গল্প
উপন্যাস
পরিশিষ্ট

১২. পান্থশালা

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ – পান্থশালা

চিত্রক ও রাজকুমারী রট্টা যখন পান্থশালায় উপনীত হইলেন, তখন সূর্যাস্ত হইতে আর দুই দণ্ড বাকি আছে।

দুইটি পথের সন্ধিস্থলে পান্থশালাটি অবস্থিত। যে পথ চষ্ঠন দুর্গের সহিত কপোতকূটের সংযোগ স্থাপন করিয়াছে, এই স্থানে সেই পথ হইতে একটি শাখা বাহির হইয়া অগ্নিকোণে আর্যাবর্তের দিকে চলিয়া গিয়াছে, দ্বিধা-ভিন্ন পথের মধ্যস্থলে প্রস্তর-প্রাকার-বেষ্টিত এই পান্থশালা।

স্থানটি মনোরম। উত্তর ও পূর্বদিকে ঘন পর্বতের শ্রেণী; পশ্চিমদিকে বহুদূর পর্যন্ত উন্মুক্ত উপত্যকা। এই উপত্যকার মধ্য দিয়া একটি উপল-কুটিলা ক্ষুদ্র নদী বহিয়া গিয়াছে; মনে হয় পূর্বদিকে পর্বতকন্দর হইতে নির্গত এক রজতবর্ণ নাগ শ্লথগতিতে অস্তাচলের পানে কোনও নূতন বিবরের সন্ধানে চলিয়াছে।

পান্থশালাটি আয়তনে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র হইলেও দুর্গের আকারে নির্মিত, উচ্চ পাষাণ-প্রাচীর দ্বারা পরিবেষ্টিত। জনালয় হইতে দূরে অরক্ষিত পথপার্শ্বে পান্থশালা নিমাণ করিতে হইলে বেশ দৃঢ় করিয়া নির্মাণ করিতে হয়। একে তো এ অঞ্চলে খণ্ড যুদ্ধাদি লাগিয়াই আছে, তদুপরি উত্তর-পশ্চিমের গিরিসঙ্কট মধ্যে যে সকল বন্য জাতি বাস করে তাহারা বড়ই দুর্দম প্রকৃতি। তাহারা মেষ পালনের অবকাশকালে দল বাঁধিয়া দস্যুতা করে। পথে অরক্ষিত যাত্রিদল পাইলে লুটপাট করে; সুযোগ পাইলে পান্থশালাকেও অব্যাহতি দেয় না। তাই দিবাভাগে পান্থশালার লৌহ-কণ্টকযুক্ত দ্বার খোলা থাকিলেও সূর্যাস্তের সঙ্গে উহা বন্ধ হইয়া যায়। তখন আর কাহারও প্রবেশাধিকার থাকে না; চিরাগত যাত্রীরা দ্বারের বাহিরে রাত্রি যাপন করে।

চিত্রক ও রট্টা পান্থশালার তোরণমুখে উপস্থিত হইলে পান্থপাল ছটিয়া আসিয়া জোড়হস্তে অভ্যর্থনা করিল— ‘আসুন, কুমার-ভট্টারিকা, আপনার পদার্পণে আমার স্থান পবিত্র হইল। — দূত মহাশয়, আপনিও স্বাগত। আমি ভাগ্যবান, তাই আজ—’ বলা বাহুল্য, পান্থপাল পূর্বেই নকুল প্রমুখাৎ সংবাদ পাইয়াছিল যে ইহারা আসিতেছেন।

চিত্রক ও রট্টা অশ্ব হইতে অবতরণ করিলেন। পান্থপাল ব্যস্ত হইয়া ডাকিল— ‘ওরে কে আছিস— কঙ্ক ডুণ্ডুভ— শীঘ্র কম্বোজ দু’টিকে মন্দুরায় লইয়া যা, যব-শক্তু শালি-প্রিয়ঙ্গু দিয়া সেবা কর।’

দুইজন কিঙ্কর আসিয়া অশ্ব দু’টির বল্‌গা ধরিয়া ভিতরে লইয়া গেল। রট্টা জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘আমার রক্ষীরা কি চলিয়া গিয়াছে?’

