ছোটোগল্প
উপন্যাস
অন্যান্য

১২. সংখ্যার নাম চার

১২. সংখ্যানাম চার

সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। বিশাল বটবৃক্ষের তলদেশে দাঁড়িয়ে আছে তিন ব্যক্তি কর্ণদেব, বল্লভ, শায়ন। শায়নের আচরণে অস্থিরতার চিহ্ন পরিস্ফুট। সে ইতস্তত পদচালনা করছে, কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়াচ্ছে, আবার পদচালনা করছে। তাকে দেখে পিঞ্জরে আবদ্ধ শার্দুলের কথা মনে পড়ে।

অকস্মাৎ কর্ণদেবের সম্মুখে দাঁড়িয়ে শায়ন অসহিষ্ণু স্বরে বলে উঠল, কর্ণদেব। সন্ধ্যা উত্তীর্ণ। এখনো যে পরন্তপের দেখা নেই?

কর্ণদেব উত্তর দেওয়ার আগেই পিছন থেকে ভেসে এল গম্ভীর কণ্ঠস্বর, পরন্তপ যথাসময়েই উপস্থিত হয়েছে।

সচমকে ফিরে দাঁড়িয়ে বল্লভ ও শায়ন দেখলে তাদের পিছনে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে এক দীর্ঘকায় পুরুষ! উক্ত পুরুষের মাথা ও মুখ কৃষ্ণবর্ণ উষ্ণীষ ও উষ্ণীষ সংলগ্ন বস্ত্রের আবরণে অদৃশ্য, উর্ধ্বাঙ্গে আঙরাখা ও নিম্নাঙ্গে পারসিকদের মতো সেলাই করা পরিচ্ছদ ও কৃষ্ণবর্ণে রঞ্জিত; কটিদেশে লম্বিত রয়েছে দীর্ঘ তরবারি এবং বক্ষস্থলের বামপাশ্ব থেকে দক্ষিণ কটিতট অবধি বেষ্টন করে পিঠের উপর দিয়ে ঘুরে গেছে একটি চমবন্ধনী– ওই বন্ধনীর সঙ্গে ধনুর্বাণের পরিবর্তে সংলগ্ন রয়েছে অনেকগুলি ছুরিকা!

প্রদোষের প্রায়ান্ধকার প্রান্তরের বুকে ওই অপরূপ মূর্তির আকস্মিক উপস্থিতি বল্লভ ও শায়নকে চমকিত করে দিল।

প্রথম কথা বলল বল্লভ, সন্ধ্যার প্রাক্কালে তোমার এখানে আসার কথা ছিল। পরন্তপ! তুমি কথা রাখতে পারোনি।

আবরণের অন্তরাল থেকে মৃদু হাসির শব্দ ভেসে এল, সন্ধ্যার প্রাক্কালে এলে দেখা হবে এই কথাই ছিল। তোমরা ওই সময়ে এসেছ এবং আমার সঙ্গে সাক্ষাৎও হয়েছে। আমি সন্ধ্যার পূর্বে দেখা দেব এমন কথা নিশ্চয়ই কর্ণদেব বলেনি বলেছে কি?

ক্ষণকাল নীরব থেকে বল্লভ বলল, পরন্তপ! তুমি যথার্থ বলেছ বটে। কিন্তু অন্ধকার এখনও ঘনীভূত হয় নি। তুমি কোথা থেকে কেমন করে হঠাৎ আমাদের চোখের সামনে এসে উপস্থিত হলে সেকথা ভেবে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি। মুহূর্ত পুর্বেও তোমার অস্তিত্ব আমরা বুঝতে পারি নি। তোমার চালচলন সত্যই রহস্যময়।

পরন্তপ আবার হাসল, রহসময় না হলে মহারাজ রুদ্রদমনের গুপ্তরচবর্গ বহু পূর্বেই আমায় বন্দি করে ফেলত। অথবা একদিন বক্ষে বা ললাটে শায়কচিহ্ন ধারণ করে পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করতাম।

হঠাৎ শায়নের তিরকণ্ঠ বেজে উঠল, প্রদোষের অন্ধকারে ভূমির উপর শায়িত অবস্থায় হাত ও জানুর উপর ভর দিয়ে অগ্রসর হলে চলমান মানুষের অস্তিত্ব দণ্ডায়মান মানুষের চোখে সহসা ধরা পড়ে না। মৃগয়ার সময়ে আমরা অভীষ্ট পশুর দিকে ওইভাবেই অগ্রসর হই। এটা এমন কিছু রহস্যময় ব্যাপার নয়। পরন্তপ! অনর্থক নিজেকে রহস্যের আবরণে ঢেকে রাখার চেষ্টা করো না।

পরন্তপ বলল, শায়ন! তুমি মৃগয়ায় অভ্যস্ত বলেই এই ধরনের গতিবিধি সম্পর্কে অবহিত। অনভিজ্ঞ ব্যক্তির কাছে ওইভাবে আত্মপ্রকাশ করলে সে বিস্ময়ে অভিভূত হবে সন্দেহ নেই।

বল্লভ বলল, আমি সত্যই বিস্মিত হয়ে পড়েছিলাম। পরন্তপ কিছুমাত্র অত্যক্তি করেনি। তা ছাড়া, দস্যু দলপতির পক্ষে রহস্যের আবরণ সৃষ্টি করার প্রয়োজন আছে।

শায়ন বলল, আমরা দস্যু নই। পরন্তপ বর্তমান অভিযানের নেতা হলেও তাকে এখন দস্যু দলপতি বললে ভুল হবে।

পরন্তপ বলল, নিশ্চয়। এবার কাজের কথা বলি। শায়ন! তোমার পরিচয় নিষ্প্রয়োজন। শ্রাবস্তী রাজ্যে তুমি খ্যাতনামা তিরন্দাজ! অসিচালনাতেও তোমার খ্যাতি আছে। তুমি যদি আমাদের দলে যোগ দাও, তাহলে আমি সুখী হব। কর্ণদেবের মুখে সব কিছুই শুনেছ তো?

-শুনেছি। আমি এই অভিযানে যোগ দিতে রাজি আছি।

সাধু! সাধু! এসো, তোমার করমর্দন করি।

হাত বাড়িয়ে পরন্তপ ও শায়ন পরস্পরের করগ্রহণ করল। বেশ কিছুক্ষণ তারা ওইভাবেই অবস্থান করল, তারপর পরন্তপ উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল, বড়োই সুখী হলাম। শক্তিমান পুরুষের হাতে হাত মিলিয়ে আনন্দ পাওয়া যায়।

পরন্তপ হাত টেনে নিল। তার কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক হলেও ঈষৎ কম্পিত। মনে হয়, শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি হঠাৎ দ্রুত হয়ে পড়েছে।

শায়ন সম্পূর্ণ স্তব্ধ। তবে করমর্দনের পরেই তার ললাটে কয়েকটি স্বেদবিন্দুর আবির্ভাব ঘটেছে।

এইবার বল্লভকে সম্বোধন করে পরন্তপ বলল, বল্লভ! আমি তোমাকে জানি না। তবে কর্ণদেবের মুখে যা শুনলাম, তাতে বুঝলাম তুমি জয়দ্রথের চাইতে অনেক বেশি শক্তিমান।… বল্লভ! তুমি তাহলে ওই অভিযানে যোগ দিতে রাজি?

আমি রাজি, বল্লভ হাসল, এখন তুমি আমাকে মনোনীত করবে কি না সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন।

তোমার ন্যায় মহাবলী পুরুষ আমাদের দলে যোগ দিলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করব,দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত করে পরন্তপ হাসল, বল্লভ। এসো, বন্ধুত্বের শপথ নিয়ে আমরা করমর্দন করি।

বল্লভও হাত বাড়াল। কিন্তু তাদের হাত মিলিত হওয়ার আগেই কর্ণদেব সভয়ে এগিয়ে এসে ধাক্কা দিয়ে বল্লভের হাত সরিয়ে দিল। ক্রুদ্ধভঙ্গিতে কর্ণদেবের দিকে ফিরে পরন্তপ বলল, এই অদ্ভুত আচরণের অর্থ কি কর্ণদেব?

কর্ণদেব গম্ভীরস্বরে বলল, করমর্দন করে বল্লভের শক্তিপরীক্ষা করতে চাও?… পরন্তপ! ওই কর্মটি করো না। করমর্দনের ফলে তোমার করতল চুর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। যদি তা না হয়, তাহলেও অন্তত কয়েকটা দিন ওই হাতে অস্ত্রধারণ করা তোমার পক্ষে সম্ভব হবে না।

তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে একবার বল্লভের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে পরন্তপ বলল, আমাদের কিশোর বন্ধু কর্ণদেবের আজ্ঞা শিরোধার্য। এই মুহূর্তে দক্ষিণ হস্তটি আমার পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বস্তু। ওই বস্তুটিকে অটুট রাখার জন্য বল্লভের সঙ্গে করমর্দনের দুর্লভ আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করলাম।

কিছুক্ষণ স্তব্ধ থেকে পরন্তপ আবার বলল, তাহলে শল্যকে উদ্ধার করার জন্য আমরা চারজন যাত্রা করছি? অর্থের বণ্টন বিষয়ে যে ব্যবস্থা ধার্য হয়েছে, সে কথা নিশ্চয়ই কর্ণদেব তোমাদের বলেছে। তাহলেও আমি আবার বলছি- গুপ্তধন উদ্ধার করতে সমর্থ হলে ওই সম্পদ সমান চারভাগে ভাগ হবে। আশা করি ওই ব্যবস্থায় তোমাদের আপত্তি নেই?

