-কাটাকাটি হয়েছিল।

আর কিছু না!

না। অনিন্দ্য আমার পরিচিত—বন্ধু, স্বাতী তাকে বিয়ে করতে চায়, অনিন্দ্যও স্বাতীকে বিয়ে করতে চায়। অথচ বড়মা কিছুতেই রাজী নন। আমি কথাটা উত্থাপন করতেই বড়মা আমাকে যা-তা বলতে শুরু করেন।

তিনি আপনাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেছিলেন?

হ্যাঁ

হুঁ। আচ্ছা মণীন্দ্রবাবু, আপনাদের ভাইদের মধ্যে কাকে বেশি চিত্রাঙ্গদা দেবী পছন্দ করতেন বলে আপনার মনে হয়?

সত্যি কথা বলতে গেলে কাউকেই তিনি আমাদের সত্যিকারের পছন্দ করতেন না। ভালবাসতেন বলে আমার মনে হয় না।

আপনাদের ছোট ভাই শচীন্দ্রবাবুকে?

না।

জয়ন্তবাবুকে?

ওকে তো তিনি দুচক্ষে দেখতে পারতেন না।

জগদীন্দ্ৰও মণীন্দ্রর কথার পুনরাবৃত্তি করল।

গণেশ!

কিরীটী এবারে গণেশের দিকে ফিরে তাকাল।

গণেশ একপাশে দাঁড়িয়েছিল। জবাব দিল, আজ্ঞে?

শচীন্দ্রবাবুকে ডেকে নিয়ে এস তো। আর শোন, তোমাদের স্বাতী দিদিমণিকেও একটা খবর দাও।

গণেশ বের হয়ে গেল।

জগদীন্দ্রবাবু, মণীন্দ্রবাবু, আচ্ছা আপনাদের বড়মার কোন শত্ৰু ছিল কি?

শত্ৰু!

হ্যাঁ।

মণীন্দ্ৰই এবার বলে, না-তাঁর আবার কোন শত্ৰু থাকতে পারে?

কিন্তু এটা তো ঠিক মণীন্দ্রবাবু, আপনারা ভাইবোনেরা কেউ আপনাদের বড়মাকে পছন্দ कट्ठत না?

পছন্দ করতাম না!

হ্যাঁ-কেউ আপনারা সুখী নন।

না না-তা কেন হবে?

কিন্তু আমি যতদূর শুনেছি। কেউ আপনারা তার ব্যবহারে সন্তুষ্ট ছিলেন না।

জগদীন্দ্র জিজ্ঞাসা করে, কে বলেছে সেকথা আপনাকে? জয়ন্ত?

না।

তবে?

বলেছেন আপনাদের বড়মা।

বড়মা?

হ্যাঁ-আর তার ধারণা হয়েছিল–

কি?

তাকে আপনারা হত্যাও করতে পারেন।

এসব আপনি কি বলছেন?

যা বলছি তা যে মিথ্যা নয়। সে আপনারা সকলেই জানেন—আপনি, মণীন্দ্রবাবু, শচীন্দ্রবাবু, স্বাতী দেবী-কেউ আপনারা আপনাদের বড়মাকে সহ্য করতে পারতেন না।

শচীন্দ্র আর স্বাতী একই সঙ্গে ঐ সময় এসে ঘরে ঢুকল। গণেশ কোন কথা তাদের বলেনি। দুজনেই ঘরের মধ্যে অত লোক ও থানা-অফিসারকে দেখে একটু যেন অবাকই হয়।

শচীন্দ্র বলে, কি ব্যাপার, কি হয়েছে রে বড়দা? জগদীন্দ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করে শচীন্দ্র।

আমি বলছি শচীন্দ্রবাবু,-কিরাটাই বলে, আপনাদের বড়মাকে কে যেন একটু আগে খুন করেছে।

খুন!

হ্যাঁ। কি বলছেন। আপনি? ব্যাপারটা অপ্রত্যাশিত ও বিস্ময়কর হলেও সত্যি সত্যিই তাই ঘটেছে। She has been brutally murdered.

স্বাতী এতক্ষণ চুপ করে ছিল; সে হঠাৎ বলে, এই রকমই যে কিছু একটা শেষ পর্যন্ত ওর ভাগ্যে ঘটবে সে আমি জানতাম।

কি বললেন? কিরীটী স্বাতীর মুখের দিকে তাকাল।

বলছি। ওর বরাতে যে শেষ পর্যন্ত এমনি একটা কিছু ঘটবে, সে তো জানাই ছিল।

কেন?

অমন দাম্ভিক, হৃদয়হীন স্ত্রীলোকের পক্ষে ওই রকম একটা কিছু ঘটাই তো স্বাভাবিক। আপনি তো জানেন না—কতটুকু পরিচয় ওর আর এ দুদিনে পেয়েছেন? আমরা দীর্ঘদিন ধরে ওর কাছে থেকে বুঝতে পেরেছি, কি টাইপের স্ত্রীলোক ছিল আমাদের বড়মা।

আপনাদের ওপর বুঝি খুব অত্যাচার করতেন?