পান্থপাল বলিল— ‘আজ্ঞা হাঁ। নকুল মহাশয়ের ইচ্ছা ছিল না; কিন্তু কুমার-ভট্টারিকার আদেশ অলঙঘনীয়। তাঁহারা দ্বিপ্রহরেই চলিয়া গিয়াছেন।’

পান্থপাল মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি; স্থূলকায় কিন্তু নিরেট। বচনবিন্যাসে বেশ পটু। চিত্রক তাহাকে উত্তমরূপে নিরীক্ষণ করিয়া বলিল— ‘এখানে দেবদুহিতা রাত্রিযাপন করিলে ভয়ের কোনও কারণ নাই?’

‘ভয়! আমার পান্থশালার দ্বার বন্ধ হইলে মূষিকেরও সাধ্য নাই ভিতরে প্রবেশ করে।’ পান্থপাল কণ্ঠস্বর হ্রস্ব করিয়া বলিল— ‘তবে ভিতরে কয়েকটি পান্থ আছে। তাহারা বিদেশী বণিক, পারস্যদেশ হইতে আসিতেছে; মগধে যাইবে—’

‘তাহারা কি বিশ্বাসযোগ্য নয়?’

‘বিশ্বাসের অযোগ্য বলিতে পারি না। ইহারা বহু বৎসর ধরিয়া এই পথে গতায়াত করিতেছে। মেষরোমের আস্তরণ গাত্রাবরণ প্রভৃতি লইয়া আর্যাবর্তের বিভিন্ন প্রান্তে বাণিজ্য করিয়া বেড়ায়। তবে উহারা অগ্নি-উপাসক, ম্লেচ্ছ। সাবধানের নাশ নাই।’

‘কিরূপ সাবধানতা অবলম্বন কর্তব্য?’

পান্থপাল বলিলেন— ‘ইনি দেবদুহিতা একথা প্রকাশ না করিলেই চলিবে। ইনি আসিতেছেন। তাহা আমি ভিন্ন আর কেহ জানে না।’

চিত্রক দেখিল পান্থপাল লোকটি চতুর ও প্রত্যুৎপন্নমতি; সে বলিল— ‘ভাল। — পান্থপাল, তোমার নাম কি?’

পান্থপাল সবিনয়ে বলিল— ‘দেবদ্বিজের কৃপায় এ দাসের নাম জয়কম্বু। কিন্তু আর্যভাষা সকলের মুখে উচ্চারণ হয় না, কেহ কেহ জম্বুক বলিয়া ডাকে।’

চিত্রক হাসিয়া বলিল— ‘ভাল। জম্বুক, আমাদের ভিতরে লইয়া চল। আমরা শ্রান্ত হইয়াছি।’

জম্বুক বলিল— ‘আসুন, মহাভাগ, আসুন দেবি—। আপনাদের জন্য শ্রেষ্ঠ দু’টি কক্ষ সজ্জিত করিয়া রাখিয়াছি। এদিকে স্নিগ্ধ অম্লসীধু প্রস্তৃত আছে, অনুমতি হইলেই—’

চিত্রক ও রট্টা প্রাকারের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন। সূর্য তখনও অস্তাচল স্পর্শ করে নাই, কিন্তু জম্বুকের আদেশে দুইজন দ্বারী বন্ধ করিয়া ইন্দ্রকীলক আঁটিয়া দিল। কাল সূর্যোদয় পর্যন্ত আর কেহ প্রবেশ করিতে পারিবে না।

