চোখের সামনে একজন মরা মানুষকে দেখে সন্তুর শরীরটা ঘুলিয়ে উঠল। সে মুখ ফিরিয়ে নিল অন্যদিকে।
চীনা ভদ্রলোকটির গায়ে একটা ভেড়ার চামড়ার কোট। থুতনিতে অল্প অল্প দাড়ি। চোখ দুটি খোলা। দৃষ্টিতে ভয়ের বদলে যেন খানিকটা বিস্ময়ের ভাব মাখানো।
সন্তু মৃতদেহটির দিকে তাকাতে চায় না, কিন্তু কাকাবাবুদের কথাবার্তা শোনার জন্যও দারুণ কৌতূহল। সে কাকাবাবুর পেছনে গিয়ে বসে পড়ল।
কাকাবাবু বললেন, এই চীনা ভদ্রলোকটি কোথা থেকে এখানে এলেন, তা কিছুই বোঝা গেল না। অথচ আমরা এখানে আর বেশিক্ষণ অপেক্ষাও করতে পারি না। অনেক কাজ আছে।
ভার্মা বললেন, এই মৃতদেহটি কি এখানেই পড়ে থাকবে? একে এখানেই কবর দিয়ে দেওয়া হোক। চীনারা মৃতদেহ পোড়ায় না, কবরই দেয়।
কাকাবাবু বললেন, তা হলে চটপট বরফ খুঁড়ে ফেলা যাক। সন্তু গাঁইতিটা নিয়ে আয় তো!
জং বাহাদুর রানা হাত তুলে বাধা দিয়ে বললেন, দাঁড়ান, একটা কথা আছে। এই চীনা ভদ্রলোক একজন বিদেশি, এর গায়ে যে কোটটা আছে, সে-রকম কোটি আমাদের দেশে পাওয়া যায় না। ইনি এখানে কী করে এলেন, তা জানা আমাদের সরকারের কর্তব্য। এঁর মৃত্যুর কারণটা জানা দরকার। এই দেহ পোস্টমর্টেম করতে হবে।
ভার্মা বললেন, তার মানে এই দেহটা এখন কাঠমাণ্ডুতে পাঠাতে হবে?
রানা বললেন, হ্যাঁ।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এদিকে কোনও চীনা অভিযাত্রী দল কি এসেছিল শিগগির?
ভার্মা বললেন, না তো!
বেশ কিছুদিন আগে, আড়াই কিংবা তিন বছর হবে।
সে দলের কেউ কি হারিয়ে গিয়েছিল?
সে-রকম কিছু শোনা যায়নি। তবে চারনম্বর ক্যাম্পের কাছে দুজন দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল, একথা জানি। সে জায়গা তো এখান থেকে অনেক দূরে।
যদি ধরা যায় সেই দলেরই কেউ হারিয়ে গিয়েছিল কিংবা দুর্ঘটনায় পড়েও কোনওক্রমে বেঁচে গিয়েছিল, তবু তার পক্ষে এখানে এক-একা এতদিন বেঁচে থাকা কী করে সম্ভব?
কিংবা হয়তো মৃত্যু হয়েছিল তখনই, বরফের তলায় চাপা পড়ে শরীরটা এরকম অবিকৃত অবস্থায় রয়েছে।
মৃতদেহটা বার করেছে আমাদের সঙ্গে ঠাট্টা করবার জন্য
ভার্মা বললেন, মিঃ রায়চৌধুরী, আপনি দেখছি ইয়েতিদের অস্তিত্বে একেবারেই বিশ্বাস করেন না! অথচ, আপনি নিজেই ইয়েতির দাঁত সঙ্গে করে এনেছেন!
কাকাবাবু এ কথার কোনও উত্তর না দিয়ে শুধু বললেন, হুঁ!
তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, যাই হোক, এবারে যা ব্যবস্থা করার করুন। সময় নষ্ট করে তো লাভ নেই।
রানা আর ভার্মা দুজনে ধরাধরি করে মৃতদেহটা তুলল। সন্তুও হাত লাগাল। তারপর ওরা চলে এল হেলিকপটারের কাছে।
কাকাবাবু খানিকটা আফশোষের সুরে বললেন, মৃতদেহটা তো এই হেলিকপটারেই পাঠাতে হবে। অথচ এখন হেলিকপটারটা আমাদের খুব কাজে লগত।
রানা বললেন, ঘণ্টা দু একের মধ্যেই আবার ফিরে আসতে পারবে। কাঠমাণ্ডু পৰ্যন্ত যাবে না, সিয়াংবেচি পৰ্যন্ত পৌঁছে দিয়ে এলেই চলবে। তারপর ওরা ব্যবস্থা করবে।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের সঙ্গে খাবার-দাবার কিছু আছে? কাল দুপুরের থেকে আমাদের ভাল করে কিছু খাওয়া হয়নি। দেখুন না, এই ছেলেটার মুখ শুকিয়ে গেছে।
রানা বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, অনেক খাবার আছে। কিন্তু আমি একটা প্ৰস্তাব দেব? আমাদেরও আর এখানে থাকবার দরকার কী? আমরা সবাই তো এই হেলিকপটারে ফিরে গেলে পারি।
কাকাবাবু দারুণ অবাক হয়ে ভুরু তুলে বললেন, আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন রানাসাহেব?
রানা হাসতে হাসতে বললেন, কেন, পাগল হবার মতন কী করলুম?
কাকাবাবু বললেন, একটা কাজ করতে এসেছি, সেটা শেষ না করে ফিরে যাব? তাহলে মানুষ হয়ে জন্মেছি কেন? তা হলে লেখাপড়া শিখেছি কেন? যদি ইচ্ছে হয়, আপনারা চলে যান, আমি থাকব।
সেই মুহুর্তে কাকাবাবুর জন্য খুব গর্ব হল সন্তুর। সে জানে, তার কাকাবাবু ছাড়া এরকম কথা জোর দিয়ে আর কেউ বলতে পারে না।
ভার্মা বললেন, রানাসাহেব, আপনি মিঃ রায়চৌধুরীকে তো ভাল করে চেনেন না, তাই ওকথা বললেন। উনি কোনও একটা কাজ শুরু করে তার শেষ না দেখে ছাড়েন না। সে কাজ যত বিপজ্জনকই হোক না কেন! দারুণ গোঁয়ার লোক! আন্দামানে জারোয়াদের দ্বীপের কাছাকাছি কোনও মানুষ ভয়ে যায় না। উনি নিজে জোর করে সেখানে নেমেছিলেন!
রানা বললেন, কিন্তু উনি কী কাজের জন্য এখানে এসেছেন সেটাই তো আমরা ভাল করে জানি না।
কাকাবাবু বললেন বলছি। আগে খাবার বার করুন।
হেলিকপটারে একটা ত্রিপল ছিল। সেটাকে ভাঁজ করে পাতা হল বরফের ওপর। তারপর নামানো হল অনেকগুলো সসেজ, হ্যামবাগার, স্যান্ডউইচ আর দুটো ফ্লাস্কভর্তি গরম কফি।
সুন্দর রোদ উঠেছে আজ। আকাশ ঝকঝকে নীল। কে বলবে যে কালকেই সারা রাত এখানে তুষারের ঝড় বয়ে গেছে। রোদ্দুরের স্পর্শে দারুণ আরাম লাগছে এখন।
রানা হেলিকপটার-চালককে কয়েকটি নির্দেশ দিলেন। মৃতদেহটি নিয়ে হেলিকপটার উড়ে চলে গেল। তারপর তেরপলের ওপর গোল হয়ে বসে ওরা খাওয়া শুরু করল।
রানা বললেন, ধরা যাক, এখানে ইয়েটি আছে। কিন্তু সে-জন্য তো পরে আরও অনেক লোকজন নিয়ে ফিরে আসা যায়। আমরা তিনজনে মিলে খোঁজার চেষ্টা করাটা নিবুদ্ধিতার কাজ হবে না?
