যজ্ঞকার্য্যে যুধিষ্ঠিরের উদ্বোধন
কৃষ্ণ কহিলেন, “হে ধৰ্ম্মরাজ! ব্যাধি দুই প্রকার—শারীরিক ও মানসিক। এই দুই প্রকার ব্যাধি পরস্পরের সহিত পরস্পর সমুৎপন্ন হইয়া থাকে। শরীরে যে ব্যাধি উপস্থিত হয়, তাহাকে শারীরিক এবং মনোমধ্যে যে পীড়া উপস্থিত হয়, তাহাকে মানসিক ব্যাধি কহে। কফ, পিত্ত ও বায়ু এই তিনটি শরীরের গুণ। যখন এই তিন গুণ সমভাবে অবস্থান করে, তখন শরীরকে সুস্থ এবং যখন ঐ গুণত্রয়ের মধ্যে বৈষম্য উপস্থিত হয়, তখন শরীরকে অসুস্থ বলা যায়। পিত্তের আধিক্য হইলে কফের হ্রাস ও কফের আধিক্য হইলে পিত্তের হ্রাস হইয়া থাকে। শরীরের ন্যায় আত্মারও তিনটি গুণ আছে। ঐ তিনটি গুণের নাম সত্ত্ব, রজ ও তম। ঐ গুণত্রয় সমভাবে অবস্থান করিলে আত্মার স্বাস্থ্যলাভ হয়। ঐ গুণত্রয়ের মধ্যে একের আধিক্য হইলে অন্যের হ্রাস হয়। হর্ষ, উপস্থিত হইলে শোক এবং শোক উপস্থিত হইলে হর্ষ তিরোহিত হইয়া যায়। দুঃখের সময় কি কেহ সুখানুভব করে এবং সুখের সময় কি কাহারও দুঃখানুভব হয়? যাহা হউক, এক্ষণে সুখদুঃখ উভয়ই স্মরণ করা আপনার কর্ত্তব্য নহে। সুখদুঃখাতীত পরব্রহ্মকে স্মরণ করাই আপনার বিধেয়। অথবা যদি সুখদুঃখ জীবের স্বভাবসিদ্ধ বলিয়া আপনি এককালে উহা পরিত্যাগ করিতে না পারেন, তথাপি সভামধ্যে পণ্ডিতগণসমক্ষে রজঃস্বলা দ্রৌপদীর কেশাম্বরাকর্ষণ [১], আপনাদিগের অজিনধারণপূৰ্ব্বক নগর হইতে বহির্গমন, মহারণ্যমধ্যে অবস্থান, জটাসুরকর্ত্তৃক দ্রৌপদীহরণ, চিত্রসেনের সহিত যুদ্ধ, সিন্ধুরাজকর্ত্তৃক দ্রৌপদীর অপমান, অজ্ঞাতবাস এবং দ্রৌপদীর গাত্রে কীচকের পদাঘাতজনিত অতীব দুঃখসমুদয় স্মরণ করা আপনার কদাপি উচিত নহে।
“পূৰ্ব্বে ভীষ্ম-দ্রোণাদির সহিত আপনার যে ঘোরতর যুদ্ধ উপস্থিত হইয়াছিল, এক্ষণে একমাত্র অহঙ্কারের সহিত তাহা অপেক্ষা অধিক ভীষণ সংগ্রাম সমুপস্থিত হইয়াছে। ঐ যুদ্ধে অভিমুখীন হওয়া আপনার অবশ্য কর্ত্তব্য। যোগ ও তদুপযোগী কাৰ্য্যসমুদয় অবলম্বন করিলেই এই যুদ্ধে জয়লাভ করিতে পারিবেন। এই যুদ্ধে শরনিকর, ভৃত্য ও বন্ধুবর্গের কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই; একমাত্র মনকে সহায় করিয়া ঐ সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইতে হইবে। ঐ যুদ্ধে জয়লাভ করিতে না পারিলে দুঃখের পরিসীমা থাকিবে না। অতএব আপনি আমার এই উপদেশানুসারে অচিরাৎ অহঙ্কারকে পরাজয়পূৰ্ব্বক শোক পরিত্যাগ করিয়া সুস্থচিত্তে পৈত্রিক রাজ্য প্রতিপালন করুন।”