রট্টা পূর্বে কখনও পান্থশালা দেখেন নাই, তিনি পরম কৌতূহলের সহিত চারিদিকে দৃষ্টি ফিরাইয়া দেখিতে দেখিতে চলিলেন। প্রাচীর দ্বারা পরিবৃত স্থানটি চতুষ্কোণ; তিনটি প্রাচীরের গাত্রে সারি সারি প্রকোষ্ঠ; প্রকোষ্ঠগুলির সম্মুখে একটানা অপ্রশস্ত অলিন্দ। মধ্যস্থলে শিলাপট্টাবৃত সুপরিসর উন্মুক্ত অঙ্গন। অঙ্গনের কেন্দ্রস্থলে চক্রাকৃতি বৃহৎ জলকুণ্ড।

অঙ্গনের এক কোণে কয়েকটি উষ্ট্র ও গর্দভ রহিয়াছে; তাহারা পারসিক পণ্যবাহক। পারসিকেরা নিকটেই আস্তরণ বিছাইয়া বসিয়া আছে এবং নিজেদের মধ্যে রহস্যালাপ করিতেছে। তাহাদের মুখমণ্ডল শ্মশ্রু-মণ্ডিত; বর্ণ পক্ক দাড়িম্বের ন্যায়; চক্ষু ও কেশ ঘনকৃষ্ণ।

রট্টা যখন চিত্রক ও জম্বুকের সহিত তাহাদের নিকট দিয়া চলিয়া গেলেন তখন তাহারা একবার চক্ষু তুলিয়া দেখিল, তারপর আবার পরস্পর বাক্যালাপ করিতে লাগিল। ইহারা নিতান্ত নিরীহ বণিক, ছদ্মবেশী দস্যু তস্কর নয়; কিন্তু চিত্রকের মন সন্দিগ্ধ হইয়া উঠিল। নারী লইয়া পথ চলা যে কিরূপ উদ্বেগজনক কাজ এ অভিজ্ঞতা পূর্বে তাহার ছিল না।

চিত্রক নিম্নস্বরে জম্বুককে প্রশ্ন করিল— ‘ইহারা কয়জন?’

জম্বুক বলিল— ‘পাঁচজন।’

‘সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র আছে?’

‘আছে। অস্ত্র না লইয়া এদেশে কেহ পথ চলে না।’

‘তোমার ভৃত্য অনুচর কয়জন?’

‘আমরা পুরুষ আটজন আছি।’

‘স্ত্রীলোকও আছে নাকি?’

জম্বুক প্রাঙ্গণের বিপরীত প্রান্তে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বলিল— ‘আমাদের চারিজন অন্তঃপুরিকা আছে।’

চিত্রক অনেকটা আশ্বস্ত হইল।

অঙ্গনের অন্য প্রান্তে চারিজন নারী বসিয়া গৃহকর্ম করিতেছিল। রট্টা সেখানে গিয়া স্মিতমুখে দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিলেন। চত্বরের কিয়দংশ পরিষ্কৃত করিয়া নারীগণ নৈশ ভোজনের আয়োজন করিতেছে। একজন ঘরট্ট ঘুরাইয়া গোধূম চূর্ণ করিতেছে; নবচূর্ণিত গোধূম হইতে রোটিকা প্রস্তুত হইবে। দ্বিতীয়া শাক বাছিতেছে; তৃতীয়া প্রস্তরের উদূখলে সুগন্ধি বেশার কুট্টন করিতেছে; চতুর্থী মেষমাংস ছুরিকা দিয়া কাটিয়া কাটিয়া পৃথক করিয়া রাখিতেছে। তাহারা মাঝে মাঝে সম্ভ্রম-কৌতূহলপূর্ণ চক্ষু তুলিয়া এই পুরুষবেশিনী সুন্দরীকে দেখিল, কিন্তু তাহাদের ক্ষিপ্র নিপুণ হস্তের কার্য শিথিল হইল না।

রট্টা কিছুক্ষণ ইহাদের মসৃণ কর্মদক্ষতা নিরীক্ষণ করিলেন। তারপর একটি ক্ষুদ্র নিশ্বাস ফেলিয়া জম্বুকের দিকে ফিরিলেন— ‘জম্বুক, তোমাকে একটা কাজ করিতে হইবে।’

জম্বুক তৎক্ষণাৎ যুক্তপাণি হইল— ‘আজ্ঞা করুন।’

‘কপোতকূটের পথে পর্বতের উপর একটি বৌদ্ধবিহার আছে জান কি?’

