[১৮৯৬, ২৪ ফেব্রুআরী নিউ ইয়র্কে নবপ্রতিষ্ঠিত বেদান্ত সোসাইটির উদ্যোগে স্বামীজী বিখ্যাত My Master বক্তৃতাটি দেন; ঐ বৎসরের শেষদিকে লণ্ডন ত্যাগের পূর্বে উইম্বল্ডনে শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে আর একটি বক্তৃতা দেন। বর্তমান অনুবাদ উভয় বক্তৃতা হইতে সঙ্কলিত।]
ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভগবদগীতায় বলিয়াছিলেনঃ যখনই ধর্মের প্রভাব কমিয়া যায় ও অধর্মের প্রভাব বাড়িতে থাকে, তখনই আমি মানবজাতিকে সাহায্য করিবার জন্য জন্মগ্রহণ করি।৩৩
আমাদের এই জগৎ ক্রমাগত পরিবর্তন ও নূতন নূতন পরিস্থিতির জন্য যখনই নূতন সামঞ্জস্যের প্রয়োজন হয়, তখনই এক শক্তি-তরঙ্গ আসিয়া থাকে। আর মানব আধ্যাত্মিক ও জড় উভয় স্তরে ক্রিয়াশীল বলিয়া উভয়ত্র এই সমন্বয়-তরঙ্গের আবির্ভাব হয়। আধুনিক কালে ইওরোপই প্রধানতঃ জড়রাজ্যে সামঞ্জস্য বিধান করিয়াছে, আর সমগ্র জগতের ইতিহাসে এশিয়াই আধ্যাত্মিক রাজ্যে সমন্বয়-সাধনের ভিত্তিস্বরূপ। অধুনা আবার আধ্যাত্মিক স্তরে সমন্বয়ের প্রয়োজন দেখা যাইতেছে। বর্তমানে জড়বাদী ভাবসমূহই অত্যুচ্চ গৌরব ও শক্তির অধিকারী; আজ মানুষ ক্রমাগত জড়ের উপর নির্ভর করিতে করিতে নিজের দিব্য স্বরূপ ভুলিয়া গিয়া অর্থোপার্জনের যন্ত্রবিশেষে পরিণত হইতে বসিয়াছে—এখন আর একবার সমন্বয়ের প্রয়োজন। সমন্বয়ের সেই শক্তি আসিয়াছে, সেই বাণী উচ্চারিত হইয়াছে—যাহা ক্রমবর্ধমান জড়বাদের মেঘ অপসারিত করিয়া দিবে। সেই শক্তির ক্রিয়া আরম্ভ হইয়াছে, অনতিবিলম্বেই তাহা মানবজাতিকে তাহার প্রকৃত স্বরূপের কথা স্মরণ করাইয়া দিবে, আর এশিয়া হইতে এই শক্তি চারিদিকে বিস্তৃত হইতে আরম্ভ করিবে।
আমাদের এই জগৎ শ্রমবিভাগের নিয়মে পরিকল্পিত। একজন মানুষই সব কিছুর অধিকারী হইবে—একথা বলা অর্থহীন। কোন একটি জাতিই যে সকল বিষয়ের অধিকারী হইবে—এরূপ ভাবা আরও ভুল। তথাপি আমরা কি ছেলেমানুষ! অজ্ঞতাবশতঃ শিশু ভাবিয়া থাকে যে, সমগ্র জগতে তাহার পুতুলের মত কাম্য আর কিছুই নাই। যে-জাতি জড়শক্তিতে বড়, সে ভাবে জড়বস্তুই একমাত্র কাম্য, উন্নতি বা সভ্যতা বলিতে জড়শক্তির অধিকারই বুঝায়; আর যদি এমন কোন জাতি থাকে, যাহাদের ঐ শক্তি নাই বা যাহারা ঐ শক্তি চাহে না, তাহারা নগণ্য—তাহারা বাঁচিয়া থাকার অযোগ্য, তাহাদের সমগ্র অস্তিত্বই নিরর্থক। অন্যদিকে আর এক জাতি ভাবিতে পারে, কেবল জড়বাদী সভ্যতা সম্পূর্ণ নিরর্থক। প্রাচ্যদেশ হইতে উত্থিত বাণী একদা সমগ্র জগৎকে বলিয়াছিলঃ যদি কোন ব্যক্তি বিশ্বের সব কিছুর অধিকার করে অথচ তাহার আধ্যাত্মিকতা না থাকে, তবে তাহাতে কি সার্থকতা? ইহাই প্রাচ্য ভাব, অপরটি পাশ্চাত্য।
এই উভয় ভাবেরই মহত্ত্ব আছে, উভয় ভাবেরই গৌরব আছে। বর্তমান সমন্বয়ে এই উভয় আদর্শের সামঞ্জস্য, উভয় আদর্শের মিলন হইবে। পাশ্চাত্য জাতির নিকট ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ যেমন সত্য, প্রাচ্য জাতির নিকট আধ্যাত্মিক জগৎ তেমনি সত্য। প্রাচ্য জাতি যাহা কিছু চায় বা আশা করে, যাহা থাকিলে জীবনটাকে সত্য বলিয়া বোধ হয়, আধ্যাত্মিক স্তরেই সে তাহা পাইয়া থাকে। পাশ্চাত্য জাতির চক্ষে সে স্বপ্নমুগ্ধ; প্রাচ্য জাতির নিকট পাশ্চাত্যও সেইরূপ স্বপ্নমুগ্ধ বলিয়া প্রতীয়মান হয়—পাঁচ মিনিটও যাহা স্থায়ী নহে, এমন পুতুল লইয়া সে খেলা করিতেছে! আর যে মুষ্টিমেয় জড়বস্তুকে শীঘ্র বা বিলম্বে পরিত্যাগ করিয়া যাইতে হইবে, তাহাকেই বয়স্ক নরনারীগণ এত বড় মনে করে—ইহা চিন্তা করিয়া প্রাচ্য হাসিতেছে। একে অন্যকে স্বপ্নবিলাসী বলিয়া থাকে। কিন্তু পাশ্চাত্য আদর্শ মানবজাতির উন্নতির পক্ষে যেমন আবশ্যক, প্রাচ্য আদর্শও সেইরূপ; আর আমার বোধ হয়, পাশ্চাত্য আদর্শ অপেক্ষা উহা অধিক প্রয়োজনীয়। যন্ত্র কখনই মানবকে সুখী করে নাই, কখনই করিবে না। যে আমাদিগকে বিশ্বাস করাইতে চায় যে, যন্ত্র আমাদিগকে সুখী করিবে, সে জোর করিয়া বলে যন্ত্রেই সুখ আছে; কিন্তু সুখ চিরকাল মনেই বর্তমান। যে মনের উপর প্রভুত্ব করিতে পারে, সে-ই কেবল সুখী হইতে পারে, অপরে নহে। আর এই যন্ত্রের শক্তিই বা কি? যে ব্যক্তি তারের মধ্য দিয়া তড়িৎপ্রবাহ প্রেরণ করিতে পারে, তাহাকে খুব মহৎ ও বুদ্ধিমান্ বলিব কেন? প্রকৃতি কি প্রতি মুহূর্তে ইহা অপেক্ষা লক্ষগুণ অধিক তড়িৎপ্রবাহ প্রেরণ করিতেছে না? তবে প্রকৃতির পদতলে নত হইয়া তাহারই উপাসনা কর না কেন? যদি সমগ্র জগতের উপর তোমার শক্তি বিস্তৃত হয়, যদি তুমি জগতের প্রত্যেকটি পরমাণুকে বশীভূত করিতে পার, তাহা হইলেই বা কি আসিয়া যায়? যতদিন মানুষ তাহার নিজের ভিতর সুখী হইবার শক্তি অর্জন না করে, এবং নিজেকে জয় করিতে সমর্থ না হয়, ততদিন সে সুখী হইতে পারিবে না। ইহা সত্য যে, মানুষ প্রকৃতিকে জয় করিবার জন্যই জন্মগ্রহণ করিয়াছে; কিন্তু পাশ্চাত্য জাতি ‘প্রকৃত’ শব্দে কেবল জড় বা বাহ্য প্রকৃতিই বুঝিয়া থাকে। ইহা সত্য যে, নীল-শৈল-সাগর-সমন্বিতা নানা শক্তি ও ভাবমণ্ডিতা বাহ্যপ্রকৃতি অতি মহৎ। কিন্তু তাহা অপেক্ষাও মহত্তর মানবের অন্তঃপ্রকৃতি—সূর্য-চন্দ্র-তারকা, পৃথিবী তথা সমগ্র জড়জগৎ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। আমাদের এই ক্ষুদ্র জীবনের ঊর্ধ্বে এই অন্তঃপ্রকৃতি আমাদের গবেষণার অন্যতম ক্ষেত্র। পাশ্চাত্য জাতি যেমন বহির্জগতের গবেষণায় প্রাধান্য লাভ করিয়াছে, প্রাচ্য জাতি তেমনি এই অন্তর্জগতের গবেষণায় শ্রেষ্ঠতা লাভ করিয়াছে। অতএব ইহাই সঙ্গত যে, যখন আধ্যাত্মিক সামঞ্জস্যের প্রয়োজন হয়, তখন প্রাচ্য হইতেই হইয়া থাকে। এরূপ হওয়াই সঙ্গত। আবার যখন প্রাচ্য জাতি যন্ত্রনির্মিত শিক্ষা করিতে ইচ্ছা করে, তখন তাহাকে যে পাশ্চাত্য জাতির পদতলে বসিয়া উহা শিখিতে হইবে, ইহাও সঙ্গত। পাশ্চাত্য জাতির যখন আত্মতত্ত্ব, ঈশ্বরতত্ত্ব ও ব্রহ্মাণ্ডরহস্য শিখিবার প্রয়োজন হইবে, তখন তাহাকেও প্রাচ্যের পদতলে বসিয়া শিক্ষা করিতে হইবে।
আমি তোমাদের নিকট এমন এক ব্যক্তির জীবনকথা বলিতে যাইতেছি, যিনি ভারতে এইরূপ এক তরঙ্গ প্রবাহিত করিয়াছেন। কিন্তু তাঁহার জীবনচরিত বলিবার পূর্বে তোমাদের নিকট ভারতের ভিতরের রহস্য, ভারত বলিতে কি বুঝায়, তা বলিব। যাহাদের চক্ষু জড়বস্তুর কৃত্রিম সৌন্দর্যে বিভ্রান্ত হইয়াছে, যাহারা সারা জীবনটাকে পান-ভোজন ও সম্ভোগের বেদীমূলে উৎসর্গ করিয়াছে, কাঞ্চন ও ভূখণ্ডকেই যাহারা যথাসর্বস্ব বলিয়া স্থির করিয়াছে, ইন্দ্রিয়সুখকেই যাহারা সুখের সীমা বলিয়া বুঝিয়াছে, অর্থকেই যাহারা আরাধ্য দেবতা করিয়াছে, যাহাদের চরম লক্ষ্য ইহলোকে কয়েক মুহূর্তের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও তারপর মৃত্যু, যাহাদের মন সম্মুখে ঝাঁপ দিতে অক্ষম, যাহারা ইন্দ্রিয়ভোগ্য বিষয়ের মধ্যে বাস করিয়া তদপেক্ষা উচ্চতর কোন কিছুর চিন্তা কখনও করে না, এইরূপ ব্যক্তিরা ভারতে গিয়া কি দেখে?—দেখে চারিদিকে কেবল দারিদ্র্য আবর্জনা কুসংস্কার অজ্ঞতা বীভৎসভাবে তাণ্ডব নৃত্য করিতেছে। ইহার কারণ কি? কারণ—তাহারা সভ্যতা বলিতে পোষাক, পরিচ্ছদ, শিক্ষা ও সামাজিক শিষ্টাচার মাত্র বুঝে। পাশ্চাত্য জাতি তাহাদের বাহ্য অবস্থার উন্নতি করিতে সর্বপ্রকার চেষ্টা করিয়াছে; ভারত কিন্তু অন্য পথে গিয়াছে। সমগ্র জগতের মধ্যে কেবল সেখানেই এমন এক জাতির বাস, যে জাতি কখনও নিজদেশের সীমা ছাড়াইয়া অপর জাতিকে জয় করিতে গিয়াছে—সমগ্র ইতিহাসে কোথাও ইহা দেখিতে পাওয়া যায় না, যে জাতি কখনও অপরের দ্রব্যে লোভ করে নাই, যাহাদের একমাত্র দোষ এই যে, তাহাদের মস্তিষ্ক এবং দেশের ভূমি অতিশয় উর্বর, আর তাহারা গুরুতর পরিশ্রমে ধনসঞ্চয় করিয়া যেন অপরাপর জাতিকে ডাকিয়া নিজেদের সর্বস্বান্ত করিতে প্রলুব্ধ করিয়াছে। তাহারা সর্বস্বান্ত হইয়াছে, অপর জাতি তাহাদিগকে বর্বর বলিয়াছে—ইহাতে তাহাদের দুঃখ নাই, ইহাতে তাহারা সন্তুষ্ট। পরিবর্তে তাহারা এই জগতের নিকট সেই পরমপুরুষের দর্শন-বার্তা প্রচার করিতে চায়, জগতের নিকট মানবপ্রকৃতির গূঢ় রহস্য উদ্ঘাটন করিতে চায়, যে আবরণে মানবের প্রকৃত স্বরূপ আবৃত, তাহা ছিন্ন করিতে চায়; কারণ তাহারা জানে—এ সবই স্বপ্ন, তাহারা জানে—এই জড়ের পশ্চাতে মানবের প্রকৃত দিব্যভাব বিরাজমান, যাহা কোন পাপে মলিন হয় না, কাম যাহাকে কলঙ্কিত করিতে পারে না, অগ্নি যাহাকে দগ্ধ করিতে পারে না, জল সিক্ত করিতে পারে না, তাপ শুষ্ক করিতে পারে না, মৃত্যু বিনষ্ট করিতে পারে না। পাশ্চাত্য জাতির চক্ষে জড়বস্তু যতখানি সত্য, ভারতবাসীর নিকট মানবের যথার্থ স্বরূপও ততখানি সত্য।
তোমাদের যেমন কামানের মুখে লাফাইয়া পড়িবার সাহস আছে, তোমাদের যেমন স্বদেশের জন্য প্রাণ বিসর্জন করিবার সাহস আছে, ঈশ্বরের নামে তাহাদেরও তেমনি সাহস আছে। এই ভারতেই মানুষ যখন মনের কল্পনা বা স্বপ্নমাত্র বলিয়া ঘোষণা করে, তখন সে যাহা বিশ্বাস করে এবং চিন্তা করে, তাহা যে সত্য, ইহা প্রমাণ করিবার জন্য পোষাক-পরিচ্ছদ, বিষয়-সম্পত্তি সকলই সে ত্যাগ করিয়া থাকে। মানব-জীবনটা দু-দিনের নয়, প্রকৃতপক্ষে মানুষের জীবন অনাদি অনন্ত—এ কথা যখনই কেহ বুঝিতে পারে, তখন এই ভারতেই মানুষ নদীতীরে বসিয়া অনায়াসে শরীরটা পরিত্যাগ করিতে পারে, যেমন তোমরা সামান্য তৃণখণ্ড অনায়াসে পরিত্যাগ করিতে পার। ইহাই তাহাদের বীরত্ব—তাহারা মৃত্যুকে পরমাত্মীয় বলিয়া আলিঙ্গন করিতে প্রস্তুত হয়, কারণ তাহারা নিশ্চয় জানে যে, তাহাদের মৃত্যু নাই। এইখানেই তাহাদের শক্তি নিহিত—এই শক্তিবলেই শত শত বর্ষব্যাপী বৈদেশিক আক্রমণ ও অত্যাচারে তাহারা অক্ষত রহিয়াছে; এই জাতি এখনও জীবিত এবং জাতির ভিতর ভীষণতম দুঃখ-বিপদের দিনেও ধর্মবীরের অভাব হয় নাই। পাশ্চাত্যে যেমন বড় বড় রাজনীতিজ্ঞ ও বৈজ্ঞানিক জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, এশিয়াতেও তেমনি বড় বড় ধর্মবীর জন্মিয়াছেন। বর্তমান (ঊনবিংশ) শতাব্দীর প্রারম্ভে, যখন ভারতে পাশ্চাত্য ভাব প্রবেশ করিতে আরম্ভ করে, যখন পাশ্চাত্য দিগ্বিজয়ীগণ তরবারি হস্তে ঋষির বংশধরগণের নিকট প্রমাণ করিতে আসে যে, তাহারা বর্বর ও স্বপ্নবিলাসী, তাহাদের ধর্মে শুধু পৌরাণিক গল্প, ঈশ্বর আত্মা ও অন্য যাহা কিছু পাইবার জন্য তাহারা এতদিন চেষ্টা করিতেছিল, তাহা শুধু অর্থশূন্য শব্দসমষ্টি; আর হাজার হাজার বৎসর যাবৎ এই জাতি ক্রমাগত যে ত্যাগ-বৈরাগ্য অভ্যাস করিয়া আসিতেছে, সেগুলি বৃথা; তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের যুবকগণকে এই প্রশ্ন চঞ্চল করিয়া তুলিলঃ তবে কি এতদিন পর্যন্ত এই জাতির জীবন যে-আদর্শে গঠিত হইয়াছে, তাহার সার্থকতা একেবারেই নাই? তবে কি আবার এই জাতিকে পাশ্চাত্য ধারায় নূতনভাবে জীবন গঠন করিতে হইবে? তবে কি প্রাচীন পুঁথি-পত্র ছিঁড়িয়া ফেলিতে হইবে, দর্শনশাস্ত্রগুলি পুড়াইয়া ফেলিতে হইবে, ধর্মাচার্যগণকে তাড়াইয়া দিতে হইবে, মন্দিরগুলি ভাঙিয়া ফেলিতে হইবে?
