১২. মহাকাশযানটি ছোট নক্ষত্রের কাছাকাছি

মহাকাশযানটি ছোট নক্ষত্রের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। নক্ষত্রটির আকর্ষণে মহাকাশযানের গতিবেগ যে ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে, টুকি এবং ঝা সেটা গত কয়েকদিন থেকে বেশ অনুভব করতে পারছে। বিশাল মহাকাশযানটি থরথর করে কাঁপতে থাকে, মাঝে মাঝেই বিচিত্র ধরনের শব্দ করতে থাকে। মহাকাশযান থেকে বের হয়ে আসা নানা ধরনের এন্টেনাকে গুটিয়ে আনা হয়েছে। মহাকাশযানের সূচালো অগ্রভাগে তাপ নিরোধক বিশেষ আস্তরণে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। মূল ইঞ্জিনটিকে চালু করার জন্যে বড় বড় ট্যাংক থেকে জ্বালানীর সরবরাহ শুরু হয়েছে। সহায়ক ইঞ্জিনগুলো এর মাঝে চালু করা হয়েছে, ভয়ংকর। শব্দ করে সেগুলো গর্জন করছে।

টুকি এবং ঝা বিশেষ মহাকাশচারীর পোশাক পরে তাদের জন্যে আলাদা করে রাখা চেয়ারে বসে আছে। রোবি তাদের জীবন ধারণের সহায়ক যন্ত্রপাতিগুলো তাদের পোশাকের সাথে লাগিয়ে দিয়ে গেছে। তাদের শরীরে সমস্ত তথ্য মূল কম্পিউটারের ডাটাবেসে সংগৃহীত হচ্ছে। মহাকাশযানটির ভিতরে একটা লাল আলো একটু পর পর জ্বলে উঠছে। উপরে একটা বড় ঘড়িতে কাউন্ট ডাউন শুরু হয়েছে, যে সংখ্যাটি দেখানো হচ্ছে সেটি কমতে কমতে যখন শূন্য হয়ে যাবে সেই মুহূর্তে মহাকাশযানটি হাইপার ডাইভ দিয়ে বিশাল দূরত্ব পার হয়ে পৃথিবীর কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। প্রচলিত বিজ্ঞান ব্যাপারটিকে এখনো সত্যিকার অর্থে আয়ত্ত করতে পারে নি, দুর্ঘটনা প্রায় নিত্যনৈমত্তিক। হাইপার ডাইভ দিয়ে যেখানে পৌঁছানোর কথা সেখানে না পৌঁছে বিশ্বভ্রহ্মাণ্ডের অন্য কোথাও পৌঁছে যাওয়া অত্যন্ত সাধারণ ঘটনা। আরো একটি ব্যাপার ঘটে যায় মাঝে মাঝে, সময় নিয়ে গোলমাল হয়ে যায়—একদিন রওনা দিয়ে আগের দিন পৌঁছে যাবার মত।

শেষ মুহূর্তে রোবি সমস্ত মহাকাশযানে ছোটাছুটি করতে লাগল। মূল ইঞ্জিন চালু করে কন্ট্রোল প্যানেলে ঝুকে পড়ে চিৎকার করে বলল, হাইপার ডাইভের জন্যে প্রস্তুত হয়ে যান মহামান্য টুকি এবং মহামান্য ঝা!

টুকি এবং ঝা শক্ত করে তাদের চেয়ারে হাতল চেপে ধরল, মহাকাশযানের গতিবেগ বেড়ে যাচ্ছে, বড় বড় ইঞ্জিনগুলো প্রচণ্ড শব্দে গর্জন করতে শুরু করেছে, মহাকাশযানটি থরথর করে কাঁপছে মনে হচ্ছে বুঝি ভেঙে পড়বে যে কোন মুহূর্তে। টুকি এবং ঝা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দেয়ালে লাগানো বড় ঘড়িতে সংখ্যাটি কমে আসছে দ্রুত। কমতে কমতে সংখ্যাটি শূন্যে এসে স্থির হল, প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ হল সাথে সাথে পুরো মহাকাশযানটি দুলে উঠল একবার, টুকি

এবং ঝা জ্ঞান হারালো সাথে সাথে।

টুকি এবং ঝায়ের যখন জ্ঞান হল তারা তখন সৌরজগতের মাঝে ঢুকে পড়েছে, মহাকাশযানটি মঙ্গল গ্রহের পাশে দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে পৃথিবীর দিকে ছুটে যাচ্ছে। রোবি কন্ট্রোল প্যানেলের উপর ঝুকে আছে, কোন একটা কিছু দেখছে খুব মনোযোগ দিয়ে। টুকি চেয়ারের বাঁধন খুলতে খুলতে বলল, সবকিছু ঠিক আছে রোবি?

বুঝতে পারছি না।

কী বুঝতে পারছ না?