‘আজ্ঞা জানি। চিল্লকূট বিহার।’

‘সেখানে ভিক্ষুদের জন্য দুই আঢ়ক উত্তম গোধূম পাঠাইতে হইবে।’

‘আজ্ঞা পাঠাইব। কল্য প্রাতেই গর্দভপৃষ্ঠে গোধূম পাঠাইয়া দিব। ভিক্ষুরা সূর্যাস্তের পূর্বেই পাইবেন।’

‘ভাল। আমি মূল্য দিব।’

চিত্রক ও রট্টার জন্য যে দুইটি কক্ষ নির্দিষ্ট হইয়াছিল তাহা আকার ও আয়তনে অন্যান্য কক্ষের মতই, কিন্তু কক্ষের কুট্টিমে উষ্ট্ররোমের আস্তরণ বিস্তৃত হইয়াছিল, তদুপরি কোমল শয্যা। কোণে পিত্তলের দীপদণ্ডে বর্তি জ্বলিতেছে। রাজকুমারীর পক্ষে ইহা তুচ্ছ আয়োজন; কিন্তু দেখিয়া রট্টা প্রীত হইলেন।

অম্লসীধু সহযোগে কিছু ক্ষীরের মণ্ড ভক্ষণ করিয়া উভয়ে আপাতত ক্ষুৎপিপাসার নিবৃত্তি করিলেন। রাত্রির আহার বাকি রহিল।

আহারান্তে চিত্রক গাত্রোত্থান করিয়া রট্টাকে বলিল— ‘আপনি এখন কিয়াৎকাল বিশ্রাম করুন।’ বলিয়া রট্টার কক্ষের দ্বার ভেজাইয়া দিয়া বাহিরে আসিল।

আকাশে তখন নক্ষত্র ফুটিয়াছে; রাত্রি অন্ধকার, এখনও চন্দ্রোদয় হয় নাই। পান্থশালার প্রাঙ্গণের স্থানে স্থানে অগ্নি জ্বলিতেছে। ওদিকে পারসিকেরা অঙ্গার কুণ্ড প্রস্তুত করিয়া শূল্য মাংস রন্ধন করিতেছে; দগ্ধ মাংসের বেশার-মিশ্র সুগন্ধ ঘ্রাণেন্দ্রিয়কে লুব্ধ করিয়া তুলিতেছে।

চিত্রক বলিল— ‘হিঙ্গু-পলাণ্ডু-ভোজী ম্লেচ্ছগুলা রাঁধে ভাল। জম্বুক, রাত্রে আমাদের ভোজনের কি ব্যবস্থা?’

জম্বুক ভোজ্য বস্তুর দীর্ঘ তালিকা দিল। প্রথমেই মিষ্টান্ন; মধু পিষ্টক লড্ডু ও ক্ষীর; তারপর শাক ঘৃত-তণ্ডুল মুদ্‌গ-সূপ, ময়ূর ডিম্ব; সর্বশেষে রোটিকা পুরোডাশ ও তিন প্রকার অবদংশ সহ উখ্য মাংস শূল্য মাংস ও দধি।

চিত্রক সন্তুষ্ট হইয়া বলিল— ‘উত্তম। দেবদুহিতার কষ্ট না হয়। আর শুন, শূল্য মাংস আমি রন্ধন করিব।’