কিন্তু আপনাকে তো আমি ঠিক চিনতে পারছি না, যদিও দুদিন থেকে এ বাড়িতে আপনি আছেন। আমি জানতে পেরেছিলাম। আজই সকালে গণেশের কাছ থেকে—

জয়ন্ত চৌধুরীই তখন পুনরায় কিরীটীর পরিচয়টা ওদের কাছে ব্যক্ত করে।

স্বাতী সব শুনে বলে, ও আপনি ওই ডাইনি বুড়ীর আমন্ত্রণ নিয়েই এখানে এসেছিলেন। আমাদের ওপর খবরদারী করতে যখন, তখন তো তার সত্য পরিচয়টা নিশ্চয়ই আপনার সর্বাগ্রে জানা দরকার বিশেষ করে আমি নিশ্চয় জানি, সে পরিচয়টা আপনি তার পাননি–

বেশ তো, বলুন না শুনি।

এক জঘন্য প্রকৃতির নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন প্রকৃতির স্ত্রীলোক ছিলেন তিনি।

কি রকম?

সে ইতিহাস বর্ণনা করতে গেলে পুরো দিন লেগে যাবে। কিন্তু জয়ন্তদাও তো তাকে চিনত, তার কাছেও কিছু আপনি আগে শোনেননি?

শুনেছি কিছু কিছু, আপনিও বলুন না।

এই যে দেখছেন আমার সহোদর ভাই কাটিকে, এদের চারটেকে একেবারে ভেড়া করে রেখেছিল মহিলা। এই যে বাড়িটা-ইন্দ্ৰালয় যার নাম—এর আসল নাম কি হওয়া উচিত ছিল জানেন? নরকালয়। কতকগুলো জ্যান্ত মানুষকে অনুকম্পা ও সাহায্য করার ভান করে দিনের পর দিন রাতের পর রাত চরম জঘন্য নির্যাতন চালিয়েছে, আর তার ফলে যা হবার ঠিক তাই হয়েছিল, এরা সকলে মুখে যতই শ্রদ্ধা ও প্রীতি জানাক না কেন, মনে মনে করত প্রচণ্ড ঘৃণা।

ঘৃণা!

হ্যাঁ, ঘৃণা। অথচ মজা কি জানেন, তবু এরা কেউ বিদ্রোহ করতে পারেনি—এই বিচিত্র বন্দীশালা ছেড়ে চলে যেতে পারেনি। এর চেয়ে দুঃখ, লজ্জা ও ভীরুতার আর কি থাকতে পারে বলতে পারেন?–

একটু থেমে স্বাতী আবার বলে, কাজেই আজ যা ঘটেছে, সে তো খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু দুঃখ হচ্ছে আমার, আমি যখন এই বন্দীশালা ছেড়ে চলে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়েছি, ঠিক সেই মুহুর্তে ব্যাপারটা ঘটল।

আপনি কি

হ্যাঁ, সকালেই অনিন্দ্যর আসার কথা—আমাকে সে নিয়ে যাবে। এখান থেকে বলে গিয়েছে।

আপনার চলে যাবার কথাটা আপনার বড়মা জানতেন?

হ্যাঁ।

আপনি বলেছিলেন বুঝি?

হ্যাঁ, কাল দুপুরেই জানিয়ে দিয়েছিলাম।

তিনি কি বলেছিলেন?

বলেছিল, তাহলে তার সম্পত্তির একটা কপর্দকও আমি পাব না। আমিও সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দিয়েছিলাম তাকে-চাই না।

তাহলে দুপুরে আপনার সঙ্গে আপনার বড়মার দেখা হয়েছিল?

হ্যাঁ।

আপনার মেজদা কথাটা জানতেন কি?

হ্যাঁ, তাকে বলেছিলাম।

কিরীটী এবার শচীন্দ্রর দিকে ফিরে তাকাল, আপনার নামই শচীন্দ্ৰ চৌধুরী?

হ্যাঁ।

আপনি আপনার ঘরেই ছিলেন এতক্ষণ বোধ হয়?

হ্যাঁ।

গানের আসরে যাননি?

না, ওসব আমার ভাল লাগে না।

আচ্ছা শচীনবাবু, শেষ আপনার বড়মার সঙ্গে কখন দেখা হয়?

গতকাল সন্ধ্যায়।

কি কথা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে আপনার?

বিশেষ কিছুই না।

ক্রমশ রাত শেষ হয়ে আসে।

আসর ইতিমধ্যে ভেঙে গিয়েছিল, অতিথি-অভ্যাগতরাও একে একে ইন্দ্ৰালয় ছেড়ে চলে গিয়েছিল।