বল্লভ ও শায়ন সমস্বরে জানাল ওই ব্যবস্থায় তাদের কিছুমাত্র আপত্তি নেই।

আরো একটা কথা, পরন্তপ বলল, শল্যের উদ্ধারকার্য যে খুব সহজে হবে না একথা নিশ্চয়ই তোমরা বুঝতে পারছ। দুস্যরা আমাদের চাইতে সংখ্যায় অনেক বেশি এবং প্রাণ দেওয়া-নেওয়ার খেলা খেলতে তারা সর্বদাই প্রস্তুত। তাদের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে আমাদের পক্ষেও হতাহত হওয়ার আশঙ্কা আছে একথা বলে আমি পূর্বেই তোমাদের সতর্ক করে দিচ্ছি। ভেবে দেখ– যদি কারও প্রাণের ভয় থাকে, তার এখনও সরে যাওয়ার সময় আছে।

শায়ন এগিয়ে এসে রূঢ়স্বরে বলল, পরন্তপ! আমরা শিশু নই। শল্যকে দস্যুদের কবল থেকে উদ্ধার করতে গেলে তারা যে আমাদের পাদ্য-অর্ঘ দিয়ে অভ্যর্থনা করবে না এটুকু উপলদ্ধি করার মতো বুদ্ধি আমাদের আছে। আমি দস্যুবৃত্তি করি না। কিন্তু ধনুর্বাণ ও অসি সম্বল করে নরখাদক সিংহ, ব্যাঘ্র অথবা মদোন্মত্ত হস্তীর আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছি বারংবার। প্রাণ দেওয়া-নেওয়ার খেলায় আমি অভ্যস্ত। শুধু হিংস্র পশু নয়– একাধিক পশুবৎ হিংস্র মানুষও আমার অসি ও শায়কের চিহ্ন দেহে ধারণ করে যমালয়ে ভ্রমণ করতে গেছে। অতএব মিছেমিছি বিপদের কথা না বলে এখন আমাদের কি কর্তব্য সে কথাই বলো।

পরন্তপ বলল, শায়ন! আমি তোমাকে ভালোভাবেই জানি। তবু কর্তব্যবোধে আসন্ন বিপদের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। দস্যুদলের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হয়ে শল্যকে উদ্ধার করলেও বিপদের কবল থেকে আমরা মুক্তি পাচ্ছি না। বনপথে হিংস্র জন্তুর ভয় আছে। তার চেয়েও ভয়ানক অনার্য যোদ্ধার দল উদ্যত ধনুর্বাণ হস্তে পাহারা দিচ্ছে সীমান্ত অঞ্চলে। তাদের শ্যেনদৃষ্টি এড়িয়ে গুপ্তধন উদ্ধার করা খুবই কঠিন। আমি জানি তোমরা সাহসী মানুষ, সেইজন্যই তোমাদের সাহায্য চেয়েছি। তবু অভিযানের নেতা হিসাবে এই সকল বিপদ-আপদের সম্ভাবনা জানিয়ে আমি তোমাদের সতর্ক করে দেব। সব জেনেও যদি তোমরা আমার সঙ্গে যোগ দাও, তাহলে আমি আনন্দিত হব। মনে রেখো- এই কাজে পদে পদে প্রাণের আশঙ্কা বর্তমান।

শায়ন বলল, আমার অভিমত পুর্বেই তোমাকে জানিয়েছি। এবিষয়ে আর আলোচনা না করে ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতি অবিলম্বে স্থির করা প্রয়োজন।

পরন্তপ বলল, বল্লভের মতামত আমি এখনও শুনতে পাইনি। বল্লভ! তুমি নীরব কেন? বিপদের কথা শুনে তোমার মনে আতঙ্কের সঞ্চার হয়েছে? তাহলে বলল, এখনও ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

বল্লভ শান্তস্বরে বলল, আমি মৌন ছিলাম, তার কারণ মৌনই সম্মতির লক্ষণ। এখন জানতে চাই শল্যকে উদ্ধার করতে আমরা কখন যাত্রা করব।

–এখনই।

বল্লভ ও শায়ন একসঙ্গে বলে উঠল, এখন! সেকি!

পরন্তপ বলল, শুভস্য শীঘ্রং। বিলম্বে প্রয়োজন কি?

শায়নের পৃষ্ঠে রক্ষিত ধনুর্বাণ ও কটিদেশে বিলম্বিত তরবারির দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে সে বলল, শায়ন তো দেখছি সশস্ত্র হয়েই এসেছে। তবে বল্লভের কাছে অস্ত্র নেই এটা চিন্তার কথা। কিন্তু আমাদের কিশোর বন্ধু কর্ণদেব চেষ্টা করলে মধ্যযামের আগেই বল্লভের উপযুক্ত অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।

বল্লভ বলল, কর্ণদেবকে ব্যতিব্যস্ত করার প্রয়োজন হবে না। অস্ত্র আমার সঙ্গেই আছে। কর্ণদেবই আমাকে অস্ত্র নিয়ে আসতে বলেছিল।

পরন্তপ বলল, কোথায়? কোথায় তোমার অস্ত্র?

নত হয়ে পায়ের তলা থেকে বল্লভ তার অস্ত্র তুলে ধরল। ম্লান অন্ধকারে অনাবৃত প্রান্তরের উপর বস্তুটি এতক্ষণ পরন্তপের দৃষ্টিগোচর হয়নি। সবিস্ময়ে বল্লভের হাতের দিকে তাকিয়ে পরন্তপ বলল, কুঠার! এত বড়ো?

কর্ণদেব ও শায়ন পূর্বেই সুবিশাল ওই কুঠারটি দেখেছিল। তারা কোনো মন্তব্য প্রকাশ করল না। কুঠারফলকের একপাশে সস্নেহে হস্ত স্থাপন করে বল্লভ বলল, এইটি আমার অস্ত্র। দণ্ড ও কুঠার ছাড়া অন্য অস্ত্র ব্যবহারে আমি অভ্যস্ত নই। বর্তমান অভিযানে দণ্ডের চাইতে কুঠারই অধিকতর প্রয়োজনীয় মনে হয়।

পরন্তপ বিস্মিত হয়ে বলল, এই গুরুভার কঠার নিয়ে তুমি কি যুদ্ধ করতে পারবে?

উত্তরে সুবিশাল কুঠারটিকে বিদ্যুৎবেগে মাথার উপর কয়েকবার ঘুরিয়ে কুঠারফলক মাটিতে স্থাপন করল বল্লভ– তারপর কুঠারদণ্ডের উপর ভর দিয়ে পরন্তপের মুখের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।

বিস্ময়-বিহ্বল স্বরে পরন্তপ বলল, তুমি অমিত শক্তিধর পুরুষ। তোমার ক্ষমতা সম্পর্কে আমার আর কিছুমাত্র সন্দেহ নেই।

শায়ন বলল, তাহলে আমরা এখনই অভীষ্ট স্থান অভিমুখে যাত্রা করছি?

-হ্যাঁ। এখন যাত্রা করলে কাল প্রত্যূষে অথবা পূর্বাহ্নে আমরা যথাস্থানে পৌঁছে যাব। সেখানে পৌঁছে অবস্থা অনুসারে ব্যবস্থা হবে।

অভীষ্ট স্থান কতদুরে জানতে পারি কি?

 প্রায় ছয় ক্রোশ।

 ছয় ক্রোশ!

