দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
০১.
পারমিটটা পকেটে পুরে ক্রন্দনরত লুসিলির দিকে পিছন ফিরে বাথরুমে গেলাম। টয়লেটে বেসিনের জলে ঘাড়ের কাটা জায়গাটা ধুতে থাকলাম। রক্ত পড়া বন্ধ হলে আয়নায় নিজেকে দেখে মনে হচ্ছিল এতক্ষণ নিশ্চয়ই কোথাও মারামারি করছিলাম।
শোবার ঘরে এসে পায়জামা পালটে একটা গলাখোলা শার্ট ও স্ন্যাক্স পরে লাউঞ্জে এসে সমুদ্রের বালি ও পাম গাছগুলো দেখতে দেখতে ভাবছিলাম।
এমন সময় একটা শব্দ হতেই পিছনে ফিরে দেখলাম লুসিলি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। কাঁপা কাঁপা গলায়…চেস…আমি সব বুঝিয়ে বলছি…সত্যি…আমি…।
ঠিক আছে, ভিতরে এসে সব বুঝিয়ে বল। শুনতে মন্দ লাগবে না, যথেষ্ট প্রমাণ পেয়েছি যে তুমি প্রথম শ্রেণীর মিথ্যাবাদী। এখন সত্যিই যদি তোমার কার্যকলাপ বুঝিয়ে বল, তার তোমাকে অস্কার পুরস্কার দেওয়া উচিত।
সে একটা চেয়ার নিয়ে বসতে বসতে বলল, দয়া করে শোন, চেস..আমি জানি তোমার পরিমাণ রাগ করা উচিত, কিন্তু আমি কখনও তোমার কাছে মিথ্যা বলিনি। তার মুখে একটা নিরপরাধ ভাব। কোনদিন যদি পারমিট চাইতে সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দিতাম। এ রকম ব্যবহার তোমার উচিত হয়নি।
দেখ, আমাকে তুমি রাগিয়ে দিও না।
অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে সে বলল, অত্যন্ত দুঃখিত, চেস। তোমাকে রাগাতে আমি চাই না কোনদিনই তোমার কাছে মিথ্যা বলিনি, যদি, তুমি আমাকে বিশ্বাস না কর…।
উঃ, এসব কথা ছাড়া তোমার কথাগুলো শোনা যাক। গাড়ি চালানো শিখতে চাওয়া আর কি একটা ধাপ্পা?
দেখ চেস, তোমাকে যে মুহূর্তে প্রথম দেখি সেদিনই তোমার প্রেমে পড়ি।
সেই মুহূর্তটা কখন?
যেদিন রাতে তুমি আমাদের বাড়িতে এসেছিলে–আমাকে দেখেছিলে।
মনে হল অনেক অনেক দিন আগের কথা।
যখন নিজের দেহটাকে আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিলে? সেই সময়?
হ্যাঁ, আমি অত্যন্ত একা, চেস। একটা বুড়োর সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কষ্ট তুমি বুঝবেনা। অত্যন্ত বিরক্তিকর। আমি তোমার সঙ্গে পরিচিত হতে চেয়েছিলাম। আমি জানতাম তোমার কাছে আনন্দ পাব। সেইজন্যেই আমি গাড়ি চালাতে শিখতে চাওয়ার ভান করি।
প্রশংসার ভঙ্গিতে বললাম, বাঃ, সত্যিই দারুণ ব্যাপার। কেবলমাত্র আমার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য একটা ওজর খুঁজছিলে?
