১২. রিশান দীর্ঘ সময় ঘরে পায়চারি

রিশান দীর্ঘ সময় ঘরে পায়চারি করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে, তাকে দেখায় খাঁচায় আটকে থাকা একটা বুনো প্রাণীর মতো যেটি কিছুতেই নিজের পরিস্থিতিকে মেনে নিতে পারছে না। রিশান সমস্ত ঘরটি আরেকবার ঘুরে এসে বুঝতে পারল তার কিছু করার নেই; কিন্তু তবুও সে কিছুতেই পুরো ব্যাপারটি মেনে নিতে পারবে না। সব মানুষের ভিতরেই নিশ্চয়ই সম্পূর্ণ যুক্তিহীন এক ধরনের বিশ্বাস কাজ করে যে কারণে একটি অবাস্তব অসম্ভব পরিবেশেও সে একেবারে শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে যেতে থাকে। রিশান এ রকম একটা পরিবেশে এসে পড়েছে। তার কিছু করার নেই তবু তাকে চেষ্টা করে যেতে হবে।

সে প্রথমে ঘরটিকে ঘুঁটিয়ে ঘুঁটিয়ে পরীক্ষা করে। দেখে বোঝা যাচ্ছে না কিন্তু নিশ্চিতভাবে এখানে কোনো ধরনের পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে যেটি তার ওপর দৃষ্টি রাখছে এবং কোনো একটা তথ্যকেন্দ্রে খবর পাঠিয়ে যাচ্ছে। যেহেতু ঘরটি মানুষের আবাসস্থলে, কাজেই সেটি নিশ্চয়ই এখানে অক্সিজেন সরবরাহ করে যাচ্ছে, বাতাস পরিশোধন করে নির্দিষ্ট তাপমাত্রা বজায় রাখছে। রিশান খুঁজে খুঁজে বাতাস, তাপ এবং আলোর উৎসগুলো বের করে, তারপর নিজের মহাকাশচারীর পোশাক থেকে যন্ত্রপাতির ছোট বাক্সটি বের করে সেগুলো নষ্ট করে দেয়। সাথে সাথে ঘরের মাঝে এক ধরনের ভূতুড়ে অন্ধকার নেমে আসে। ঘরটিতে এখন অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যাবার কথা এবং সেটি কোথাও একটি বিপদ সঙ্কেত পাঠিয়ে তাকে উদ্ধার করার ব্যবস্থা করার কথা। তাকে কীভাবে উদ্ধার করা হবে সে জানে না কিন্তু তার জন্যে প্রথমেই দরজাটি খুলতে হবে। একবার দরজা খোলা হলে বাইরে। বের হবার কিছু একটা ব্যবস্থা করা হয়তো অসম্ভব হবে না।

ঘরটিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে আসছে, সে নিজে মহাকাশচারীর পোশাকের মাঝে রয়েছে বলে তার কোনো অসুবিধে হচ্ছে না। তাপমাত্রাও কমে আসছে, কিছুক্ষণের মাঝেই সেটা বিপদসীমা অতিক্রম করে যাবে। তার মহাকাশচারীর পোশাকের যোগাযোগ কেটে দেয়া হয়েছে কিন্তু তবুও নিশ্চয়ই সেটা তার শারীরিক অবস্থার নানারকম তথ্য পাঠিয়ে যাচ্ছে। সে হাতড়ে হাতড়ে সেই যোগাযোগটাও কেটে দিল, এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক একটি কাজ, যার অর্থ সে এই আবাসস্থলের মূল কেন্দ্র থেকে আর কোনো ধরনের সাহায্য পেতে পারবে না। সাথে সাথে রিশান একটি ক্ষীণ শব্দ শুনতে পায়–শেষ পর্যন্ত সে নিশ্চয়ই একটা বিপদ সঙ্কেত তৈরি করতে পেরেছে।

এই আবাসস্থলে কোনো মানুষ নেই, তাকে উদ্ধার করার জন্যে কোনো এক ধরনের রবোট হাজির হবে, তাদের বুদ্ধিমত্তা বা যুক্তিতর্ক সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। সে কী করবে এখনো জানে না; কিন্তু সেটা নিয়ে ভাবার সময় নেই। রিশান হঠাৎ ঘরের বাইরে একটা শব্দ শুনতে পায়–কিছু একটা তাকে উদ্ধার করতে এসেছে বলে মনে হয়।