 বল্লভ সভয়ে বলল, আমি পঞ্চাশটি যোদ্ধার সঙ্গে এককভাবে যুদ্ধ করতে ভয় পাই না। কিন্তু ছয় ক্রোশ পথ আজ রাত্রে অতিক্রম করতে হলে আমার ন্যায় স্থূলকায় মানুষ নির্ঘাত মৃত্যুবরণ করবে। দ্রুত পদচালনায় দীর্ঘ পথ অতিক্রম করা আমার পক্ষে অসম্ভব।

শায়ন বলল, আমি দ্রুত ধাবন ও ভ্রমণে অভ্যস্ত। তবু এক রাতের মধ্যে পদব্রজে ছয় ক্রোশ পথ অতিক্রম করা আমার পক্ষেও কঠিন।

কে বলল আমরা পদব্রজে যাব? পরন্তপ গম্ভীরস্বরে বলল, অশ্ব প্রস্তুত আছে। আমরা অশ্বারোহণে যাত্রা করব।

একটু থেমে সে আবার বলল, আরও একটা কথা, সময় বিশেষে আমাদের সঙ্গে অন্যান্য লোকজনের সাক্ষাৎ হতে পারে। পরন্তপ নামে আমাকে সম্বোধন করলে বহু মানুষের মনে সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে। যদিও শ্রাবস্তী রাজ্যে এই নামে বহু মানুষ আছে, তবু অনর্থক সন্দেহের বিষয়বস্তু হয়ে নিজেদের বিপন্ন করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। অতএব, এখন থেকে তোমরা আমাকে দারুক নামেই সম্বোধন করবে। নিজেদের মধ্যে পরন্তপ নামে সম্বোধন করলে বিপত্তির ভয় নেই, কিন্তু মানুষ অভ্যাসের দাস– অপর ব্যক্তির সম্মুখে পরন্তপসম্বোধন সময় বিশেষে ভীষণ বিপদের সূচনা করতে পারে। তাই এখন থেকে সর্বদাই তোমাদের কাছে আমি দারুক। কথাটা যেন মনে থাকে।

থাকবে, শায়ন বলল, কিন্তু আমার একটি প্রশ্ন আছে।

–বলো।

আমরা তোমার সঙ্গে এমন এক অভিযানে যোগ দিচ্ছি, যার পরিণামে আমাদের পক্ষে কোনো কোনো ব্যক্তির, এমনকি সকলেরই মৃত্যু ঘটা অসম্ভব নয়।

-সে কথা তো আগেই বলেছি। সব জেনেই তোমরা আমার সঙ্গী হতে সম্মত হয়েছ।

-নিশ্চয়। কিন্তু আমাদের অধিনায়কের মুখের চেহারা আমরা দেখতে চাই। কি বলল বল্লভ?

–আমিও ওইকথা বলতে যাচ্ছিলাম। শায়ন! তুমি আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়েছ।

পরন্তপ ইতস্তত করতে লাগল।

 দারুক, গম্ভীরস্বরে শায়ন বলল, আমার অনুরোধ না রাখলে আমি এখান থেকেই ফিরে যাব।

বল্লভ বলল, আমারও সেই কথা।

 বেশ, পরন্তপ বলল, কিন্তু পরবর্তীকালে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হলেও তোমরা অপরিচিতের ন্যায় ব্যবহার করবে। শপথ করো- কার্যসিদ্ধি হলে কখনো আমার সঙ্গে সাক্ষাতের চেষ্টা করবে না। দৈবক্রমে যদি আমার সঙ্গে কখনও সাক্ষাৎ হয়, তাহলেও বাক্যালাপের চেষ্টা করবে না।

শায়ন বলল, আমি শপথ করছি ভবিষ্যতে কখনো তোমার মুখদর্শন করার চেষ্টা করব না। দেখা হলেও বাক্যালাপ থেকে বিরত থাকব।

বল্লভ বলল, আমারও সেই কথা।

উষ্ণীষ ও তৎসংলগ্ন বস্ত্রের আবরণ মুক্ত হল। সকলের চোখের সামনে ভেসে উঠল এক মধ্যবয়স্ক পুরুষের মুখ। অন্ধকারের মুখের রং ভালো বোঝা যায় না, তবু মনে হল উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, রৌদ্রদগ্ধ হয়ে তাম্রবর্ণ ধারণ করেছে। মস্তকে কৃষ্ণ কেশরাশি, ললাট অপ্রশস্ত, রোমশ জ্বর তলায় না-ছোটো না বড় দুই চোখে তীব্র দৃষ্টি, গুম্ফরেখার নীচে পরিপূর্ণ ওষ্ঠাধরে ক্ষীণ হাসির আভাস চিবুক ও মুখমণ্ডল ক্ষৌরকর্মের কল্যাণে পরিচ্ছন্ন ও পরিমার্জিত।

বল্লভ ও শায়ন তীব্র দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেও যোদ্ধা সুলভ কাঠিন্য ও দৃঢ়তায় চিহ্নিত সেই মুখে দস্যুজনোচিত বর্বর হিংসার ছায়া আবিষ্কার করতে পারল না।

মুখের অধিকারী হেসে বলল, আশা করি ভোমারা সন্তুষ্ট হয়েছে।

মৌনমুখে দুজনেই মাথা নেড়ে জানাল তারা সন্তুষ্ট হয়েছে।

–অনুগ্রহ করে আমার সঙ্গে এসো।

তিনজনেই নীরবে পরন্তপকে অনুসরণ করল। একটু দূরে অন্ধকার আচ্ছন্ন ঝোপের মধ্যে চারটি অশ্ব দৃষ্টিগোচর হল। একটি গাছের সঙ্গে ঘোড়া চারটিকে বেঁধে রাখা হয়েছিল। পরন্তপের ঈঙ্গিতে তাদের বন্ধন মুক্ত করে তিনজন তিনটি অশ্বে আরোহণ করল। চতুর্থ অশ্বটির পৃষ্ঠে একলক্ষে উপবিষ্ট হয়ে পরন্তপ বাহনকে সবেগে ছুটিয়ে দিল…।

অশ্বপৃষ্ঠে তাকে অনুসরণ করল আর্যাবর্তের তিনটি দুর্ধর্য মানুষ…।

.

১৩. অপরিচিত আগন্তুক

উচ্চভূমির উপর থেকে নীচে সমতল ভূমিতে অবস্থিত একটি সুবৃহৎ পর্ণকুটিরের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে পরন্তপ বলল, ওইখানে রয়েছে শল্য। ওই কুটিরের ভিতর থেকেই ওকে উদ্ধার করতে হবে।

তার তিন সঙ্গী নির্দিষ্ট দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ করল–

কুটিরের নিকটেই অলস বাক্যালাপে সময় অতিবাহিত করছে পাঁচটি বিভিন্ন বয়সের মানুষ। প্রত্যেকেই সশস্ত্র। কটিবন্ধে ছুরিকা ও তরবারি রয়েছে। একজনের পৃষ্ঠে ধনুর্বাণও দেখা গেল।

শায়ন বলল, আমরা তো নিশ্চয়ই রাত্রে আক্রমণ করব?

দলের অধিনায়ক পরন্তপ বলল, না। রাত্রে শল্যকে নিয়ে পলায়নের অসুবিধা আছে। ওই অঞ্চলের বনপথ তোমাদের পরিচিত নয়। তাছাড়া এই অরণ্য হিংস্র শ্বাপদের প্রিয় বাসভূমি। অন্ধকারে বন্যপশু কর্তৃক আক্রান্ত হলে আমরা আত্মরক্ষা করতে পারব না।

বল্লভ প্রশ্ন করল, ওই পাঁচটি দস্যু যদি শল্যকে বন্দি করে রেখে থাকে, তাহলে উদ্ধার কার্য নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। ইচ্ছা করলে এখনই ওদের বিধ্বস্ত করে আমরা শল্যকে উদ্ধার করতে পারি।

পরন্তপ বলল, না পাঁচজন নয়- যতদূর জানি বিদ্রোহী দস্যুদের সংখ্যা আট কি দশ হবে। ওই কুটির ছিল শল্যের গোপন বাসস্থান। বর্তমানে তার বাসস্থানই তার কারাগারে পরিণত হয়েছে। কুটিরের মধ্যে অন্যান্য দস্যুরা রয়েছে কিনা, অথবা থাকলেও কতজন আছে, এখান থেকে তা অনুমান করা সম্ভব নয়। কেউ কেউ হয়তো শিকারের সন্ধানে নিকটস্থ অরণ্যের মধ্যে প্রবেশ করেছে। তবে দ্বিপ্রহরে মধ্যাহ্ন ভোজনের সময়ে সকলেই এখানে সমবেত হবে। দস্যুদল একত্রে ভোজন করে। সেইটাই পদ্ধতি। খুব সম্ভব, কুটিরের নিকট কোনো বৃক্ষের তলদেশে ওরা সমবেত হয়ে ভোজন করবে। সেইটাই হবে আক্রমণের উপযুক্ত সময়।

বল্লভ বলল, মধ্যাহ্ন ভোজনের এখনো যথেষ্ট বিলম্ব আছে। সূর্য এখনও প্রখর হয়নি। আপাতত আমরা কি করব?