সে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, হয়ত কোনদিনও তোমাকে একথা বলতাম না চেস, কারণ প্রেম এমনই জিনিস মেয়েরা মুখ ফুটে বলতে পারে না।
আমার কিন্তু মনে পড়ছে যখন আমরা সমুদ্রের ধারে গিয়েছিলাম, তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি আমাকে ভালবাস কিনা? তুমি কিন্তু অবাক হয়ে আমার উপর রেগেও গিয়েছিলে।
সে অস্বক্তিভরে বলল, আমি–আমি ভেবেছিলাম ভালবাসি এটা স্বীকার করে নেওয়া বিপজ্জনক। আমি–আমি সেটা চাইনি…
লুসিলি, আমি তোমাকে কোন অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলতে চাই না। তুমি গাড়ি চালাতে না জানার ভান করেছিলে কেবলমাত্র মজা মারার জন্য? আমি সোজাসুজি উত্তর চাই।
না, ঠিক তা নয়। তোমার সঙ্গে পরিচিত হতে চেয়েছিলাম। জানলে তুমি খুশি হবে। ভেবেছিলাম।
আচ্ছা, এখন তো আমাকে চিনেছ। এখন কি আমাকে তোমার ভাল লাগছে?
নিশ্চয়ই। যার প্রেমে পড়েছি তাকে জানা ভাল। যে কোন মেয়ের জীবনে প্রেম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। রোজার আমাকে ভালবাসে না।
এটা কখন আবিষ্কার করেছ, বিয়ের পরে না আগে?
সে যে আগে অভিনয় করেছিল সেটা মনে পড়তেই বলল, বিয়ের পরে এটা জানতে পারি। আমার উপর তার আর কোন আগ্রহ নেই।
কেন নেই? আশ্চর্য কথা।
সে বৃদ্ধ। তাছাড়া আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিও ভিন্ন।
বুঝতে পারছি। তোমার প্রতি অনুরক্ত এমন কোন মানুষকে খুঁজে নিতে চেয়েছিলে এবং সেইজন্যেই আমার উপর তোমার দৃষ্টি পড়ে।
তোমার রাগ করার কারণ বুঝতে পারি, চেস। তোমার জায়গায় আমি হলে এইরকমই মনে করতাম। তোমার রাগ করার জন্য একটুও দোষ দিচ্ছি না। এর অনেকটা দোষ আমার। আমি অত্যন্ত একা বোধ করি। তুমি আমার জীবন আবার সজীব করে তুলেছিলে।
হ্যাঁ, আমার জীবনেও তুমি যথেষ্ট আলোড়ন তুলেছিলে। তুমি সব কিছুই বলেছ। এখন সেগুলো খুঁটিয়ে দেখা যাক। তুমি নিশ্চয়ই বছর দুয়েক গাড়ি চালান শিখেছ, তাই না?
না, না, বছর দুই গাড়ি চালাচ্ছি না। আমার একটা পারমিট ছিল বটে। কিন্তু খুব বেশি চালাইনি। রোজার তার গাড়ি ব্যবহার করতে দিত না। হপ্তা দুয়েক চালিয়েছি, সে বলত আমি নাকি খুব জোরে গাড়ি চালাই সে জন্য আমাকে গাড়ি চালাতে দিত না।
যখন তুমি আমাকে শেখাতে বল তখন বুঝি আবার নতুন করে শিখতে চেয়েছিলে?
হ্যাঁ।
পারমিটটা তার কোলের উপর ছুঁড়ে দিলাম।
আশা করি তুমি এটা প্রমাণ করতে পারবে। তোমার স্বামীর ড্রাইভারকে যদি জিজ্ঞাস করা হয় কখনও তুমি গাড়ি ব্যবহার করতে কিনা। তোমাকে আমি সন্দেহ করি, লুসিলি। একজন– শিক্ষানবীসের পক্ষে পুলিশের লোককে চাপা দেওয়া এবং একজন অভিজ্ঞ ড্রাইভারের চাপা দেওয়া এক নয়। আদালতে বিচারক যখন তোমার পারমিট দেখবেন, তখন অন্যরকম হবে।
এভাবে কথা বলবে না। তুমি কেবল আমাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করছ।
সত্যিই তোমাকে ভয় দেখানোর ইচ্ছা আমার আছে, লুসিলি। তোমার বিশ্বাস তুমি এভাবে ছাড়া পেয়ে যাবে, তাই না?
