নবুয়তের চতুর্থ বছরে ইসলামের প্রকাশ্য দাওয়াত বন্ধ করতে পৌত্তলিকরা যেসব কাজ করছে তার বিবরণ ইতিপূর্বে বর্ণনা করা হয়েছে। এসব অপতৎপরতা পৌত্তলিকরা পর্যায়ক্রমে এবং ধীরে ধীরে চালিয়েছে। সপ্তাহের পর সপ্তাহ, এমনকি মাসে পর মাস অতিরিক্ত কিছু করেনি এবং যুলুম অত্যাচারের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়িও করেনি। কিন্তু তারা যখন লক্ষ্য করলো যে, তাদের তৎপরতা ইসলামের দাওয়াতের পথে বাধা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হচ্ছে তখন তারা পুনরায় সমবেত হয়ে পঁচিশজন কাফেরের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করলো। এরা ছিলো কোরায়শ বংশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। এ কমিটির প্রধান ছিলো রসূলুল্লাহ (সাঃ)’র চাচা। পারস্পরিক পরামর্শ এবং চিন্তা-ভাবনার পর কমিটি রসূলুল্লাহ (সাঃ) এবং সাহাবাদের বিরুদ্ধে একটি সিন্ধান্তমূলক প্রস্তাব অনুমোদন করলো। তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো যে, ইসলামের বিরোধিতা করতে গিয়ে রসূলুল্লাহ (সাঃ) কষ্ট দেয়া এবং ইসলাম গ্রহণকারীদের নির্যাতন করার ব্যাপারে কোন প্রকার শিথিলতার পরিচয় দেয়া হবে না।
পোত্তলিকরা এ প্রস্তাব গ্রহণ করার পর সর্বাত্মকভাবে তা বাস্তবায়নের দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করলো। মুসলমান বিশেষত দুর্বল মুসলামানদের ক্ষেত্রে পৌত্তলিকদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন সহজ ছিলো। কিন্তু রসূলুল্লাহ (সাঃ) এর ক্ষেত্রে ছিলো কঠিন। কেননা তিনি ছিলেন অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী এক অসাধারণ মানুষ। সবাই তাকে সম্মান চোখে দেখতো। তাঁর কাছে সম্মানজনকভাবেই যাওয়া সহজ এবং স্বাভাবিক ছিলো। তাঁর বিরুদ্ধে অবমাননাকর এবং ঘৃণ্য তৎপরতা বর্বর এবং নিবোর্ধদের জন্যোই ছিলো মানানসই। ব্যক্তিত্বের এ স্বাতন্ত্র্য এবং প্রখরতা ছাড়া আবু তালেবের সাহায্যও তিনি পাচ্ছিলেন। মক্কায় আবু তালেবের প্রভাব ছিলো অনতিক্রম্য। ব্যক্তিগত বা সম্মিলিতভাবে এ প্রভাব অতিক্রম করা এবং তাঁর সাথে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করার সহাস ছিলো না। এ পরিস্থিতিতে কোরায়শরা নিদারুন মর্মপীড়ার মধ্যে দিন যাপন করছিলো। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যে দ্বীনের প্রচার প্রসার তাদের ধর্মীয় আধিপত্য এবং পার্থিব নেতৃত্ব কর্তৃত্বের শেকড় কেটে দিচ্ছিলো, সে দ্বীনের ব্যাপারে আর কতোকাল তারা ধৈর্যধারণ করবে?