তরবারি ও বন্দুকের সাহায্যে নিজ নিজ ধর্মের সত্যতা প্রমাণ করিতে সমর্থ বিজেতা পাশ্চাত্য জাতিগুলি কি বলে নাই, তোমাদের পুরাতন যাহা কিছু আছে, সবই কুসংস্কারময়—সবই পৌত্তলিকতা? পাশ্চাত্য ভাবে পরিচালিত নূতন বিদ্যালয়সমূহে শিক্ষাপ্রাপ্ত বালকগণ অতি বাল্যকাল হইতেই এই সকল ভাবে অভ্যস্ত হইল, সুতরাং তাহাদের ভিতর যে সন্দেহের আবির্ভাব হইবে, ইহা কিছু আশ্চর্যের বিষয় নহে। কিন্তু কুসংস্কার ত্যাগ করিয়া প্রকৃতভাবে সত্যানুসন্ধানে তাহার ব্রতী হইল না; তাহার পরিবর্তে পাশ্চাত্য যাহা বলে, তাহাই সত্য বলিয়া ধরিয়া লইল—পাশ্চাত্য ভাবই সত্যের মাপকাঠি হইয়া দাঁড়াইল! পুরোহিতকুলের উচ্ছেদসাধন করিতে হইবে, বেদরাশি পুড়াইয়া ফেলিতে হইবে, কারণ পাশ্চাত্য এ কথা বলিতেছে! এইরূপ সন্দেহ ও অস্থিরতার ভাব হইতেই ভারতে তথাকথিত সংস্কারের তরঙ্গ উঠিল।
যদি তুমি ঠিক ঠিক সংস্কারক হইতে চাও, তবে তোমার তিনটি জিনিষ থাকা চাই—প্রথমতঃ হৃদয়বত্তা। তোমার ভ্রাতাদের জন্য যথার্থই কি তোমার প্রাণ কাঁদিয়াছে? পৃথিবীতে এত দুঃখ-কষ্ট, এত অজ্ঞান, এত কুসংস্কার রহিয়াছে—ইহা কি তুমি যথার্থই প্রাণে প্রাণে অনুভব কর? সকল মানুষকে ভাই বলিয়া কি তুমি যথার্থই অনুভব কর? তোমার সমগ্র সত্তাই কি এই ভাবে পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে? এই ভাব কি তোমার রক্তের স্রোতে মিশিয়া গিয়াছে, তোমার শিরায় শিরায় প্রবাহিত হইতেছে? এই ভাব কি তোমার প্রত্যেক স্নায়ুর ভিতর ঝঙ্কার তুলিতেছে? তুমি কি সহানুভূতির ভাবে পূর্ণ হইয়াছ? যদি তাহা হইয়া থাকে, তবে বুঝিতে হইবে, তুমি প্রথম সোপানে মাত্র পদার্পণ করিয়াছ। তারপর ভাবিতে হইবেঃ প্রতিকারের কোন পন্থা খুঁজিয়া পাইয়াছ কিনা? তোমরা যে চীৎকার করিয়া সকলকে সবই ভাঙিয়া-চুরিয়া ফেলিতে বলিতেছ, তোমরা নিজেরা কি কোন পথ পাইয়াছ? হইতে পারে প্রাচীন ভাবগুলি কুসংস্কারপূর্ণ, কিন্তু ঐ-সকল কুসংস্কারের সঙ্গে অমূল্য সত্য মিশ্রিত রহিয়াছে, নানাবিধ খাদের সহিত স্বর্ণখণ্ডও রহিয়াছে। এমন কোন উপায় আবিষ্কার করিয়াছ কি, যাহাতে খাদ বাদ দিয়া খাঁটি সোনাটুকু মাত্র লওয়া যাইতে পারে? যদি তাহাও করিয়া থাক, তবে বুঝিতে হইবে, তুমি দ্বিতীয় সোপানে মাত্র পদার্পণ করিয়াছ। আরও একটি জিনিষের প্রয়োজন—প্রাণপণ অধ্যবসায়। তুমি যে কল্যাণ করিতে যাইতেছ, বল দেখি, তোমার আসল অভিসন্ধিটা কি? নিশ্চিতরূপে কি বলিতে পার যে, তোমার এই কল্যাণেচ্ছার পশ্চাতে অর্থ মান যশ বা প্রভুত্বের বাসনা নাই? তুমি কি নিশ্চিতরূপে বলিতে পার, যদি সমগ্র জগৎ তোমাকে পিষিয়া ফেলিবার চেষ্টা করে, তথাপি তোমার আদর্শকে দৃঢ়ভাবে ধরিয়া কাজ করিয়া যাইতে পারিবে? তুমি কি নিশ্চিতরূপে বলিতে পার, তুমি যাহা চাও তাহা জান, আর তোমার জীবন পর্যন্ত বিপন্ন হইলেও তোমার কর্তব্য—সেই কর্তব্যই সাধন করিয়া যাইতে পারিবে? তুমি কি নিশ্চিতরূপে বলিতে পার, যতদিন জীবন থাকিবে, যতদিন হৃদয়ের গতি সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ না হইবে, ততদিন অধ্যবসায়ের সহিত উদ্দেশ্য সাধনে লাগিয়া থাকিবে? এই ত্রিবিধ গুণ যদি তোমার থাকে, তবেই তুমি প্রকৃত সংস্কারক, তবেই তুমি যথার্থ আচার্য ও গুরু, তবেই তুমি আমাদের নমস্য। যদি তোমার এই গুণগুলি না থাকে, তবে তুমি আমাদের শ্রদ্ধার যোগ্য নও। কিন্তু মানুষ বড়ই দুর্বল, বড়ই সংকীর্ণদৃষ্টি। অপেক্ষা করিয়া থাকিবার ধৈর্য তাহার নাই, প্রকৃত দর্শনের শক্তি তাহার নাই—সে এখনই ফল দেখিতে চায়। ইহার কারণ কি? কারণ এই যে, সে নিজেই ফল ভোগ করিতে চায়, প্রকৃতপক্ষে অপরের জন্য তাহার বড় ভাবনা নাই। সে কর্তব্যের জন্য কর্তব্য করিতে চাহে না। ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ বলিয়াছেনঃ কর্মেই তোমাদের অধিকার আছে, ফলে কখনও নয়।
ফল কামনা কর কেন? আমাদের কেবল কর্তব্য করিয়া যাইতে হইবে। ফল যাহা হইবার হইতে দাও। কিন্তু মানুষের সহিষ্ণুতা নাই—ঐরূপ অসহিষ্ণুতার জন্য শীঘ্র শীঘ্র ফলভোগের আকাঙ্ক্ষায় সে যে কোন একটা মতলব লইয়া তাহাতেই লাগিয়া যায়। জগতের অধিকাংশ ভাবী সংস্কারককেই এই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করিতে পারা যায়।
পূর্বেই বলিয়াছি, ভারতে এই সংস্কারের ভাব আসিল। কিছুকালের জন্য বোধ হইল, যে জড়বাদ ও ‘অহং’-সর্বস্বতার তরঙ্গ ভারতের উপকূলে প্রবলবেগে আঘাত করিতেছে, তাহা আমাদের পূর্বপুরুষগণের নিকট হইতে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত হৃদয়ের প্রভূত সরলতা, ঈশ্বরলাভের জন্য হৃদয়ের তীব্র ব্যাকুলতা প্রভৃতি সবই ভাসাইয়া লইয়া যাইবে। মুহূর্তের জন্য বোধ হইল, যেন সমগ্র জাতির অদৃষ্টে বিধাতা একেবারে ধ্বংস লিখিয়াছেন। কিন্তু এই জাতি এরূপ সহস্র বিপ্লব-তরঙ্গের আঘাত সহ্য করিয়া আসিয়াছে। সেগুলির তুলনায় এ তরঙ্গের বেগ তো অতি সামান্য। শত শত বর্ষ ধরিয়া তরঙ্গের পর তরঙ্গ আসিয়া এই দেশকে বন্যায় ভাসাইয়া দিয়াছে, সম্মুখে যাহা পাইয়াছে তাহাই ভাঙিয়া-চুরিয়া দিয়াছে; তরবারি ঝলসিত হইয়াছে; ‘আল্লার জয়’-রবে ভারত-গগন বিদীর্ণ হইয়াছে। কিন্তু পরে যখন বিপ্লবের বন্যা থামিল, দেখা গেল জাতীয় আদর্শ অপরিবর্তিত রহিয়া গিয়াছে।
ভারতীয় জাতি নষ্ট হইবার নহে। মৃত্যুকে উপহাস করিয়া ভারতবাসী নিজ মহিমায় বিরাজিত রহিয়াছে, এবং যতদিন ভারতের জাতীয় ভিত্তিস্বরূপ ধর্মভাব অক্ষুণ্ণ থাকিবে, যতদিন ভারতের লোক ধর্মকে ছাড়িয়া বিষয়সুখে উন্মত্ত না হইবে, যতদিন ভারতবাসীরা ঈশ্বরকে পরিত্যাগ না করিবে, ততদিন তাহারা এরূপই থাকিবে। হয়তো তাহারা চিরকাল ভিক্ষু ও দরিদ্র থাকিবে, ধূলি ও মলিনতার মধ্যে হয়তো তাহাদিগকে চিরদিন থাকিতে হইবে, কিন্তু তাহারা যেন তাহাদের ঈশ্বরকে পরিত্যাগ না করে; তাহারা যে ঋষির বংশধর, এ কথা যেন তাহারা ভুলিয়া না যায়। যেমন পাশ্চাত্য দেশে একটি মুটে-মজুর পর্যন্ত মধ্যযুগের কোন দস্যু-‘ব্যারনে’র বংশধররূপে আপনাকে প্রতিপন্ন করিতে চেষ্টা করে, ভারতে তেমনি সিংহাসনারূঢ় সম্রাট্ পর্যন্ত অরণ্যবাসী বল্কলপরিহিত অরণ্যফলমূলভোজী ব্রহ্মধ্যানপরায়ণ অকিঞ্চন ঋষিগণের বংশধররূপে নিজেকে প্রমাণ করিতে চেষ্টা করেন। আমরা এইরূপ ঋষিগণেরই বংশধর বলিয়া পরিচিত হইতে চাই; আর যতদিন পুণ্যচরিত্রের উপর এইরূপ গভীর শ্রদ্ধা থাকিবে, ততদিন ভারতের বিনাশ নাই।
ভারতের চারিদিকে যখন এইরূপ নানাবিধ সংস্কারের চেষ্টা চলিতেছিল, সেই সময় ১৮৩৬ খ্রীষ্টাব্দের ১৭ ফেব্রুআরী, বঙ্গদেশের কোনও সুদূর পল্লীগ্রামে দরিদ্র ব্রাহ্মণকুলে একটি শিশুর জন্ম হয়। তাঁহার পিতামাতা অতি নিষ্ঠাবান্ প্রাচীনপন্থী লোক ছিলেন। এরূপ ব্রাহ্মণের জীবন নিত্য ত্যাগ ও তপস্যায় পূর্ণ। জীবিকানির্বাহের জন্য তাঁহার পক্ষে অল্প কয়েকটি পথই উন্মুক্ত, তাহার উপর আবার নিষ্ঠাবান্ ব্রাহ্মণের পক্ষে যে-কোন বিষয়কর্ম নিষিদ্ধ। আবার যথেচ্ছভাবে কাহারও নিকট হইতে কিছু গ্রহণ করিবার যো নাই। কল্পনা করিয়া দেখ—এরূপ জীবন কি কঠোর! ব্রাহ্মণদের কথা ও তাহাদের পৌরোহিত্য-ব্যবসায়ের কথা তোমরা অনেক শুনিয়াছ। কিন্তু জিজ্ঞাসা করি, তোমাদের কয়জন ভাবিয়া দেখিয়াছ—এই অদ্ভুত মানুষগুলি কিভাবে তাহাদের প্রতিবেশিগণের উপর এরূপ প্রভাব বিস্তার করিল? দেশের সকল জাতির মধ্যে তাহারা দরিদ্রতম, ত্যাগই তাহাদের শক্তির রহস্য। তাহারা কখনও ধনের আকাঙ্ক্ষা করে নাই। জগতের মধ্যে তাহারাই সর্বাপেক্ষা দরিদ্র পুরোহিত, সেইজন্যই তাহারা সর্বাপেক্ষা শক্তিমান্। তাহারা নিজেরা এরূপ দরিদ্র বটে, তথাপি দেখিবে—যদি গ্রামে কোন দরিদ্র ব্যক্তি আসিয়া উপস্থিত হয়, ব্রাহ্মণপত্নী তাহাকে গ্রাম হইতে কখনও অভুক্ত চলিয়া যাইতে দিবে না। ইহাই ভারতীয় মাতার সর্বপ্রথম কর্তব্য; যেহেতু তিনি মাতা, সেইজন্য তাঁহার কর্তব্য সকলকে খাওয়াইয়া সর্বশেষে নিজে খাওয়া। প্রথমে তাঁহাকে দেখিতে হইবে—সকলে খাইয়া পরিতৃপ্ত হইয়াছে, তবেই তিনি খাইতে পাইবেন; সেই জন্যই ভারতে জননীকে সাক্ষাৎ ভগবতী বলা হয়। আমরা যাঁহার জীবনী আলোচনায় প্রবৃত্ত হইয়াছি, তাঁহার মাতা এইরূপ আদর্শ হিন্দু জননী ছিলেন। ভারতে যে জাতি যত উচ্চ, তাহার বিধিনিষেধও তত বেশী। খুব নীচ জাতি যাহা খুশী খাইতে পারে, কিন্তু তদপেক্ষা উচ্চতর জাতিসমূহে আহারে বিধিনিষেধ দেখা যায়; আর উচ্চতম জাতি, ভারতের বংশানুক্রমিক পুরোহিত জাতি, ব্রাহ্মণের জীবনে—পূর্বেই বলিয়াছি—খুব বেশী আচারনিষ্ঠা। পাশ্চাত্য দেশের আচার ব্যবহারের তুলনায় এই ব্রাহ্মণদের জীবন বিরামহীন তপস্যায় পূর্ণ, কিন্তু তাহাদের খুব স্থৈর্য আছে। তাহারা কোন একটা ভাব পাইলে তাহার চূড়ান্ত না করিয়া ছাড়ে না, আর বংশানুক্রমে সে-ভাব পোষণ করিয়া কার্যে পরিণত করে। একবার তাহাদিগকে কোন একটা ভাব দাও, সহজে তাহা অপসারিত করিতে পারিবে না; তবে তাহাদিগকে কোন নূতন ভাব দেওয়া বড় কঠিন।