এই প্রথম বোঝা গেল সে ক্রমশ আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে এবং তাকে অত্যন্ত বিরক্ত হতে হল।
তুমি কি বলতে চাইছে বুঝতে পারছি না, সে তীক্ষ্ণস্বরে বলে উঠল।
বুঝতে পারছনা? আমাকে একটু অনুগ্রহ করবে? তোমার হতাশা, তোমার স্বার্থ এবং তোমার সমস্যা নিয়ে আমার এখান থেকে চলে যাবে? তোমার যৌন–আবেদন, তোমার ছেলেমানুষি ভাব এবং তোমার লোভনীয় দেহ আমার দৃষ্টির সামনে থেকে সরিয়ে নেবে? তোমার রাতের পোশাকে যখন তুমি তোমার দেহটাকে তুলে ধরেছিলে, তখন সত্যিই আমি আসক্ত হয়ে পড়েছিলাম। যখন তোমাকে গাড়ির ভিতর দেখি তখন আবার আমার অনুরাগ জেগে ওঠে। আবার সমুদ্রের ধারে যখন তুমি এমন ভাব দেখাচ্ছিলে যেন যে–কোন মুহূর্তে আমাকে দেহদান করবে, কোন স্বার্থে বা মূল্যে নয়, তখনও অনুরাগ কম জেগে ওঠেনি। কিন্তু সেই সব ঘটনার পর আমার চোখ খুলে গিয়েছে। তোমার প্রতি কোন আগ্রহই বর্তমানে আমার নেই। আমার ধারণা তুমি প্রতারক। আমি জানি তুমি একজন মিথ্যাবাদী। এটাও জানি, যে কোন কারণেই হোক তোমার টাকার প্রয়োজন। কোনমতেই এ টাকা আমার কাছ থেকে পাবে না। অন্য কোন লোককে ধাপ্পা দেবার চেষ্টা কর। আমার মত তোমার ফাঁদে পা দেবার হাজার হাজার লোক আছে। আবার চেষ্টা কর। তবে এমন লোক বেছে নেবে যার বুদ্ধিসুদ্ধি কম। আমার উপদেশ নাও, তবে আমার আশা ছেড়ে দাও। যদি তাড়াতাড়ি চেষ্টা কর আর একজনকে নিশ্চয়ই বাগাতে পারবে। তোমার শুভ কামনা করি, এখন তোমার সুললিত দেহটা আমার সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দাও।
আমার দিকে চেয়ে সে চুপ করে বসে রইল। তার মুখটা ফ্যাকাসে এবং চোখদুটো কঠিন ও চকচকে দেখাচ্ছিল।
তুমি কি বলতে চাইছে বুঝতে পারছি না, সে শেষ পর্যন্ত বলল। তার নিঃশ্বাস জোরে জোরে পড়ছিল। আমাদের সঙ্গে এভাবে কথা বলতে পারলে কি করে? আমাদের ব্ল্যাকমেল করা হচ্ছে! এ ব্যাপারে আমি যতটা জড়িত তুমিও ততটা! আগেই বলেছি কেন আমার একটা ড্রাইভিং পারমিট আছে। কিন্তু তাতে সমস্ত ঘটনাটার পরিবর্তন হওয়া উচিত নয়। এই লোকটা তিরিশ হাজার ডলার চায়, নাহলে রোজারকে আমাদের কথা বলবে। এই অবস্থায় আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলতে পারলে কি করে?
উঠে দাঁড়ালাম।
বল, লুসিলি, কতদিন তুমি ও অসকার একসঙ্গে কাজ করেছ? কতদিন লোকের এভাবে রক্ত চোষার চেষ্টা করছ? তোমার ঘাড় ধরে বার করে দেবার আগে এই কথাটা বলে যাও।
সে ভয়ঙ্কর রেগে তার হাত দুটো নিয়ে আমার দিকে ছুটে এল। আমি তৈরিই ছিলাম। তার মনিবন্ধ চেপে ধরে ধাক্কা দিয়ে চেয়ার থেকে উঠিয়ে নিলাম ও হাতটা বাঁকিয়ে পিছন দিকে চেপে ধরলাম।
সে যন্ত্রণায় চীৎকার করছে। তাকে এক পাক ঘুরিয়ে মনিবন্ধটা ছেড়ে দিয়ে তার বাহু চেপে ধরলাম ও তার হিংস, জ্বলজ্বলে চোখ দুটোর দিকে চেয়ে রইলাম।
বল, এবার উত্তর দাও। কতদিন ধরে তোমরা দুজনে একসঙ্গে কাজ করছ?