পরিশেষে পোত্তলিকরা আবু লাহাবের নেতৃত্ব রসূলুল্লাহ (সাঃ) ওপর অত্যাচার নির্যাতন চালাতে শুরু করলো। প্রকৃত পক্ষে প্রিয় নবীর সাথে আবু লাহাবের শক্রতার মূলক আচরণ আগে থেকেই ছিলো। কোরায়শরা আল্লাহর রাসূলের ওপর নির্যাতনের কথা চিন্তা করারও আগে লাহাব চিন্তা করারও আগে আবু লাহাব চিন্তা করেছিলো। বনি হাশেমের মজলিস এবং সাফা পাহাড়ের পাদদেশে এই দুর্বৃত্ত যা বলেছিলো, ইতিপূর্বে সেসব কথা কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কোন কোন বর্ণনায় উল্লেখ করেছে যে, সাফা পাহাড়ের পাদদেশে দ্বীনের দাওয়াত দেয়ার পর নবী রসূলুল্লাহ (সাঃ) কে মারার জন্যে আবু লাহাব একটি পাথরও তুলেছিলো।
রসূলুল্লাহ (সাঃ) নবুওয়াত পাওয়ার আগে আবু লাহাব তার দুই পুত্র ওতবা এবং ওতাইবাকে রসূলুল্লাহ (সাঃ)’র দুই কন্যা রোকাইয়া এবং উম্মে কুলসুমের সাথে বিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু রসূলুল্লাহ (সাঃ)’র নবুয়াত পাওয়ার পর এবং দ্বীনের দাওয়াত প্রচারের শুরুতে আবু লাহাব নবীর দুই কন্যাকেই তালাক দিতে তার দুই পুত্রকে বাধ্য করেছিলো।
রসূলুল্লাহ (সাঃ)’র দ্বিতীয় পুত্র আবদুল্লাহর ইন্তেকালে পর আবু লাহাব এতো খুশি হয়েছিলো যে, তার বন্ধুদের কাছে দৌড়ে গিয়ে গদগদ করে বলেছিলো যে, মোহাম্মাদ অপুত্রক হয়ে গেছে।
ইতিপূর্বে এটাও উল্লেখ করা হয়েছে যে, হজ্জ মৌসুমে আবু লাহাব রসূলুল্লাহ (সাঃ)কে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করতে বাজার এবং বিভিন্ন জনসমাবেশে তাঁর পেছনে লগে থাকতো। তারেক ইবনে আবদুল্লাহ মুহাবেরীর বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, আবু লাহাব রসূলুল্লাহ (সাঃ)’র কথা মিথ্যা প্রমাণ করতেই শুধু ব্যস্ত থাকত না বরং তাঁকে পাথরও নিক্ষেপ করতো। এতে তার পায়ের গোড়ালি রক্তাক্ত হয়ে যেতো।
আবু লাহাবে স্ত্রী উম্মে জামিলের প্রকৃত নাম ছিলো আবওয়া। সে ছিলো হারর ইবনে উমাইয়ার কন্যা এবং আবু সুফিয়ানের বোন। রসূলুল্লাহ (সাঃ)’র প্রতি শক্রতার ক্ষেত্রে সে তার স্বামীর চেয়ে কোন অংশে কম ছিলো না। রসূলুল্লাহ (সাঃ) যে পথে চলাফেরা করেতেন, ঐ পথে এবং তাঁর দরজায় সে কাঁটা বিছিয়ে রাখতো। অত্যন্ত অশ্লীল ভাষী এবং ঝগড়াটে ছিলো এ নোংরা মহিলা। রসূলুল্লাহ (সাঃ) কে গালাগাল দেয়া এবং কুটনামি, নানা ছুতার ঝগড়া, ফেতনা-ফাসাদ সৃষ্টি এবং সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করা ছিলো তার কাজ। এ কারণে কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “এবং তার স্ত্রীও সে ইন্ধন বহন করে”।