পরন্তপ বলল, শুধু ওদের উপর দৃষ্টি রাখা ছাড়া আপাতত আর কোনো কাজ নেই।

শায়ন বলল, একটু দূরে গাছের তলায় চারটি ঘোড়া বাঁধা আছে। মনে হয়, সর্বসমেত দস্যুদলে ছয়জন আছে।

পরন্তপ বলল, ঘোটকের সংখ্যা দিয়ে দস্যুদের সংখ্যা নির্ণয় করার চেষ্টা করলে ভুল হবে। প্রত্যেক দস্যুই যে অশ্বারোহী তা নয়। ওই যে শ্বেতবর্ণ অশ্বটি দেখছ, ওই অশ্বের প্রকৃত অধিকারী হচ্ছে শল্য- তবে আমার মনে হয় বর্তমানে শ্বেত অশ্বটিকে অধিকার করেছে বিদ্রোহী দস্যুদের দলপতি স্বয়ং।

বল্লভ বলল, যুদ্ধের এখনও বিলম্ব আছে। এই অবসরে কিছু ভক্ষণ করতে পারলে ভালো হত। আমার বিলক্ষণ ক্ষুধার উদ্রেক হয়েছে। পরন্তপ ভ্রু কুঞ্চিত করল।

কর্ণদেব হাসল, দারুক! বল্লভের ক্ষুধা কিন্তু বেশি। অবিলম্বে ওই ক্ষুধাকে প্রশমিত করতে না পারলে যথাসময়ের বল্লভের বিক্রম সম্যক প্রকাশিত হবে না।

পরন্তপ বলল, আমার অশ্বের পৃষ্ঠদেশে বেশ কিছু ফল ও শলাকাপক্ক শুষ্ক মাংস আছে। অসময়ে প্রয়োজন হতে পারে বলে ওই খাদ্য আমি সঙ্গে এনেছি। কিন্তু এত শীঘ্র যে বল্লভের উদরে অগ্নি প্রজ্বলিত হবে সে কথা ভাবিনি। বল্লভ! এখন ওই মাংস ও ফলের কিয়দংশ দিয়ে তোমার ক্ষুধাকে শান্ত করে। কিন্তু সমুদয় আহার্য উদরসাৎ করো না।

বল্লভ হেসে বলল, না, না। আমি অত স্বার্থপর নই।

যে উচ্চভূমিতে আশ্রয় দিয়ে চারটি দুর্ধর্ষ মানুষ তলদেশের পটভূমির উপর নজর রাখছিল, সেই উচ্চভূমির এক পাশে একটি প্রকাণ্ড পাথরের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছিল চারটি অশ্বকে। বল্লভ সেইদিকে পা বাড়িয়ে আবার থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

নিকটবর্তী অরণ্যের ভিতর থেকে একটি বাণবিদ্ধ হরিণের মৃতদেহ বহন করে প্রান্তরের উপর আত্মপ্রকাশ করেছে তিনটি সশস্ত্র পুরুষ!

যে পাঁচটি মানুষ এতক্ষণ নিবিষ্টচিত্তে বাক্যালাপ করছিল, তারা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে সোল্লাসে শিকারিদের অভ্যর্থনা জানাল। কুটিরের দ্বারপথে মুখ বাড়িয়ে মৃগয়ালব্ধ হরিণটিকে দেখে চিৎকার করে আনন্দ প্রকাশ করল।

পরন্তপ ও তার তিন সঙ্গী বুঝল পূর্বোক্ত তিন ব্যক্তি দস্যুদের দলের মানুষ, তারা অরণ্যে প্রবেশ করেছিল সকলের জন্য মাংসের ব্যবস্থা করতে এখন মৃগয়ালব্ধ মৃগমাংস দেখে দস্যুদল আসন্ন ভোজের সম্ভাবনায় উৎফুল্ল হয়ে উঠেছে।

কিছুক্ষণ তাদের উল্লাসধ্বনি শ্রবণ করে বল্লভ আবার ফিরল অশ্বপৃষ্ঠ থেকে আহার্য সংগ্রহের জন্য। কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কুটিরের ভিতর থেকে একটা কাতর আর্তনাদ ভেসে আসতেই সে চমকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল।

কয়েক মুহূর্তে পরেই কুটিরের দ্বারপথ দিয়ে বাহিরে এল তিন ব্যক্তি। একজনের কোমরে দড়ি বাঁধা। দড়ির প্রান্ত একব্যক্তির হাতে, অপরজন মুষ্টিবদ্ধ হাত আস্ফালন করে রজ্জবদ্ধ মানুষটিকে ভর্ৎসনা করছে এবং মাঝে মাঝে প্রহার করছে। প্রহৃত ব্যক্তি সম্পূর্ণ মৌন, আঘাতের যন্ত্রণা অসহ্য হলে আর্তনাদ করে উঠেই আবার স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে।

তারা প্রান্তরের উপর এগিয়ে আসতেই তাদের কথাবার্তা পরন্তপ ও তার সঙ্গীদের শ্রুতিগোচর হল। যে ব্যক্তি আস্ফালন সহকারে বন্দিকে প্রহার করছিল, সে বন্দিকে উদ্দেশ করে ক্রুদ্ধস্বরে বলল, শল্য! আজই তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যদি ধনভাণ্ডারের সন্ধান দাও, তাহলে প্রাণে বাঁচবে। না হলে, এইখানেই তোমাকে আমরা হত্যা করব।

উচ্চভূমিতে অপেক্ষমাণ চারটি মানুষ বুঝল ওই বন্দি হচ্ছে শল্য নামক দস্যু। যে ব্যক্তি বদ্ধমুষ্টি আস্ফালন করে শল্যকে প্রহার করছিল, সে নিশ্চয়ই বিদ্রোহী দস্যুদের দলপতি।

শল্য কোনো উত্তর দিল না। দেখে আরও ক্রুদ্ধ হয়ে দলপতি শল্যের মুখে প্রচণ্ড বেগে মুষ্টাঘাত করল। কাতর আর্তনাদ করে রক্তাক্ত মুখে শল্য ধরাশায়ী হল।

দলপতি বলল, তুমি সহজে মুখ খুলবে না। আচ্ছা, তোমার ব্যবস্থা করছি।

ঘুরে দাঁড়িয়ে নিকটস্থ এক দস্যুকে উদ্দেশ করে দলপতি বলল, রাঘব! কুটিরের ভিতর থেকে একটি কুঠার নিয়ে এস।

তৎক্ষণাৎ কুটিরের ভিতর থেকে একটি কুঠার নিয়ে রাঘব ফিরে এল। আর একটি দস্যুকে ডেকে দলপতি বলল, রাঘব আর কঞ্জুক, তোমরা আমার সঙ্গে বনের ভিতর চলো।

দুই দস্যুকে নিয়ে দলপতি বনের ভিতর প্রবেশ করল। শল্য হেঁটমুণ্ডে বসে রইল প্রান্তরের উপর। তাকে ঘিরে রঙ্গরসিকতা করতে লাগল অন্যান্য দস্যবৃন্দ।

বল্লভ ফিসফিস্ করে জিজ্ঞাসা করল, দারুক! দলপতি কুঠার নিয়ে দুই দস্যুর সঙ্গে বনমধ্যে প্রবেশ করল কেন?

কঠিন স্বরে পরন্তপ বলল, দেখতেই পাবে। এখন চুপ করে থাকো। কর্ণদেব! তোমার অশ্বের পৃষ্ঠে আমি ধনুক আর শরপূর্ণ তুণীর রেখে দিয়েছি। ওইগুলি নিয়ে এস। বোধহয় শীঘ্রই ধনুর্বাণ ব্যবহারের প্রয়োজন হবে।

কর্ণদেব নীরবে অধিনায়কের আজ্ঞা পালন করল।… কিছুক্ষণ পরেই দস্যু দলপতি তার দুই সহচরের সঙ্গে বনের ভিতর থেকে এসে প্রান্তরের উপর দাঁড়াল। তার এক সহচরের মাথায় শুকনো কাঠের বোঝা অপর ব্যক্তি বহন করছে দুটি বৃক্ষশাখা। শাখা দুটি সাত-আট হাত দীর্ঘ এবং অতিশয় স্থূল। দলপতির নির্দেশে দুস্যরা শাখা দুটিকে মাটিতে পুঁতে দিল। দুটি শাখার মধ্যবর্তী দূরত্ব চার-পাঁচ হাতের বেশি নয়।

এইবার শল্যকে টেনে এনে তার দুই হাত শক্ত করে দুই বৃক্ষশাখার সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হল। দলপতির নির্দেশে শুকনো কাঠ স্তূপকারে সাজিয়ে দেওয়া হল শল্যের পায়ের কাছে।

শল্য! দলপিত হেসে বলল, তোমাকে ধীরে ধীরে অগ্নিদগ্ধ করা হবে। দেখ, যদি গুপ্তধনের সন্ধান দাও, তাহলে এখনই নিষ্কৃতিলাভ করতে পারো। নচেৎ শলাকাপ মৃগমাংসের ন্যায় তোমাকে অগ্নিপক্ক করা হবে।