নিষ্ঠাবান্ হিন্দুরা এই কারণে অতিশয় স্বাতন্ত্র্যপ্রিয়, তাহারা সম্পূর্ণরূপে নিজেদের চিন্তা ও ভাবের রাজ্যে বাস করে। কিরূপে জীবনযাপন করিতে হইবে, তাহা আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বর্ণিত আছে; তাহারা সেই-সকল বিধি-নিষেধের সামান্য খুঁটিনাটি পর্যন্ত দৃঢ়ভাবে আঁকড়াইয়া থাকে। তাহারা বরং উপবাস করিয়া থাকিবে, তথাপি তাহাদের স্বজাতির ক্ষুদ্র গণ্ডীর বহির্ভূত কোন ব্যক্তির হাতে খাইবে না। এইরূপ স্বাতন্ত্র্য-প্রিয় হইলেও তাহাদের ঐকান্তিক ও অসাধারণ নিষ্ঠা আছে। নিষ্ঠাবান্ হিন্দুদের ভিতর অনেক সময় এইরূপ প্রবল বিশ্বাস ও ধর্মভাব দেখা যায়, কারণ সত্যের প্রতি গভীর বিশ্বাস হইতেই তাহাদের নিষ্ঠা আসিয়াছে। তাহারা এরূপ অধ্যবসায়ের সহিত লাগিয়া থাকে যে, আমরা সকলে হয়তো তাহা ঠিক বলিয়া মনে না-ও করিতে পারি, কিন্তু তাহাদের মতে তাহা সত্য। আমাদের শাস্ত্রে লিখিত আছে, মানুষ সর্বদা দানশীল হইবে—এমন কি চরমভাবেও। যদি কোন ব্যক্তি অপরকে সাহায্য করিতে—সেই ব্যক্তির জীবন রক্ষা করিতে গিয়া নিজে অনশনে প্রাণত্যাগ করে, শাস্ত্র বলেন, ইহা অন্যায় নহে, বরং ইহাই মানুষের কর্তব্য। বিশেষতঃ ব্রাহ্মণের পক্ষে নিজের মৃত্যুভয় না রাখিয়া সম্পূর্ণভাবে দানব্রতের অনুষ্ঠান করা কর্তব্য। যাঁহারা ভারতীয় সাহিত্যের সহিত পরিচিত, তাঁহারা এইরূপ চূড়ান্ত দানশীলতার দৃষ্টান্তস্বরূপ একটি প্রাচীন সুন্দর উপাখ্যানের কথা স্মরণ করিতে পারেন। মহাভারতে লিখিত আছে, এক অতিথিকে ভোজন করাইতে গিয়া কিরূপে একটি সমগ্র পরিবার অনশনে প্রাণ দিয়াছিল। ইহা অতিরঞ্জিত নহে, কারণ এখনও এরূপ ব্যাপার ঘটিতে দেখা যায়। মদীয় আচার্যদেবের পিতামাতার চরিত্র এই আদর্শে গঠিত ছিল। তাঁহারা খুব দরিদ্র ছিলেন, কিন্তু অনেক সময় কোন দরিদ্র অথিতিকে খাওয়াইতে গিয়া মাতা সারাদিন উপবাস করিয়া থাকিতেন।
এইরূপ পিতামাতার কোলে এই শিশু জন্মগ্রহণ করেন—আর জন্ম হইতেই তাঁহার মধ্যে একটু বিশেষত্ব, একটু অসাধারণত্ব ছিল। জন্মাবধিই তাঁহার পূর্ববৃত্তান্ত স্মরণ হইত—কি কারণে তিনি জগতে আসিয়াছেন, তাহা জানিতেন, আর সেই উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য সমুদয় শক্তি নিয়োগ করেন। অল্প বয়েসেই তাঁহার পিতৃবিয়োগ হইলে তিনি পাঠশালায় প্রেরিত হন।
ব্রাহ্মণ সন্তানকে পাঠশালায় যাইতেই হয়। লেখাপড়ার কাজ ছাড়া ব্রহ্মণের অন্য কাজে অধিকার নাই। এখনও দেশের অনেক স্থানে প্রচলিত, বিশেষতঃ সন্ন্যাসীদের সহিত সম্পর্কিত ভারতের প্রাচীন শিক্ষাপদ্ধতি আধুনিক প্রণালী হইতে খুবই ভিন্ন রকমের। সেই শিক্ষাপ্রণালীতে ছাত্রদের বেতন দিতে হইত না। প্রাচীন ধারণা ছিল—জ্ঞান এত পবিত্র বস্তু যে, ইহা বিক্রয় করা উচিত নয়। কোন মূল্য না লইয়া অবাধে জ্ঞানবিতরণ করিতে হইবে। আচার্যেরা ছাত্রগণকে বিনা বেতনে নিজেদের নিকট রাখিতেন; আর শুধু তাহাই নহে, তাঁহাদের মধ্যে অনেকে ছাত্রগণকে খাওয়া-পরাও দিতেন। এই সকল আচার্যের ব্যয়নির্বাহের জন্য ধনী পরিবারের লোকেরা বিবাহ-শ্রাদ্ধাদি উপলক্ষ্যে তাঁহাদিগকে দান করিতেন। বিশেষ বিশেষ দানের অধিকারী বলিয়া তাঁহারা বিবেচিত হইতেন এবং আচার্যদিগকেও ছাত্রদের প্রতিপালন করিতে হইত। যে বালকের কথা আমি বলিতেছি, তাঁহার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা একজন পণ্ডিত ছিলেন। বালক জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার নিকট পাঠ আরম্ভ করিলেন। অল্পদিন পরে বালকের দৃঢ় ধারণা হইল যে, সকল লৌকিক বিদ্যার উদ্দেশ্য শুধু পার্থিব উন্নতি। সুতরাং লেখাপড়া ছাড়িয়া তিনি আধ্যাত্মিক জ্ঞানন্বেষণে সম্পূর্ণভাবে জীবন উৎসর্গ করিতে সংকল্প করিলেন। তাঁহার পিতার মৃত্যুর পর সংসারে প্রবল দারিদ্র্য দেখা দিল; বালককে নিজের আহারের সংস্থানের চেষ্টা করিতে হইল। তিনি কলিকাতার নিকট এক স্থানে একটি মন্দিরে পুরোহিত নিযুক্ত হইলেন। মন্দিরে পৌরোহিত্য-কর্ম ব্রাহ্মণের পক্ষে বড় নিন্দনীয় বলিয়া বিবেচিত হয়। তোমরা যে অর্থে ‘চার্চ’ শব্দ ব্যবহার কর, আমাদের মন্দির সেরূপ নহে। মন্দিরগুলি সাধারণ উপাসনার স্থান নহে, কারণ ভারতে সমবেত উপাসনা বলিয়া কিছু নাই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধনী ব্যক্তিরা পুণ্যসঞ্চয়ের জন্য মন্দির নির্মাণ করিয়া দেন।
বিষয় সম্পত্তি যাঁহার বেশী আছে, তিনি এইরূপ মন্দির করিয়া দেন। মন্দিরে তিনি ঈশ্বরের কোন প্রতীক বা ঈশ্বরাবতারের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন এবং ভগবানের নামে পূজার জন্য তাহা উৎসর্গ করেন। রোমান ক্যাথলিক চার্চে যেরূপ অর্চনা (Mass) হইয়া থাকে, এই সকল মন্দিরে কতকটা সেইভাবে পূজা হয়—শাস্ত্র হইতে মন্ত্র-শ্লোকাদি পাঠ করা হয়, প্রতিমার সম্মুখে আলো ঘুরানো হয়; মোট কথা, আমরা একজন মহৎ ব্যক্তিকে যেভাবে সম্মান করি, প্রতিমার প্রতি ঠিক সেইরকম আচরণ করা হয়। মন্দিরে এই অনুষ্ঠানগুলিই হয়। যে ব্যক্তি কখনও মন্দিরে যায় না, তাহার অপেক্ষা যে মন্দিরে যায়, মন্দিরে যাওয়ার দরুন সে মহত্তর বলিয়া বিবেচিত হয় না। বরং যে কখনও মন্দিরে যায় না, সে-ই অধিকতর ধার্মিক বলিয়া বিবেচিত হয়, কারণ ভারতে ধর্ম প্রত্যেক ব্যক্তির নিজস্ব, আর লোকে নিজগৃহে নির্জনেই আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় উপাসনাদি নির্বাহ করিয়া থাকে। আমাদের দেশে অতি প্রাচীনকাল হইতে মন্দিরে পৌরোহিত্য নিন্দনীয় কার্য বলিয়া পরিগণিত হইয়াছে। ইহার তাৎপর্য এই যে, অর্থবিনিময়ে বিদ্যাদানই যখন নিন্দার্হ বলিয়া পরিগণিত হয়, তখন ধর্ম সম্বন্ধে যে ইহা আরও অধিক প্রযোজ্য, বলাই বাহুল্য। মন্দিরের পুরোহিত যখন বেতন লইয়া কার্য করে, তখন বলিতে হইবে, সে এই ধর্মগত বিষয় লইয়া ব্যবসায় করিতেছে। অতএব যখন দারিদ্র্যের তাড়নায় বাধ্য হইয়া এই বালককে জীবিকার একমাত্র উপায়রূপে মন্দিরে পুরোহিতের কর্ম অবলম্বন করিতে হইল, তখন তাঁহার মনের ভাব কিরূপ হইয়াছিল, তাহা কল্পনা করিয়া দেখ।
বাঙলাদেশে অনেক কবি জন্মিয়াছিলেন, তাঁহাদের রচিত সঙ্গীতসমূহ সাধারণ লোকের মধ্যে খুব প্রচলিত। কলিকাতার রাস্তায় এবং পল্লীগ্রামগুলিতে সেই-সকল গান গীত হইয়া থাকে। ইহাদের মধ্যে অধিকাংশই ধর্মসঙ্গীত এবং সেগুলির সারমর্ম এই যে, ধর্মকে সাক্ষাৎ অনুভব করিতে হইবে। এই ভাবটি সম্ভবতঃ ভারতীয় ধর্মসমূহের বিশেষত্ব। ভারতে ধর্ম সম্বন্ধে এমন কোন গ্রন্থ নাই, যাহাতে এই ভাবটি নাই। ঈশ্বরকে সাক্ষাৎ করিতে হইবে, তাঁহাকে প্রত্যক্ষ অনুভব করিতে হইবে, তাঁহাকে দেখিতে হইবে তাঁহার সহিত কথা কহিতে হইবে—ইহাই ধর্ম। অনেক সাধুপুরুষের ঈশ্বরদর্শন-কাহিনী ভারতে সর্বত্র শুনিতে পাওয়া যায়। এইরূপ বিশ্বাস তাঁহাদের ধর্মের ভিত্তি। ভারতের আবহাওয়া সাধুসন্তদের ঈশ্বরদর্শনের কাহিনীতে পরিপূর্ণ। বুদ্ধিবৃত্তির উন্নতির জন্য ঐ গ্রন্থগুলি লিখিত হয় নাই, কোনরূপ যুক্তি দ্বারা ইহাদিগকে বুঝিবার উপায় নাই, কারণ তাঁহারা নিজেরা যাহা দেখিয়াছেন, তাহাই লিখিয়া গিয়াছেন; যাঁহারা নিজদিগকে ঐরূপ উচ্চভাবাপন্ন করিয়াছেন, তাঁহারাই কেবল ঐ-সকল তত্ত্ব বুঝিতে পারিবেন। তাঁহারা বলেন, ইহজীবনেই এরূপ প্রত্যক্ষানুভূতি সম্ভব, আর সকলেরই ইহা হইতে পারে। মানবের এই শক্তি বিকশিত হইলেই ধর্মের আরম্ভ। ইহাই সকল ধর্মের সার কথা।
এইজন্যই দেখিতে পাই, একজনের খুব ভাল বক্তৃতা দিবার শক্তি আছে, তাঁহার যুক্তিসমূহ অকাট্য, এবং তিনি খুব উচ্চ উচ্চ ভাব প্রচার করিতেছেন, তথাপি তাঁহার কথা কেহ শুনে না; আর একজন অতি সামান্য ব্যক্তি, নিজের মাতৃভাষাই হয়তো ভাল করিয়া জানেন না, কিন্তু তাঁহার জীবদ্দশায় দেশের অর্ধেক লোক তাঁহাকে ঈশ্বর বলিয়া পূজা করিতেছে। ভারতে এরূপ হয়, যখন লোকে কোনরূপে জানিতে পারে কাহারও এইরূপ প্রত্যক্ষানুভূতি হইয়াছে, ধর্ম তাঁহার পক্ষে আর অনুমানের বিষয় নয়—ধর্ম, আত্মার অমরত্ব, ঈশ্বর প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লইয়া তিনি আর অন্ধকারে হাতড়াইতেছেন না, তখন চারিদিক হইতে লোক তাঁহাকে দেখিতে আসে এবং ক্রমে তাঁহাকে পূজা করিতে আরম্ভ করে।৩৪
পূর্বকথিত মন্দিরে আনন্দময়ী জগন্মাতার একটি মূর্তি ছিল। এই বালককে প্রত্যহ প্রাতে ও সায়াহ্নে তাঁহার পূজা করিতে হইত। পূজা করিতে করিতে এই ভাব আসিয়া তাঁহার মন অধিকার করিলঃ এই মূর্তির ভিতর সত্যই কিছু আছে কি? সত্যিই কি জগতে আনন্দময়ী মা বলিয়া কেহ আছেন? তিনি কি সত্য সত্যই চৈতন্যময়ী এবং এই বিশ্বের নিয়ন্ত্রী? অথবা এ সব কি স্বপ্নবৎ মিথ্যা? ধর্মের মধ্যে কিছু সত্য আছে কি?