সৌরজগতে আমরা ঢুকে গেছি, মঙ্গল গ্রহের পাশে দিয়ে ছুটে যাচ্ছি কিন্তু তবুও হিসেব মিলছে না।

কী হিসেব মিলছে না?

গ্রহগুলো যেখানে থাকার কথা সেখানে নেই।

কোথায় আছে?

অন্য জায়গায়।

ঝা শুকনো মুখে বলল, তার মানে কী?

মনে হচ্ছে সময় নিয়ে গোলমাল হয়ে গেছে। আমরা আগে চলে এসেছি।

কিসের আগে?

সময়ের আগে।

টুকি চিন্তিত মুখে বলল, পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করতে পার না? জিজ্ঞেস করতে পার না আজকে কত তারিখ, কি বৃত্তান্ত?

সেটাই চেষ্টা করছি মহামান্য টুকি কিন্তু কাজ হচ্ছে না। কিছুতেই যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে–

কী মনে হচ্ছে?

মনে হচ্ছে কেউ আমাদের দেখতে পারছে না। পৃথিবীর চোখে আমরা অদৃশ্য।

টুকি নিজের চেয়ার থেকে উঠে কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, কী বলছ তুমি?

আপনি নিজেই দেখুন মহামান্য টুকি। আমরা পৃথিবীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। মঙ্গল গ্রহের মহাকর্ষ বলের কারণে আমাদের গতিপথ বামদিকে বেঁকে যাবার কথা কিন্তু সেটা বেঁকে যাচ্ছে না। আমরা সোজাসুজি এগিয়ে যাচ্ছি।

টুকি ব্যাপারটা বুঝতে পারল না কিন্তু তবু জিজ্ঞেস করল, এরকম হওয়ার মানে কী?

মানে আমরা এখনো প্রকৃত জগতে প্রবেশ করি নি। অতিপ্রাকৃত জগতে আছি।

প্রকৃত জগতে কখন ঢুকব?

আমি জানি না মহামান্য টুকি। এ ধরনের ব্যাপার খুব বেশি ঘটে নি। তাই কেউ ঠিক জানে না।

ঝা-ও নিজের চেয়ারে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে এসে বলল, এখন কী হবে রোবি? আমরা কী মরে যাব?

রোবি কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, মরে যাওয়ার ব্যাপারটি আমি ভাল বুঝি না। তবে বাস্তব এবং অবাস্তব জগৎ বলে একটা ব্যাপার আছে। আমরা এখন অবাস্তব জগতে আছি—এক অর্থে বলতে পারেন। আমরা মরে আছি।

মরে আছি? ঝা আর্তনাদ করে বলল, মরে আছি মানে আবার কী?

আমরা যদি বাস্তব জগতে ফিরে না আসি তাহলে বেঁচে থাকা বা মরে যাওয়ার মাঝে কোন পার্থক্য নেই।

টুকি এবং ঝা মনিটরের দিকে তাকিয়ে রইল। মহাকাশযানটি তীব্র গতিতে পৃথিবীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এর গতিপথ নিয়ন্ত্রণের কোন উপায় নেই। রোবির কথা যদি সত্যি হয় তাহলে এই অবাস্তব অতিপ্রাকৃত জগত থেকে মহাকাশযানটি পৃথিবী ভেদ করে কোন অচেনা জগতে চলে যাবে। টুকি রোবির দিকে তাকিয়ে ভয় পাওয়া গলায় বলল, তুমি বলেছ আমরা সময়ের আগে চলে এসেছি?

মনে হচ্ছে তাই।

কত আগে?

রোবি হিসেব করে তারিখটি বলতেই ঝা চমকে উঠে বলল, অসম্ভব।

কী অসম্ভব?

ঐ তারিখে আমরা পৃথিবীতে ছিলাম, চুরি করতে গিয়েছিলাম সেন্ট্রাল ব্যাংকে।

কিন্তু গ্রহের অবস্থান দেখুন। পৃথিবীর সাথে মঙ্গল গ্রহের আনুপাতিক অবস্থান। বুধ গ্রহ শুক্র গ্রহকে দেখুন–

রোবির কথা শেষ হবার আগেই হঠাৎ মহাকাশযানটি প্রচণ্ড শব্দ করে কাঁপতে শুরু করে, মনে হচ্ছে সেটি বুঝি তার সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে। রোবি মনিটরের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, বাস্তব জগতে ঢুকে যাচ্ছি–

টুকি এবং ঝা প্রচণ্ড আঘাতে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ল। কোনমতে নিজেদের সামলে নিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করল কিন্তু মহাকাশযানটি নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে, কোনমতেই আর তাল সামলানো যাচ্ছে না। কন্ট্রোল প্যানেলটা ধরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে করতে দেখতে পেল মহাকাশযানটির দেয়ালে দেয়ালে আগুনের শিখা জ্বলে উঠছে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেল তারা তারপর হঠাৎ করে গাঢ় নিঃশব্দ অন্ধকারে ড়ুবে গেল চারিদিক।

 

টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে, নাক মুখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে নিচে। টুকি চোখ খুলে তাকাল, লম্বা ঘাসের মাঝে উপুর হয়ে পড়ে আছে সে, পাশে ঝা লম্বা হয়ে শুয়ে আছে দেখে মনে হয় বুঝি প্রাণহীন। টুকি বুকের উপর ঝুকে পড়ে দেখল বুক ধুকপুক করছে, মরে যায়নি তাহলে। টুকি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ঝাকে ধাক্কা দিল, সাথে সাথে ঝা চোখ খুলে তাকিয়ে বলল, আমরা কোথায়?