আবু লাহাবের স্ত্রী যখন জানতে পারলো যে, তার এবং স্বামীর নিন্দা করে আয়াত নাযিল হয়েছে, তখন সে রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে খুঁজে খুঁজে কাবা শরীফের কাছে এলো। প্রিয় নবী সে সময় কাবাঘরের পাশে অবস্থান করেছিলেন। তাঁর সাথে আবু বকর সিদ্দিক(রা) ও ছিলেন। আবু লাহাবের স্ত্রীর হাতে ছিলো এক মুঠি পাথর। আল্লাহর রসূলের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছুলে আল্লাহ তায়ালা তার দৃষ্টি কেড়ে নেন, সে আল্লাহর রসূলকে দেখতে পায়নি, হযরত আবু বকর দেখতে পাচ্ছিলো। হযরত আবু বকরের সামনে গিয়ে সে জিজ্ঞাসা করলো যে, তোমার সাথী কথায়? আমি শুনছি তিনি আমার নামে নিন্দা করেছেন। আল্লাহর শপথ, যদি আমি তাকে পেয়ে যাই তার মুখে এ পাথর ছুড়ে মারব। দেখো আল্লাহর শপথ, আমিও একজন কবি। এরপর সে এ কবিতা শোনালো, “মোযাম্মাম আছাইনা ওয়া আমরাহু আবাইনা ওয়া দ্বানাহু কালাইনা”। অর্থাৎ মোযাম্মালের অবাধ্যতা করেছি, তার কাজকে সমর্থন করিনি এবং তার দ্বীনকে ঘৃণা অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখান করেছি। এরপর সে চলে গেলো।
আবু বকর সিদ্দিক (রা) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল সে কি আপনাকে দেখতে পায়নি? তিনি বললেন, না দেখতে পায়নি, আল্লাহ তায়ালা আমার ব্যাপারে তার দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছিলেন।
আবু বকর রাযযারও এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন। তিনি সংযোজন করেছেন যে, আবু লাহাবের স্ত্রী হযরত আবু বকরের সামনে গিয়ে একথাও বলেছিলো যে, আবু বকর , আপনার সঙ্গী আমার নিন্দা করেছেন। আবু বকর বললেন, এ কথা ঠিক নয়। এই ঘরের প্রভুর শপথ, তিনি কবিতা রচনা করেন না এবং কবিতা মুখেও উচ্চারণ করেন না। আবু লাহাবের স্ত্রী বলল আপনি ঠিকই বলেছেন।
আবু লাহাব ছিল রাসুলে মাকবুল (সাঃ)’র প্রতিবেশী এবং চাচা। তাঁর ঘর রাসুলে মাকবুল (সাঃ)’র ঘরের কাছাকাছি ছিল। অন্য প্রতিবেশীরাও রাসুলে মাকবুল (সাঃ)’কে কষ্ট দিতো। ইবনে ইসহাক বলেন, যেসব লোক রাসুলে মাকবুল (সাঃ)কে ঘরের মধ্যে কষ্ট দিতো তাদের নাম হলো আবু লাহাব, হাকাম ইবনে আবুল আস ইবনে উমাইয়া, উকবা ইবেন মুঈত, আদি ইবনে হামারা, ছাকাফি ইবনুল আছদা হুজ্জালি প্রমুখ। এরা সবাই ছিল তাঁর প্রতিবেশী। এদের মধ্যে হাকাম ইবনে আবুল আস ব্যতিত অন্য কেউ মুসলমান হয়নি। এদের কষ্ট দেয়ার পদ্ধতি ছিল এরকম যে, যখন রাসুলে মাকবুল (সাঃ) নামায আদায় করতেন তখন এদের কেউ বকরীর নাড়িভুড়ি এমনভাবে ছুড়ে মারতো যে সেসব গিয়ে তাঁর গাঁয়ে পরতো। আবার উনুনের উপর হাড়ি চাপানো হলে বকরীর নাড়িভুড়ি এমনভাবে নিক্ষেপ করতো যে সেসব গিয়ে সেই হাড়িতে পরতো। রাসুলে মাকবুল (সাঃ) পরে নিরাপদে নামায আদায় করার জন্য ঘরের ভিতর একটি জায়গা করে নিয়েছিলেন।
রাসুল (সাঃ)’র উপর এসব নাড়িভুড়ি নিক্ষেপের পর তিনি সেগুলো একটা কাঠির মাথায় নিয়ে দরজায় দাড়িয়ে বলতেন, হে বনী আবদে মন্নাফ, এটা কেমন ধরনের প্রতিবেশী সুলভ আচরণ ? এরপর সেসব নাড়িভুড়ি ফেলে দিতেন।