তিনি শুনিয়াছিলেন, অতীতকালে অনেক বড় বড় সাধু মহাপুরুষ এইরূপে ভগবান্ লাভের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াছেন এবং অবশেষে তাঁহার উদ্দেশ্য সফলও হইয়াছে। তিনি শুনিয়াছিলেন, ভারতের সকল ধর্মের একমাত্র লক্ষ্য—এই জগন্মাতার সাক্ষাৎ উপলব্ধি। তাঁহার সমুদয় মন প্রাণ যেন সেই একভাবে তন্ময় হইয়া গেল। কিরূপে তিনি জগন্মাতাকে লাভ করিবেন, এই এক চিন্তাই তাঁহার মনে প্রবল হইতে লাগিল। ক্রমশঃ তাঁহার এই ভাব বাড়িতে লাগিল। শেষে তিনি ‘কিরূপে মায়ের দর্শন পাইব’—ইহা ছাড়া আর কিছু বলিতে বা শুনিতে পারিতেন না।
সকল হিন্দু বালকের মনেই এই সংশয় আসিয়া থাকে। এই সংশয়ই আমাদের দেশের বিশেষত্বঃ আমরা যাহা করিতেছি, তাহা কি সত্য? কেবল মতবাদে আমাদের তৃপ্তি হইবে না। অথচ ঈশ্বর সম্বন্ধে যত মতবাদ এ পর্যন্ত প্রচারিত হইয়াছে, সেগুলি সবই ভারতে আছে। শাস্ত্র বা মতবাদ আমাদিগকে তৃপ্ত করিতে পারে না। আমাদের দেশের সহস্র সহস্র ব্যক্তির মনে এইরূপ প্রত্যক্ষানুভূতির আকাঙ্ক্ষা জাগিয়া থাকেঃ এ-কথা কি সত্য যে, ঈশ্বর বলিয়া কেহ আছেন? যদি থাকেন, তবে আমি কি তাঁহার দর্শন পাইতে পারি? আমি কি সত্য উপলব্ধি করিতে সমর্থ? পাশ্চাত্য জাতি এগুলিকে কেবল কল্পনা মনে করিতে পারে, কিন্তু আমাদের পক্ষে ইহাই বিশেষ কাজের কথা। এই ভাব আশ্রয় করিয়া লোক নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে। এই ভাবের জন্য প্রতি বৎসর সহস্র সহস্র হিন্দু গৃহত্যাগ করে এবং কঠোর তপস্যা করিবার ফলে অনেকে মরিয়া যায়। পাশ্চাত্য জাতির মনে ইহা খুবই কাল্পনিক বলিয়া বোধ হইবে; তাহারা যে কেন এইরূপ মত প্রকাশ করে, তাহারও কারণ আমি অনায়াসে বুঝিতে পারি। তবু পাশ্চাত্য দেশে অনেকদিন বসবাস করা সত্ত্বেও আমি এই প্রাচ্য ভাবকেই জীবনে সর্বাপেক্ষা সত্য—বাস্তব বলিয়া মনে করি।
জীবনটা তো মুহূর্তের জন্য—তা তুমি রাস্তার মুটেই হও, আর লক্ষ লক্ষ লোকের শাসক সম্রাটই হও। জীবন তো ক্ষণভঙ্গুর—তা তোমার স্বাস্থ্য খুব ভালই হউক, অথবা খুব মন্দই হউক। হিন্দু বলেন, এ জীবন-সমস্যার একমাত্র সমাধান—ঈশ্বরলাভ। ধর্মলাভই এই সমস্যার একমাত্র সমাধান। যদি ঈশ্বর ও ধর্ম সত্য হয়, তবেই জীবন-রহস্যের ব্যাখ্যা হয়, জীবনভার দুর্বহ হয় না, জীবনটা উপভোগ্য হয়। তাহা না হইলে জীবন একটা বৃথা ভারমাত্র। ইহাই আমাদের ধারণা; শত শত যুক্তি দ্বারা ধর্ম ও ঈশ্বরকে প্রমাণ করা যায় না। যুক্তিবলে ধর্ম ও ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্ভব বলিয়া প্রমাণিত হইতে পারে, কিন্তু ঐখানেই শেষ। সত্যকে সাক্ষাৎ উপলব্ধি করিতে হইবে, আর ধর্মের প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাইতে গেলে অনুভূতি আবশ্যক। ঈশ্বর আছেন, এইটি নিশ্চয় করিয়া বুঝিতে হইলে ঈশ্বরকে অনুভব করিতে হইবে। সাক্ষাৎ উপলব্ধি ব্যতীত অন্য কোন উপায়ে আমাদের নিকট ধর্মের সত্যতা প্রমাণিত হইতে পারে না।
বালকের হৃদয়ে যখন এই ধারণা প্রবেশ করিল, তখন তাঁহার সারাদিন কেবল ঐ এক ভাবনা—কিসে প্রত্যক্ষ দর্শন হইবে। দিনের পর দিন তিনি কাঁদিয়া বলিতেন—‘মা, সত্যই কি তুমি আছ, না এ সব কল্পনা মাত্র? কবিগণ ও ভ্রান্ত ব্যক্তিগণই কি এই আনন্দময়ী জননীর কল্পনা করিয়াছেন অথবা সত্যই কিছু আছে?’ আমরা পূর্বেই বলিয়াছি, আমরা—যে অর্থে শিক্ষা-শব্দ ব্যবহার করি, সেরূপ শিক্ষা তাঁহার কিছুই ছিল না; ইহাতে বরং ভালই হইয়াছিল। অপরের ভাব—অপরের চিন্তার অনুগামী হইয়া তাঁহার মনের স্বাভাবিকতা, মনের স্বাস্থ্য নষ্ট হইয়া যায় নাই। তাঁহার মনের এই প্রধান চিন্তাটি দিন দিন বাড়িতে লাগিল, শেষে এমন হইল যে, তিনি আর কিছু ভাবিতে পারিতেন না। নিয়মিতরূপে পূজা করা, সব খুঁটিনাটি নিয়ম পালন করা—তখন তাঁহার পক্ষে অসম্ভব হইয়া পড়িল। সময়ে সময়ে তিনি দেবতাকে ভোগ দিতে ভুলিয়া যাইতেন, কখনও কখনও আরতি করিতে ভুলিতেন, আবার কখনও সব ভুলিয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা আরতি করিতেন। লোকমুখে ও শাস্ত্রমুখে তিনি শুনিয়াছিলেন, যাহারা ব্যাকুলভাবে ভগবানকে চায়, তাহারাই তাঁহাকে পাইয়া থাকে। এক্ষণে ভগবানকে লাভ করিবার জন্য তাঁহার সেই প্রবল আগ্রহ দেখা দিল। অবশেষে তাঁহার পক্ষে মন্দিরের নিয়মিত পূজা করা অসম্ভব হইয়া পড়িল। তিনি পূজা পরিত্যাগ করিয়া মন্দিরের পার্শ্ববর্তী পঞ্চবটীতে গিয়া বাস করিতে লাগিলেন। তাঁহার জীবনের এই ভাব সম্বন্ধে তিনি আমাকে অনেকবার বলিয়াছেন, ‘কখন সূর্য উদিত হইল, কখন বা অস্ত গেল, তাহা আমি জানিতে পারিতাম না।’ তিনি নিজের দেহভাব একেবারে ভুলিয়া গেলেন, আহার করিবার কথাও তাঁহার স্মরণ থাকিত না। এই সময়ে তাঁহার এক আত্মীয় তাঁহাকে খুব যত্নপূর্বক সেবাশুশ্রূষা করিতেন, তিনি তাঁহার মুখে জোর করিয়া খাবার দিতেন। অজ্ঞাতসারে ঐ খাদ্য কতকটা উদরস্থ হইত। তিনি উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া বলিতেন, ‘মা, মা, তুই কি সত্যি আছিস, তবে আমায় কেন অজ্ঞানে ফেলে রেখেছিস? সত্য কি, আমাকে তা জানতে দিচ্ছিস না কেন? আমি তোকে সাক্ষাৎ দেখতে পাচ্ছি না কেন? লোকের কথা, শাস্ত্রের কথা, ষড়দর্শন—এ-সব পড়ে শুনে কি হবে মা? এ সবই মিছে। সত্য—যথার্থ সত্য আমি সাক্ষাৎ ভাবে উপলব্ধি করতে চাই। সত্য অনুভব করতে—স্পর্শ করতেই আমি চাই।’
এইভাবে সেই বালকের দিনরাত্রি কাটিত। দিবাবসানে সন্ধ্যায় যখন মন্দিরে আরতির শঙ্খঘণ্টা-ধ্বনি শুনিতে পাইতেন, তাঁহার মন তখন অতিশয় ব্যাকুল হইত; তিনি কাঁদিতে কাঁদিতে বলিতেন, ‘মা, আরও এক দিন বৃথা চলে গেল, তবু তোমার দেখা পেলাম না! এই ক্ষণস্থায়ী জীবনের আর একটা দিন চলে গেল, আমি সত্যকে জানতে পারলাম না!’ হৃদয়ের দারুণ যন্ত্রণায় তিনি কখনও কখনও মাটিতে মুখ ঘর্ষণ করিয়া কাঁদিতেন।
মনুষ্যহৃদয়ে এইরূপ তীব্র ব্যাকুলতা আসিয়া থাকে। শেষ অবস্থায় তিনি আমাকে বলিয়াছিলেন, ‘বৎস, মনে কর, একটা ঘরে এক থলি মোহর রহিয়াছে, আর তার পাশের ঘরে একটা চোর রহিয়াছে, তুমি কি মনে কর সেই চোরের নিদ্রা হইবে? সে নিদ্রা যাইতে পারে না। তাহার মনে ক্রমাগত এই চিন্তার উদয় হইবে যে, কি করিয়া সে ঐ ঘরে ঢুকিয়া মোহরের থলিটি লইবে? তাই যদি হয়, তবে তুমি কি মনে কর, যাহার এই ধারণা দৃঢ় হইয়াছে যে, এই সকল আপাত-প্রতীয়মান বস্তুর পশ্চাতে সত্য রহিয়াছে, ঈশ্বর বলিয়া একজন আছেন, একজন অবিনশ্বর অনন্ত-আনন্দস্বরূপ আছেন, যে আনন্দের সহিত তুলনা করিলে ইন্দ্রিয়-সুখ ছেলেখেলা বলিয়া বোধ হয়, সে কি তাঁহাকে লাভ করিবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা না করিয়া স্থির থাকিতে পারে? এক মুহূর্তের জন্যও কি সে এই চেষ্টা পরিত্যাগ করিবে? তাহা কখনই হইতে পারে না। সে উহা লাভের জন্য উন্মত্ত হইবে।’ এই বালকের হৃদয়ে এই উন্মত্ততা প্রবেশ করিল। সে-সমযে তাঁহার কোন গুরু ছিল না, এমন কেহ ছিল না—যে তাঁহার আকাঙ্ক্ষিত বস্তুর কোন সন্ধান দেয়, বরং সকলেই মনে করিত, তাঁহার মস্তিষ্ক বিকৃত হইয়াছে। সাধারণে তো এইরূপ বলিবেই। যদি কেহ সংসারের অসার বিষয়সমূহ পরিত্যাগ করে, লোক তাহাকে উন্মত্ত বলে, কিন্তু এইরূপ ব্যক্তিই সংসারে যথার্থ শ্রেষ্ঠ। এইরূপ উন্মত্ততা হইতেই জগৎ-আলোড়নকারী শক্তির উদ্ভব হইয়াছে, আর ভবিষ্যতেও এইরূপ উন্মত্ততা হইতেই শক্তি উদ্ভূত হইয়া জগৎকে আলোড়িত করিবে।
দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস সত্যলাভের অবিশ্রান্ত চেষ্টা চলিল। তখন তাঁহার নানাবিধ অলৌকিক ও অদ্ভুত দর্শন হইতে লাগিল, নিজ স্বরূপের রহস্য তাঁহার নিকট ক্রমশঃ উদ্ঘাটিত হইতে লাগিল, যেন আবরণের পর আবরণ অপসারিত হইতে লাগিল। জগন্মাতা নিজেই গুরু হইয়া বালককে আকাঙ্ক্ষিত সত্যলাভের সাধনায় দীক্ষিত করিলেন। এই সময়ে সেই স্থানে এক পরমাসুন্দরী অনুপম বিদুষী আসিলেন। পরবর্তী সময়ে এই মহাত্মা বলিলেন যে, বিদুষী বলিলে তাঁহাকে ছোট করা হয়—তিনি ছিলেন মূর্তিমতী বিদ্যা, যেন সাক্ষাৎ সরস্বতী মূর্তি ধারণ করিয়া আসিয়াছেন। এই মহিলার বিষয় আলোচনা করিলেও তোমরা ভারতীয়দের বিশেষত্ব কোথায় বুঝিতে পারিবে। সাধারণতঃ হিন্দুনারীগণ যেরূপ অজ্ঞানান্ধকারে বাস করেন—পাশ্চাত্যদেশে যাহাকে স্বাধীনতার অভাব বলে—তাঁহার মধ্যেও এইরূপ উচ্চ আধ্যাত্মিকভাবাপন্ন নারীর জন্ম সম্ভব হইয়াছিল। তিনি একজন সন্ন্যাসিনী ছিলেন—কারণ ভারতে নরনারীগণও বিবাহ না করিয়া, সংসারত্যাগ করিয়া ঈশ্বরোপাসনায় জীবন সমর্পণ করেন। এই মন্দিরে আসিয়াই তিনি যেমন শুনিলেন যে, একটি বালক দিনরাত ঈশ্বরের নামে অশ্রু বিসর্জন করিতেছে আর লোকে তাঁহাকে পাগল বলে, অমনি তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে চাহিলেন। এই মহিলার নিকটেই বালক প্রথম সাহায্য পাইলেন। মহিলা তৎক্ষণাৎ বালকের হৃদয়ের অবস্থা বুঝিতে পারিয়া বলিলেন, ‘বৎস, তোমার মত উন্মত্ততা যাহার আসিয়াছে, সে ধন্য। সমগ্র বিশ্বই পাগল—কেহ ধনের জন্য, কেহ সুখের জন্য, কেহ নামের জন্য, কেহ বা অন্য কিছুর জন্য। সে-ই ধন্য, যে ঈশ্বরের জন্য পাগল। এইরূপ মানুষ বড়ই দুর্লভ।’ এই মহিলা বালকটির নিকট অনেক বৎসর থাকিয়া তাঁহাকে ভারতের বিভিন্ন ধর্মপ্রণালীর সাধন শিখাইতে লাগিলেন, নানা প্রকার যোগসাধনায় দীক্ষিত করিলেন এবং এই বেগবতী ধর্ম-স্রোতস্বতীর গতিকে যেন পরিচালিত ও প্রণালীবদ্ধ করিলেন।
কিছুদিন পরে সেখানে একজন পরম পণ্ডিত ও দর্শনশাস্ত্রবিৎ সন্ন্যাসী আসিলেন। তিনি ছিলেন অদ্ভুত আদর্শবাদী এবং বিশ্বাস করিতেন, প্রকৃতপক্ষে জগতের কোন অস্তিত্ব নাই; ইহা প্রমাণ করিবার জন্য তিনি গৃহে বাস করিতেন না, রৌদ্র ঝঞ্ঝা বর্ষায় বাহিরে থাকিতেন। তিনি এই সাধককে বেদান্ত-শিক্ষা দিতে আরম্ভ করিলেন, কিন্তু শীঘ্রই দেখিয়া আশ্চর্য হইলেন যে, গুরু অপেক্ষা শিষ্য অনেক বিষয়ে শ্রেষ্ঠ। তিনি কয়েক মাস তাঁহার নিকট থাকিয়া তাঁহাকে সন্ন্যাস-দীক্ষা দিয়া চলিয়া গেলেন। পূর্বোক্ত সাধিকা মহিলা ইতঃপূর্বেই দক্ষিণেশ্বর ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছেন। যখনই বালকের হৃৎপদ্ম প্রস্ফুটিত হইতে আরম্ভ হইল, অমনি তিনি চলিয়া গেলেন। আজ তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে অথবা তিনি এখনও জীবিত আছেন, তাহা কেহই জানে না। তিনি আর ফিরেন নাই।