পৃথিবীতে। বেঁচে গেছি মনে হয়।

ঝা উঠে বসে চারিদিকে তাকাল, বহুদূরে কোথায় আগুন জ্বলছে, কালো ধোঁয়া উড়ছে সেখান থেকে। অন্ধকার হয়ে আসেছ, কী চমৎকার লাগছে এই পৃথিবীটা। চারিদিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমরা কেমন করে বেঁচে গেলাম? কী হয়েছিল মহাকাশযানটিতে? রোবি কোথায়?

জানি না। টুকি মাথা নেড়ে বলল, কিছুই জানি না।

দুজনে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নিজেদের টেনে-ছেচড়ে সামনে নিতে থাকে, ঝা বলল, একটা জিনিস জান?

কী?

আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই ব্যাপারটা আগে ঘটেছে।

কোন ব্যাপারটা?

এই যে আমরা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নিজেদেরকে টেনে-ছেচড়ে নিচ্ছি। সেটা। আচ্ছা আমরা হাঁটছি না কেন?

টুকি বলল, আমরা হাঁটছি না, কারণ হাঁটলে পুলিশ আমাদের দেখে ফেলবে।

কিন্তু আমরা তো মহাকাশযান থেকে এসেছি। মনে নেই আমরা এম সেভেন্টি-ওয়ানে গেলাম?

টুকি ভুরু কুচকে মনে করার চেষ্টা করতে থাকে। মহাকাশযানের বিস্ফোরণে মাথায় চোট খেয়েছে। কী হয়েছে মনে করতে পারছে না ঠিক করে। মাথাটা ঝাকিয়ে বলল, হ্যাঁ! মনে পড়ছে আবছা আবছা। কোথায় জানি গেলাম?

ঝা মনে করার চেষ্টা করতে করতে বলল, ঠিক ভাল করে মনে পড়ছে না এখন। একটা মহাকাশযানে উঠে পড়েছিলাম ভুলে। হীরা চুরি করে–

মনে পড়েছে। টুকি মাথা নেড়ে বল, হীরা চুরি করে পালাবার জন্যে গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলাম। ঐ দেখ আগুন জ্বলছে।

হ্যাঁ! তাড়াতাড়ি সরে পড়ি এখান থেকে।

টুকি আর ঝা দ্রুত গড়াতে গড়াতে সামনে এগুতে থাকে। প্যাচপ্যাচে কাদায় গড়াতে গড়াতে সামনে আকাশের দিকে মুখ করে টুকি বলল, কী বাজে বৃষ্টি!

ঝা হাসি হাসি মুখে বলল, মৌসুমী বৃষ্টি। একেবারে সময়মত এসেছে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল পলিউশান একেবারে ধুয়ে নিয়ে যাবে।

টুকি রেগে মেগে বলল, তোমার বৃষ্টির চৌদ্দগুষ্ঠির লিভারে ক্যান্সার হোক।

ঝা মুখের হাসিকে আরো বিস্তৃত করে বলল, এতো রেগে যাচ্ছ কেন? কী চমৎকার বৃষ্টি, দেখ না একবার। তিন চার ঘণ্টার মাঝে থেমে যাবে।

তিন চার ঘণ্টা? টুকি মুখ খিচিয়ে বলল, ততক্ষণ আমরা কী করব?

ভিজব। মঙ্গল গ্রহে বৃষ্টিতে ভেজার একটা টুর আছে। সাড়ে সাতশ ইউনিট দিলে দশ মিনিট ভিজতে দেয়। সিনথেটিক বৃষ্টি। আর এইটা হল একেবারে খাঁটি প্রাকৃতিক বৃষ্টি।

টুকি রেগেমেগে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল। সামনে আবছা অন্ধকারে উঁচু মতন কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। উপরে হঠাৎ একটা আলো জ্বলে উঠে আবার নিভে গেল। টুকির হঠাৎ মনে হল সে আগে কোথাও ওটা দেখেছে, কিন্তু কোথায় দেখেছে কিছুতেই মনে করতে পারল না। ভয় পাওয়া গলায় বলল, ওটা কী—

 

(উৎসাহী পাঠকেরা ইচ্ছে করলে আবার বইয়ের গোড়া থেকে শুরু করতে পারেন!)