ওকবা ইবনে মুঈত ছিল জঘন্য দুবৃর্ত্ত ও দৃস্কৃতিতে ওস্তাদ। সহীহ বোখারীতে আব্দুল ইবনে মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত আছে, নবী (সাঃ) কাবা ঘরের পাশে নামায আদায় করছিলেন। আবু জাহেল এবং তার কয়জন বন্ধু সেখানে বসা ছিল। এমন সময় একজন অন্যজনকে বললঃ কে আছো অমুকের উটের নাড়িভুড়ি এনে মোহাম্মদ যখন সেজদায় যাবে, তখন তার পিঠে চাপিয়ে দিতে পারবে ? এরপর ওকবা ইবনে আবু মুঈত উটের নাড়িভুড়ি এনে অপেক্ষা করতে লাগলো। নবী কারীম (সাঃ) সেজদায় যাওয়ার পর সেই নাড়িভুড়ি তাঁর উভয় কাঁধের উপর ঝুলিয়ে দিল। আমি সব কিছু দেখছিলাম, কিন্ত কিছু বলতে পারছিলাম না। কি যে ভালো হত হায় যদি আমার মধ্যে তাঁকে রক্ষা করার শক্তি থাকতো।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেনঃ এরপর দৃর্বৃত্তরা হাসতে হাসেতএকজন আরেকজনের গায়ে ঢলে পরছিলো। এদিকে রাসুল (সাঃ) সেজদায় পরে রইলেন মাথা তুললেন না। হযরত ফাতেমা (রা) খবর পেয়ে ছুটে এসে নাড়িভুড়ি সরিয়ে ফেললেন। এরপর রাসুলে আকরাম (সাঃ) সেজদা হতে মাথা উঠালেন। এরপর তিনবার বললেনঃ “আল্লাহুম্মা আলাইকা বে-কোরাইশ” অর্থ্যাৎ হে আল্লাহ তাআ’লা, কোরাইশদের দায়িত্ব তোমার উপর। এই বদদোআ শুনে তারা নাখোশ হলো। কেননা তারা একথা দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করতো যে, এ শহরে তার দোআ কবুল হয়ে থাকে। এরপর রাসুলে আকরাম (সাঃ) নাম উল্লেখ করে বদদোয়া করলেন, হে আল্লাহ আবু জাহেলকে পাকড়াও করো, ওতবা ইবনে রবিয়া, শায়রা ইবনে রাবিয়া, ওলিদ ইবনে ওতবা, উমাইয়া ইবনে খালফ, এবং ওকবা ইবনে আবু মুঈতকে পাকড়াও করো। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আরো কয়েকজনের নাম বলেছিলেন কিন্ত হাদিস বর্ণনাকারী সেসব নাম ভুলে গেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) যে সব কাফেরের নাম উচ্চারণ করে বদ-দোআ করেছিলেন,আমি দেখেছি বদরের কুয়োয় সেসব ব্যক্তি লাশ পরে আছে।
উমাইয়া ইবনে খালফ এর অভ্যাস ছিল, সে যখনই রাসুলুল্লাহ (সাঃ)কে দেখতো তখনই নানা কটুক্তি করতো এবং অভিশাপ দিতো। আল্লাহ তাআ’লা তার সম্পর্কে এ আয়াত নাজিল করেনঃ “ওয়াইলুল্লি কুল্লি হুমাজাতিল লুমাযা” অর্থ্যাৎ দুর্ভোগ প্রত্যেকের জন্য,যে পেছনে এবং সামনে লোকের নিন্দা করে। ইবনে হিশাম বলেনঃ “হুমাযা” সেই ব্যক্তিকে বলা হয়, যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে গালাগাল দেয় এবং চোখ বাঁকা করে ইশারা করে। লুমাযা সেই ব্যক্তিকে বলা হয়, যে পশ্চাতে মানুষের নিন্দা করে এবং কষ্ট দেয়।