মন্দিরে পূজারী থাকাকালে আমাদের আলোচ্য মহাপুরুষের অদ্ভুত আচরণ দেখিয়া লোকে স্থির করিয়াছিল, তাঁহার একটু মাথার গোল হইয়াছে। আত্মীয়েরা তাঁহাকে দেশে লইয়া গিয়া অল্পবয়স্কা বালিকার সহিত তাঁহার বিবাহ দিল—মনে করিল, ইহাতেই তাঁহার মনের গতি ফিরিয়া যাইবে, মাথার গোল আর থাকিবে না। কিন্তু আমরা পূর্বেই দেখিয়াছি, তিনি দক্ষিণেশ্বরে ফিরিয়া আসিয়া ভগবানকে লইয়া আরও মাতিয়া গেলেন। অবশ্য তাঁহার যেরূপ বিবাহ হইল, উহাকে ঠিক বিবাহের নাম দেওয়া যায় না। যখন স্ত্রী একটু বড় হয়, তখনই প্রকৃত বিবাহ হইয়া থাকে, আর এই বিবাহের পর স্বামী শ্বশুরালয়ে গিয়া স্ত্রীকে নিজগৃহে লইয়া আসে—ইহাই সামাজিক প্রথা। এ ক্ষেত্রে কিন্তু স্বামী একেবারে ভুলিয়াই গিয়াছিলেন যে, তাঁহার স্ত্রী আছেন। সুদূর পল্লীতে পিত্রালয়ে বালিকাটি শুনিলেন যে, তাঁহার স্বামী ধর্মে মত্ত হইয়া গিয়াছেন, এমন কি অনেকে তাঁহাকে পাগল বলিয়াই মনে করিতেছেন। তিনি স্থির করিলেন, এ কথার সত্যতা জানিতে হইবে—তাই তিনি পল্লী হইতে বাহির হইয়া তাঁহার স্বামী যেখানে আছেন, পদব্রজে সেখানে গেলেন। অবশেষে যখন তিনি স্বামীর সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইলেন, স্বামী তাঁহাকে ত্যাগ করিলেন না। যদিও ভারতে নরনারী যে-কেহ ধর্মজীবন অবলম্বন করে, তাহারই আর কাহারও সহিত কোন বাধ্যবাধকতা থাকে না, তথাপি ইনি স্ত্রীকে ত্যাগ না করিয়া তাঁহার পদতলে পতিত হইয়া বলিলেন, ‘আমি জানিয়াছি, সকল নারীই আমার জননী; তবু এখন তুমি যাহা বলিবে, আমি তাহাই করিতে প্রস্তুত আছি।’
এই বিশুদ্ধস্বভাবা মহীয়সী মহিলা স্বামীর মনোভাব বুঝিতে পারিয়া সহানুভূতি প্রকাশ করিলেন। কালবিলম্ব না করিয়া তিনি বলিলেন, ‘জোর করিয়া আপনাকে সংসারী করিবার ইচ্ছা আমার নাই, আমি কেবল নিকটে থাকিয়া আপনার সেবা করিতে চাই, আপনার নিকট সাধনভজন শিখিতে চাই।’ তিনি স্বামীর একজন প্রধান অনুগতা শিষ্যা হইলেন—তাঁহাকে ঈশ্বরজ্ঞানে ভক্তি-পূজা করিতে লাগিলেন। এইরূপে স্ত্রীর অনুমতি পাইয়া তাঁহার শেষ বাধা অপসারিত হইল এবং তিনি স্বাধীনভাবে নিজ মনোনীত পথে জীবনযাপন করিতে সমর্থ হইলেন।
যাহা হউক, এইরূপে তিনি সাংসারিক বন্ধনমুক্ত হইলেন এবং সাধনাতেও অনেক অগ্রসর হইয়াছিলেন। এক্ষণে প্রথমেই তাঁহার হৃদয়ে এই আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত হইল—কিভাবে তিনি সম্পূর্ণরূপে অভিমান-বিবর্জিত হইবেন, ‘আমি ব্রাহ্মণ, ও শূদ্র’ বলিয়া নিজের যে জাত্যাভিমান আছে, কিরূপে তাহা সমূলে উৎপাটিত করিবেন; কিভাবে তিনি অতি হীনতম জাতির সঙ্গে পর্যন্ত নিজের সমত্ব বোধ করিবেন। আমাদের দেশে যে জাতিভেদ-প্রথা আছে, তাহাতে বিভিন্ন মানবের মধ্যে পদমর্যাদার ভেদ স্থির ও চিরনির্দিষ্ট হইয়া থাকে। জন্মবশেই প্রত্যেক ব্যক্তি বিশেষ সামাজিক মর্যাদা লাভ করে, আর যতদিন না সে কোন গুরুতর অন্যায় কর্ম করে, ততদিন সেই মর্যাদা হইতে বঞ্চিত হয় না। জাতিসমূহের মধ্যে ব্রাহ্মণ সর্বোচ্চ এবং মেথর বা চণ্ডাল সর্বনিম্ন। সুতরাং যাহাতে নিজেকে কাহারও অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলিয়া অভিমান না থাকে, এই কারণে এই ব্রাহ্মণসন্তান মেথরের কাজ করিয়া তাহার সহিত নিজের অভেদ-বুদ্ধি আনিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। মেথরের কাজ রাস্তা সাফ করা, ময়লা সাফ করা—কেহই তাহাকে স্পর্শ করে না। এইভাবে মেথরের প্রতি যাহাতে তাঁহার ঘৃণাবুদ্ধি না থাকে, এই উদ্দেশ্যে তিনি গভীর রাত্রে উঠিয়া তাহাদের ঝাড়ু ও অন্যান্য যন্ত্র লইয়া মন্দিরের নর্দমা, পায়খানা প্রভৃতি নিজ হস্তে পরিষ্কার করিতেন এবং পরে নিজ দীর্ঘ কেশ দ্বারা সেই স্থান মুছিয়া দিতেন। শুধু যে এইরূপেই তিনি দীনতা স্বীকার করিতেন, তাহা নহে; মন্দিরে প্রত্যহ অনেক ভিক্ষুককে প্রসাদ দেওয়া হইত—তাহাদের মধ্যে আবার অনেকে মুসলমান, পতিত ও দুশ্চরিত্র ব্যক্তিও থাকিত। তিনি সেইসব কাঙালীদের খাওয়া হইলে তাহাদের পাতা উঠাইতেন, তাহাদের ভুক্তাবশিষ্ট জড়ো করিতেন, তাহা হইতে স্বয়ং কিছু গ্রহণ করিয়া অবশেষে যেখানে এইরূপ সকল শ্রেণীর ও অবস্থার লোক বসিয়া খাইয়াছে, সেই স্থান পরিষ্কার করিতেন। আপনারা এই শেষোক্ত ব্যাপারটিতে যে কি অসাধারণত্ব আছে, ইহা দ্বারা বিশেষ কি উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইল, তাহা বুঝিতে পারিবেন না, কিন্তু ভারতে আমাদের নিকট বড়ই অদ্ভুত ও নিঃস্বার্থ কাজ বলিয়া বোধ হয়। এই উচ্ছিষ্ট পরিষ্কার করার কাজ নীচ অস্পৃশ্য জাতিরাই করিয়া থাকে। তাহারা কোন শহরে প্রবেশ করিলে নিজের জাতির পরিচয় দিয়া লোককে সাবধান করিয়া দেয়—যাহাতে তাহারা তাহাদের স্পর্শদোষ হইতে মুক্ত থাকিতে পারে। প্রাচীন স্মৃতিগ্রন্থে লিখিত আছে, যদি ব্রাহ্মণ হঠাৎ এইরূপ নীচজাতির মুখ দেখিয়া ফোলে, তবে তাহাকে সারাদিন উপবাসী থাকিয়া এক সহস্র গায়ত্রী জপ করিতে হইবে। এই সকল শাস্ত্রীয় নিষেধবাক্য সত্ত্বেও এই ব্রাহ্মণোত্তম যে-স্থানে বসিয়া নীচজাতি আহার করে, সে-স্থান পরিষ্কার করিতেন, তাহাদের ভুক্তাবশেষ ভগবৎপ্রসাদজ্ঞানে গ্রহণ করিতেন। শুধু কি তাই, রাত্রে গোপনে উঠিয়া ময়লা পরিষ্কার করিয়া অস্পৃশ্যদের সহিত আপনার সমত্ব বোধ করিবার চেষ্টা করিতেন। তাঁহার এই ভাব ছিলঃ আমি যে যথার্থ সমগ্র মানবজাতির সেবক হইয়াছি, ইহা প্রমাণ করিবার জন্য আমাকে তোমার বাড়ীর ঝাড়ুদার হইতে হইবে!
তারপর তাঁহার অন্তরে এই প্রবল আকাঙ্ক্ষা জাগিল যে, বিভিন্ন ধর্মপ্রণালীতে কি সত্য আছে, তাহা জানিবেন। এ পর্যন্ত তিনি নিজের ধর্ম ব্যতীত আর কিছু জানিতেন না। এখন তাঁহারা বাসনা হইল, অন্যান্য ধর্ম কিরূপ তাহা জানিবেন। আর তিনি যাহা কিছু করিতেন, তাহাই সর্বান্তঃকরণে অনুষ্ঠান করিতেন। সুতরাং তিনি অন্যান্য ধর্মের গুরু সন্ধান করিতে লাগিলেন। গুরু বলিতে ভারতে আমরা কি বুঝি, এটি সর্বদা স্মরণ রাখিতে হইবে। গুরু বলিতে শুধু গ্রন্থকীট বুঝায় নাঃ তিনিই গুরু, যিনি প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করিয়াছেন, যিনি সত্যকে সাক্ষাৎ জানিয়াছেন—অপর কাহারও নিকট শুনিয়া নহে। একজন মুসলমান সাধুকে পাইয়া তাঁহার প্রদর্শিত সাধনপ্রণালী অনুসারে তিনি সাধন করিতে লাগিলেন। তিনি মুসলমানদিগের মত পোষাক পরিতে লাগিলেন, সেই মুসলমানদিগের শাস্ত্রানুযায়ী সমুদয় অনুষ্ঠান করিতে লাগিলেন, সেই সময়ের জন্য তিনি ইসলাম-ভাবাপন্ন হইয়া গেলেন। আর তিনি দেখিয়া আশ্চর্য হইলেন যে, এই সকল সাধনপ্রণালীর অনুষ্ঠানও তাঁহাকে তাঁহার পূর্ব-উপনীত অবস্থাতেই পৌঁছাইয়া দেয়। তিনি যীশুখ্রীষ্টের সত্যধর্মের অনুসরণ করিয়াও একই ফল লাভ করিলেন। তিনি যে কোন ধর্মসম্প্রদায়ের সাধককে পাইতেন, তাঁহারই নিকট শিক্ষা করিয়া তাঁহার সাধনপ্রণালী সাধনা করিয়াছিলেন; আর তিনি যখন যে প্রণালীতে সাধন করিতেন, সর্বান্তঃকরণে তাহার অনুষ্ঠান করিতেন। ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের গুরুগণ তাঁহাকে যেমন যেমন করিতে বলিতেন, তিনি যথাযথ অনুষ্ঠান করিতেন, আর সকল ক্ষেত্রেই তিনি একই প্রকার ফল লাভ করিতেন। এইভাবে নিজে প্রত্যক্ষ করিয়া তিনি জানিতে পারিলেন যে, প্রত্যেক ধর্মেরই উদ্দেশ্য এক, সকলেই সেই একই বস্তু শিক্ষা দিতেছে—প্রভেদ প্রধানতঃ সাধনপ্রণালীতে, আরও অধিক প্রভেদ ভাষায়। মূলতঃ সকল সম্প্রদায় ও সকল ধর্মেরই উদ্দেশ্য এক।
তারপর তাঁহার দৃঢ় ধারণা হইল, সিদ্ধিলাভ করিতে হইলে একেবারে স্ত্রী-পুরুষ-ভেদজ্ঞান-বর্জিত হওয়া প্রয়োজন; কারণ আত্মার কোন লিঙ্গ নাই; আত্মা পুরুষও নহেন স্ত্রীও নহেন। লিঙ্গভেদ কেবল দেহেই বিদ্যমান, আর যিনি সেই আত্মাকে লাভ করিতে ইচ্ছা করেন, তাঁহার এই ভেদবুদ্ধি থাকিলে চলিবে না। তিনি পুরুষদেহধারী,, অতএব এক্ষণে তিনি সর্ব বিষয়ে স্ত্রীভাব আনিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন, তিনি নিজেকে নারী বলিয়া ভাবিতে লাগিলেন, স্ত্রীলোকের ন্যায় বেশ ধারণ করিলেন, স্ত্রীলোকের ন্যায় কথাবার্তা বলিতে লাগিলেন, পুরুষের কাজ সব ছাড়িয়া দিলেন, নিজ পরিবারস্থ নারীদের মধ্যে বাস করিতে লাগিলেন—এইরূপে অনেক বর্ষ ধরিয়া সাধন করিতে করিতে তাঁহার মন পরিবর্তিত হইয়া গেল, তাঁহার স্ত্রী-পুরুষ-ভেদ-জ্ঞান একেবারে দূর হইয়া গেল, সঙ্গে সঙ্গে কামের বীজ পর্যন্ত দগ্ধ হইয়া গেল—তাঁহার জীবনের দৃষ্টিভঙ্গী সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হইয়া গেল।
আমরা পাশ্চাত্য দেশে নারীপূজার কথা শুনিয়া থাকি, কিন্তু সাধারণতঃ এই পূজা নারীর সৌন্দর্য ও যৌবনের পূজা। ইনি কিন্তু নারীপূজা বলিতে বুঝিতেন—মা আনন্দময়ীর পূজা। সকল নারীই সেই আনন্দময়ী মা ব্যতীত অন্য কিছু নহেন। আমি নিজে দেখিয়াছি, সমাজ যাহাদিগকে স্পর্শ করে না—এরূপ স্ত্রীলোকদিগের সম্মুখে তিনি করজোড়ে দাঁড়াইয়া রহিয়াছেন, শেষে কাঁদিতে কাঁদিতে তাহাদের পদতলে পতিত হইয়া অর্ধবাহ্যশূন্য অবস্থায় বলিতেছেন, ‘মা, একরূপে তুমি রাস্তায় দাঁড়াইয়া রহিয়াছ, আর একরূপে তুমি এই জগৎ হইয়াছ। আমি তোমাকে বারবার প্রণাম করি।’ ভাবিয়া দেখ, সেই ব্যক্তির জীবন কিরূপ ধন্য, যাঁহার অন্তর হইতে সর্ববিধ পশুভাব চলিয়া গিয়াছে, যিনি প্রত্যেক নারীকে ভক্তিভাবে দর্শন করেন, যাঁহার নিকট সকল নারীর মুখ অন্য রূপ ধারণ করিয়াছে। কেবল সেই আনন্দময়ী জগন্মাতার মুখ তাহাতে প্রতিবিম্বিত হইতেছে। ইহাই আমাদের প্রয়োজন। তোমরা কি বলিতে চাও, নারীর মধ্যে যে দেবত্ব রহিয়াছে, তাহাকে প্রতারণা করা যায়? তাহা কখনও হয় নাই, হইতেও পারে না। জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে উহা সর্বদাই আত্মপ্রকাশ করিতে চেষ্টা করিতেছে। উহা অব্যর্থভাবেই সমুদয় প্রবঞ্চনা ও কপটতা ধরিয়া ফেলে, উহা অভ্রান্তভাবে সত্যের তেজ, আধ্যাত্মিকতার আলোক ও পবিত্রতার শক্তি উপলব্ধি করিয়া থাকে। যদি প্রকৃত ধর্মলাভ করিতে হয়, তবে এইরূপ পবিত্রতাই সর্বতোভাবে আবশ্যক।
এই ব্যক্তি এইরূপ কঠোর নিষ্কলঙ্ক পবিত্রতা লাভ করিলেন। আমাদের জীবনে যে-সকল প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবের সহিত সংঘর্ষ রহিয়াছে, তাঁহার পক্ষে আর তাহা রহিল না। তিনি অতি কষ্টে আধ্যাত্মিক রত্নসমূহ সঞ্চয় করিয়া মানবজাতিকে দিবার জন্য প্রস্তুত হইলেন, তখন তাঁহার ঈশ্বর নির্দিষ্ট কার্য আরম্ভ হইল। তাঁহার প্রচারকার্য ও উপদেশদান আশ্চর্য ধরনের। আমাদের দেশে আচার্যের খুব সম্মান, তাঁহাকে সাক্ষাৎ ঈশ্বর জ্ঞান করা হয়। গুরুকে যেরূপ সম্মান দেওয়া হয়, পিতামাতাকেও আমরা সেরূপ সম্মান করি না। পিতামাতা হইতে আমরা দেহ পাইয়াছি, কিন্তু গুরু আমাদিগকে মুক্তির পথ প্রদর্শন করেন; আমরা তাঁহার সন্তান, তাঁহার মানসপুত্র। কোন অসাধারণ আচার্যের অভ্যুদয় হইলে সকল হিন্দুই তাঁহাকে সম্মান প্রদর্শন করিতে আসে, দলে দলে লোক তাঁহাকে ঘিরিয়া বসিয়া থাকে। কিন্তু লোকে এই আচার্যবরকে সম্মান করিল কিনা, এ বিষয়ে তাঁহার কোন খেয়ালই ছিল না, তিনি যে একজন শ্রেষ্ঠ আচার্য, তাহা তিনি নিজেই জানিতেন না। তিনি জানিতেন—মা-ই সব করিতেছেন, তিনি কিছুই নহেন। তিনি সর্বদা বলিতেন, ‘যদি আমার মুখ দিয়া কোন ভাল কথা বাহির হয়, তাহা আমার মায়ের কথা, আমার তাহাতে কোন গৌরব নাই।’ তিনি তাঁহার নিজের প্রচারকার্য সম্বন্ধে এইরূপ ধারণা পোষণ করিতেন এবং মৃত্যুর দিন পর্যন্ত এ ধারণা ত্যাগ করেন নাই।
