পরদিন ভোর বেলা আমাকে আর টিশাকে বিজ্ঞানী লিংলির ল্যাবরেটরি কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়া হলো। অনেক উঁচু একটা বিল্ডিংয়ের লিফটে করে আমরা দুজন যখন উপরে উঠছিলাম তখন আমি ফিসফিস করে টিশাকে বললাম, “আমাদের কি এখন হোস্টেলে নিয়ে যাচ্ছে?”
টিশা কোনো কথা বলল না। কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে টিশা হঠাৎ করে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। লিফটটি প্রায় বাইশ তলা ওঠার পর বন্ধ হয়ে গেল, তখন আমরা লিফট থেকে নামলাম। আমাদের সাথে যে মানুষটি ছিল সে আমাদেরকে বলল, “তোমাদের এখন সিঁড়ি দিয়ে বাকি দুই তলা উঠতে হবে। এর উপরের অংশে লিফট যায় না।”
আমি আর টিশা অবাক হলাম, এত উঁচু বিল্ডিংয়ের একেবারে উপরে পর্যন্ত লিফট যায় না সেটি কেমন ব্যাপার? কিন্তু আমাদের এ নিয়ে কথা বলার কিংবা তর্ক-বিতর্ক করার কোনো সুযোগ নেই, আমরা তার চেষ্টাও করলাম না। আমরা আমাদের ব্যাগ নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে লাগলাম, যে মানুষটি আমাদের এ পর্যন্ত নিয়ে এসেছে সে আমাদের সাথে আর উপরে উঠল না।
আমাদের কয়েকটা চেকপোস্ট পার হতে হলো, কোথাও কোনো মানুষ নেই, চেকপোস্ট পার হওয়ার জন্য কী করতে হবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার নির্দেশ দেওয়া হতে লাগল। আমরা সেই নির্দেশ মেনে এগিয়ে যেতে থাকলাম। কোনো চেকপোস্টে রেটিনা স্ক্যান আমি বললাম,
করতে হলো, কোনো চেকপোস্টে ত্বকের পরিত্যক্ত কোষ দিয়ে ডিএনএ টেস্ট করতে হলো।
শেষ চেকপোস্টটা আমাদের পুরো শরীর স্ক্যান করে একটা ঘরে ঢুকতে দিল। প্রথমে টিশা, তার পিছু পিছু আমি। ঘরটাতে ঢোকার সাথে সাথে পিছনের স্বয়ংক্রিয় দরজাটা বন্ধ হয়ে যাবার সাথে সাথে আমি হঠাৎ করে এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করি। কারণ দরজাটির কোনো হাতল নেই, কোনো চাবির গর্ত নেই, মনে হলো ধাতব একটি দেয়াল দিয়ে আমাদের একটা ঘরে বন্দি করে ফেলা হয়েছে। আমি আর টিশা আমাদের ব্যাগ হাতে নিয়ে আরেকটু এগিয়ে গেলাম, সামনে এগোতেই একটা দরজা খুলে গেল এবং আমরা একটা হলঘরের মতো জায়গায় পৌঁছলাম। হলঘরটির মেঝে এবং দেয়াল ধূসর বর্ণের, দেখে কেমন যেন মন খারাপ হয়ে যায়।
আমি বললাম, “আমরা কোথায় এসেছি। এটাকে মোটেও একটা হোস্টেল মনে হচ্ছে না।”
টিশা এবারেও কোনো কথা বলল না, তার হাতের ব্যাগটি নিয়ে সোজা সামনের দিকে এগিয়ে গেল। দেয়ালের কাছাকাছি পৌঁছতেই নিঃশব্দে একটা দরজা খুলে গেল। আমরা সেই দরজা দিয়ে পাশের ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়ালাম, আমাদের সামনে অনেকগুলো নানা বয়সী মানুষ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ বলে দেয়নি কিন্তু দেখেই বুঝতে পারলাম আমাদেরকে যেভাবে এখানে আনা হয়েছে এই মানুষগুলোকেও ঠিক একইভাবে এখানে আনা হয়েছে।
মানুষগুলো পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। আমি অভিবাদনের ভঙ্গি করে হাত নেড়ে বললাম, “শুভ সকাল।” কী কারণ জানা নেই কথাটা খুবই বেখাপ্পা শোনাল।
মানুষগুলো কেউ কোনো কথা বলল না, শুধু মনে হলো পেছন থেকে কমবয়সী একজন হাসির মতো শব্দ করল, আনন্দহীন এক ধরনের হাসি। এই হাসিটি শুনে আমি বুঝতে পারলাম সকালটি আর যাই হোক শুভ নয়।
আমি বললাম, “আমার নাম রিহি। আর এ হচ্ছে টিশা।”
ভেবেছিলাম মানুষগুলোর ভেতর থেকে কেউ একজন নিজের পরিচয় দেবে, কিন্তু কেউ কোনো কথা বলল না। স্থির দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তোমরা কারা?”