উমাইয়ার ভাই উবাই ইবনে খালফ ছিলো ওকবা ইবনে আবু মুঈতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ওকবা একদিন রাসুলুল্লাহ (সাঃ)’র কাছে বসে ইসলামের কথা শুনছিলো । উবাই এ কথা শুনে ওকবাকে সমালোচনা করলো এবং নির্দেশ দিলো যাও মোহাম্মদের মুখে থুথু দিয়ে এসো। ওকবা তাই করলো। উকবা ইবনে খালফ একবার একটি পুরানো হাড় গুড়ো করলো। এরপর সেই গুড়া বাতাসে ফুঁ দিয়ে রাসুলুল্লাহ (সাঃ)’র প্রতি উড়িয়ে দিলো।
আখলাস ইবনে শোরাইক ছাকাফিও রাসুলুল্লাহ (সাঃ)কে কষ্ট দেয়ার কাজে উৎসাহি ছিল। কোরআনে কারিমে তার নয়টি বদ-অভ্যাসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকেই তার কর্মতৎপরতা সম্পর্কে ধারনা করা যায়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেনঃ “এবং অনুসরণ করোনা তার, যে কথায় কথায় শপথ করে, পশ্চাতে নিন্দাকারী,একজনের কথা অন্যজনের কাছে লাগিয়ে বেড়ায়,কল্যাণের কাজে বাধা প্রদান করে, সীমা লঙঘনকারী, পাপিষ্ঠ, রুঢ়স্বভাব, এবং তদুপরি কুখ্যাত”। (১০-১৩/৬৮)
আবু জাহেল কখনো কখনো রাসুলুল্লাহ (সাঃ)’র কাছে এসে কোরআন তেলওয়াত শুনতো, কিন্ত শুনা পর্যন্তই। সে ঈমানও আনত না ইসলামের শিক্ষাও গ্রহণ করতো না এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসুলে আনুগত্যের পরিচয়ও দিতোনা। বরং সে নিজের কথার দ্বারা রাসুলুল্লাহ (সাঃ)কে কষ্ট দিতো এবং আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করতো। এরপর নিজের একাজের জন্য গর্বের সাথে বুক ফুলিয়ে নিতো। মনে হতো যে, বড় ধরনের কোন কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে ফেলেছে। পবিত্র কোরআনের নিম্নোক্ত আয়াতসমূহ আল্লাহ তায়ালা তার সম্পর্কে নাযিল করেছেন। আল্লাহ বলেন, যে বিশ্বাস করেনি এবং নামায আদায় করেনি, বরং সত্য প্রত্যাখান করেছিলো এবং মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো। এরপর সে তার পরিবার পরিজনের কাছে ফিরে গিয়েছিলো দম্ভ ভরে। দুর্ভোগ, তোমার জন্য।
আবু জেহেল প্রথম দিনেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নামায আদায় করতে দেখে তাঁকে নামায থেকে ফিরেয়ে রাখার চেষ্টা করেছে। একবার নবী (সাঃ) মাকামে ইবরাহীমের কাছে নামায আদায় করেছিলেন। আবু জেহেল সে পথ দিয়ে যাচ্ছিলো। সে বললো, মোহাম্মাদ, আমি কি তোমাকে এ কাজ করতে নিষেধ করিনি? সাথে সাথে সে হুমকিও দিলো। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-ও হুমকি দিয়ে জবাব দিলেন। এরপর আবু জেহেল বললো, মোহাম্মাদ, আমাকে কেন ধমক দিচ্ছো? দেখো এই মক্কায় আমার মজলিস হচ্ছে সবেচেয়ে বড়। আবু জেহেলের এর উদ্ধত কথায় আল্লাহ তায়ালা এই নাযিল করেন, আচ্ছা সে যেন মজলিসকে ডাকে। আমিও শাস্তি দেয়ার ফেরেশতাদের ডাক দিচ্ছি।
এ বর্ণনায় উল্লেখ রয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু জেহেলের চাদর গলার কাছে ধরে বললেন, দুর্ভোগ, তোমার জন্যে দুর্ভোগ। আবার দুর্ভোগ, তামার জন্যে দুর্ভোগ।