খুট করে একটা শব্দ হল এবং সাথে সাথে দরজা খুলে একটা প্রাচীন রবোট এসে ঢোকে, তার মাথার উপরে দুটি ফটোসেলের চোখ, পায়ের নিচে ধাতব চাকা। শক্তিশালী যান্ত্রিক দেহে সেটি প্রায় রিশানের দিকে ছুটে আসতে শুরু করে। রিশানের কাছাকাছি এসে সেটি তাকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করল, যোগাযোগ ব্যবস্থা নষ্ট করে রেখেছে বলে কিছু শুনতে পেল না। রবোটটি তার উপর ঝুঁকে পড়ার চেষ্টা করছে, শারীরিক তথ্যগুলো পৌঁছাচ্ছে না বলে সেটি এখনো কিছু বুঝতে পারছে না। রিশান মুখে যন্ত্রণার মতো একটা ভঙ্গি করে মেঝেতে শুয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিল, রবোটটিকে তখন আরো অনেক ঝুঁকে পড়তে হবে। প্রাচীন এই রবোটগুলো এ রকম ভঙ্গিতে কাজ করার উপযোগী নয়, সেটিকে তখন কোনোভাবে বিভ্রান্ত করার সুযোগ পাওয়া যেতে পারে।

রিশান প্রথমে দুই হাতে তার মাথা স্পর্শ করে, তারপর তাল সামলাতে না পারার ভঙ্গি করে ঘুরে নিচে পড়ে যায়। রবোটটি দ্রুত কিছু বিপদ সঙ্কেত তৈরি করে মূল কেন্দ্রে তথ্য। পাঠাতে শুরু করে রিশানের উপর ঝুঁকে পড়ে। তার সমস্যাটি কোথায় রবোটটি এখনো বুঝে উঠতে পারে নি।

রবোটটি বিপজ্জনক ভঙ্গিতে তার উপর ঝুঁকে পড়েছে। সে যদি হঠাৎ করে খুব জোরে ভরকেন্দ্রে একটা ধাক্কা দিতে পারে সেটা তাল হারিয়ে পড়ে যেতে পারে, তখন কপোট্রনের পিছনে পারমাণবিক ব্যাটারিটা অচল করে দেয়ার সময় পাওয়া অসম্ভব নয়। রিশান চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে মুখে যন্ত্রণার একটা ভাব ফুটিয়ে কথা বলার ভঙ্গি করতে থাকে। যোগাযোগ মডিউল বন্ধ করে রাখা আছে, রবোটটির পক্ষে কথা শোনার কোনো উপায় নেই। মাইক্রোফোনে শব্দতরঙ্গ অনুভব করার একটা চেষ্টা করার জন্যে রবোটটি আরো ঝুঁকে পড়ল এবং রিশান তখন তার বুকের কাছাকাছি অংশ স্পর্শ করে জোরে একটা ধাক্কা দিল, রবোটটি তাল হারিয়ে হঠাৎ সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে যায় এবং সেটিকে খুব বিচিত্র এবং হাস্যকর দেখাতে থাকে।

রিশান দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে রবোটটির পিছনে ছুটে গিয়ে কপোট্রনের নিচে হাত দিয়ে ঢাকনাটি খুলে দেখে পাশাপাশি দুটি পারমাণবিক ব্যাটারি লাগানো রয়েছে। হ্যাঁচকা টান দিতেই দুটি ব্যাটারিই খুলে গেল এবং সাথে সাথে রবোটটি সম্পূর্ণ অকেজো জঞ্জালের মতো উবু হয়ে পড়ে রইল। রিশান কিছুক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কোথাও অস্বাভাবিক কিছু ঘটছে না। সে ঘর থেকে বের হয়ে এল। তার হাতে কোনো অস্ত্র নেই, থাকলে ভালো। হত।

