১২শ অধ্যায়
যুধিষ্ঠিরাদির ধৃতরাষ্ট্র-সাক্ষাৎকার
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! অনন্তর ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির বৃদ্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্র হস্তিনা হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়াছেন শ্রবণ করিয়া তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিবার মানসে মহাত্মা বাসুদেব, সাত্যকি, যুযুৎসু ও ভ্রাতৃগণসমভিব্যাহারে যাত্রা করিলেন। দ্রৌপদীও দুঃখশোকাকুলিতচিত্তে পাঞ্চালমহিলাগণের সহিত ধর্ম্মরাজের অনুগমনে প্রবৃত্ত হইলেন। অনন্তর ধর্ম্মনন্দন কিয়দ্দূর গমন করিয়া দেখিলেন, পুত্রশোকপীড়িত বৃদ্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্র মহিলাগণে পরিবৃত হইয়া ভাগীরথীতীরাভিমুখে গমন করিতেছেন। কামিনীগণ কুররীর ন্যায় দুঃখিতমনে এই বলিয়া বিলাপ করিতেছেন, “হা ধর্ম্মরাজ। এক্ষণে তোমার সে ধর্ম্মানুরাগিতা ও অনৃশংসতা কোথায় গেল? তুমি কিরূপে ভ্রাতা, গুরুপুত্র ও মিত্রগণকে বিনাশ করিলে? মহাবীর ভীষ্ম, দ্রোণ ও জয়দ্রথকে সংহার করিয়া কি তোমার মন ব্যথিত হইতেছে না? এক্ষণে মহাবীর অভিমন্যু, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র এবং গুরু ও ভ্রাতৃগণবিরহে তোমার রাজ্যলাভ নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর হইবে।”
ধৃতরাষ্ট্রকরে লৌহভীমচুৰ্ণ
ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির সেই মহিলাগণের এইরূপ বিলাপ শ্রবণ করিতে করিতে তাঁহাদিগকে অতিক্রম করিয়া রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে প্রণাম করিলেন। তৎপরে অন্যান্য পাণ্ডবেরাও স্ব স্ব নাম নির্দেশপূর্ব্বক অন্ধরাজের অভিবাদনে প্রবৃত্ত হইলেন। তখন রাজা ধৃতরাষ্ট্র অপ্রসন্নমনে ধর্ম্মরাজকে আলিঙ্গন ও সান্ত্বনা করিয়া স্বীয় দুষ্টাভিসন্ধি সম্পন্ন করিবার মানসে ভীমকে অনুসন্ধান করিতে লাগিলেন। তৎকালে বোধ হইল যেন তাঁহার শোকানল ক্রোধসমীরণে সন্ধুক্ষিত হইয়া ভীমসেনরূপ তৃণরাশি দগ্ধ করিবার অভিলাষ করিয়াছে। হে মহারাজ! অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন মহাত্মা বাসুদেব ইহার পূর্বেই ভীমের উপর ধৃতরাষ্ট্রের দুরভিসন্ধি বুঝিতে পারিয়া তাহার প্রতিবিধানার্থ লৌহময় ভীম সংগ্রহ করিয়া রাখিয়াছিলেন। এক্ষণে তিনি অন্ধরাজের ভাবদর্শনে তাহার অভিপ্রায় সবিশেষ অবগত হইয়া ভীমকে হস্তদ্বারা অবরোধপূর্ব্বক ধৃতরাষ্ট্রকে সেই লৌহময় ভীম প্রদান করিলেন। অযুত নাগতুল্য বলশালী মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র সেই লৌহময় ভীমকে প্রাপ্তিমাত্র ভুজদ্বারা গ্রহণ করিয়া যথার্থ ভীমবোধে বলপ্রকাশপূর্ব্বক চূর্ণ করিয়া ফেলিলেন। ভীমের লৌহময় প্রতিকৃতি চূর্ণ করিবামাত্র ধৃতরাষ্ট্রের বক্ষঃস্থল বিমথিত হইয়া গেল এবং আস্যদেশ হইতে অনবরত রুধিরপ্রবাহ নিগতি হইতে লাগিল। তখন তিনি শোণিতসিক্তকলেবরে পুষ্পিত পারিজাতের ন্যায় অচিরাৎ ভূতলে নিপতিত হইলেন। মহামতি সঞ্জয় তাহাকে অবলম্বনপূর্ব্বক সান্ত্বনা করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে রাজা ধৃতরাষ্ট্র ক্রোধ পরিত্যাগপূর্ব্বক শোকাকুলিতচিত্তে “হা ভীম! হা ভীম!” বলিয়া রোদন করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন পুরুষপ্রধান বাসুদেব অন্ধরাজকে এোধহীন ও ভীমবধে নিতান্ত কাতর দেখিয়া কহিলেন, “মহারাজ! আর শোক প্রকাশ করিবেন না। আপনি লৌহময় ভীমকে চুর্ণ করিয়াছেন, প্রকৃত ভীমকে বিনাশ করেন। নাই। আমি আপনাকে নিতান্ত ক্রোধাবিষ্ট দেখিয়া ভীমকে মৃত্যুর দশনান্তৰ্গত বোধ করিয়া অগ্রেই অপসারিত করিয়াছিলাম। আপনার তুল্য বলশালী আর কেহই নাই। আপনি ভুজযুগলদ্বারা পরিগ্রহ করিলে কোন্ ব্যক্তি উহা সহ্য করিতে পারে? কৃতান্তের সন্নিহিত হইলে যেমন কেহ জীবিতসত্ত্বে’ বিমুক্ত হইতে পারে না, তদ্রূপ আপনার বাহুযুগলের মধ্যগত হইলে কোন বীরই। জীবিতলাভে সমর্থ হয় না। আমি সেই নিমিত্তই আপনার নিকট দুৰ্য্যোধননির্শিত লৌহময় ভীমপ্রতিমূৰ্ত্তি প্রদান করিয়াছিলাম। হে মহারাজ! আপনার মন পুত্রশোকে নিতান্ত সন্তপ্ত ও ধর্ম্মর্ভাবশূন্য হইয়াছে, এই নিমিত্তই আপনি ভীমসেনকে বিনাশ করিবার অভিলায় করিয়াছিলেন। কিন্তু বস্তুতঃ ভীমকে সংহার করা আপনার শ্রেয়ঃ নহে। দেখুন, আপনার পুত্রগণ কদাচ জীবিত থাকিতেন না, নচেৎ আমরা পূর্বে শান্তিস্থাপনের নিমিত্ত বিশেষ যত্ন করিয়াও কি নিমিত্ত কৃতকাৰ্য্য হইতে পারিলাম না? অতএব এক্ষণে উহা বিশেষরূপে অনুধ্যান করিয়া শোক পরিত্যাগ করুন।”