একথা শুনে আল্লাহর দুশমন আবু জাহেল বললো, হে মোহাম্মাদ, হে আমাকে হুমকি দিচ্ছো? খোদার কসম, তুমি এবং তোমার পরওয়ারদেগার আমার কিছুই করতে পারবে না। মক্কার উভয় পাহাড়ের মাঝে চলাচলকারীদের মধ্যে আমিই সবচেয়ে বেশী সম্মানিত মানুষ।
পবিত্র কোরআনে ঘোষিত হুমকি সত্তেও আবু জাহেল তার নির্বুদ্ধিতামূলক আচরণ থেকে বিরত থাকেনি। বরং তার দুষ্কৃতি আরো বেড়ে গিয়েছিলো। সহীহ মুসলিম শরীফে হযরত আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত আছে যে, কোরায়শ সর্দারদের কাছে একদিন আবু জেহেল বললো, মোহাম্মাদ আপনাদের সামনে নিজের চেহারা ধুলার লাগিয়ে রাখে কি? কোরায়শ সর্দাররা বললো, হ্যাঁ। আবু জেহেল বললো, লাত এবং ওযযার শপথ, আমি যদি তাকে এ অবস্থায় দেখি, তবে তার ঘাড় ভেঙ্গে দেবো, তার চেহারা মাটিতে হেঁচড়াবো। এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নামায আদায় করতে দেখে তার ঘাঁড় মটকে দেয়ার জন্যে সে অগ্রসর হলো। কিন্তু সবাই দেখলো যে, আবু জেহেল চিৎকাত হয়ে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে এবং চিৎকার করে বলছে, বাঁচাও, বাঁচাও।
পরিচিত লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, আবু হাকাম, তোমার কি হয়েছে? আবু জেহেল বললো, আমি দেখলাম যে, আমার এবং মোহাম্মাদের মাঝখানে আগুনের পরিখা। ভয়াবহ সে আগুনের পরিখায় দাউ দাউ করে জ্বলছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একথা শুনে বললেন, যদি সে আমার আমার কাছে আসতো, তবে ফেরেশতা তার অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ছেড়ে ফেলতো।
একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে এ ধরণের যুলুম অত্যাচারমূলক ব্যবহার করা হচ্ছিলো অন্যদিকে তাঁর প্রতি মক্কার যে সাধারণ মানুষের গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিলো, তারা তাঁকে তাঁর মহান ব্যক্তিত্ত্বের কারণে অসাধারণ মর্যাদা ও সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতো। উপরন্তু তাঁর চাচা আবু তালেবের সমর্থন ও সহায়তা তাঁর প্রতি ছিলো। তা সত্ত্বের তাঁর প্রতি এসব অত্যাচার করা হচ্ছিলো। ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণকারী মুসলমানদের প্রতি, বিশেষত দুর্বল মুসলমানদের প্রতি পৌত্তলিকদের অত্যাচার নির্যাতন ছিলো আরো ভয়াবহ। প্রত্যেক গোত্র তাদের গোত্রের ইসলাম গ্রহণকারীদের শাস্তি দিচ্ছিলো। যারা মক্কার গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলো না তাদের ওপর উচ্ছৃঙ্খল এবং নেতৃস্থানীয় লোকেরা নানাপ্রকার অত্যাচার নির্যাতন চালাতো। সেসব অত্যাচারের বিবরণ শুনলে শক্ত মনে মানুষও অস্থির হয়ে উঠতো।