রিশান সাবধানে করিডোর ধরে হেঁটে যেতে থাকে। ষুন তার যোগাযোগ মডিউলটি অকেজো করে রেখেছে, যদি সেটা চালু থাকত তাহলে এখন কে কোথায় আছে বুঝতে পারত। আশপাশের শব্দ শোনার জন্যে সে তার পোশাকের সবগুলো ইউনিট চালু করে দেয়। করিডোরের শেষে একটি দরজা, তার অন্য পাশে একটা বড় হলঘরের মতো। হলঘরটি থেকে সে বের হয়ে আরেকটি করিডোরে হাজির হল, তার শেষ মাথায় একটা ঘরে একটা আলো জ্বলছে। রিশান সাবধানে সেদিকে হেঁটে যেতে থাকে এবং ঠিক তখন সে প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেল। বিস্ফোরণটি এসেছে তার এটমিক ব্লাস্টারটি থেকে, যেটি সে সানির হাতে দিয়ে এসেছিল। ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটছে এই আবাসস্থলে– ভেবেচিন্তে কাজ করার সময় পার হয়ে গেছে এখন। রিশান বিস্ফোরণের শব্দের দিকে ছুটে যেতে থাকে।

অনেক দূর থেকে সে হইচই চেঁচামেচি এবং চিৎকার শুনতে পায়, কাছে গিয়ে তার চক্ষুস্থির হয়ে যায়। দেয়ালে পিঠ দিয়ে সানি ড়িয়ে আছে, তার হাতে রিশানের এটমিক ব্লাস্টারটি। ঘরে ষুন এবং নিডিয়া পাথরেঞ্জর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। কাছাকাছি একটি রবোটের ধ্বংসাবশেষ, হাঁটুর উপর থেকে পুরো অংশটি এটমিক ব্লাস্টারের বিস্ফোরণে পুরোপুরি বাষ্পীভূত হয়ে গেছে। ঘরে দেয়ালে একটা বড় গর্ত এবং সমস্ত ঘরে এক ধরনের ধোঁয়া। সানি এটমিক ব্লাস্টারটি আরেকটু উপরে তুলে বলল, আমার কাছে যদি কেউ আসে আমি ঠিক এইভাবে শেষ করে দেব। খবরদার কেউ আছে আসবে না।

রিশান দরজার কাছাকাছি থেমে গিয়ে বলল, আমি তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি সানি। তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পার।

আমি কাউকে বিশ্বাস করি না

এটমিক ব্লাস্টারটি অসম্ভব শক্তিশালী সানি, যদি কোনোভাবে আবাসস্থলের মূল দেয়ালে ফুটো হয়ে যায়, পুরো আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যাবে।

ধ্বংস হলে হবে, কিছু আসে যায় না আমার

রিশান এক পা এগিয়ে এসে বলল, সানি সত্যি তুমি আমাকে বিশ্বাস কর না? বেঁচে থাকতে হলে কাউকে–না–কাউকে বিশ্বাস করতে হয়।

আমি কাউকে বিশ্বাস করি না

কর। তুমি তোমার মাকে বিশ্বাস কর। কর না?

সানি চমকে উঠে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রিশানের দিকে তাকাল, কিন্তু কিছু বলল না। রিশান আরো এক পা এগিয়ে গিয়ে বলল, কর না?

তুমি আমার মায়ের কথা জান?

জানি।

সানি হঠাৎ করে এটমিক ব্লাস্টারটা বিপজ্জনকভাবে ঝাঁকুনি দিয়ে চিৎকার করে বলল, তাহলে সবাইকে মেরে ফেলছ কেন?

আমি মারছি না সানি। বিশ্বাস কর আমি বাঁচাতে চাইছি। তুমি আমাকে এটমিক ব্লাস্টারটি দাও, হয়তো কিছু একটা করা যাবে

না।

দাও সানি। তুমি আমাকে বিশ্বাস কর– মানুষ হলে কাউকে–না–কাউকে বিশ্বাস করতে হয়। আমাকে তোমার বিশ্বাস করতেই হবে।

তুমি আমার মাকে বাঁচাবে?

আমি জানি না সম্ভব হবে কি না; কিন্তু আমি চেষ্টা করব। আমাদের হাতে সময় খুব কম সানি। তুমি আমাকে এটমিক ব্লাস্টারটা দাও।

সানি কিছুক্ষণ রিশানের দিকে তাকিয়ে থেকে তার দিকে এটমিক ব্লাস্টারটা এগিয়ে দেয়।

রিশান এগিয়ে গিয়ে সানির হাত থেকে সেটা নেয়া মাত্র ষুন রিশানের দিকে ঘুরে বলল, তুমি কেমন করে বের হয়ে এসেছ?