আমরা দেখিয়াছি, সংস্কারক ও সমালোচকদের কার্যপ্রণালী কিরূপ। তাঁহারা কেবল অপরের দোষ দেখেন, সব ভাঙিয়া-চুরিয়া ফেলিয়া নিজেদের কল্পিত নূতন ভাবে নূতন করিয়া গড়িতে যান। আমরা সকলেই নিজ নিজ মনোমত এক-একটা কল্পনা লইয়া বসিয়া আছি। দুঃখের বিষয়, কেহই তাহা কার্যে পরিণত করিতে প্রস্তুত নহে, কারণ সকলেই আমাদের মত উপদেশ দিতে প্রস্তুত। তাঁহার কিন্তু সেই ভাব ছিল না, তিনি কাহাকেও ডাকিতে যাইতেন না। তাঁহার এই মূলমন্ত্র ছিল—প্রথমে চরিত্র গঠন কর, প্রথমে আধ্যাত্মিক ভাব অর্জন কর, ফল আপনি আসিবে। তাঁহার প্রিয় দৃষ্টান্ত ছিলঃ যখন পদ্ম ফোটে, তখন ভ্রমর নিজে নিজেই মধু খুঁজিতে আসে। এইরূপে যখন তোমার হৃৎপদ্ম ফুটিবে, তখন শত শত লোক তোমার নিকট শিক্ষা লইতে আসিবে।—এইটি জীবনের এক মহা শিক্ষা। মদীয় আচার্যদেব আমাকে শত শত বার এই শিক্ষা দিয়াছেন, তথাপি আমি প্রায়ই ভুলিয়া যাই। খুব কম লোকেই চিন্তার অদ্ভুত শক্তি বুঝিতে পারে। যদি কোন ব্যক্তি গুহায় বসিয়া উহার প্রবেশদ্বার রুদ্ধ করিয়া একটিমাত্র প্রকৃত মহৎ চিন্তা করিয়া প্রাণত্যাগ করে, সেই চিন্তা সেই গুহার প্রাচীর ভেদ করিয়া সমগ্র আকাশে বিচরণ করিবে, পরিশেষে সমগ্র মানবজাতির হৃদয়ে ঐ ভাব সংক্রামিত হইবে। চিন্তার এইরূপ অদ্ভুত শক্তি! অতএব তোমার ভাব অপরকে দিবার জন্য ব্যস্ত হইও না। প্রথমে দিবার মত কিছু সঞ্চয় কর। তিনিই প্রকৃত শিক্ষা দিতে পারেন, যাঁহার দিবার কিছু আছে; কারণ শিক্ষাপ্রদান বলিতে কেবল কথা বলা বুঝায় না, উহা কেবল মতামত বুঝান নহে; শিক্ষাপ্রদান বলিতে বুঝায় ভাব-সঞ্চার। যেমন আমি তোমাকে একটি ফুল দিতে পারি, তদপেক্ষা অধিকতর প্রত্যক্ষভাবে ধর্মও দেওয়া যাইতে পারে। ইহা কবিত্বের ভাষায় বলিতেছি না, অক্ষরে অক্ষরে সত্য। ভারতে এই ভাব অতি প্রাচীনকাল হইতেই বিদ্যমান, আর পাশ্চাত্য দেশে যে ‘প্রেরিতগণের গুরুশিষ্যপরম্পরা’’ (Apostolic succession) মত প্রচলিত আছে, তাহাতেই ইহার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। অতএব প্রথমে চরিত্র গঠন কর—এইটিই তোমার প্রথম কর্তব্য। আগে সত্য কি—তাহা নিজে জান, পরে অনেকে তোমার নিকট শিখিবে, তাহারা তোমার নিকট আসিবে। আমার গুরুদেবের মনোভাব এইরূপই ছিল, তিনি কাহারও সমালোচনা করিতেন না।
বৎসরের পর বৎসর দিবারাত্র আমি এই ব্যক্তির সহিত বাস করিয়াছি, কিন্তু কখনও শুনি নাই, তাঁহার জিহ্বা কোন সম্প্রদায়ের নিন্দাসূচক বাক্য উচ্চারণ করিয়াছে। সকল সম্প্রদায়ের প্রতিই তিনি সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন। তিনি সম্প্রদায়গুলির মধ্যে সামঞ্জস্য দেখিয়াছিলেন। মানুষ—হয় জ্ঞানপ্রবণ, না হয় ভক্তিপ্রবণ, না হয় যোগপ্রবণ, না হয় কর্মপ্রবণ হইয়া থাকে। বিভিন্ন ধর্মসমূহে এই বিভিন্ন ভাবসমূহের কোন-না-কোনটির প্রাধান্য দৃষ্ট হয়। তথাপি একই ব্যক্তিতে এই চারটি ভাবের বিকাশই সম্ভব এবং ভবিষ্যৎ মানব ইহা করিতে সমর্থ হইবে, ইহাই তাঁহার ধারণা ছিল। তিনি কাহারও দোষ দেখিতেন না, সকলের মধ্যেই ভাল দেখিতেন। আমার বেশ মনে আছে, একদিন এক ব্যক্তি ভারতীয় কোন সম্প্রদায়ের নিন্দা করিতেছেন, এই সম্প্রদায়ের আচার-অনুষ্ঠান নীতিবিগর্হিত বলিয়া বিবেচিত। তিনি কিন্তু তাহাদেরও নিন্দা করিতে প্রস্তুত নহেন—স্থিরভাবে কেবলমাত্র বলিলেন, ‘কেউ বা সদর দরজা দিয়ে বাড়ীতে ঢোকে, কেউ বা আবার পায়খানার দোর দিয়ে ঢুকতে পারে। এদের মধ্যেও ভাল লোক থাকতে পারে। আমাদের কাকেও নিন্দা করা উচিত নয়।’ তাঁহার দৃষ্টি সংস্কারশূন্য ও নির্মল হইয়া গিয়াছিল। প্রত্যেক সম্প্রদায়ের ভিন্ন ভাব, তাহাদের ভিতরের কথাটা তিনি সহজেই ধরিতে পারিতেন। তিনি নিজ অন্তরের মধ্যে এই সকল বিভিন্ন ভাব একত্র করিয়া সামঞ্জস্য করিতে পারিতেন।
সহস্র সহস্র ব্যক্তি এই অপূর্ব মানুষটিকে দেখিতে এবং সরল গ্রাম্য ভাষায় তাঁহার উপদেশ শুনিতে আসিতে লাগিল। তাঁহার প্রত্যেকটি কথায় একটা শক্তি মাখান থাকিত, প্রত্যেক কথাই হৃদয়ের তমোরাশি দূর করিয়া দিত। কথায় কিছু নাই, ভাষাতেও কিছু নাই; যে ব্যক্তি সেই কথা বলিতেছিলেন, তাঁহার সত্তা—তিনি যাহা বলেন তাহাতে জড়াইয়া থাকে, তাই কথার জোর হয়। আমরা সকলে সময়ে সময়ে ইহা অনুভব করি। আমরা খুব বড় বড় বক্তৃতা শুনিয়া থাকি, অনেক সুযুক্তিপূর্ণ প্রসঙ্গ শুনিয়া থাকি, তারপর বাড়ী গিয়া সব ভুলিয়া যাই। আবার অন্য সময় হয়তো অতি সরল ভাষায় দুই-চারটি কথা শুনিলাম—সেগুলি আমাদের প্রাণে এমন লাগিল যে, সারা জীবনের জন্য সেই কথাগুলি আমাদের হৃদয়ে গাঁথিয়া গেল, আমাদের অঙ্গীভূত হইয়া গেল, স্থায়ী ফল প্রসব করিল। যে ব্যক্তি নিজের কথাগুলিতে নিজ সত্তা, নিজ জীবন প্রদান করিতে পারেন, তাঁহারই কথায় ফল হয়, কিন্তু তাঁহার মহাশক্তিসম্পন্ন হওয়া আবশ্যক। সর্বপ্রকার শিক্ষার অর্থই আদান-প্রদান—আচার্য দিবেন, শিষ্য গ্রহণ করিবেন। কিন্তু আচার্যের কিছু দিবার বস্তু থাকা চাই, শিষ্যেরও গ্রহণ করিবার জন্য প্রস্তুত হওয়া চাই।
এই ব্যক্তি ভারতের রাজধানী৩৫—আমাদের দেশে শিক্ষার প্রধান কেন্দ্র, যেখান হইতে প্রতি বৎসর শত শত সন্দেহবাদী ও জড়বাদী সৃষ্টি হইতেছিল, সেই কলিকাতার নিকট বাস করিতে লাগিলেন, কিন্তু অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধিধারী, অনেক সন্দেহবাদী, অনেক নাস্তিক তাঁহার নিকট আসিয়া তাঁহার কথা শুনিতেন।
আমি বাল্যকাল হইতেই সত্যের সন্ধান করিতাম, বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের সভায় যাইতাম। যখন দেখিতাম, কোন ধর্মপ্রচারক বক্তৃতা-মঞ্চে দাঁড়াইয়া অতি মনোহর উপদেশ দিতেছেন, তাঁহার বক্তৃতা শেষে তাঁহার নিকট গিয়া জিজ্ঞাসা করিতাম, ‘এই যে-সব কথা বলিলেন, তাহা কি আপনি প্রত্যক্ষ উপলব্ধি দ্বারা জানিয়াছেন, অথবা উহা কেবল আপনার বিশ্বাসমাত্র? ধর্মতত্ত্ব সম্বন্ধে আপনি নিশ্চিতরূপে কি কিছু জানিয়াছেন?’ তাঁহার উত্তরে বলিলেন, ‘এ-সকল আমার মত ও বিশ্বাস।’ অনেককে আমি এই প্রশ্ন করিতাম, ‘আপনি কি ঈশ্বর দর্শন করিয়াছেন?’ কিন্তু তাঁহাদের উত্তর শুনিয়া ও তাঁহাদের ভাব দেখিয়া আমি সিদ্ধান্ত করিলাম যে, তাঁহারা ধর্মের নামে লোক ঠকাইতেছেন মাত্র। এখানে ভগবান্ শঙ্করাচার্যের একটি কথা আমার মনে পড়িতেছেঃ বিভিন্ন প্রকার বাক্যযোজনার রীতি, শাস্ত্রব্যাখ্যার কৌশল পণ্ডিতদিগের ভোগের জন্য; উহা দ্বারা কখনও মুক্তি হইতে পারে না।৩৬
এইরূপে আমি ক্রমশঃ নাস্তিক হইয়া পড়িতেছিলাম, এমন সময়ে এই আধ্যাত্মিক জ্যোতিষ্ক আমার ভাগ্যগগনে উদিত হইলেন। আমি এই ব্যক্তির কথা শুনিয়া তাঁহাকে দর্শন করিতে গেলাম। তাঁহাকে একজন সাধারণ লোকের মত বোধ হইল, কিছু অসাধারণত্ব দেখিলাম না। অতি সরল ভাষায় তিনি কথা কহিতেছিলেন, আমি ভাবিলাম, এ ব্যক্তি কি একজন বড় ধর্মাচার্য হইতে পারেন? আমি সারা জীবন অপরকে যাহা জিজ্ঞাসা করিয়াছি, তাঁহার নিকট গিয়া তাঁহাকেও সেই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘মহাশয়, আপনি কি ঈশ্বর বিশ্বাস করেন?’ তিনি উত্তর দিলেন—‘হাঁ।’ ‘মহাশয়, আপনি কি তাঁহার অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে পারেন?’ ‘হাঁ।’ ‘কি প্রমাণ?’ ‘আমি তোমাকে যেমন আমার সম্মুখে দেখিতেছি, তাঁহাকেও ঠিক সেইরূপ দেখি, বরং আরও স্পষ্টতর, আরও উজ্জ্বলতররূপে দেখি।’ আমি একেবারে মুগ্ধ হইলাম। এই প্রথমে আমি এমন একজনকে দেখিলাম, যিনি সাহস করিয়া বলিতে পারেন, ‘আমি ঈশ্বর দেখিয়াছি, ধর্ম সত্য, উহা অনুভব করা যাইতে পারে-—আমরা এই জগৎ যেমন প্রত্যক্ষ করিতে পারি, তাহা অপেক্ষা ঈশ্বরকে অনন্তগুণ স্পষ্টরূপে প্রত্যক্ষ করা যাইতে পারে।’ ইহা একটা তামাসার কথা নয়, বা মানুষের তৈরী কোন গল্প নয়, ইহা বাস্তবিক সত্য। আমি দিনের পর দিন এই ব্যক্তির নিকট যাইতে লাগিলাম। অবশ্য সকল কথা আমি এখন বলিতে পারি না, তবে এইটুকু বলিতে পারি—ধর্ম যে দেওয়া যাইতে পারে, তাহা আমি বাস্তবিক প্রত্যক্ষ করিলাম। একবার স্পর্শে, একবার দৃষ্টিতে একটা সমগ্র জীবন পরিবর্তিত হইতে পারে। আমি এইরূপ ব্যাপার বারবার হইতে দেখিয়াছি।
বুদ্ধ, খ্রীষ্ট, মহম্মদ ও প্রাচীনকালের বিভিন্ন মহাপুরুষের বিষয় পাঠ করিয়াছিলামঃ তাঁহারা উঠিয়া বলিলেন—সুস্থ হও, আর সেই ব্যক্তি সুস্থ হইয়া গেল। দেখিলাম, ইহা সত্য; আর যখন আমি এই ব্যক্তিকে দেখিলাম, আমার সকল সন্দেহ দূর হইয়া গেল। ধর্ম দান করা সম্ভব, আর মদীয় আচার্যদেব বলিতেন, ‘জগতের অন্যান্য জিনিষ যেমন দেওয়া-নেওয়া যায়, ধর্ম তদপেক্ষা অধিকতর প্রত্যক্ষভাবে দেওয়া-নেওয়া যাইতে পারে।’ অতএব আগে ধার্মিক হও, দিবার মত কিছু অর্জন কর, তারপর জগতের সম্মুখে দাঁড়াইয়া তাহা বিতরণ কর। ধর্ম ব্যাক্যাড়ম্বর নহে, মতবাদবিশেষ নহে, অথবা সাম্প্রদায়িকতা নহে। সম্প্রদায়ে বা সমিতির মধ্যে ধর্ম আবদ্ধ থাকিতে পারে না। ধর্ম আত্মার সহিত পরমাত্মার সম্বন্ধ লইয়া। ধর্ম কিরূপে সমিতিতে পরিণত হইবে? কোন ধর্ম কি কখনও সমিতি দ্বারা প্রচারিত হইয়াছে? ঐরূপ করিলে ধর্ম ব্যবসাদারিতে পরিণত হয়, আর যেখানে এইরূপ ব্যবসাদারি ঢোকে, সেখানেই ধর্ম লোপ পায়। এশিয়াই সকল ধর্মের প্রাচীন জন্মভূমি। এমন একটি ধর্মের নাম কর, যাহা সংগঠিত দলের দ্বারা প্রচারিত হইয়াছে। এরূপ একটির নাম তুমি করিতে পারিবে না। ইওরোপই এই উপায়ে ধর্মপ্রচারের চেষ্টা করিয়াছিল, আর সেইজন্যই ইওরোপ এশিয়ার মত সমগ্র জগৎকে আধ্যাত্মিক ভাবে কখনই প্রভাবিত করিতে পারে নাই। কতকগুলি ভোটের সংখ্যাধিক্য হইলেই কি মানুষ অধিক ধার্মিক হইবে, অথবা উহার সংখ্যাল্পতায় কম ধার্মিক হইবে? মন্দির বা চার্চ নির্মাণ অথবা সমবেত উপাসনায় ধর্ম হয় না; কোন গ্রন্থে, বচনে, অনুষ্ঠানে বা সমিতিতেও ধর্ম পাওয়া যায় না; ধর্মের আসল কথা—অপরোক্ষানুভূতি। আর আমরা সকলেই দেখিতেছি—যতক্ষণ না সত্যকে জানা যায়, ততক্ষণ কিছুতেই তৃপ্তি হয় না। আমরা যতই তর্ক করি না কেন, যতই উপদেশ শুনি না কেন, কেবল একটি জিনিষেই আমাদের তৃপ্তি হইতে পারে—সেটি আমাদের নিজেদের প্রত্যক্ষানুভূতি; আর এই প্রত্যক্ষানুভূতি সকলের পক্ষেই সম্ভব, কেবল উহা লাভ করিবার জন্য চেষ্টা করিতে হইবে। এইরূপে ধর্মকে প্রত্যক্ষ অনুভব করিবার প্রথম সোপান—ত্যাগ। যতদূর সাধ্য ত্যাগ করিতে হইবে। অন্ধকার ও আলোক, বিষয়ানন্দ ও ব্রহ্মানন্দ—দুই-ই কখনও একসঙ্গে অবস্থান করিতে পারে না। ‘তোমরা ঈশ্বর ও ধনদেবতার সেবা একসঙ্গে করিতে পার না।’৩৭