শল্য নীরব। দলপতি হাঁক দিয়ে দস্যুদের বলল, তোমরা কাষ্ঠে অগ্নিসংযোগ করো।

উচ্চভূমির উপরে পরন্তপ তার সঙ্গীদের উদ্দেশ করে বলল, আমি এইখান থেকে সজোরে ছুরিকা নিক্ষেপ করে দলপতিকে বিদ্ধ করব। সঙ্গে সঙ্গে শায়ন ও কর্ণদেব তির নিক্ষেপ করে দস্যুদের হত্যা করতে থাকবে। দস্যুদের মধ্যে দুই ব্যক্তির সঙ্গে ধনুর্বাণ রয়েছে, অপর সকলেরই তরবারি ও ছুরিকা সম্বল। তোমরা প্রথমেই ধনুর্বাণধারী দুই দস্যুকে তিরবিদ্ধ করবে। অতর্কিত বাণাঘাতে বিপর্যস্ত দস্যুদল পলায়নের চেষ্টা করবে। আশা করি প্রথম আক্রমণেই আমরা ওদের পাঁচজনকে মৃত্যুশয্যায় শুইয়ে দিতে পারব। বাকি পাঁচজন প্রাণ নিয়ে পালাতে চেষ্টা করবে, কিন্তু ওদের পালাতে দিলে পরবর্তীকালে আমরা বিপন্ন হতে পারি– অতএব বাণবিদ্ধ দস্যরা ধরাশায়ী হতে না হতেই এই স্থান হতে লাফিয়ে পড়ে আমি অন্যান্য দস্যুদের আক্রমণ করব। বল্লভ! তুমি কুঠার হস্তে আমার সহযাত্রী হবে এবং প্রথম সুযোগেই শল্যকে বহন করে এই উচ্চভূমির উপর নিয়ে আসবে। আচ্ছা, এইবার প্রস্তুত হও। মনে রেখো আমি ছুরিকা নিক্ষেপ করার সঙ্গে সঙ্গে তোমরাও শর নিক্ষেপ করবে। তার আগে কিন্তু আরে! আরে! ও আবার কে!

পূর্ণকুটিরের পশ্চাৎবর্তী অরণ্য ভেদ করে যে মানুষটি হঠাৎ প্রান্তরের উপর এসে দাঁড়িয়েছে, তাকে দেখেই পরন্তপের বিস্ময়-চকিত উক্তি– ও আবার কে!

আগন্তুকের চেহারা দেখলেই মনে হয় তরবারি ও তৃণীর সম্বল করে যে সকল ভাগ্যান্বেষী যোদ্ধা আর্যাবর্তের বুকে বিচরণ করে, এই ব্যক্তি তাদেরই একজন।

আগন্তুক সশস্ত্র। পষ্ঠে ধনুর্বাণ, কটিতে অসি ও ছুরিকা। গায়ের রং তপ্ত কাঞ্চনের মতো, দাড়িগোঁফ আর ঘন কেশের অরণ্যে আবৃত মখমণ্ডল ও মস্তক– দীর্ঘ উন্নত দেহ, পেশীবদ্ধ গ্রীবা, বিশাল বাহু এবং বৃষবৎ স্কন্ধের প্রশস্ত বিস্তার মানুষটির অসধারণ দৈহিক শক্তির পরিচয় দিচ্ছে। বক্ষের বামদিক বেষ্টন করে দক্ষিণ কটি পর্যন্ত নেমে এসে একটি সবুজ উত্তরীয় উর্ধ্বাঙ্গের নগ্নতা নিবারণ করছে, অধমাঙ্গে পীতাভ বস্ত্র যোদ্ধৃসুলভ ভঙ্গিতে দৃঢ়ভাবে পরিহিত। পায়ে চর্মরঙ্গুতে আবদ্ধ চর্মপাদুকা।

দস্যুরা শল্যকে নিয়েই ব্যস্ত ছিল, আগন্তুককে তারা দেখতে পায়নি। মানুষটি ধীর পদে এগিয়ে এসে যখন শুল্যের নিকট দণ্ডায়মান হল, তখনই তারা সচমকে তার অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন হল।

দলপতি ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল, কে তুমি?

আগন্তুক উত্তর দিল, আমি পথিক। কিন্তু এখানে কি হচ্ছে?

একজন দস্যু কর্কশ স্বরে বলল, এখানে যাই হোক, তাতে তোমার কি?

যে দস্যুটি চকমকি পাথর ঠুকে অগ্নিসংযোগ করার চেষ্টা করছিল, তার দিকে তাকিয়ে আগন্তুক বলল, তোমরা কি নরমাংস ভক্ষণ করো নাকি? এই ব্যক্তিকে অগ্নিদগ্ধ করে তোমরা ক্ষুধা নিবারণ করবে?

ভীষণ গর্জন করে দলপতি তার কোষ থেকে তরবারি আকর্ষণ করল, ওরে নির্বোধ! এখানে অধিকক্ষণ থাকলে তোরও এই দশা হবে। যা, এই স্থান ত্যাগ করে পলায়ন কর।

আগন্তুক এক পা পিছিয়ে বলল, যথা আজ্ঞা। আমি এখনই এই স্থান ত্যাগ করছি। আমার বিবেচনায় এই স্থান অতিশয় অস্বাস্থ্যকর।

সে বামদিকে অরণ্য অভিমুখে পদচালনা করল এবং দেখতে দেখতে বনমধ্যে অদৃশ্য হল তার সুদীর্ঘ দেহ।

কিছুক্ষণ সেইদিকে তাকিয়ে থেকে দলপতি বলল, গর্দভটাকে শেষ করে দিলেই ভালো হত।

একজন দস্যু বলল, আমাদের দলে লোকসংখ্যা তাহলে কিছু কমে যেত।

 দলপতি ভ্রু কুঞ্চিত করল, মাধব! তোর চাইতে ঐকটা ইঁদুরেরও বেশি বুদ্ধি আছে। মারব ওই লোকটাকে, আর লোক কমবে আমাদের দলে?

মাধব নামে দস্যুটি হেসে বলল, লোকটাকে দেখে কি মনে হয়, ওই লোক মার না দিয়ে মার খাওয়ার মানুষ? তুমি এখনো মানুষ চেন না? এতগুলো লোকের পাল্লায় পড়লে মানুষটা মারা পড়ত ঠিকই, কিন্তু যমরাজের কাছে যাওয়ার সময় আমাদের দল থেকে কয়েক জনকে সঙ্গে নিয়ে যেত।

দস্যুদের মধ্যেও কয়েকজন বক্তার কথায় সায় দিল।

 দলপতি রুষ্টস্বরে বলল, বাজে কথা রেখে এইবার আসল কাজে মন দে। নে, আগুন লাগা।

 চকমকির ছোঁয়ায় এতক্ষণে কাঠের স্তূপে আগুনের ঝলক দেখা দিল।

উচ্চভূমিতে পরন্তপের ডান হাত একটা ছুরির হাতলে চেপে বসল। শায়ন ও কর্ণদেব ধনুকে বাণ লাগিয়ে নিল। বল্লভ তার প্রকাণ্ড কুঠারের হাতল চেপে ধরল শক্ত মুঠিতে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে প্রান্তরের বুকে জাগল ঘন ঘন অশ্বখুরধ্বনি!

নীচে দস্যুদল আর উপরে পরন্তপেরদল চমকে উঠে দেখল দস্যুদের বাঁধা ঘোড়াগুলি হঠাৎ মুক্ত হয়ে প্রান্তরের উপর দিয়ে ছুট অরণ্যের মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে! শুধু একটি ঘোড় তীরবেগে ছুটে আসছে দুস্যদের দিকে এবং তার পিঠের উপর তরবারি হাতে উপবিষ্ট হয়েছে পূর্বে উল্লিখিত আগন্তুক।

.

১৪. ধন্য শায়ন ধন্য

ঘটনাটা কি ঘটছে ভালো করে উপলব্ধি করার আগেই ঝড়ের বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে আগন্তুক এসে পড়ল দস্যুদলের মধ্যে প্রথমেই তার তরবারির আঘাতে প্রাণ হারিয়ে ধরাশায়ী হল দলপতি, তারপরই আর দুজন দস্যুর রক্তাক্ত দেহ মৃত্যুশয্যায় লুটিয়ে পড়ল।

ভীত আর্তনাদে চারদিক কাঁপিয়ে দস্যুরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে তরবারির দ্রুত সঞ্চালনে শল্যের বন্ধনরঙ্কু ছিন্ন করে আগন্তুক তাকে ঘোড়ার পিঠে তুলে নিল এবং সবেগে বাহনকে চালনা করল পশ্চাৎবর্তী অরণ্যের অভিমুখে।

দস্যুদলে অবস্থিত ধনুর্বাণধারী দুই দুবৃত্তের মধ্যে একজন আগেই আগন্তুকের অসির আঘাতে পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হয়েছিল– অপর ব্যক্তি পলায়মান অশ্বের আরোহীদের লক্ষ্য করে চকিতে শরনিক্ষেপ করল। জ্যা-মুক্ত বাণ শল্যের দেহে বিদ্ধ হল। পরক্ষণেই আগন্তুক ও বাণহত শল্যকে বহন করে অশ্ব অরণ্যের গর্ভে অদৃশ্য হল।