তুমি ভুল করছ, ঐ লোকটার সঙ্গে আমি কোনদিনই কাজ করিনি। কি করে এ ধারণা হল?
ফাজলামি করবে না। আমাকে সেই নির্জন সমুদ্রের তটে নিয়ে যাওয়ার জন্য তুমি কাঁদ পেতেছিলে। সেখানে অন্য কেউ ছিল না। গতকাল আমি জায়গাটা দেখে এসেছি। সেখানে তোমার ও আমার ছাড়া আর কারও পায়ের চিহ্ন ছিল না। রস সেখানে যায় নি। কি ঘটেছিল সে জানত, তুমিই তাকে সব বলেছিলে। তোমার স্বামীর ব্যবসায়ে যে বিশ হাজার ডলার খাটাব ঠিক করেছিলাম, তোমরা দুজনে সেটা বাগাবার তালে ছিলে। তোমার স্বামী তোমাকে এসব বলেছিলেন, তাই না? সেই জন্যেই তুমি প্রথম সাক্ষাতের দিন একথা বারবার জিজ্ঞাসা করছিলে। তুমি রসকে সব বলেছিলে এবং দুজনে ব্ল্যাকমেল করে আমার কাছ থেকে টাকাটা বাগাবার চেষ্টা করেছ। যেদিন তোমাকে টেলিফোনে বলি যে সমস্যার একটা সমাধান হয়েছে, তুমি সেদিন খুশি হওনি। আমি রিসিভার নামিয়ে রাখামাত্র তুমি ফোন করে রসকে সব জানিয়ে দাও। সে প্রথমে এসে দেখল আমি কি করছি এবং আসার সময় একটা ক্যামেরা ও ফ্ল্যাশলাইট নিয়ে এসেছিল। এখন পারলে তোমার বর্তমান দুর্ভাগ্যের কথা মিথ্যা করে বলতে পার।
সে চেয়ারে বসে কাঁদতে লাগল।
বাইরে এসে কিছু পানীয় ঢেলে বরফ মিশিয়ে গ্লাসটা নিয়ে ফিরে এলাম, তখন সে কান্না থামিয়ে চোখ মুছছিল।
চেস…..।
আবার শুরু করা যাক। ইতিমধ্যে আর কি কি গল্প বানালে?
চেস, আমাকে এত কষ্ট দিও না, এবারের ভঙ্গি একটু নতুন। আমি কিছুই জানি না, সে–সে বেশ কয়েকমাস ধরে আমাকে ব্ল্যাকমেল করছে।
অল্প স্কচ পান করলাম।
তুমি বলতে চাও অসকার তোমাকে কয়েকমাস ধরে ব্ল্যাকমেল করছে?
হ্যাঁ
সুতরাং তুমি ভাবলে যে অসকার যদি একই সঙ্গে আমাকেও ব্ল্যাকমেল করে তবে ভাল হয়?
আমি এড়িয়ে যেতে পারিনি। সে কোন রকমে জেনেছিল যে তোমার অনেক টাকা আছে…।
নিশ্চয়ই তুমি বলেছিলে?