জম্বুক চক্ষু বিস্ফারিত করিল, কিন্তু তৎক্ষণাৎ সায় দিয়া বলিল— ‘যেরূপ আপনার অভিরুচি।’

চিত্রক কক্ষের সম্মুখে অঙ্গনের উপর একটা স্থান নির্দেশ করিয়া বলিল— ‘এইখানে অঙ্গার চুল্লী রচনা কর।’

জম্বুকের আদেশে ভৃত্য আসিয়া অঙ্গার চুল্লী রচনায় প্রবৃত্ত হইল। এই অবকাশে ইতস্তত পাদচারণা করিতে করিতে চিত্রক লক্ষ্য করিল, কক্ষশ্রেণী যেখানে শেষ হইয়াছে সেখানে একটি বংশনির্মিত নিঃশ্রেণি বক্রভাবে ছাদসংলগ্ন হইয়া রহিয়াছে। তাহার মন আবার সন্দিগ্ধ হইয়া উঠিল। ছাদে উঠিবার সিঁড়ি কেন? উপরে যদি কেহ লুকাইয়া থাকে? চিত্রক জম্বুককে সিঁড়ি দেখাইয়া বলিল— ‘ছাদে কী আছে?’

জম্বুক বলিল— ‘শুষ্ক জ্বালানি কাষ্ঠ আছে। আর কিছু নাই।’

চিত্রকের সন্দেহ ঘুচিল না; সে স্বচক্ষে দেখিবার জন্য নিঃশ্রেণি বাহিয়া ছাদে উঠিয়া গেল। জম্বুককে বলিল— ‘তুমিও এস।’

ছাদের উপর সত্যই জ্বালানি কাষ্ঠ ভিন্ন আর কিছু নাই। চিত্রক নক্ষত্রলোকে ত্রিভুজ ছাদের সর্বত্র পরিভ্রমণ করিয়া নিশ্চিন্ত হইল। ছাদের উপর মন্দ মন্দ শীতল বায়ু বহিতে আরম্ভ করিয়াছিল; চারিদিক শব্দহীন, অন্ধকার; কেবল গিরিনদীর বুকে নক্ষত্র খচিত আকাশের প্রতিবিম্ব পড়িয়াছে।

চিত্রক নামিবার উপক্রম করিতেছে এমন সময় বাহিরের অন্ধকার হইতে এক উৎকট অট্ট-কোলাহল উত্থিত হইয়া চিত্রককে চমকিত করিয়া দিল। একদল শৃগাল নিকটেই কোথাও বসিয়া যাম ঘোষণা করিতেছে।

তাহাদের সম্মিলিত ক্রোশন ক্রমে শান্ত হইলে চিত্রক হাসিয়া উঠিল, বলিল— ‘এখানে জম্বুকের অভাব নাই দেখিতেছি।’

জম্বুক হাসিল, বলিল— ‘পৃথিবীতে জম্বুকের অভাব কোথায়? তবে জয়কম্বু বড় অধিক নাই মহাশয়।’

চিত্রক বলিল— ‘সেকথা সত্য। তুমি উত্তম পান্থপাল।’

এই সময় পশ্চিম দিগন্তের পানে দৃষ্টি পড়িতে চিত্রক দেখিল, বহুদূরে চক্রবালরেখার নিকট যেন পাহাড়ে আগুন লাগিয়াছে; আগুন দেখা যাইতেছে না, কেবল তাহার উৎসারিত প্রভা দিগন্তকে রঞ্জিত করিয়াছে।

অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া চিত্রক জিজ্ঞাসা করিল— ‘উহা কি? পাহাড়ের জঙ্গলে কি আগুন লাগিয়াছে?’