অশ্ব যে-পথে অন্তর্ধান করেছে, সেই দিকে তাকিয়ে বিমূঢ় অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইল দস্যুর দল। প্রথম সংবিৎ ফিরে পেল কৰ্ণদেব। সঙ্গীদের উদ্দেশ করে সে বলে উঠল, বল্লভ! শায়ন! দারুক। তোমরা এস, অশ্বপৃষ্ঠে আমরা ওদের অনুসরণ করব। যেভাবেই হোক শল্যকে উদ্ধার করতেই

আত্মবিস্মৃত কর্ণদেবের উচ্চকণ্ঠ নিকটবর্তী দস্যুদের মধ্যে কয়েকজনের শ্রুতিগোচর হয়েছিল। শব্দ অনুসরণ করে মুখ তুলতেই পাথরের আড়াল থেকে চারটি মানুষের মাথা তাদের চোখে পড়ল। একজন চিৎকার করে উঠল, সাবধান! চারদিকে শত্রু! তোমরা

কথা শেষ হওয়ার আগেই শূন্যপথে উড়ে গিয়ে পরন্তপের নিক্ষিপ্ত ছুরি বক্তার কণ্ঠকে চিরতরে স্তব্ধ করে দিল।

আর একটি ছুরি শুন্যে তুলে প্রচণ্ড কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল পরন্তপ, শায়ন! কর্ণদেব! ওদের হত্যা করো। ওরা বেঁচে থাকতে আমরা নিরাপদ নই।

পরক্ষণেই সূর্যালোকে বিদ্যুৎবর্ষণ করে ছুটে গেল শাণিত ছুরিকা ও ধনুমুক্ত বাণ এবং ভূমিপৃষ্ঠকে রক্তাক্ত করে তুলল আরও তিনটি দস্যুর মৃতদেহ।

হতাবশিষ্ট দস্যুরা অরণ্যের নিরাপদ আশ্রয় লক্ষ্য করে ছুটল। কিন্তু শায়নের ধনুক দ্রুত বাণবর্ষণ করে তাদের ইহলীলা সাঙ্গ করে দিল।

ছুটে গিয়ে অশ্বকে বন্ধনমুক্ত করে একলাফে পরন্তপ তার পিঠে উঠে বসল, তারপর উচ্চৈঃস্বরে বলল, বন্ধুগণ! আমাদের একটি সমস্যা মিটে গেল। দুরাত্মা দস্যুর দল আর আমাদের বিরক্ত করতে পারবে না। কিন্তু সম্মুখে আর এক সমস্যা অপরিচিত অশ্বারোহীর কবল থেকে শল্যকে উদ্ধার করতে হবে। শীঘ্র চলো, পলাতক অশ্বারোহীকে অনুসরণ করো।

কথা শেষ করেই পরন্তপ সবেগে বাহনকে চালনা করল এবং ঢালুপথে নীচে না নেমে উপর থেকেই অশ্বপৃষ্ঠে অবতীর্ণ হল তলদেশে অবস্থিত সমতলভূমির উপর!

মুহূর্তমাত্র অপেক্ষা না করে যে-পথে অজ্ঞাত অশ্বারোহী শল্যকে নিয়ে অন্তর্ধান করেছে, সেই দিকেই ঘোড়া ছুটিয়ে দিল পরন্তপ।

বল্লভ সবিস্ময়ে দেখল একই ভঙ্গিতে অশ্বকে চালনা করে উপর থেকে নীচে লাফ দিয়ে নেমে গেল শায়ন ও কর্ণদেব এবং একটুও না থেমে পরন্তপকে অনুসরণ করল বায়ুবেগে!

ঘোড়ার পিঠে উঠে বসে বল্লভ আপনমনেই বলল, ওরা রাগ করুক আর যাই করুক, আমি অমনভাবে এই পাহাড়ি পথে ঘোড়া ছোটাতে পারব না।

বল্লভ সহজভাবেই ঢালু পথ বেয়ে অশ্বপৃষ্ঠে সমভূমির বুকে অবতরণ করল, তারপর যে-পথে বন্ধুদের ধাবমান অশ্বগুলি অরণ্যের অন্তরালে অদৃশ্য হয়েছে, সেই পথ ধরে অপেক্ষাকৃত দ্রুতবেগে অগ্রসর হল…।

বল্লভ যখন তার বন্ধুদের কাছে পৌঁছল, সে দেখল ঘোড়া থামিয়ে তারা গভীর গবেষণায় ব্যস্ত। কেউ তার দিকে দৃকপাত করল না। অথচ সে ভেবেছিল বিলম্বের জন্য তিরস্কৃত হবে। মনে মনে কৈফিয়ত তৈরি করেই সে এসেছিল, কিন্তু তিরস্কার থেকে নিষ্কৃতিলাভ করেও সে খুশি হতে পারল না বরং বন্ধুরা তার প্রতি তাচ্ছিল্য প্রকাশ করছে ভেবে সে মনে মনে অপমানিত বোধ করল। কিছুক্ষণ অন্যমনস্কর ভান করে সে আলোচনা থেকে নিরস্ত রইল, কিন্তু শ্রবণেন্দ্রিয়কে সজাগ রেখে বন্ধুদের কথাবার্তা শুনতে লাগল উত্তর্ণ হয়ে।

পলাতক অশ্বের পদচিহ্ন ধরে এতখানি পথ এসেছে তিন অশ্বারোহী, কিন্তু সম্মুখে কঙ্কর ও প্রস্তরাকীর্ণ কঠিন ভূমির উপর আর পায়ের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না বলেই পলাতক কোন্ পথে গেছে তাই নিয়ে তর্ক করছে পরন্তপ ও কর্ণদেব। শায়ন সম্পূর্ণ নীরব। অশ্বের বপ্পা কর্ণদেবের হাতে দিয়ে সে ইতস্তত পদচালনা করছে, মাঝে মাঝে নত হয়ে কি যেন দেখছে ভূমিপৃষ্ঠে, আবার ঊর্ধ্বমুখে অদূরবর্তী পর্বতের দিকে তাকিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে গভীর মনোযোগর সঙ্গে…।

হঠাৎ ফিরে এসে কর্ণদেবের হাত থেকে অশ্বের বা গ্রহণ করে শায়ন বলে উঠল, সন্ধান পেয়েছি। অশ্বারোহী শল্যকে নিয়ে ওইদিকে গেছে।

সে যেদিকে অঙ্গুলি-নির্দেশ করল সেদিকে সবুজ অরণ্যের পরিবর্তে বিরাজ করছে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ অসংখ্য প্রস্তর এবং ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কয়েকটি কণ্টকপূর্ণ প্রায়-শুষ্ক বৃক্ষ। প্রস্তর ও শুষ্ক বৃক্ষে সজ্জিত সেই ঊষর ভূমির উপর মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে দুটি বৃহৎ পর্বত।

ওই পর্বতের দিকেই শল্যকে নিয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তি পলায়ন করেছে বলে অনুমান করছে শায়ন।

বিপরীত দিকে তৃণাবৃত প্রান্তর ও ঘন অরণ্যের দিকে তাকিয়ে পরন্তপ অবিশ্বাসভরে মস্তক সঞ্চালন করল, অসম্ভব! ওদিকে কোথায় যাবে ওরা? ওই পর্বত দুটির মধ্যে দ্বিতীয়টিতে আরোহণ করা প্রায় অসম্ভব। দক্ষিণপার্শ্বে যে পর্বতটি রয়েছে, ওই পাহাড়ের গিরিপথ ধরে কোনোক্রমে দুটি মানুষ পাশাপাশি উঠতে পারে কিন্তু অশ্বারোহণে ওই গিরিপথ ধরে উপরে ওঠা সম্ভব নয়।

শায়ন চিবুকের উপর অঙ্গুলি ঘর্ষণ করতে করতে বলল, অশ্বারোহণে তারা নাও যেতে পারে। পর্বতের তলদেশে ঘোড়া ছেড়ে দিয়েছে। দুটি পাহাড়ের মাঝখানে যে সঙ্কীর্ণ পথ রয়েছে, সেই পথে হয়তো অশ্ব অন্তর্হিত হয়েছে। অথবা ওই স্থান থেকে ভারমুক্ত অশ্ব পাহাড়ের সমান্তরাল রেখা ধরে ছুটতে ছুটতে দূর অরণ্যে আত্মগোপন করেছে।

পরন্তপ বলল, সবই অনুমান। তবে আহত মানুষকে নিয়ে অশ্বারোহণে বনপথের উপর ভ্রমণ করাই নিরাপদ ও স্বাভাবিক। দুরারোহ পার্বত্য পথ ধরে একটি আহত মানুষকে নিয়ে ঊর্ধ্বে আরোহণ করতে গেলে পদস্খলিত হয়ে মৃত্যুবরণের সম্ভাবনা আছে। অতএব, স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া যায় ওরা অরণ্যের দিকেই পলায়ন করেছে। তৃণাবৃত প্রান্তর শুরু হওয়ার আগে ভূমিপৃষ্ঠ অতি কঠিন বলে অশ্বের পদচিহ্ন লক্ষিত হচ্ছে না। আমার বিশ্বাস ওই প্রান্তরের বুকে সন্ধান করলে আমরা ঘোটকের পায়ের দাগ দেখতে পাব। 