আমার গুরুদেবের নিকট আমি আর একটি বিশেষ প্রয়োজনীয় বিষয়—একটি অদ্ভুত সত্য শিক্ষা করিয়াছি; ইহাই আমার বিশেষ প্রয়োজনীয় বলিয়া বোধ হয় যে, জগতের ধর্মসমূহ পরস্পর বিরোধী নহে। এগুলি এক সনাতন ধর্মেরই বিভিন্ন ভাবমাত্র। এক সনাতন ধর্ম চিরকাল ধরিয়া রহিয়াছে, চিরকালই থাকিবে, আর এই ধর্মই বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন ভাবে প্রকাশিত হইতেছে। অতএব আমাদের সকল ধর্মকে সম্মান করিতে হইবে, আর যতদূর সম্ভব সবগুলিকে গ্রহণ করিবার চেষ্টা করিতে হইবে। কেবল যে বিভিন্ন জাতি ও বিভিন্ন দেশ অনুসারে বিভিন্ন হয়, তাহা নহে, ব্যক্তি হিসাবেও উহা বিভিন্ন ভাব ধারণ করে। কোন ব্যক্তির ভিতর ধর্ম তীব্র কর্ম রূপে প্রকাশিত, কাহারও ভিতর গভীর ভক্তি-রূপে, কাহারও ভিতর যোগ-রূপে, কাহারও ভিতর বা জ্ঞান-রূপে প্রকাশিত। তুমি যে পথে যাইতেছ, তাহা ঠিক নহে—এ কথা বলা ভুল। এইটি করিতে হইবে, এই মূল রহস্যটি শিখিতে হইবেঃ সত্য একও বটে, বহুও বটে। বিভিন্ন দিক্ দিয়া দেখিলে একই সত্যকে আমরা বিভিন্নভাবে দেখিতে পারি। তাহা হইলেই কাহারও প্রতি বিরোধ পোষণ না করিয়া সকলের প্রতি আমরা অনন্ত সহানুভূতিসম্পন্ন হইব। যতদিন পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রকৃতির মানুষ জন্মগ্রহণ করিতেছে, ততদিন এক আধ্যাত্মিক সত্যই বিভিন্ন ছাঁচে ঢালিয়া লইতে হইবে; এইটি বুঝিলে অবশ্যই আমরা পরস্পরের বিভিন্নতা সত্ত্বেও পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করিতে সমর্থ হইব। যেমন প্রকৃতি বলিতে ‘বহুত্বে একত্ব’ বুঝায়, ব্যাবহারিক জগতে অনন্ত ভেদ থাকা সত্ত্বেও যেমন সেই সমুদয় ভেদের পশ্চাতে অনন্ত অপরিণামী নিরপেক্ষ একত্ব রহিয়াছে, প্রত্যেক ব্যক্তি সম্বন্ধেও তদ্রূপ। আর ব্যষ্টি—ক্ষুদ্রাকারে সমষ্টির পুনরাবৃত্তি মাত্র। এই সমুদয় ভেদ সত্ত্বেও ইহাদেরই মধ্যে অনন্ত একত্ব বিরাজমান—ইহাই আমাদিগকে স্বীকার করিতে হইবে। অন্যান্য ভাব অপেক্ষা এই ভাবটি আজকাল বিশেষ প্রয়োজন বলিয়া আমার বোধ হয়। আমি এমন এক দেশের মানুষ, যেখানে ধর্মসম্প্রদায়ের অন্ত নাই, আর দুর্ভাগ্যবশতই হউক বা সৌভাগ্যবশতই হউক, যে-কোন ব্যক্তি ধর্ম লইয়া একটু নাড়াচাড়া করে, সে-ই একজন প্রতিনিধি সে-দেশে পাঠাইতে চায়; এমন দেশে জন্মিয়াছি বলিয়া অতি বাল্যকাল হইতেই জগতের বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়গুলির সহিত আমি পরিচিত। এমন কি, ‘মর্মনেরা’ (Mormons)৩৮ পর্যন্ত ভারতে ধর্মপ্রচার করিতে আসিয়াছিল। আসুক সকলে; সেই তো ধর্মপ্রচারের স্থান। অন্যান্য দেশ অপেক্ষা সেখানেই ধর্মভাব অধিক বদ্ধমূল হয়। তোমরা আসিয়া হিন্দুদিগকে যদি রাজনীতি শিখাইতে চাও, তাহারা বুঝিবে না, কিন্তু যদি তুমি আসিয়া ধর্মপ্রচার কর—উহা যতই কিম্ভূতকিমাকার ধরনের হউক না কেন, অল্পকালের মধ্যেই সহস্র সহস্র লোক তোমার অনুসরণ করিবে; আর জীবৎকালেই সাক্ষাৎ ভগবানরূপে পূজিত হইবার তোমার যথেষ্ট সম্ভাবনা। ইহাতে আমি আনন্দই বোধ করি, কারণ ভারতে আমরা এই একটি বস্তুই চাহিয়া থাকি। হিন্দুদের মধ্যে নানাবিধ সম্প্রদায় আছে, তাহাদের সংখ্যাও অনেক, আবার কতকগুলি আপাততঃ এত বিরুদ্ধ বলিয়া বোধ হয় যে, তাহাদের মিলিবার যেন কোন ভিত্তিই খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। তথাপি সকলেই বলিবে, তাহারা এক ধর্মেরই বিভিন্ন প্রকাশ মাত্র।
‘যেমন বিভিন্ন নদী বিভিন্ন পর্বতে উৎপন্ন হইয়া, ঋজু কুটিল নানা পথে প্রবাহিত হইয়া অবশেষে সমুদ্রে আসিয়া মিলিয়া যায়, তেমনি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ভাব বিভিন্ন হইলেও সকলেই অবশেষে তোমার নিকট আসিয়া উপস্থিত হয়।’৩৯ ইহা শুধু একটা মতবাদ নহে, ইহা কার্যতঃ স্বীকার করিতে হইবে; তবে আমরা সচরাচর যেমন দেখিতে পাই, কেহ কেহ অনুগ্রহ করিয়া বলেন, ‘অপর ধর্মে কিছু সত্য আছে; হাঁ, হাঁ, এতে কতকগুলি বড় ভাল জিনিষ আছে বটে’—সেভাবে নহে। আবার কাহারও কাহারও এই অদ্ভুত উদার ভাব দেখিতে পাওয়া যায়—‘অন্যান্য ধর্ম ঐতিহাসিক যুগের পূর্ববর্তী সময়ের ক্রমবিকাশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চিহ্নস্বরূপ, কিন্তু আমাদের ধর্মে উহা পূর্ণতা লাভ করিয়াছে!’ একজন বলিতেছেন, ‘আমার ধর্মই শ্রেষ্ঠ, কেননা ইহা সর্বাপেক্ষা প্রাচীন’, আবার অপর একজন তাহার ধর্ম সর্বাপেক্ষা আধুনিক বলিয়া সেই একই দাবী করিতেছে। আমাদের বুঝিতে হইবে ও স্বীকার করিতে হইবে যে, প্রত্যেক ধর্মেরই মানুষকে মুক্ত করিবার সমান শক্তি আছে। মন্দিরে বা চার্চে ধর্মসকলের প্রভেদ সম্বন্ধে যাহা শুনিয়াছি, তাহা কুসংস্কার মাত্র। সেই একই ঈশ্বর সকলের ডাকে সারা দেন। অতি ক্ষুদ্র জীবাত্মারও রক্ষা এবং উদ্ধারের জন্য তুমি, আমি বা অপর কোন মানুষ দায়ী নয়, সেই এক সর্বশক্তিমান্ ঈশ্বরই সকলের জন্য দায়ী। আমি বুঝিতে পারি না, লোকে কিরূপে একদিকে নিজদিগকে ঈশ্বরবিশ্বাসী বলিয়া ঘোষণা করে, আবার ইহাও ভাবে যে, ঈশ্বর একটি ক্ষুদ্র জনসমাজের ভিতর সমুদয় সত্য দিয়াছেন, আর তাহারাই অবশিষ্ট মানবসমাজের রক্ষক। কোন ব্যক্তির বিশ্বাস নষ্ট করিবার চেষ্টা করিও না। যদি পার তবে তাহাকে কিছু ভাল জিনিষ দাও। যদি পার তবে মানুষ যেখানে আছে, সেখান হইতে তাহাকে একটু উপরে তুলিয়া দাও। ইহাই কর, কিন্তু মানুষের যাহা আছে, তাহা নষ্ট করিও না। কেবল তিনিই যথার্থ আচার্য নামের যোগ্য, যিনি আপনাকে এক মুহূর্তে যেন সহস্র সহস্র বিভিন্ন ব্যক্তিতে পরিণত করিতে পারেন; কেবল তিনিই যথার্থ আচার্য, যিনি অল্পায়াসেই শিষ্যের অবস্থায় আপনাকে লইয়া যাইতে পারেন—যিনি নিজের শক্তি শিষ্যের মধ্যে সঞ্চারিত করিয়া তাহার চক্ষু দিয়া দেখিতে পান, তাহার কান দিয়া শুনিতে পান, তাহার মন দিয়া বুঝিতে পারেন। এইরূপ আচার্যই যথার্থ শিক্ষা দিতে পারেন, অপর কেহ নহে। যাঁহারা কেবল অপরের ভাব নষ্ট করিবার চেষ্টা করেন, তাঁহারা কখনই কোন প্রকার উপকার করিতে পারেন না।
মদীয় আচার্যদেবের নিকট থাকিয়া আমি বুঝিয়াছি, মানুষ এই দেহেই সিদ্ধাবস্থা লাভ করিতে পারে, তাঁহার মুখ হইতে কাহারও প্রতি অভিশাপ বর্ষিত হয় নাই, এমন কি তিনি কাহারও সমালোচনা পর্যন্ত করিতেন না। তাঁহার দৃষ্টি জগতে কোন কিছুকে মন্দ বলিয়া দেখিবার শক্তি হারাইয়াছিল—তাঁহার মন কোনরূপ কুচিন্তা করিবার সামর্থ্য হারাইয়াছিল। তিনি ভাল ছাড়া আর কিছু দেখিতেন না। সেই মহাপবিত্রতা, মহাত্যাগই ধর্মলাভের একমাত্র নিগূঢ় উপায়। বেদ বলেনঃ ‘ধন বা পুত্রোৎপাদনের দ্বারা নহে, একমাত্র ত্যাগের দ্বারাই অমৃতত্ব লাভ করা যায়।’ যীশু বলিয়াছেন, ‘তোমার যাহা কিছু আছে, বিক্রয় করিয়া দরিদ্রদিগকে দান কর ও আমার অনুসরণ কর।’
সব বড় বড় আচার্য ও মহাপুরুষগণ এই কথা বলিয়া গিয়াছেন এবং জীবনে উহা পরিণত করিয়াছেন। এই ত্যাগ ব্যতীত আধ্যাত্মিক লাভের সম্ভাবনা কোথায়? যেখানেই হউক না কেন, সকল ধর্মভাবের পশ্চাতেই ত্যাগ রহিয়াছে; আর ত্যাগের ভাব যত কমিয়া যায়, ইন্দ্রিয়পরতা ততই ধর্মের ভিতর ঢুকিতে থাকে, এবং ধর্মভাবও সেই পরিমাণে কমিয়া যায়। এই মহাপুরুষ ত্যাগের সাকার বিগ্রহ ছিলেন। আমাদের দেশে যাঁহারা সন্ন্যাসী হন, তাঁহাদিগকে সমুদয় ধন-ঐশ্বর্য মান-সম্ভ্রম ত্যাগ করিতে হয়; আর আমার গুরুদেব এই আদর্শ অক্ষরে অক্ষরে কার্যে পরিণত করিয়াছিলেন। তিনি কাঞ্চন স্পর্শ করিতে না, তাঁহার কাঞ্চনত্যাগ-স্পৃহা তাঁহার স্নায়ুমণ্ডলীর উপর পর্যন্ত এইরূপ প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল যে, নিদ্রিতাবস্থাতেও তাঁহার দেহে কোন ধাতুদ্রব্য স্পর্শ করাইলে তাঁহার মাংসপেশীসমূহ সঙ্কুচিত হইয়া যাইত এবং তাঁহার সমুদয় দেহই যেন ঐ ধাতুদ্রব্যকে স্পর্শ করিতে অস্বীকার করিত। এমন অনেকে ছিল, যাহাদের নিকট হইতে তিনি কিছু গ্রহণ করিলে তাহারা কৃতার্থ বোধ করিত, যাহারা আনন্দের সহিত তাঁহাকে সহস্র টাকা দিতে প্রস্তুত ছিল; কিন্তু যদিও তাঁহার উদার হৃদয় সকলকে আলিঙ্গন করিতে সদা প্রস্তুত ছিল, তথাপি তিনি এইসব লোকের নিকট হইতে দূরে সরিয়া যাইতেন। সম্পূর্ণভাবে কাম-কাঞ্চন-জয়ের এক জীবন্ত উদাহরণ ছিলেন তিনি; এই দুই ভাব তাঁহার ভিতর বিন্দুমাত্র ছিল না, আর বর্তমান শতাব্দীর জন্য এইরূপ মানুষের অতিশয় প্রয়োজন। বর্তমানকালে লোকে যাহাকে নিজেদের ‘প্রয়োজনীয় দ্রব্য’ বলে, তাহা ব্যতীত তাহারা এক-মাসও বাঁচিতে পারিবে না মনে করে, আর এই প্রয়োজন তাহারা অতিরিক্তরূপে বাড়াইতে আরম্ভ করিয়াছে; এ সময়ে এরূপ ত্যাগের প্রয়োজন আছে। বর্তমানে এমন একজন লোকের প্রয়োজন, যিনি জগতের অবিশ্বাসীদের নিকট প্রমাণ করিতে পারেন যে, এখনও এমন মানুষ আছেন, যিনি সংসারের সমুদয় ধন রত্ন ও মান-যশের জন্য বিন্দুমাত্র লালায়িত নহেন। বাস্তবিক এখনও এরূপ অনেক লোক আছেন।
তাঁহার জীবনে আদৌ বিশ্রাম ছিল না। তাঁহার জীবনের প্রথমাংশ ধর্ম-উপার্জনে ও শেষাংশ উহার বিতরণে ব্যয়িত হইয়াছিল। দলে দলে লোক তাঁহার উপদেশ শুনিতে আসিত, আর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২০ ঘণ্টা তিনি তাহাদের সহিত কথা কহিতেন। এরূপ ঘটনা যে দু-এক দিন ঘটিয়াছিল তাহা নহে, মাসের পর মাস এরূপ হইতে লাগিল; অবশেষে এই কঠোর পরিশ্রমে তাঁহার শরীর ভাঙিয়া গেল। মানবজাতির প্রতি তাঁহার অগাধ প্রেম ছিল। যাহারা তাঁহার কৃপালাভের জন্য আসিত, এইরূপ সহস্র সহস্র লোকের মধ্যে অতি সামান্য ব্যক্তিও তাঁহার কৃপা হইতে বঞ্চিত হইত না। ক্রমে তাঁহার গলায় ঘা হইল, তথাপি অনেক বুঝাইয়াও তাঁহার কথা বলা বন্ধ করা গেল না। আমরা তাঁহার নিকট সর্বদা থাকিতাম; যাহাতে তাঁহার কষ্ট না হয়, এজন্য লোকজনের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলাম; কিন্তু যখনই তিনি শুনিতেন, লোকে তাঁহাকে দেখিতে আসিয়াছে, তিনি তাহাদিগকে তাঁহার কাছে আসিতে দিবার জন্য অত্যন্ত আগ্রহ প্রকাশ করিতেন এবং তাহারা আসিলে তাহাদের সকল প্রশ্নের উত্তর দিতেন। যদি কেহ বলিত, ‘এইসব লোকজনের সঙ্গে কথা কহিলে আপনার কষ্ট হইবে না?’ তিনি হাসিয়া একমাত্র উত্তর দিতেন, ‘কি! দেহের কষ্ট! আমার কত দেহ হইল, কত দেহ গেল। যদি এ দেহ পরের সেবায় যায়, তবে তো ইহা ধন্য হইল। যদি একজন লোকেরও যথার্থ উপকার হয়, সেজন্য আমি হাজার হাজার দেহ দিতে প্রস্তুত আছি।’ একবার এক ব্যক্তি তাঁহাকে বলিল, ‘মহাশয়, আপনি তো একজন মস্ত যোগী—আপনি আপনার দেহের উপর একটু মন রাখিয়া ব্যারামটা সারাইয়া ফেলুন না।’ প্রথমে তিনি ইহার কোন উত্তর দিলেন না। অবশেষে যখন ঐ ব্যক্তি আবার সেই কথা তুলিল, তিনি আস্তে আস্তে বলিলেন, ‘তোমাকে আমি একজন জ্ঞানী মনে করিতাম, কিন্তু দেখিতেছি—তুমি অপরাপর সংসারী লোকেদের মতই কথা বলিতেছ। এই মন ভগবানের পাদপদ্মে অর্পিত হইয়াছে—তুমি কি বল, ইহাকে ফিরাইয়া লইয়া আত্মার খাঁচাস্বরূপ দেহে দিব?’