সেটা নিয়ে এখন কথা বলার প্রয়োজন বা সময় কোনোটাই নেই ষুন। তোমাকে সবার আগে নিক্সিরল গ্যাসের ট্যাংকগুলো বিকল করতে হবে।

ষুন খানিকক্ষণ কোনো কথা না বলে তার দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর শীতল গলায় বলে, আমি এই অভিযানের দলপতি, এখানে আমি আদেশ দেব–

রিশান অধৈর্য হয়ে বলল, দলপতিগিরি দেখানোর অনেক সময় পাবে ষুন, এখন কাজের কথায় আস–এই মুহূর্তে আমাদের নিক্সিরল গ্যাস থামাতে হবে, যেভাবে হোক। এই পৃথিবীর সব বুদ্ধিমান প্রাণী ধ্বংস হয়ে যাবে না হয়। তারা গ্রুন দিয়ে তৈরী–এই গ্রহের যারা মারা গেছে তাদের সবার মস্তিষ্কের কপি তৈরি করেছে, সানির মা আছে সেখানে, আমি নিশ্চিত লি–রয়ও এখন আছে!

কী বলছ তুমি?

আমি সত্যি বলছি। সানিকে জিজ্ঞেস করে দেখ।

ষুন ঘুরে সানির দিকে তাকাল, সানি মাথা নাড়ল সাথে সাথে। ষুন খানিকক্ষণ হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে থেকে বলল, তার মানে এখানে বুদ্ধিমান প্রাণী আসলে এখানকার মৃত মানুষেরা?

অনেকটা তাই—

তাহলে তারা আমাদের সাথে যোগাযোগ করে না কেন?

আমরা কি তার সুযোগ দিয়েছি? কিন্তু এখন কথা বাড়িয়ে লাভ নেই ষুন, নিক্সিরল গ্যাসকে যেভাবে হোক বন্ধ করতে হবে ষুন। যেভাবে হোক–

ষুন কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল। রিশান অধৈর্য হয়ে বলল, কথা বলছ না কেন ষুন?

ষুন ইতস্তত করে বলল, আমি দুঃখিত রিশান, নিক্সিরল গ্যাসের ট্যাংকগুলো চার্জ করা হয়ে গেছে।

তার অর্থ কী?

তার অর্থ সেগুলোর নিয়ন্ত্রণের জন্যে যে ইউনিটগুলো ছিল সেগুলো কাজ করতে শুরু করেছে। এখন থেকে কিছুক্ষণের মাঝে সেগুলো বিস্ফোরিত হয়ে সারা গ্রহে নিক্সিরল ছড়িয়ে দেবে।

এটা বন্ধ করার কোনো উপায় নেই?

না।

রিশান হতবুদ্ধির মতো খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সানির দিকে ঘুরে তাকাল, তার সারা মুখ রক্তশূন্য ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সে বিড়বিড় করে বলল, তোমরা আমার মাকে আবার মেরে ফেলবে?

রিশান কোনো কথা বলল না

সানি হঠাৎ ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। রিশান পিছনে পিছনে ছুটে গিয়ে তাকে কোনোমতে ধরে ফেলে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাও সানি।

একটা ঝটকা মেরে হাত ছুটিয়ে নিয়ে সানি চিৎকার করে বলল, ছাড় আমাকে

কিন্তু, তুমি কোথায় যাও

মায়ের কাছে।

মায়ের কাছে?

হ্যাঁ।

তুমি জান তারা কোথায়?

জানি

আমিও যাব তোমার সাথে।

কেন?

হয়তো সেখানে কিছু একটা করা যাবে, হয়তো কোনোভাবে তাদের বাঁচানো যাবে।

সত্যি? সানি বড় বড় চোখ করে বলল, সত্যি?