না দিব্যি করে বলতে পারি আমি বলিনি, সে নিজেই জেনেছিল।
রেগে বললাম, দেখ বাজে কথা বল না। ভগবানের দোহাই, এমন গল্প বানাবে যেন সেটা বিশ্বাসযোগ্য হয়। কেবল আইকেন ও তুমি জানতে যে আমি কি পরিমাণ অর্থ ব্যবসায়ে খাটাব। আইকেন কিছুতেই বলবেন না। সুতরাং তুমিই বলেছ।
আমি–আমি তাকে বলতে চাইনি চেস। তুমি এটুকু বিশ্বাস রেখ। আমরা দুজনে কথা বলছিলাম এবং বলেছিলাম, এমন একজনকে চিনি যার অনেক টাকা আছে। আমিও যদি এত টাকার মালিক হতে পারতাম। এমনি কথাচ্ছলে…মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, ইচ্ছা করে তাকে বলিনি।
তাহলে তুমিই বলেছিলে?
সে আবার হাঁটুর ভিতর হাত দুটো ঘষার কৌশল রপ্ত করতে লাগল।
হ্যাঁ, তবে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে বলিনি।
সে কেন মাসের পর মাস তোমাকে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছিল?
সে ইতস্ততঃ করছিল এবং অস্বস্তি ভরে বলল, আমি সে কথা বলতে পারব না চেস। এটা–এটা অত্যন্ত গোপনীয়। এমন কিছু আমি করেছিলাম…।
কোন আকর্ষণীয় ব্যক্তিকে সমুদ্রের ধারে নিয়ে যাওয়ার মত ঘটনা?
না, সেরকম নয়। আমি আগে কখনই এরকম করিনি।
বেশ ঠিক আছে, বলে ফেল। সে তাহলে তোমাকে ব্ল্যাকমেল করছিল এবং তা সত্ত্বেও তুমি বেশ খোশ মেজাজেই তার সঙ্গে গল্প করছিলে, যেমন ধর তোমার স্বামীর কর্মচারীদের নিয়ে এবং তাদের কার কত টাকা আছে সে সব নিয়ে।
না, এসব নিয়ে নয়…
বাজী রেখে বলতে পারি এসব নিয়ে। যাই হোক, আমাকে সমুদ্রের ধারে নিয়ে যাওয়া, তোমাকে গাড়ি চালান শেখাতে বলা তারই আইডিয়া, কি বল?
হা।
তুমি আমাকে কেন সমুদ্রের ধারে নিয়ে গিয়েছিলে তা জানতে না। কি বল?
না না, সে বলেনি।
যেহেতু সে তোমাকে ব্ল্যাকমেল করে সেজন্য তার কথামত তুমি ওঠা বসা কর। কি বল?
তার মুখে রক্ত জমা হল।
সে যা বলে তাই আমাকে করতে হয়।
তুমি কি তাকে টাকা দাও?
সংকুচিত মুখে সে বলল, না, কোন টাকা দিইনি।
সে তাহলে ব্ল্যাকমেল করে কেবল তার ইচ্ছেমত তোমাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিয়ে।
হ্যাঁ।
আমার সঙ্গে সেদিনের ছোষ্ট্র অভিনয়ের পর তুমি গাড়ি চালিয়ে যেভাবেই হোক একজন পুলিশকে চাপা দাও। তাড়াতাড়ি কাছের কোন জায়গা থেকে তাকে ফোন করে বল যে তুমি একজন পুলিশকে চাপা দিয়েছ। সে দেখল আমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করার মত এটা মারাত্মক অস্ত্র এবং তোমাকে উপদেশ দিল আমার বাংলোতে গিয়ে আর এক দফা অভিনয় করতে। তার কথামত তুমি বারবার আমাকে অনুরোধ করতে লাগলে দায়িত্ব আমার নিজের কাঁধে তুলে নেওয়ার জন্যে। সে তোমাকে আশ্বাস দিল টাকাটা আমার কাছ থেকে সে নেবে। যেহেতু তুমি তার কথায় ওঠবস, সেহেতু তার উপদেশ মত কাজ করলে।
সমস্ত ঘটনাটা এভাবে ঘটে নি, চেস। আমি ফোন করিনি। আমি এখানে এসেছিলাম।