কোন সম্ভ্রান্ত ও সম্মানিত মানুষের ইসলাম গ্রহণের কথা শুনলে আবু জেহেল তাকে গালমন্দ ও অপমান করতো। এছাড়া সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকেও ক্ষতিগ্রস্থ করার হুমকি দিতো। কোন দুর্বল মানুষ ইসলাম গ্রহণ করলে তাকে ধরে প্রহার করতো এবং অন্যদেরও প্রহার করতো অন্যদের উৎসাহিত করতো।
হযরত ওসমান ইবনে আফফান (রাঃ) ইসলাম গ্রহনের পর তাঁর চাচা তাঁকে খেজুরের চাটাইয়ের মধ্যে জুড়িয়ে ধুয়ো দিতো।
হযরত মসয়াব ইবনে ওমায়ের (রাঃ)এর মা তাঁর ইসলাম গ্রহণের খবর শোনার পর পুত্রের পানাহার করে দেয় এবং তাকে ঘর থেকে বের করে দেয়। হযরত মসয়াব ছোট বেলা থেকে স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যে আরাম-আয়েশে জীবন কাটিয়েছিলেন। পরিস্থিতির কারণে তিনি এমন অব্স্থার সম্মুখীন হয়েছিলেন যে, তাঁর গায়ের চামড়া খোলস ছাড়ানো সাপের গায়ের মতো হয়ে গিয়েছিলো।
হযরত বেলাল (রা) ছিলেন উমাইয়া ইবনে খালফের ক্রীতদাস। ইসলাম গ্রহণের পর উমাইয়া হযরত বেলাল (রা) কে গলায় দড়ি বেঁধে উচ্ছৃঙ্খল বালকদের হাতে তুলে দিত। বালকেরা তাঁকে মক্কার বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেতো। এ রকম করায় তাঁর গলায় দড়ি দাগ পড়ে যেতো। উমাইয়া নিজেও তাকে বেঁধে নির্মম প্রহারে জর্জরিত করতো। এরপর উত্তপ্ত বালির ওপর জোর করে শুইয়ে রাখতো। এ সময় তাকে অনাহারে রাখা হতো, পানাহার কিছুই দেয়া হতো না। কখনো কখনো রোদে মরু বালুকার ওপর শুইয়ে বুকের ওপর ভারি পাথর চাপা দিয়ে রাখতো। এ সময় বলতো, তোমার মৃত্যু হওয়ার পর্যন্ত এভাবে ফেলে রাখা হবে। তবে বাঁচতে চাইলে মোহাম্মদের পথ ছাড়ো। কিন্তু তিনি এমনি কষ্টকর অবস্থাতেও বলতেন, আহাদ, আহাদ। তার ওপর নির্যাতন চলতে দেখে হযরত আবু বকর (রা) এক দিন খুবই ব্যথিত হলেন। তিনি হযরত বেলাল(রাঃ)কে একটি কালো ক্রীতদাসের পরিবর্তে মতান্তরে দুশো দেরহামের পরিবর্তে ক্রয় করে মুক্তি দেন।
হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসের (রা) ছিলেন বনু মাখযুমের ক্রীতদাস। তিনি এবং তার পিতামাতা ইসলাম গ্রহণের পর তাদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন শুরু করা হলো। আবু জেহেলের নেতৃত্বে পৌত্তলিকরা তাঁদেরকে উত্তপ্ত রোদে বালুকাময় প্রান্তরে শুইয়ে কষ্ট