রিশান সানির ঘাড়ে হাত দিয়ে বলল আমি জানি না সেটা সত্যি কি না, কিন্তু চেষ্টা তো করতে হবে। যাও তুমি পোশাক পরে আস, আমাদের হাতে কোনো সময় নেই।

সানি ছুটতে ছুটতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। রিশান ঘরের ভিতরে ঢুকে ষুনের কাছাকাছি এগিয়ে গিয়ে বলল, ষুন, আমি আর সানি বাইরে যাচ্ছি, শেষ চেষ্টা করে দেখতে চাই

কিন্তু

কিন্তু কী?

ষুন একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমি পুরো ব্যাপারটা আবার ভেবে দেখেছি। আমরা এখন যেটা জেনেছি, পৃথিবীর মানুষেরা সেটা নিশ্চয়ই জানে। তারপরও তারা যদি চায় আমরা এই গ্ৰহটাকে জীবাণুমুক্ত করি তার নিশ্চয়ই কোনো একটা কারণ আছে–

তুমি আমাকে সাহায্য করবে না?

না। তোমাকে আমি একটা ঘরে বন্দি করে রেখেছিলাম। আবার তোমাকে আমার বন্দি করে রাখতে হবে রিশান। মহাকাশ অভিযানের বিধিমালায় খুব পরিষ্কার বলা আছে–

মহাকাশ অভিযানের বিধিমালায় কি বিদ্রোহ সম্পর্কে কিছু লেখা আছে?

বিদ্রোহ?

হ্যাঁ। যেখানে সাধারণ একজন সদস্য জোর করে দলের নেতৃত্ব নিয়ে নেয়?

ষুন ফ্যাকাশে মুখে বলল, হ্যাঁ রিশান। লেখা আছে। তার জন্যে খুব কঠোর শাস্তির কথা লেখা আছে–

রিশান জোর করে মুখে এক ধরনের হাসি টেনে এনে বলল, শাস্তি অনেক পরের ব্যাপার, সেটা নিয়ে এখন চিন্তা করে লাভ নেই। আমি অভিযান নয় নয় শূন্য তিনের নেতৃত্ব তোমার কাছ থেকে নিয়ে নিচ্ছি। এখন থেকে সবাই আমার আদেশে কাজ করবে।

কিন্তু আমি বেঁচে থাকতে সেটি সম্ভব নয়।

হ্যাঁ। রিশান পাথরের মতো মুখ করে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ, তুমি বেঁচে থাকতে সেটি সম্ভব নয়।

ষুন হঠাৎ চমকে উঠে রিশানের দিকে তাকাল—-সরু চোখে বলল, তুমি কী বলতে চাইছ?।

রিশান তার এটমিক ব্লাস্টারটি উপরে তুলে সোজাসুজি ষুনের মাথার কাছে ধরে বলল, তুমি স্বেচ্ছায় আমাকে নেতৃত্বটি দিতে পার ষুন– মানুষের মস্তিষ্ক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে দেখতে আমার একেবারে ভালো লাগে না।

ষুন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রিশানের দিকে তাকিয়ে রইল, সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। যে সত্যি সত্যি রিশান তার মাথায় একটা এটমিক ব্লাস্টার ধরে রেখেছে। 

রিশান শীতল গলায় বলল, যোগাযোগ মডিউলে তোমার কোডটি বলে আমাকে নেতৃত্বটি দিয়ে দাও ষুন। তোমার মাথায় গুলি করলে নেতৃত্বটি এমনিতেই চলে আসবে– আমার ধৈর্য খুব কম, তুমি খুব ভালো করে জান।

ষুন বিড়বিড় করে নেতৃত্ব কোডটি উচ্চারণ করা মাত্র হঠাৎ করে তার যোগাযোগ মডিউলটিতে নীল আলো ঝলসে ওঠে। ষুনের কাছ থেকে মূল নেতৃত্ব রিশানের কাছে হস্তান্তরিত হয়ে গেছে। মহাকাশ অভিযানের দলপতির প্রয়োজনীয় তথ্যাদি মূল তথ্যকেন্দ্র থেকে আনা নেয়া শুরু হতে থাকে। রিশান এটমিক ব্লাস্টারটি নিচে নামিয়ে রেখে নিডিয়ার দিকে ঘুরে তাকাল, বলল, নিডিয়া