তোমাকে বিশ্বাস করি না, লুসিলি। আমি বিশ্বাস করি না রস তোমাকে ব্ল্যাকমেল করেছে। আমি বিশ্বাস করি তুমি এবং রস একই সঙ্গে এই ব্যবসা চালাচ্ছ।
ভুল করছ, চেস! দিব্যি করে বলছি আমরা ব্ল্যাকমেল করি না, সে বলল, আমি যা বলেছি। তাই সত্যি।
তাকে চেয়ে দেখছিলাম, সে মিথ্যা বলছে।
ঠিক আছে, দুজনে এক সঙ্গে গিয়ে রসের সঙ্গে কথা বলব। তার কি বলার আছে শুনতে চাই। তুমি অপেক্ষা কর, পোশাক পালটে এখনই আসছি। তুমি আর আমি তার সঙ্গে কথা বলব।
তার প্রতিবাদ করার আগেই লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে এসে ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিলাম। শোবার ঘরটায় এলাম। সে–ঘরের দরজাটা খুলে চুপ করে দাঁড়িয়ে শুনতে লাগলাম।
লাউঞ্জের দরজা খোলার শব্দ পেলাম। লুসিলিকে হলঘরে ঢুকতে এবং সেখান থেকেই আর শোবার ঘরের দিকে চাইতে দেখলাম, সে লাউঞ্জে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল। একটু পরে টেলিফোন করার শব্দ পেলাম।
তার জন্য যে ফাঁদ পেতে রেখে এলাম সে তাতে পা দিল।
পা টিপে টিপে দরজার কপাটে কান পেতে শুনতে লাগলাম।
তাকে বলতে শুনলামঃ আমি এখন কি করব? মনে হয় না সে টাকা দেবোনা…আর সামলাতে পারছি না, তোমার কিছু করা দরকার…।
হাতলটা ঘুরিয়ে ঢুকলাম।
লুসিলি টেলিফোনের কাছ থেকে সরে এল।
ঠিক আছে, ঠিক আছে, বললাম। অপরাধীর মত চেয়ে থেকো না, তোমার কথা শুনেছি। এবার স্বীকার করবে তুমি তাদের দলে।
সে আমার দিকে চেয়ে রইল। তাকে আর সুন্দর বা তাজা যুবতী দেখাচ্ছিল না। তাকে বয়স্কা, পরাজিত এবং ফাঁদে ধরা-পড়া জীবের মত দেখাচ্ছিল।
নিজেকে খুব চালাক ভেবেছ, তাই না?
ঠিক আছে, আমি দোষ স্বীকার করছি। কিন্তু টাকা তোমাকে দিতে হবে। তুমি প্রমাণ করতে পারবে না আমি তোমার সঙ্গে ছিলাম। আমি গাড়ি চালাচ্ছিলাম। গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় তোমার একটা ছবি আমার হাতে আছে। যদি টাকা না দাও তোমার ছবি পুলিশের কাছে পাঠিয়ে দেব। আমি অন্য জায়গায় ছিলাম প্রমাণ করতে পারব। আমার লোক আছে, যারা সাক্ষ্য দিতে পারবে যে, দুর্ঘটনার সময় আমি তাদের সঙ্গে ছিলাম। টাকা দেওয়া ছাড়া তোমার গত্যন্তর নেই।
গাড়ির পিছনের চাকার রক্তের দাগগুলো আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল কিন্তু এখন বুঝতে পারলাম দাগগুলো কি করে হয়েছিল। ডলোরেস এবং নাটলের মত ও ব্রায়ানকেও হত্যা করা হয়েছিল।
তুমি ও রস তাকে হত্যা করেছিলে, তাই না? ধাক্কা দেওয়াটা মিথ্যে ঘটনা। তুমি তার মাথায় আঘাত করেছিলে, পরে ক্যাডিলাকটার পিছনের চাকা দিয়ে তাকে চাপা দিয়েছিলে। না ভেবে কাজ করায় তোমরা বিরাট ভুল করেছিলে। ভুল করে পিছনের চাকা দিয়ে তাকে চাপা দিয়েছিয়ে এটা এত বড় ভুল, লুসিলি যে হত্যাকারীর তার জন্য ফাঁসি হতে পারে।