জম্বুক বলিল— ‘বোধহয় না। কয়েকদিন ধরিয়া দেখিতেছি, একই স্থানে আছে। পাহাড়ের আগুন হইলে দক্ষিণে বামে ব্যাপ্ত হইত।’

‘তবে কী? ওদিকে কি কোনও নগর আছে? কিন্তু নগর থাকিলেও রাত্রে এত আলো জ্বলিবে কেন? ইহা তো দীপোৎসবের সময় নয়।’

‘ওদিকে নগর নাই। তবে—’

‘তবে?’

জম্বুক বলিল— ‘পান্থশালায় অনেক লোক আসে যায়, অনেক কথা শুনিতে পাই। শুনিয়াছি, হূণ আবার আসিতেছে। যদি কথা সত্য হয়, আবার দেশ লণ্ডভণ্ড হইবে।’ বলিয়া জম্বুক নিশ্বাস ফেলিল।

চিত্রক বলিল— ‘তোমার কি মনে হয় হূণেরা ঐখানে ছত্রাবাস ফেলিয়াছে?’

জম্বুক বলিল— ‘না, তাহা মনে হয় না। হূণেরা এত কাছে আসিলে লুটপাট করিত, অত্যাচার করিত। কিন্তু এদিকে হূণ দেখি নাই।’

‘তবে কী হইতে পারে?’

‘জনশ্রুতি শুনিয়াছি, সম্রাট স্কন্দগুপ্ত সসৈন্যে হূণের গতিরোধ করিতে আসিয়াছেন।’

চিত্রক বিস্মিত হইয়া বলিল— ‘স্কন্দগুপ্ত স্বয়ং!’

জম্বুক বলিল— ‘এইরূপ শুনিয়াছি। সত্য মিথ্যা বলিতে পারি না। কেন, আপনি কিছু জানেন না?’

চিত্রক চকিতে আত্মসংবরণ করিয়া বলিল— ‘না, আমি কিছু জানি না। যুদ্ধ সম্ভাবনার পূর্বেই আমি পাটলিপুত্র ছাড়িয়াছি।’

চিত্রক ও জম্বুক নীচে নামিয়া আসিল।

ভৃত্য ইতিমধ্যে অঙ্গার প্রস্তুত করিয়া শূল্য মাংসের উপকরণাদি আনিয়া রাখিয়ছে। চিত্রক তাহা দেখিয়া প্রথমে গিয়া রট্টার রুদ্ধ দ্বারের সম্মুখে দাঁড়াইল। কান পাতিয়া শুনিল, কিন্তু কিছু শুনিতে পাইল না। তখন সে দ্বার ঈষৎ ঠেলিয়া ভিতরে দৃষ্টিপাত করিল। দীপের স্নিগ্ধ আলোকে রট্টা শয্যায় শুইয়া আছেন, একটি বাহু চক্ষের উপর ন্যস্ত। বোধহয় নিদ্রাবেশ হইয়াছে। এই নিভৃত দৃশ্য দেখিয়া চিত্রকের মন এক অপূর্ব সম্মোহে পূর্ণ হইয়া উঠিল; মৃগমদ-সৌরভের ন্যায় মাদক-মধুর রসোচ্ছ্বাসে হৃৎকুম্ভ কণ্ঠ পর্যন্ত ভরিয়া উঠিল। সে ধীরে ধীরে দ্বার বন্ধ করিয়া দিল। মনে মনে বলিল— ‘ঘুমাও, রাজকুমারী, ঘুমাও।

চাঁদ উঠিয়াছে। কৃষ্ণা চতুর্থীর চন্দ্র পূর্বাচলের মাথায় উঠিয়া ক্লান্ত হাসি হাসিতেছে। পান্থশালার অঙ্গন শূন্য, পারসিকেরা নিজ প্রকোষ্ঠে দ্বার বন্ধ করিয়াছে। অঙ্গন স্তিমিত জ্যোৎস্নায় পাণ্ডুর।

চিত্রক রট্টার দ্বারে করাঘাত করিয়া ডাকিল— ‘দেবি, উঠুন উঠুন, আহার প্রস্তুত।’