এইরূপে তিনি সকলকে উপদেশ দিতে লাগিলেন—আর চারিদিকে এই সংবাদ প্রচারিত হইয়া গেল যে, তাঁহার দেহাবসান সন্নিকট, তাই পূর্বেপেক্ষা আরও অধিক লোক দলে দলে আসিতে লাগিল। তোমরা কল্পনা করিতে পার না, ভারতের বড় বড় ধর্মাচার্যগণের নিকট লোক আসিয়া কিরূপে চারিদিকে ভিড় করে এবং জীবদ্দশাতেই তাঁহাদিগকে ঈশ্বরজ্ঞানে পূজা করে। সহস্র সহস্র ব্যক্তি কেবল তাঁহাদের বস্ত্রাঞ্চল স্পর্শ করিবার জন্যই অপেক্ষা করে। এইরূপ ধর্মানুরাগ হইতেই মানুষের প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা আসিয়া থাকে। মানুষ যাহা চায় ও আদর করে, তাহাই পাইয়া থাকে—জাতি সম্বন্ধে ঐ কথা। যদি ভারতে গিয়া রাজনৈতিক বক্তৃতা দাও, তাহা যত চমৎকারই হউক না কেন, তুমি শ্রোতা পাইবে না; কিন্তু ধর্মশিক্ষা দাও দেখি—তবে শুধু বাক্য দ্বারা হইবে না, নিজে ধর্মজীবন যাপন করিতে হইবে, তাহা হইলে শত শত ব্যক্তি তোমার নিকট—কেবল তোমাকে দেখিবার জন্য, তোমার পদধূলি লইবার জন্য আসিবে।
যখন লোক শুনিল যে, এই মহাপুরুষ সম্ভবতঃ শীঘ্রই তাহাদের মধ্য হইতে সরিয়া যাইবেন, তখন তাহারা পূর্বাপেক্ষা অধিক সংখ্যায় আসিতে লাগিল। আমাদের গুরুদেব নিজের স্বাস্থ্যের প্রতি বিন্দুমাত্র লক্ষ্য না রাখিয়া তাহাদিগকে উপদেশ দিতে লাগিলেন। আমরা তাঁহাকে বারণ করিয়া প্রতিনিবৃত্ত করিতে পারিতাম না। অনেক লোক দূর-দূরান্তর হইতে আসিত, আর তিনি তাহাদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়া শান্তি পাইতেন না। তিনি বলিতেন, ‘যতক্ষণ আমার কথা কহিবার শক্তি রহিয়াছে, ততক্ষণ উপদেশ দিব।’ আর তিনি যাহা বলিতেন, তাহাই করিতেন। একদিন তিনি আমাদিগকে ইঙ্গিতে জানাইলেন, সেইদিন দেহত্যাগ করিবেন এবং বেদের পবিত্রতম মন্ত্র ‘ওঁ’ উচ্চারণ করিতে করিতে মহাসমাধিস্থ হইলেন। এইরূপে সেই মহাপুরুষ আমাদিগকে ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন। পরদিন আমরা তাঁহার দেহে অগ্নিসংযোগ করিলাম।
তাঁহার ভাব ও উপদেশাবলী প্রচার করিবার উপযুক্ত ব্যক্তি তখন অতি অল্পই ছিল। গৃহী ভক্তগণ ব্যতীত তাঁহার কতকগুলি যুবক শিষ্য ছিল, তাহারা সংসার ত্যাগ করিয়াছিল এবং তাঁহার কার্য চালাইয়া যাইতে প্রস্তুত ছিল। তাহাদিগকে দাবাইয়া রাখিবার চেষ্টা করা হয়; কিন্তু তাহারা তাহাদের সম্মুখে যে মহান্ জীবনাদর্শ দেখিয়াছিল, তাহার শক্তিতে দৃঢ় ভাবে দাঁড়াইয়া রহিল। বছরের পর বছর এই দিব্য জীবনের সংস্পর্শে আসাতে প্রবল উৎসাহাগ্নি তাহাদের ভিতরে সঞ্চারিত হইয়া গিয়াছিল, সুতরাং তাহারা কিছুমাত্র বিচলিত হইল না। এই যুবকগণ সন্ন্যাসিসঙ্ঘের নিয়মাবলী প্রতিপালন করিতে লাগিল, আর যদিও তাহাদের মধ্যে অনেকেই সদ্বংশজাত, তথাপি তাহারা যে শহরে জন্মিয়াছিল, তাহারই রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করিতে লাগিল। প্রথম প্রথম তাহাদিগকে প্রবল বাধা সহ্য করিতে হইয়াছিল, কিন্তু তাহারা দৃঢ়তর হইয়া রহিল, আর দিনের পর দিন ভারতের সর্বত্র এই মহাপুরুষের উপদেশ প্রচার করিতে লাগিল—অবশেষে সমগ্র দেশ তাঁহার প্রচারিত ভাবসমূহে পূর্ণ হইয়া গেল। বঙ্গদেশের সুদূর পল্লীগ্রামে জন্মগ্রহণ করিয়া এই নিরক্ষর বালক কেবল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও আত্মশক্তিবলে সত্য উপলব্ধি করিয়া অপরকে তাহা দান করিয়া গেলেন—আর সে সত্যকে জীবন্ত রাখিবার জন্য কেবল কয়েকজন যুবককে রাখিয়া গেলেন।
আজ শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের নাম ভারতের সর্বত্র কোটি কোটি লোকের নিকট পরিচিত। শুধু তাহাই নহে, তাঁহার শক্তি ভারতের বাইরেও বিস্তৃত হইয়াছে; যদি আমি জগতের কোথাও সত্য ও ধর্ম সম্বন্ধে একটি কথাও বলিয়া থাকি, তাহা আমার গুরুদেবের—আর ভুলভ্রান্তিগুলি আমার।
এরূপ ব্যক্তির প্রয়োজন ছিল—এই যুগে এইরূপ ত্যাগ আবশ্যক। আধুনিক নরনারীগণ, তোমাদের মধ্যে যদি এরূপ পবিত্র অনাঘ্রাত পুষ্পের মত কেহ থাকে, উহা ভগবানের পাদপদ্মে সমর্পণ করা উচিত। যদি তোমাদের মধ্যে এমন কেহ থাকে, যাহাদের সংসারে প্রবেশ করিবার ইচ্ছা নাই, যাহাদের বয়স বেশী হয় নাই, তাহারা সংসার ত্যাগ কর। ধর্মলাভের ইহাই রহস্য—ত্যাগ কর। প্রত্যেক নারীকে জননী বলিয়া চিন্তা কর, আর কাঞ্চন পরিত্যাগ কর। ভয় কি? যেখানেই থাক না কেন, প্রভু তোমাদিগকে রক্ষা করিবেন। প্রভু নিজ সন্তানগণের ভার গ্রহণ করিয়া থাকেন। সাহস করিয়া ত্যাগ কর দেখি। এইরূপ ত্যাগের প্রয়োজন। তোমরা কি দেখিতেছ না, পাশ্চাত্যদেশে জড়বাদের কি প্রবল স্রোত বহিতেছে? কতদিন আর চোখে কাপড় বাঁধিয়া থাকিবে? তোমরা কি দেখিতেছ না, কি ভীষণভাবে কাম ও অপবিত্রতা সমাজের অস্থিমজ্জা শোষণ করিয়া লইতেছে? কেবল বাক্যের দ্বারা অথবা সংস্কার-আন্দোলনের দ্বারা নয়—ত্যাগের দ্বারাই ক্ষয় ও বিনাশের মধ্যে ধর্মভাব লইয়া অটল অচল সুমেরুবৎ দাঁড়াইয়া থাকিলে তবেই তোমরা এই সকল অধর্মের ভাব রোধ করিতে পারিবে। বাক্যব্যয় করিও না, তোমার দেহের প্রত্যেকটি লোমকূপ হইতে পবিত্রতার শক্তি, ব্রহ্মচর্যের শক্তি, ত্যাগের শক্তি বাহির হউক। যাহারা দিবারাত্র কাঞ্চনের জন্য এই চেষ্টা করিতেছে, তাহাদিগকে ঐ শক্তি গিয়া আঘাত করুক; তাহারা কাঞ্চনের জন্য এই তীব্র আগ্রহের মধ্যে কাঞ্চনত্যাগী তোমাকে দেখিবামাত্র আশ্চর্য হউক। আর কামও ত্যাগ কর। কাম-কাঞ্চনত্যাগী হও, নিজেকে যেন বলিস্বরূপ প্রদান কর—তুমি ছাড়া আর কে ইহা সাধন করিবে? যাহারা জীর্ণ শীর্ণ বৃদ্ধ, সমাজ যাহাদিগকে ত্যাগ করিয়াছে—তাহারা নহে, কিন্তু পৃথিবীর মধ্যে যাহারা শ্রেষ্ঠ ও নবীনতম, সেই বলবান্ সুন্দর যুবাপুরুষেরাই ইহার অধিকারী, তাহাদিগকেই ভগবানের বেদীতে জীবন সমর্পণ করিতে হইবে; আর এই স্বার্থত্যাগের দ্বারা জগৎকে উদ্ধার কর। জীবনের আশা বিসর্জন দিয়া সমগ্র মানবজাতির সেবক হও—সমগ্র মানবজাতির নিকট ধর্মপ্রচার কর। ইহাকেই তো ত্যাগ বলে, শুধু বাক্যদ্বারা ইহা হয় না। উঠিয়া দাঁড়াও, এবং কাজে লাগিয়া যাও। তোমাদিগকে দেখিবামাত্র সংসারী লোকের মনে—কাঞ্চনাসক্ত ব্যক্তির মনে ভয়ের সঞ্চার হইবে। কথায় কখনও কোন কাজ হয় না—কতই তো প্রচার হইয়াছে, কোন ফল হয় নাই। প্রতিমুহূর্তেই অর্থ পিপাসায় রাশি রাশি গ্রন্থ প্রকাশিত হইতেছে, কিন্তু তাহাতে কোন উপকার হয় না, কারণ উহাদের পশ্চাতে কেবল ফাঁকি— ঐ-সকল গ্রন্থের ভিতরে কোন শক্তি নাই। এস, প্রত্যক্ষ উপলব্ধি কর। যদি কাম-কাঞ্চন ত্যাগ করিতে পার, তোমায় বাক্যব্যয় করিতে হইবে না, তোমার হৃৎপদ্ম প্রস্ফুটিত হইবে, তোমার ভাব চারিদিকে বিস্তৃত হইবে। যে ব্যক্তি তোমার নিকট আসিবে, তাহাকেই তোমার ধর্মভাব স্পর্শ করিবে।
বর্তমান জগতের সমক্ষে শ্রীরামকৃষ্ণের ঘোষণা এইঃ মতামত, সম্প্রদায়, গীর্জা বা মন্দিরের অপেক্ষা রাখিও না। প্রত্যেক মানুষের ভিতরে যে সারবস্তু অর্থাৎ ধর্ম রহিয়াছে, তাহার সহিত তুলনায় উহারা তুচ্ছ; আর যতই এই ভাব মানুষের মধ্যে বিকাশপ্রাপ্ত হয়, ততই তাহার ভিতর জগতের কল্যাণ করিবার শক্তি আসিয়া থাকে। প্রথমে এই ধর্মধন উপার্জন কর। কাহারও উপর দোষারোপ করিও না, কারণ সকল মত—সকল পথই ভাল। তোমাদের জীবন দিয়া দেখাও যে, ‘ধর্ম’ অর্থে কেবল শব্দ বা নাম বা সম্প্রদায় বুঝায় না, উহার অর্থ আধ্যাত্মিক অনুভূতি। যাহারা অনুভব করিয়াছে, তাহারাই ঠিক ঠিক বুঝিতে পারে। যাহারা নিজেরা ধর্মলাভ করিয়াছে, কেবল তাহারাই অপরের ভিতর ধর্মভাব সঞ্চার করিতে পারে, তাহারাই মানবজাতির শ্রেষ্ঠ আদর্শ হইতে পারে—তাহারাই কেবল জগতে জ্ঞানের শক্তি সঞ্চার করিতে পারে।
তাহা হইলে তোমরা এরূপ হও! কোন দেশে—এরূপ ব্যক্তির যতই অভ্যুদয় হইবে, সেই দেশ ততই উন্নত হইবে। আর যে দেশে এরূপ লোক একেবারে নাই, সে দেশের পতন অনিবার্য, কিছুতেই উহার উদ্ধারের আশা নাই। অতএব মানবজাতির নিকট মদীয় আচার্যদেবের উপদেশ এইঃ ‘প্রথমে নিজে ধার্মিক হও এবং সত্য উপলব্ধি কর।’ আর তিনি সকল দেশের দৃঢ় ও বলিষ্ঠ যুবকগণকে সম্বোধন করিয়া বলিতেন, ‘তোমাদের ত্যাগের সময় আসিয়াছে!’ তিনি চান, তোমরা তোমাদের ভাতৃস্বরূপ সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ কর। তিনি চান, তোমাদের মুখে কেবল ‘ভাইকে ভালবাসি’ না বলিয়া, তোমাদের কথা যে সত্য, তাহা প্রমাণ করিবার জন্য কাজে লাগিয়া যাও। যুবকগণের নিকট এখন এই আহ্বান আসিয়াছে, ‘কাজ কর, ঝাঁপিয়ে পড়, ত্যাগী হয়ে জগৎকে উদ্ধার কর।’
ত্যাগ ও প্রত্যক্ষানুভূতির সময় আসিয়াছে। জগতের বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে যে সামঞ্জস্য আছে তাহা দেখিতে পাইবে; বুঝিবে—বিবাদের কোন প্রয়োজন নাই এবং তখনই সমগ্র মানবজাতির সেবা করিতে পারিবে। মদীয় আচার্যদেবের জীবনের উদ্দেশ্য ছিল—সকল ধর্মের মূলে যে ঐক্য রহিয়াছে, তাহা ঘোষণা করা। অন্যান্য আচার্যেরা বিশেষ বিশেষ ধর্ম প্রচার করিয়াছেন, সেইগুলি তাঁহাদের নিজ নিজ নামে পরিচিত। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর এই মহান্ আচার্য নিজের জন্য কিছুই দাবী করেন নাই। তিনি কোন ধর্মের উপর কোনরূপ আক্রমণ করেন নাই, কারণ তিনি সত্য সত্যই উপলব্ধি করিয়াছিলেন যে, ঐ ধর্মগুলি এক সনাতন ধর্মেরই অঙ্গপ্রতঙ্গ মাত্র।