সে ফ্যাকাশে মুখে বলল, আমি তাকে হত্যা করিনি।
তুমি ও রস তাকে হত্যা করেছিলে। এক ঢিলে তোমরা দুটো পাখি মারতে চেয়েছিলে, চাও নি? তোমরা ও’ব্রায়ানের হাত থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলে এবং আমার কাছ থেকে বিশ হাজার ডলার বার করতে চেয়েছিলে।
কর্কশ স্বরে সে বলল, কথাটা ঠিক নয়। তুমি কিছুই প্রমাণ করতে পারবে না। আমি তাকে হত্যা করিনি। যদি তুমি আমাদের টাকা না দাও…
কোন মতেই টাকা পাচ্ছ না। সামনের বিকেলটা খুব ব্যস্ততায় কাটাব। আমি জানতে চাই কেন তোমরা ও ব্রায়ানকে হত্যা করেছিলে। আমি তোমাকে সঙ্গে নিচ্ছি না। তোমার হাত-পা বেঁধে এখানে রেখে যাব। আমি যা জানতে চাই যতক্ষণ না তা জানতে পারি।
সে ভয়ে পেছন দিকে হটতে শুরু করল, আমার গায়ে হাত দেওয়ার চেষ্টা করো না। আমাকে এখানে রেখে যেতে পারবে না।
তার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললাম, যদি শান্তভাবে আত্মসমর্পণ না কর তবে বল প্রয়োগ করতে হবে। গলার কাছটা যেমন আঁচড়ে দিয়েছিলে যদি সেরকম খারাপ ব্যবহার কর তবে বাধ্য হয়ে আমাকেও খারাপ ব্যবহার করতে হবে।
সে পাক খেয়ে জানালার দিকে ছুটল কিন্তু তার আগেই ছুটে গিয়ে তার বাহু চেপে ধরে এক পাক ঘুরিয়ে দিলাম। সে আমার মুখ আঁচড়ে দেবার চেষ্টা করছিল, তার হাতে দুটো ধাক্কা মেরে সরিয়ে জোরে মুখের চোয়ালে আঘাত করলাম। তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল, সে জড়বস্তুর মত আমার আলিঙ্গনে ধরা দিল।
তাড়াতাড়ি তার হাত দুটো পিছনে টেনে তার পায়ের সঙ্গে বেঁধে দিলাম। তাকে চ্যাংদোলা করে শোবার ঘরে নিয়ে আমার বিছানায় শুইয়ে দিলাম।
ওয়ার্ডরোবের কাছে গিয়ে জামা ও টাই পরে জুতো পালটে নিলাম। দেখলাম সে নড়তে শুরু করেছে।
রান্নাঘর থেকে একটা দড়ি এনে বিছানার সঙ্গে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধলাম।
সে চোখ খুলে আমার দিকে চাইল, ভয়ে পূর্ণ চোখ।
অত্যন্ত দুঃখিত, কিন্তু তোমার এটা প্রয়োজন ছিল। তোমাকে এভাবে ফেলে যেতে আমার কষ্ট হচ্ছে কিন্তু উপায় নেই। যত শীঘ্র পারি ফিরব। চুপ করে শুয়ে থাক, তোমার কোন ক্ষতি হবে না।
সে হিংস্রভাবে বলল, আমাকে ছেড়ে দাও বলছি, এর শোধ নেব।
সব ঠিক আছে দেখে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম।
আমাকে ছেড়ে যেও না। ফিরে এস।
ঘাবড়িও না। বেশি দেরি করব না
বেরিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিলাম।
প্যাসেজ দিয়ে যখন যাচ্ছি তাকে প্রাণভয়ে চীৎকার করতে শুনলাম। চেস আমাকে ছেড়ে যেও না। দয়া করে আমাকে ছেড়ে যেও না।
আমি ভ্রূক্ষেপ না করে বাংলোর সদর দরজায় তালা দিয়ে বুইক গাড়িটার দিকে ছুটে গেলাম।