সন্তু বসে আছে রানার পাশেই। সে মুখ তুলে ওঁর দিকে তাকাল। রানা সন্তুর ঘাড়ে চাপড় মেরে বললেন, দুঃখিত, দুঃখিত। তিনজন নয়, চারজন। আমাদের এই কিশোর বন্ধুটিও যথেষ্ট সাহসী। কিন্তু এই চারজনে মিলেই বা কী করব?
কাকাবাবু বললেন, আপনার কথা-মতন আমিও বলছি, ধরা যাক, এখানে ইয়েতি আছে। আমি নিজে কয়েকটি অদ্ভুত পায়ের ছাপ দেখেছি, তার ছবিও তুলেছি। আর আমার এই ভাইপো সন্তু শপথ করে বলেছে যে সে ইয়েতির মতন অতিকায় কোনও প্ৰাণী এক পলকের জন্য দেখেছে। শেরপা আর কুলির তো সেই দেখেই পলাল। তা হলে একটা কিছু আছে নিশ্চয়ই। केिछ्-?
ভাম কাকাবাবুর কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলল, আচ্ছা, মিঃ রায়চৌধুরী, ঐ শেরপা আর কুলিরাই আপনাদের গম্বুজের মধ্যে আটকে রেখে দরজা ঐ রকমভাবে বন্ধ করে দিয়ে যায়নি তো?
সন্তু বলল, না, তা হতে পারে না।
কাকাবাবু বললেন, শেরপা আর কুলির অনেকক্ষণ আগেই চলে গিয়েছিল।
যদি তারা আবার ফিরে আসে। আসতেও তো পারে।
কিন্তু আমাদের মেরে ফেলার চেষ্টা করে ওদের কী লাভ? লাভ নিশ্চয়ই আছে। আপনাদের ফেলে রেখে ওরা পালিয়েছে, সে-জন্য নেপাল সরকারের কাছ থেকে ওদের নিশ্চয়ই শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু আপনাদের মেরে ফেলতে পারলে পরে ওরা বলতে পারে যে আপনারা দুর্ঘটনায় মারা গেছেন সেইজন্যই ওরা ফিরে গেছে।
রানা বললেন, শেরপারা খুব বিশ্বাসী হয়। তারা এরকম কাজ কক্ষনো না।
সন্তু বলল, মিংমা আমায় খুব ভালবাসত। সে কক্ষনো আমাদের মারতে চাইবে না।
কাকাবাবু বললেন, শেরপারা যদি গম্বুজের দরজা বন্ধ করেও দেয়, তবু চীনে লোকটা কোথা থেকে এল? তাকে নিশ্চয়ই শেরপারা আনেনি।
রানা সন্তুকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি সত্যিই ইয়েটি দেখেছ?
সন্তু বললো, হ্যাঁ।
ভার্মা এবং রানা দুজনেই সচকিতভাবে দূরের কালাপাথর পাহাড়টার দিকে একবার তাকালেন।
কাকাবাবু বললেন, যা বলছিলাম-ধরে নেওয়া যাক, ইয়েতি আছে। এখন দিনের বেলা, আপনাদের দু জনের কাছেই আছে এল এম জি, আমার কাছে আছে রিভলভার। পৃথিবীতে অন্য কোনও প্রাণী দাঁত, নখ ছাড়া আর কিছু অস্ত্ৰ ব্যবহার করতে জানে না। সুতরাং আমাদের ভয় পাবার কিছু নেই। তা ছাড়া, আমি মনে করি, মানুষের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান কোনও প্রাণী পৃথিবীতে থাকতে পারে না। এতকাল ধরে ইয়েতির কথা শোনা যাচ্ছে, অথচ কোনও সভ্য মানুষ একটাও ইয়েতিকে ধরতে পারেনি, এমনকী একটা ছবিও তুলতে পারেনি কেন? ইয়েতি কি এতই বুদ্ধিমান? সেটাই আমাদের দেখা দরকার।
রানা বললেন, মিঃ রায়চৌধুরী, এই রহস্যের সন্ধানের জন্যই কি আপনি এখানে এসেছেন?