দিতো । একবার তাদের এভাবে শাস্তি দেয়া হয়েচ্ছিলো। এমন সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সে পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, হে ইয়াসের পরিবার, ধৈর্যধারণ করো, তোমাদের ঠিকানা জান্নাত। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে হযরত ইয়াসের (রা) ইন্তিকাল করেন। তাঁর স্ত্রী হযরত আম্মারের মা হযরত ছুমাইয়া (রা) এর লজ্জাস্থানে দৃর্বৃত্ত আবু জেহেল বর্শা নিক্ষেপ করে। এতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। তিনি ছিলেন ইসলামের প্রথম শহীদ। হযরত আম্মারের ওপর তখনো অব্যাহতভাবে অত্যাচার চালানো হচ্ছিলো। তাঁকে কখনো উত্তপ্ত বালুকার ওপরে শুইয়ে রাখা হতো, কখনো বুকের ওপর ভারি পাথর চাপা দেয়া হতো, কখনো পানিতে চেপে ধরা হতো। পৌত্তলিকরা তাকে বলতো যতক্ষণ পর্যন্ত তুমি মোহাম্মদকে গালি না দেবে এবং লাত ওযযা আম্মার (রা) বাধ্য হয়ে তাদের কথা মেনে নেন। এরপর রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে কাঁদতে কাঁদতে হাযির হন। আল্লাহ রব্বুল আলামীন তখন পবিত্র কোরআনের এই আয়াত নাযিল করেন, “কেউ তারে ঈমান আনার পর আল্লাহকে অস্বীকার করলে এবং কুফরীর জন্যে উন্মুক্ত রাখলে তার ওপর আপতিত হবে আল্লাহর গযব এবং তার জন্যে আছে সহজ শাস্তি কিন্তু তার জন্যে নয়, যাকে কুফরীর জন্যে বাধ্য করা হয়। কিন্তু তার চিত্ত ঈমানে অবিচালিত থাকে।
হযরত খাব্বার ইবনে আরত (রা) খোজায়া গোত্রের উম্মে আনসার নামে এক মহিলার ক্রীতদাস ছিলেন। পৌত্তলিকরা তাঁর ওপর নানাভাবে নির্যাতন চালাতো। তাকে মাটির ওপর টানতো। তাঁর মাথার চুল ধরে টানতো এবং ঘাড় মটকে দিতো। কয়েকবার জ্বলন্ত কয়লার ওপরে তাঁকে শুইয়ে বুকে পাথর চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিলো যাতে, তিনি উঠতে না পারেন।
যিন্নীরাহ নাহদিয়া এবং তাদের কন্যা এবং উম্মে উবাইস ছিলেন ক্রীতদাসী। এরা ইসলাম গ্রহণ করে পৌত্তলিকদের হাতে কঠোর শাস্তি ভোগ করেন। শাস্তির কিছু দৃষ্টান্ত ওপরে তুলে ধরা হয়েছে। বনু আদীর গোত্রের একটি পরিবার বনু মোযাম্মেলের একজন দাসী ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। হযনত উমর ইবনে খাত্তাব (রা) তখনো ইসলাম গোহণ করেননি। তিনি সেই দাসীকে অস্বাভাবিক প্রহার করে বিরতি দিয়ে বলতেন, তোমার প্রতি দয়ার কারণে নয় বরং নিজে ক্লান্ত হয়েই ছেড়ে ছিলাম।
পরিশেষে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা) হযরত বেলাল এবং আমের ইবনে ফোহায়রার মতোই এসব দাসীকেও ক্রয় করে মুক্ত করে দিয়েছিলেন।
পৌত্তলিকরা বীভৎস উপায়েও ইসলাম গ্রহণকারীদের শাস্তি দিতো। তারা কোন কোন সাহাবাকে উট এবং গাভীর কাঁচা চামড়ার ভেতর জড়িয়ে বেঁধে রোদে ফেলে রাখতো। কাউকে লোহার বর্ম পরিয়ে তপ্ত পাথরের ওপর শুইয়ে রাখতো। কারো ইসলাম গ্রহণের পর খবর পেলে দুর্বৃত্ত পৌত্তলিকরা নানা উপায়ে তার ওপর অত্যাচার এবং নির্যাতন চালাতো। মোটকথা আল্লাহর মনোনীত দ্বীন গ্রহণকারীদের ওপর যে সব নির্মম অত্যাচার ও নির্যাতন করা হয়েছিলো তার তালিকা খুবই দীর্ঘ এবং বড়োই বেদনাদায়ক।