দ্বার খুলিয়া রট্টা হাসিমুখে সম্মুখে দাঁড়াইলেন, ঈষৎ জড়িত কণ্ঠে বলিলেন— ‘ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলাম।’

সম্মুখেই অলিন্দে আহারের আসন হইয়াছিল, দুইটি আসন মুখোমুখি; মধ্যে বহু কটোর এবং স্থালীতে খাদ্য সম্ভার। পাশে দুইটি দীপ জ্বলিতেছে। উভয়ে আহারে বসিলেন; জম্বুক দাঁড়াইয়া তত্ত্বাবধান করিতে লাগিল।

আহারের সঙ্গে সঙ্গে দুই চারিটি কথা হইতেছে। জম্বুক মাঝে মাঝে চিত্তবিনোদনের জন্য কৌতুকজনক উপাখ্যান বলিতেছে। রাজকন্যা হাসিতেছেন; তাঁহার মুখে তৃপ্তি, চোখে নিরুদ্বেগ প্রশান্তি। চিত্রক নিজ হৃদয়-মধ্যে একটি আন্দোলন অনুভব করিতেছে, যেন সাগরতরঙ্গে তাহার হৃদয় দুলিতেছে ফুলিতেছে, উঠিতেছে নামিতেছে—

রট্টা বলিলেন— ‘কাল পিতার দর্শন পাইব ভাবিয়া বড় আনন্দ হইতেছে।’

চিত্রকের মনের উপর ছায়া পড়িল। রট্টার পিতা…তাহার সহিত চিত্রকের একটা বোঝাপড়া আছে…কিন্তু সে চিন্তা এখন নয়…

চিত্রক বলিল— ‘একটা জনরব শুনিলাম। — পরমভট্টারক স্কন্দগুপ্ত নাকি চতুরঙ্গ সেনা লইয়া এদেশে আসিয়াছেন।’

রট্টা চকিত চক্ষু তুলিলেন— ‘স্কন্দগুপ্ত?’

চিত্রক নির্লিপ্তস্বরে বলিল— ‘হাঁ। হূণ আবার আসিতেছে, তাই মহারাজ তাহাদের গতিরোধ করিবার জন্য স্বয়ং আসিয়াছেন।’

রট্টা কিয়ৎকাল নতমুখে রহিলেন, তারপর মুখ তুলিয়া বলিলেন— ‘আপনি সম্ভবত প্রভুর সহিত মিলিত হইতে চাহেন?’

চিত্রক বলিল— ‘সে পরের কথা। আগে আপনাকে চষ্টন দুর্গে পৌঁছাইয়া দিয়া তবে অন্য কাজ।’

রট্টা তাহার মুখের উপর ছায়া-নিবিড় চক্ষু দু’টি স্থাপন করিয়া স্নিগ্ধ হাসিলেন।

আহার সমাপ্ত হইলে রট্টা জম্বুককে বলিলেন— ‘তোমার সেবায় আমরা তৃপ্ত হইয়াছি। অন্ন ব্যঞ্জন অতি মুখরোচক হইয়াছে। দেখ, আর্য চিত্রক কিছুই ফেলিয়া রাখেন নাই।’

জম্বুক করতল যুক্ত করিয়া সবিনয়ে হাস্য করিল। চিত্রক মৃদু হাসিয়া রট্টাকে জিজ্ঞাসা করিল— ‘কোন্‌ ব্যঞ্জন সর্বাপেক্ষা মুখরোচক লাগিল?’

রূট্টা বলিলেন— ‘শূল্য মাংস। এরূপ সুস্বাদু রন্ধন রাজ-পাচকও পারে না।’

চিত্রক মিটিমিটি হাসিতে লাগিল; রট্টা তাহা দেখিয়া সন্দিগ্ধ হইলেন, বলিলেন— ‘শূল্য মাংস কে রাঁধিয়াছে?’