শায়নের ওষ্ঠধর ব্যঙ্গের হাসি দেখা দিল, দারুণ! এটাও তোমার অনুমান মাত্র। প্রমাণ নয়।

 শায়নের ব্যঙ্গজড়িত হাসির আভাস পরন্তপের মনে ক্রোধের উদ্রেক করল, সে তপ্তস্বরে বলল, আমার অনুমানের পিছনে স্বাভাবিক যুক্তির প্রয়োগ আছে। তোমার অনুমান কষ্টকল্পিত, তাতে যুক্তি বা প্রমাণ নেই।

ঊর্ধ্বে পর্বত শিখরের দিকে দৃষ্টি স্থাপন করে শায়ন বলল, প্রমাণ না পেয়ে আমি কথা বলি না। তারা কোন দিকে গেছে সেই প্রমাণ আগেই পেয়েছি। আর এখন যে কোথায় আছে সেই সংবাদও এইমাত্র আমার কাছে পৌঁছে গেছে।

বিদ্রূপ জড়িত স্বরে পরন্তপ বলল, কোথায় সেই প্রমাণ? আমরা তো চর্মচক্ষে কোনো প্রমাণ। দেখতে পাচ্ছি না, কোনো সংবাদও কেউ আমাদের কাছে পৌঁছে দেয়নি। বোধ করি পর্বতবাসী। কোনো প্রেতাত্মা পলাতকদের সংবাদ তোমাকে দিয়ে গেছে!

–আমার সঙ্গে এসো।

পর্বত অভিমুখে কিছুদূর অগ্রসর হয়ে একস্থানে ভূমির দিকে পরন্তপের দৃষ্টি আকর্ষণ করে শায়ন বলল, কিছু দেখতে পাচ্ছ?

তীক্ষ দৃষ্টিতে স্থানটি পর্যবেক্ষণ করতে করতে পরন্তপ বলল, প্রায় একহাত উঁচু ছোটো ছোটো চারাগাছগুলির মধ্যে পলাতকদের সন্ধান করার কোনো উপায় তো দেখছি না।

শায়ন হাসল, প্রিয় পরন্তপ না, না, দারুক!–ঈশ্বর তোমাকে একজোড়া চোখ দিয়েছে, কিন্তু তুমি সেই চোখের ব্যবহার জানো না। ভালো করে চেয়ে দেখ একটি গুল্মের শাখা ভগ্ন হয়ে তরল নির্যাস নির্গত হচ্ছে।

তপ্তস্বরে পরন্তপ বলল, তা থেকে কি বুঝব?

-বুঝবে এই যে, আকস্মিক আঘাতের ফলেই চারাগাছটির এই দুর্দশা। হঠাৎ এই গুল্মটির উপর আঘাত আসবে কোথা থেকে? একমাত্র ধাবমান অশ্বের পদাঘাতেই চারাগাছটির এই অবস্থা হতে পারে। অশ্ব এই পথে ছুটলে পর্বত অভিমুখেই যাবে সন্দেহ নেই। এখন বলো, আমার ধারণার স্বপক্ষে এটা কি যথেষ্ট প্রমাণ নয়?

না। আমি এটাকে যথেষ্ট প্রমাণ মনে করতে পারছি না। বন্য ছাগ বা হরিণের পদাঘাতেও চারাগাছটি ওই ভাবে ভাঙতে পারে।

–বন্য ছাগ এই অঞ্চলে বাস করে না। হরিণের পদাঘাতে চারা গাছ ভাঙতে পারে, কিন্তু এমনভাবে বিধ্বস্ত হবে না। অরণ্যে মৃগয়ার সন্ধানে ঘোরাঘুরি করে পশুচরিত্র সম্পর্কে কিছু অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে জানি এই গুল্ম হরিণের প্রিয় খাদ্য। অথচ কোনস্থানে গুল্মের উপর হরিণের দন্তাঘাতের চিহ্ন নেই। প্রিয় খাদ্যে ক্ষুন্নিবৃত্তি না করে তাকে পদদলিত করবে এমন হরিণ বোধ হয় আজও মৃগবংশে জন্মগ্রহণ করেনি।

–এই সামান্য প্রমাণ সম্বল করে তুমি যদি পর্বত-অভিমুখে যাত্রা করতে চাও, তাহলে আমি তোমার সঙ্গী হতে আপত্তি করব না; কিন্তু সমস্ত পরিশ্রমই পণ্ডশ্রমে পরিণত হবে বলে মনে হয়। এখন বলো– ওই দুটি পর্বতের মধ্য নিকটবর্তী পর্বতেই ওরা আশ্রয় নিয়েছে বলে তুমি মনে করো কি? নাকি, দ্বিতীয় পর্বতটিতেই তুমি আবোহণ করতে চাও?

খুব স্বাভাবিক যুক্তিতেই বোঝা যায় নিকটবর্তী পর্বতেই পলাতকরা আশ্রয় নিতে চেষ্টা করবে। কিন্তু যুক্তি দিয়ে বিচার করার প্রয়োজন নেই। নিকটস্থ পর্বতের কোনো স্থানে তারা আশ্রয় গ্রহণ করেছে, তাও আমার জানা হয়ে গেছে।

–বলো কি! শায়ন! তোমাকে দক্ষ তিরন্দাজ বলেই জানতাম, কিন্তু তুমি যে অন্তর্যামী হয়ে উঠেছ সে কথা জানতাম না।

অন্তর্যামী হইনি দারুক, অন্তর্যামী হইনি। গিরিপথ আর বনভূমির বুকে মৃগয়ার সন্ধানে বিচরণ করতে করতে আমি পশুচরিত্র সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি এবং দৃষ্টিশক্তিকে ব্যবহার করতে শিখেছি। বনের পশু এর মধ্যেই আমাকে পলাতকদের সংবাদ জানিয়ে দিয়েছে।

বল্লভ এতক্ষণ নীরব ছিল, হঠাৎ সে বলে উঠল, শায়ন! তুমি যে আজকাল পশুজগৎ থেকে সংবাদ আহরণ করতে শিখেছ সেই তথ্য আমারও জানা ছিল না। কিন্তু কথা হচ্ছে তোমাকে সংবাদটি পরিবেশন করল কে? এতক্ষণ তোমার পাশে দাঁড়িয়ে আছি, কোনো জীবজন্তুকে তো ধারে কাছে আসতে দেখি নি।

শায়ন স্মিতমুখে বলল, সেই দেখার কথাই তো বলছি। মল্লযোদ্ধার চোখে দেখলে প্রকৃতির বুক থেকে সংবাদ আহরণ করা যায় না। অভিজ্ঞ শিকারির চোখ থাকলে দেখতে পেতে কেমন করে কোন সংবাদ বহন করে আনে প্রকৃতির সন্তান।

হঠাৎ ধৈর্য হারিয়ে কটুস্বরে কর্ণদেব বলে উঠল, ভণিতা রেখে বলো কোথায় আছে ওরা? আর তুমি সে কথা জানলেই বা কি করে?

নাটকীয়ভাবে পর্বতশিখরে অবস্থিত এক গুহার দিকে আঙ্গুলিনির্দেশ করে শায়ন বলল, পলাতকরা ওই গুহাতেই এখন আশ্রয় নিয়েছে।

সন্দেহজড়িত স্বরে কর্ণদেব প্রশ্ন করল, তুমি কি করে জানলে?

