১২শ অধ্যায়
ষোড়শদিবসীয় যুদ্ধ-ব্যূহরচনা
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! দুৰ্য্যোধন স্বয়ং সোদরের ন্যায় স্নিগ্ধবাক্য প্রয়োগপূর্ব্বক মহাবীর কর্ণকে সেনাপতিপদে অভিষিক্ত করিলে সূতপুত্র সৈন্যগণকে সূর্য্যোদয়সময়ে সুসজ্জিত হইতে আদেশ করিয়া কি কার্য্যের অনুষ্ঠান করিল, তাহা কীৰ্ত্তন কর।”
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! আপনার পূত্রেরা কর্ণের অভিপ্রায় অবগত হইয়া তূর্য্য প্রভৃতি বাদ্যবাদনপূর্ব্বক সৈন্যগণকে সুসজ্জিত হইতে আজ্ঞা প্রদান করিলেন। তখন রাত্রিশেষে আপনার সৈন্যমধ্যে ‘সকলে সুসজ্জিত হও, সকলে সুসজ্জিত হও’ সহসা এই শব্দ সমুদ্ভূত হইল। বৃহৎ বৃহৎ হস্তী, বরূথীযুক্ত [রথমধ্যস্থ গুপ্ত উপবেশনস্থান] রথ, সন্নদ্ধ [সমরোন্মত্ত] তুরঙ্গ ও পদাতি সুসজ্জিত হওয়াতে এবং পরস্পর ত্বরাবান [দ্রুতগমনশীল] যোধগণ চীৎকার করাতে গগনস্পর্শী ভীষণ শব্দ শ্রবণগোচর হইতে লাগিল। অনন্তর মহাবীর কর্ণ শ্বেতপতাকা পরিশোভিত, নাগ-কক্ষ-কেতুসম্পন্ন, বলাকাবর্ণ [হাওদাযুক্ত হস্তিচিহ্ন] অশ্বসংযুক্ত, বিমল, আদিত্যসঙ্কাশ [সূৰ্য্যপ্রভ] রথে আরূঢ় হইয়া স্বর্ণবিভূষিত শঙ্খ প্রধ্নাপিত [ধ্বনিত] ও কনকমণ্ডিত কোদণ্ড [ধনু] বিধুনিত করিতে লাগিলেন। ঐ রথ হেমপৃষ্ঠ [সোনায় মোড়া] ধনু, তূণীর, অঙ্গদ [বলয়], শতঘ্নী [কামান], কিঙ্কিণী [ঘন্টা], শক্তি, শূল ও তোমরাদি অস্ত্রে পরিপূর্ণ ছিল। হে মহারাজ! ঐ সময়ে কৌরবগণ মহাধনুর্দ্ধর মহারথ কর্ণকে ধ্বান্তনাশক
[অন্ধকার] উদয়োম্মুখ ভানুমানের [সূৰ্য্যের] ন্যায় রথে অবস্থিত অবলোকন করিয়া ভীষ্ম, দ্রোণ ও অন্যান্য বীরগণের বিনাশদুঃখ একেবারে বিস্মৃত হইলেন। তখন বীরবর সূতপুত্র শঙ্খশব্দে যোধগণকে ত্বরান্বিত করিয়া বিপুল কৌরবসৈন্যদ্বারা মকরব্যূহ [সৈন্যগণের অগ্র ও পশ্চাৎ বিপুল, মধ্যভাগ সূক্ষ্ম। অগ্র ও পশ্চাদভাগে শত্রুভয় উপস্থিত হইলে এই ব্যূহরচনা করিতে হয়] নিৰ্মাণ করিয়া পাণ্ডবগণের পরাজয় বাসনায় তাঁহাদিগের প্রত্যুদগমন করিলেন। ঐ মকরব্যূহের মুখে কর্ণ, নেত্রদ্বয়ে মহাবীর শকুনি ও মহারথ উলূক, মস্তকে অশ্বত্থামা, মধ্যদেশে সৈন্যগণপরিবেষ্টিত রাজা দুৰ্য্যোধন, গ্রীবায় তাঁহার সোরগণ, বামপদে নারায়ণীসেনাপরিবৃত যুদ্ধদুর্ম্মদ কৃতবর্ম্মা, দক্ষিণপদে মহাধনুর্দ্ধর ত্রিগৰ্ত্ত ও দাক্ষিণাত্যগণে পরিবেষ্টিত সত্যবিক্ৰম কৃপাচার্য্য, বামপদের পশ্চাদ্ভাগে বিপুলসেনাপরিবৃত মদ্ররাজ শল্য, দক্ষিণপদের পশ্চাদ্ভাগে সহস্র রথ ও তিনশত হস্তিসমবেত সত্যপ্রতিজ্ঞ সুষেণ এবং পুচ্ছদেশে মহাবলপরাক্রান্ত সসৈন্য রাজা চিত্র ও চিত্রসেননামে সহোদরদ্বয় অবস্থান করিতে লাগিলেন।