কাকাবাবু বললেন, আপনারা কেইন শিপটনের কথা ভুলে যাচ্ছেন। মানুষের দাঁতের চেয়েও খুব বড় একটা দাঁত, ধরা থাক ইয়েতির দাঁত, সে সব সময় গলায় ঝুলিয়ে রাখত। সেই কেইন শিপটন। এখানে এসে ইয়েতি দেখতে পেয়েছিল। অন্তত সে কথা সে তার ডায়েরিতে লিখে রেখে গেছে। তারপর কেইন শিপটন। এখান থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। তাকে কি ইয়েতি ধরে নিয়ে গেছে? ইয়েতি কি মানুষ খায়? কেইন শিপটনের হাড়গোড়ও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
রানা বললেন, অনেক খুঁজে দেখা হয়েছে। উনি সত্যিই যেন অদৃশ্য হয়ে গেছেন।
কাকাবাবু বললেন, কেইন শিপটনের অদৃশ্য হওয়ার সঙ্গে ইয়েতির কোনও সম্পর্ক আছে কি না, সেটা খুঁজে দেখা দরকার।
ভার্মা জিজ্ঞেস করলেন, আপনিও কি সেই জন্য একটা ইয়েতির দাঁত নিয়ে এসেছেন? যদি আপনিও অদৃশ্য হয়ে যান?
কাকাবাবু এতক্ষণ বাদে হাসলেন। হাসতে হাসতে বললেন, সত্যি কথা বলতে কী, আমি সেইজন্যই এখানে এসেছি। আমি অদৃশ্য হবার বিদ্যেটা শিখতে চাই।
রানা বললেন, তা হলে এখন আপনি কী করতে চান? কাকাবাবু বললেন, আমরা সবাই মিলে এক্ষুনি কালাপাথরের দিকে এগেই না!
রানা বললেন, হেলিকপটারটা ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলে হয় না? ঘন্টা দু একের মধ্যেই তো ফিরে আসবে।
কাকাবাবু বললেন, হেলিকপটারটা গেলে কিছুই দেখা যাবে না। অবশ্য হেলিকপটারটা আমাদের কাজে লাগবে পরে। চলুন, আমরা নিজেরাই হেঁটে যাই, অন্তত সন্তু যেখানে ইয়েতি দেখেছিল। সেই পর্যন্ত। দিনের আলো অনেকক্ষণ থাকবে।
ভার্মা বললেন, চলুন তা হলে যাওয়া যাক।
কাকাবাবু নিজেই আগে উঠে দাঁড়ালেন, তারপর বললেন, কেইন শিপটন যে দলের সঙ্গে এসেছিল, তারপর আর কোনও অভিযাত্রী দল এই পথ দিয়ে এভারেস্টের দিকে যায়নি। আর একটি জাপানি দল এসেছিল, তারা এই জায়গা থেকে ফিরে যায়। কী যেন একটা রহস্যময় অসুখ হয়েছিল তাদের।
রানা জিজ্ঞেস করলেন, খাবারের পাত্র আর কফির ফ্লাস্ক দুটো এখানেই থাক তা হলে?
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ! এখানে তো চোরের ভয় নেই। আর, আশা করি ইয়েতিরা কাপ ডিশ কিংবা ফ্লাস্ক ব্যবহার করে না।
সন্তু হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, কাকাবাবু, ঐ দেখুন!
সকলে একসঙ্গে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল।
গম্বুজটার পাশ দিয়ে নীল কোট পরা একজন লোক এই দিকে হেঁটে আসছে।
রানা আর ভার্মা সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের লাইট মেশিন গান দুটি তুলে ধরলেন লোকটির দিকে। কাকাবাবুও রিভলভারটাবার করলেন।
সন্তুই আবার হাত তুলে বলল, মারবেন না, মারবেন না?