তবে শোন, শায়ন বলতে লাগল, একটু আগেই যখন পলাতকরা কোন পথে গেছে সে বিষয়ে আলোচনা করে তোমরা মস্তিষ্ককে তপ্ত করে তুলছিলে, সেই সময়ই প্রথম আমি ভগ্ন গুল্মটিকে আবিষ্কার করি। তৎক্ষণাৎ বুঝলাম ওই পাহাড়েই ওরা গমন করেছে। অশ্বপৃষ্ঠে আহত মানুষ নিয়ে কোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তি দুরারোহ ওই পর্বতে আরোহণের চেষ্টা করবে না সে কথা সহজেই বুঝলাম। শল্যের উদ্ধারকর্তা যে শল্যকে নিয়ে পদব্রজে ওই পাহাড়ে উঠেছে সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হলাম। সেইসঙ্গে একথাও বুঝলাম ওই বৃহৎ পর্বতের অন্দরে কন্দরে বিভিন্ন গুহা-গহ্বরে হানা দিয়ে পলাতকদের সন্ধান করা অসাধ্য না হলেও অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ কিন্তু অনুসন্ধান চালাতে চালাতেই যদি আহত শল্যের মৃত্যু হয়, তাহলে সকল পরিশ্রমই হবে পণ্ডশ্রম! ভাবছি কি করি, এমন সময়ে গিরিপথ বেয়ে এক বিপুল বপু চিত্রকের আবির্ভাব! চিতাবাঘটি অলস-মন্থর। গতিতে ওই গহ্বরের ভিতর প্রবেশ করতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। তারপর পিছন ফিরে তিরবেগে ছুটে গিরিপথের এক প্রান্ত দিয়ে পর্বতের অপরপার্শ্বে অন্তর্ধান করল। আমি জানি চিতাবাঘ অত্যন্ত ভয়ঙ্কর জীব। সিংহ বা শার্দুলের সম্মুখীন হলে সে পলায়নের চেষ্টা করে, কিন্তু বনবাসী অন্যান্য শ্বাপদকে সে ভয় পায় না। গুহামধ্যে চিত্রকের ভীতিপ্রদ কোনো পশু থাকলে সে নিশ্চয়ই তাকে আক্রমণ করতে ছুটে এসে গুহামুখে আত্মপ্রকাশ করত, অথবা সগর্জনে বিরক্তি প্রকাশ করত– কিন্তু আমি কোনো হিংস্র পশুকে গুহার মুখে দেখতে পাইনি, অথবা শ্বাপদকণ্ঠের গর্জন ধ্বনিও আমার কর্ণে প্রবেশ করেনি। তবে চিত্ৰক পলায়নে তৎপর হল কেন? ব্যাঘ্রাদি কয়েকটি পশু ছাড়া আরও একটি জীবকে চিতাবাঘ ভয় পায় সেই জীবটি হচ্ছে অস্ত্রধারী মানুষ এই স্থানে আহত শল্য ও তার উদ্ধারকর্তা ছাড়া অন্য কোনো অস্ত্রধারী পুরুষের অস্তিত্বের প্রমাণ আমরা পাইনি, অতএব বুঝলাম ওই গুহার ভিতরই স্থান গ্রহণ করেছে আহত শল্য ও তার উদ্ধারকর্তা।

পরন্তপ বলল, একটি ভগ্ন গুল্ম ও একটি চিতাবাঘের সচকিত পলায়ন দেখেই তুমি ওইখানে পলাতকদের অস্তিত্ব আবিষ্কার করে ফেললে। ধন্য শায়ন ধন্য!

শায়ন বলল, দীর্ঘকাল গিরিকান্তারে বন্য পশুর সংসর্গে জীবন যাপন করার ফলে একটি ভগ্ন গুল্ম ও একটি চিতাবাঘের আচরণ দেখে পলাতকদের অস্তিত্ব আবিষ্কার করতে সমর্থ হয়েছি– দস্যুবৃত্তি করে সময় অতিবাহিত করলে অবশ্যই এমন পর্যবেক্ষণ-ক্ষমতার অধিকারী হতাম না।

পরন্তপ সক্রোধে গর্জন করে উঠল, শায়ন! সাবধান! তুমি দক্ষ তিরন্দাজ ও অসিযোদ্ধা সন্দেহ নেই, কিন্তু পরপকে ব্যক্তিগত ভাবে অপমান করলে তুমিও নিস্তার পাবে না। মনে রেখো– প্রবল প্রতাপশালী মহারাজ রুদ্রদমনের রাজ্যেও পরন্তপের নাম সন্ত্রাসের সৃষ্টি করে।

শায়নের দুই চক্ষু প্রখর হয়ে উঠল, সে শীতল স্বরে বলল, আমি কোনো ব্যক্তিকে অপমান করতে চাই না। কিন্তু আমাকে বিদ্রূপ করলে আমি সমুচিত উত্তর দিয়ে থাকি। আরও একটা কথা তুমি জেনে রাখো পরন্তপ কোনো দুরাত্মার নাম আমার অন্তরে সন্ত্রাসের সৃষ্টি করতে পারে না। আমার তরবারি যে-কোনো দুরাত্মাকে মুহূর্ত মধ্যে প্রেতাত্মায় পরিণত করতে পারে।

–সাবধান! শায়ন!

–সাবধান! পরন্তপ!

চকিতে ঝনকার শব্দে কোষমুক্ত হল দুটি তরবার–মধ্যাহ্নের সূর্যালোক আলোক-স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে জ্বলে উঠল শাণিত ইস্পাত-ফলকে!

তৎক্ষণাৎ দুই যুযুধানের মধ্যে হস্ত প্রসারিত করে দাঁড়াল বল্লভ ও কর্ণদেব।

বল্লভ গম্ভীর স্বরে বলল, তোমরা দুজনেই বালকোচিত আচরণ করছ। পরন্তপ! না, না– দারুক! শায়নকে বিদ্রূপ করে তুমি অন্যায় করেছে। আর শায়ন- তোমারও দোষ আছে। এই অভিযানের যে অধিনায়ক, তাকে অপমান করা গর্হিত কর্ম। আশা করি তোমরা পরস্পরের কাছে অন্যায় আচরণের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে।

কর্ণদেব তিক্তস্বরে বলল, দারুক! সামান্য কারণে উত্তেজিত হয়ে তুমি নিজেকেই হাস্যাস্পদ করেছ। অসিচালনায় তোমার দক্ষতা শায়নের চাইতে বেশি কি না সেকথা বলতে পারি না, তবে তোমার ভদ্রতাবোধ যে শায়নের চাইতে উন্নতমানের নয়, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। আর শায়ন মুহূর্তের উত্তেজনায় এভাবে আত্মবিস্মৃত হলে কখনো বন্ধুত্ব হয় না। তুমি তাকে হত্যা করে ক্ষমতার পরিচয় দিতে চাইছ? প্রতিমুহূর্তে মৃত্যু যেখানে তোমাকে গ্রাস করার জন্য অপেক্ষা করছে, সেই মৃত্যুভয়াল পথের এক বিশ্বস্ত সঙ্গীকে হত্যা করে তুমি আত্মপ্রসাদ লাভ করতে চাও? ধিক!

দুজনেই লজ্জিত হয়ে মাথা হেঁট করল। দুটি তরবারি আবার কোষের মধ্যে আত্মগোপন করল। প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করল শায়ন, আমি অন্যায় করেছি। শুধু তোমাকে অপমান করিনি, ক্রোধের বশে ভুল করে তোমাকে নিষিদ্ধ নামে সম্বোধনও করেছি। এই ত্রুটি ক্ষমার অযোগ্য। দারুক! তবু তুমি আমাকে ক্ষমা করো।

-আমারও অন্যায় হয়েছে। তোমার বিশ্লেষণে ভুল থাকলেও তোমাকে বিদ্রূপ করা অনুচিত। শায়ন! তুমিও আমাকে ক্ষমা করো।

সগর্বে মুখ তুলে শায়ন বলল, আমি অন্যায় করেছি; ভুল করিনি! ওই গিরিগুহার সম্মুখে গেলেই বুঝবে আমার অনুমান নির্ভুল।

বেশ, তবে তুমিই অগ্রবর্তী হয়ে পথ দেখাও। আমরা তোমাকে অনুসরণ করছি।

অশ্বপৃষ্ঠে পর্বতের পাদদেশে এসে তারা দেখল অতি সঙ্কীর্ণ গিরিপথ উপর দিকে উঠে গেছে। সে পথে অশ্ব চালনা নিরাপদ নয় বিবেচনা করে তারা পাহাড়ের নীচে একটি বৃক্ষের সঙ্গে অশ্ব চারটিকে রজ্জবদ্ধ করে পর্বতারোহণ শুরু করল…।

নির্দিষ্ট গুহামুখ থেকে তারা যখন প্রায় দশবারো হাত দুরে, সেই সময় হঠাৎ বল্লভের অসতর্ক পদক্ষেপের ফলে একটি প্রস্তর স্থানচ্যুত হয়ে ছিটকে পড়ল। ওই পাথরটির সংঘাতে আরও কয়েকটি ছোটোবড়ো পাথর স্থানত্যাগ করে গড়িয়ে পড়তে লাগল প্রচণ্ড শব্দের তরঙ্গ তুলে…।

সেই শব্দতরঙ্গ স্তব্ধ হওয়ার আগেই গুহামুখ থেকে ভেসে এল সুগম্ভীর কণ্ঠস্বর, তোমরা কারা? এখানে কি চাও?

সচমকে মুখ তুলে চারটি দুর্ধর্ষ মানুষ দেখল গুহার সম্মুখে অপরিসর স্থানটির উপর আবির্ভূত হয়েছে শুল্যের উদ্ধারকতা! এবং, তার হাতের ধনুর্বাণ উদ্যত লক্ষ্যে স্থির হয়ে আছে চার বন্ধুর দিকে!

অকস্মাৎ শায়নের দিকে ফিরে অভিভূত স্বরে পরন্তপ বলল, অদ্ভুত তোমার ক্ষমতা। তোমাকে বারংবার সাধুবাদ জানাচ্ছি। ধন্য! শায়ন! ধন্য!