জম্বুক তর্জনী দেখাইয়া বলিল— ‘ইনি।’

অবাক হইয়া কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া রট্টা হাসিয়া উঠিলেন— ‘আপনার তো অনেক বিদ্যা! এ বিদ্যা কোথায় শিখিলেন?’

চিত্রক বলিল— ‘আমার সকল বিদ্যা যেখানে শিখিয়াছি সেইখানে।’

‘সে কোথায়?’

‘যুদ্ধক্ষেত্রে।’

চিত্রকের মন কল্পনায় স্কন্দগুপ্তের স্কন্ধাবারের দিকে উড়িয়া গেল। ঐ যেখানে দিগন্তের কাছে আলোর আভা দেখা গিয়াছিল সেখানে ক্রোশের পর ক্রোশ বস্ত্র-শিবির তালপত্রের ছাউনি পডিয়াছে; শিবিরের ফাঁকে ফাঁকে সৈনিকেরা আগুন জ্বালিয়াছে; কেহ যবচূর্ণ মাখিয়া দুই হস্তে স্থূল রোটিকা গড়িতেছে; কেহ ভল্লাগ্রে মাংস গ্রথিত করিয়া আগুনে শূল্য পক্ক করিতেছে- চিৎকার গান বাগ্‌যুদ্ধ…নির্ভয় নিরুদ্বেগ জীবনযাত্রা…অতীত নাই, ভবিষ্যৎ নাই…আছে কেবল নিরঙ্কুশ বর্তমান।

রট্টা চিত্রকের মুখের উপর চিন্তার ক্রীড়া লক্ষ্য করিতেছিলেন, মৃদু হাসিয়া বলিলেন— ‘যুদ্ধক্ষেত্রের স্বপ্ন দেখিতেছেন?’

চিত্রক ঈষৎ চমকিয়া বলিল— ‘হাঁ। আপনি কি অন্তর্যামিনী?’

রট্টা রহস্যময় হাসিলেন।

রাত্রি গভীর হইয়াছে। চন্দ্র প্রায় মধ্যাকাশে।

কুমারী রট্টা আপন কক্ষে শয্যাশ্রয়ে ঘুমাইয়া ছিলেন, একটি নিশ্বাস ফেলিয়া জাগিয়া উঠিলেন। ঘরের কোণে দীপ জ্বলিতেছে; জ্বলিয়া জ্বলিয়া শিখাটি ক্রমে ক্ষুদ্র বর্তুলবৎ আকার ধারণ করিয়াছে। তাহার বিন্দুপ্রমাণ আলোকে ঘরের বিশেষ কিছু দেখা যাইতেছে না। শয্যায় উঠিয়া বসিয়া রট্টা কিয়ৎকাল ঐ আলোকবিন্দুর পানে চাহিয়া রহিলেন; তারপর উঠিয়া নিঃশব্দে দ্বারের অর্গল মোচন করিলেন।

দ্বার ঈষৎ বিভক্ত করিয়া দেখিলেন, তাঁহার কক্ষের সম্মুখে দ্বারের দিকে পিছন করিয়া অলিন্দের একটি স্তম্ভে পৃষ্ঠ রাখিয়া চিত্রক বসিয়া আছে। পদদ্বয় প্রসারিত, জানুর উপর মুক্ত তরবারি। তাহার ঊর্ধ্বোত্থিত মুখের উপর চাঁদের আলো পড়িয়াছে— চক্ষু স্বপ্নাতুর-

দীর্ঘকাল এক দৃষ্টিতে দেখিয়া রট্টা আবার ধীরে ধীরে দ্বার বন্ধ করিয়া দিলেন; ফিরিয়া আসিয়া অধোমুখে শয্যায় বক্ষ চাপিয়া শয়ন করিলেন। তাঁহার চক্ষু হইতে বিন্দু বিন্দু অশ্রু ঝরিয়া উপাধান সিক্ত করিয়া দিতে লাগিল।