“হে মহারাজ! নরশ্রেষ্ঠ কর্ণ এইরূপে সমরে যাত্রা করিলে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ধনঞ্জয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন, ‘ভ্রাতঃ! ঐ দেখ মহাবীর কর্ণ বীরগণাভিরক্ষিত কৌরবসৈন্য সমুদয়কে কেমন শ্রেণীবদ্ধ করিয়াছে। হে অর্জ্জুন! ধৃতরাষ্ট্রসৈন্যমধ্যে যেসকল প্রধান প্রধান বীরপুরুষ ছিল, তাহারা নিহত হইয়াছে; এক্ষণে ক্ষুদ্রতম ব্যক্তিরাই অবশিষ্ট আছে; সুতরাং নিশ্চয়ই তোমার জয়লাভ হইবে। তুমি যুদ্ধ করিলে আমার হৃদয় হইতে দ্বাদশবর্ষসংস্থিত শল্য সমুদ্ভূত হয়; অতএব এক্ষণে তুমি আপনার ইচ্ছানুসারে ব্যূহ নিৰ্মাণ কর।’ হে মহারাজ! শ্বেতবাহন অর্জ্জুন জ্যেষ্ঠভ্রাতার সেই বাক্য শ্রবণানন্তর আপনাদিগের সৈন্য লইয়া অর্দ্ধচন্দ্রাকৃতি ব্যূহ নিৰ্মাণ করিলেন। ঐ ব্যূহের বামপার্শ্বে মহাধনুর্দ্ধর ধৃষ্টদ্যুম্ন, মধ্যে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ও ধনঞ্জয় এবং যুধিষ্ঠিরের পৃষ্ঠদেশে নকুল ও সহদেব অবস্থান করিতে লাগিলেন। অর্জ্জুনপালিত চক্র’রক্ষক পাঞ্চালদেশীয় যুধামনা ও উত্তমৌজা ধনঞ্জয়ের সমীপে সমবস্থিত হইলেন। অবশিষ্ট বৰ্ম্মধারী ভূপালগণ স্ব স্ব উৎসাহ ও যত্ন অনুসারে অংশক্রমে সেই বহমধ্যে অবস্থান করিলেন।
“হে মহারাজ। এইরূপে উভয়পক্ষের ব্যূহ নিৰ্মাণ হইলে মহাধনুর্দ্ধর কৌরব ও পাণ্ডবগণ যুদ্ধার্থ সমুৎসুক হইলেন। বন্ধুবান্ধব সমবেত রাজা দুৰ্য্যোধন সূতপুত্ৰকৃত ব্যূহ দর্শন করিয়া পাণ্ডবগণকে নিহত বোধ করিতে লাগিলেন। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরও স্বীয় সৈন্যগণকে ব্যহিত দেখিয়া কর্ণসমবেত দুৰ্য্যোধন প্রভৃতি বীরগণকে নিহত বিবেচনা করিলেন। অনন্তর উভয়পক্ষীয় সৈন্যমধ্যে শঙ্খ, ভেরী, আনক, দুন্দুভি, ডিণ্ডিম ও ঝর্ঝর, প্রভৃতি বাদিত্ৰসকল চতুর্দ্দিকে বাদিত হইতে লাগিল। ঐ সময় জয়গৃধ্ন [জয়লাভাৰ্থ একান্ত তৎপর] শূরগণের সিংহনাদ, অশ্বগণের হ্রেষারব, মাতঙ্গের বৃংহিতধ্বনি ও রথনেমির ঘোর নিঃস্বন শ্রবণগোচর হইল। মহাধনুর্দ্ধর বর্ম্মধারী কর্ণকে ব্যূহমুখে নিরীক্ষণ করিয়া কৌরবপক্ষীয় কোন ব্যক্তিই দ্রোণবধজনিত দুঃখ অনুভব করিল না। তখন সেই প্রহৃষ্ট নরসঙ্কুল [মানুষময়] উভয়পক্ষীয় সৈন্য পরস্পর বিনশার্থ যুদ্ধে কৃতসঙ্কল্প হইল। ঐ সময় কর্ণ ও অর্জ্জুন পরস্পরকে নিরীক্ষণ করিয়া সৈন্যমধ্যে বিচরণ করিতে লাগিলেন। তৎকালে বোধ হইতে লাগিল যেন, সেই উভয়পক্ষীয় সৈন্যসমুদয় নৃত্য করিতেছে। এইরূপে সৈন্যগণ পরস্পর মিলিত হইলে যুদ্ধার্থী বীরগণ পক্ষ [সাহায্যকারী] ও প্রপক্ষসহ [সাহায্যকারীর সাহায্যকারী] ব্যূহ হইতে নির্গত হইতে লাগিলেন। অনন্তর পরস্পর-নিধনে প্রবৃত্ত হস্তী, অশ্ব ও রথীগণের ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ হইল।”