বল রিশান।

তুমি মূল তথ্যকেন্দ্রে খোঁজ নাও নিক্সিরল গ্যাসকে নিষ্ক্রিয় করতে হলে কী করতে হয়। যদি তার জন্যে বিশেষ কোনো রাসায়নিক থাকে সেটি খুঁজে বের কর–

আমি যতদূর জানি অক্সিজেন খুব সহজে এটাকে অক্সিডাইজ করে দেয়। আমি আরেকটু দেখতে পারি

বেশ তাহলে যতগুলো সম্ভব অক্সিজেন সিলিন্ডার তুমি একটা বাই ভার্বালে তোলার ব্যবস্থা কর।

করছি।

রিশান যোগাযোগ মডিউলে স্পর্শ করতেই ঘরের মাঝখানে মহাকাশযানের একটা অংশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেখানে হান এবং বিটিকে উদ্বিগ্ন মুখে বসে থাকতে দেখা যায়। রিশান মুখে জোর করে একটা হাসি টেনে এনে বলল, তোমাদের নূতন দলপতিকে অভিনন্দন জানানোর কোনো প্রয়োজন নেই

হান মাথা নেড়ে বলল, আমি তার কোনো চেষ্টা করছিলাম না রিশান।

বেশ– এখন আমি যেটা বলছি খুব ভালো করে শোন। মহাকাশযান থেকে তোমরা চেষ্টা কর আটত্রিশটা নিক্সিরলের ট্যাংককে খুঁজে বের করতে

সেটা খুব সহজ নয় রিশান। তুমি জান এই গ্রহের গ্যাস মোটামুটিভাবে অস্বচ্ছ।

তবুও তুমি চেষ্টা কর– অন্য কোনো কিছু যদি কাজ না করে চেষ্টা কর আলট্রাসনিক কিছু ব্যবহার করতে। পুরোপুরি নিখুঁতভাবে যদি না পার চেষ্টা কর মোটামুটিভাবে সেগুলোর অবস্থান বের করার জন্য–

চেষ্টা করব। তারপর কী করব?

চেষ্টা কর সেগুলো উড়িয়ে দিতে।

তুমি জান তবু সেগুলো থেকে নিক্সিরল বের হবে–

হ্যাঁ। কিন্তু তুমি যদি ছোটখাটো পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটাও, প্রচণ্ড উত্তাপে নিক্সিরল তার মৌলগুলোতে ভাগ হয়ে যাবার কথা–

তোমার নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়েছে রিশান, তুমি নিশ্চয়ই পুরো গ্ৰহটাকে পারমাণবিক বিস্ফোরণে উড়িয়ে দিতে চাও না?

না তা চাই না। কিন্তু যেটুকু সম্ভব নিক্সিরলকে নষ্ট করতে চাই। যেভাবে সম্ভব।

ঠিক আছে।

রিশান ঘুরে ষুনের দিকে তাকাল। বলল, ষুন—

বল।

তুমি আমাকে ছোট একটা ঘরে সবরকম যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে আটকে রেখেছিলে–

ষুন একটু অস্বস্তি নিয়ে রিশানের দিকে তাকাল। রিশান শীতল গলায় বলল, একজন মানুষকে এর থেকে বড় কোনো যন্ত্রণা দেয়া যায় বলে আমার জানা নেই।

আমি–আমি দুঃখিত। কিন্তু আমার কোনো উপায় ছিল না।

সেটা সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই। কিন্তু আমি তোমাকে এই ব্যাপারটা দেখাতে চাই যতক্ষণ আমি ফিরে না আসছি আমার ইচ্ছে তুমি একটা ছোট বদ্ধঘরে সমস্ত যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বসে থাক।

তার কি কোনো প্রয়োজন আছে, রিশান?

না নেই। তবু আমার তাই ইচ্ছে। আমি এই অভিযানের দলপতি, রবোটগুলো আমার আদেশ চোখ বন্ধ করে পালন করবে। সানি একটা রবোটের সর্বনাশ করে ফেলেছে কিন্তু তোমাকে ধরে নেয়ার জন্যে আমার মনে হয় তিনটা রবোটই যথেষ্ট।

ষুন কোনো কথা না বলে স্থির চোখে রিশানের দিকে তাকিয়ে রইল।