মানুষগুলো এবারেও কোনো কথা বলল না, আমার মনে হলো। কথা বলবেও না। কিন্তু হঠাৎ করে একজন বলল, “আমরা কারা তাতে কিছু আসে যায় না।”
আমি ভুরু কুঁচকে বললাম, “মানে?”
“মানে আমাদের নিজের পরিচয়ের এখন আর কোনো গুরুত্ব নাই। তুমি কে আমি কে তাতে কিছু আসে যায় না। আগে হোক পরে হোক তোমাকে আমাকে সবাইকে দেয়ালের ঐ পাশে চলে যেতে হবে।”
“দেয়ালের ঐ পাশে কী আছে?”
মানুষটা উত্তর দেওয়ার আগেই টিশা বলল, “ক্রেনিপিউটার।”
যারা স্থির দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়েছিল এই প্রথমবার তাদের চোখে এক ধরনের কৌতূহল ফুটে উঠল। একজন টিশার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী বললে?”
“আমি বলেছি ক্রেনিপিউটার।”
“তুমি কেমন করে জান ওখানে ক্রেনিপিউটার আছে? আমাদেরকে কেন ক্রেনিপিউটারের ঘরে নিয়ে যাবে?”
টিশা বলল, “তা না হলে কেন আমাদের একজন একজন করে এখানে ধরে এনেছে?”
আমি টিশাকে বাধা দিয়ে বললাম, “তুমি কী বলছ টিশা? আমাদেরকে মোটেও ধরে আনা হয়নি। বিজ্ঞানী লিংলি নিজে বলেছে আমাদের এই ল্যাবরেটরিতে কাজ করতে দেবে। আমাদের সব দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা শেষ করে দেবে।”
“রিহি! তোমার এবং আমার থেকে বেশি ভালো করে কে জানে যে একজন মানুষের দুঃখ কষ্ট আর যন্ত্রণা দূর করে দেবার জন্য দরকার একটি বেগুনি নীল তিন তিন দুই চার ক্রেনি-টিউব!”
বেগুনি নীল তিন তিন দুই চার কোড নম্বরের ক্রেনি-টিউব মাথায় ঢুকিয়ে দিলে মুহূর্তে একজন মানুষের ভেতর সব দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা উধাও হয়ে ভেতরে এক ধরনের প্রশান্তি নেমে আসে! মায়ী মায়ীর বাক্স থেকে আমরা যে টিউবগুলো চুরি করে এনেছি তার মাঝে এই কোড নম্বরের একটা ক্রেনি-টিউব আছে!
আমি কিছুক্ষণের জন্য টিশার দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, “তুমি কি মনে কর বিজ্ঞানী লিংলি আমাদের সাথে মিথ্যা কথা বলেছে?”
“না। বিজ্ঞানী লিংলি মিথ্যা কথা বলেনি। সত্যি কথা বলেছে। আমাদেরকে ল্যাবরেটরি কমপ্লেক্সে এনেছে। এখানে কাজ করতে দেবে–আমাদের সব দুঃখ কষ্ট দূর হয়ে যাবে–সব সত্যি। তবে যেভাবে সেটা করা হবে তুমি সেটা পছন্দ করবে কি করবে না সেটা ভিন্ন কথা!”
আমি হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম টিশা যেটা সন্দেহ করেছে সেটা হয়তো সত্যি। হঠাৎ করে আমি এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করতে থাকি। আমাদের পাশে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমাদের সাথে কি বিজ্ঞানী লিংলির দেখা হয়?”
কমবয়সী একজন মেয়ে বলল, “হয়, আবার হয় না।”
“তার মানে কী?”
কমবয়সী মেয়েটি বড় একটা দেয়াল দেখিয়ে বলল, “মাঝে মাঝে এই দেয়ালটা স্বচ্ছ হয়ে যায়। তখন দেয়ালের অন্য পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞানী লিংলি আমাদের দেখে।”
“কী দেখে?”
“আমি জানি না। “
“তোমরা সারাদিন কী কর?”
“কিছু করি না। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করি, দেখি নতুন কে আসে।”
“প্রতিদিন নতুন মানুষ আসে?”
“আসে আবার চলেও যায়। ধরে নিয়ে যায়। আমাকেও একদিন ধরে নিয়ে যাবে।” মেয়েটা এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, “তোমাকেও ধরে নিয়ে যাবে।”
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। শুধুমাত্র কিছু একটা বলার জন্য বললাম, “তোমরা কোথায় ঘুমাও?” মেয়েটা হাত নেড়ে বলল, “এই তো এখানে ঘুমাই।”
“কী খাও?”
“একজন ডিটিউন মানুষ খাবার আনে। সাথে একজন গার্ড থাকে। তার হাতে সব সময় অস্ত্র থাকে। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র।”
আমি কথা বলার মতো আর কিছু খুঁজে পেলাম না। যে দেয়ালটি মাঝে মাঝে স্বচ্ছ হয়ে যায় আর স্বচ্ছ হবার পর অন্য পাশে লিংলিকে দেখা যায় আমি সেই দেয়ালটিতে হেলান দিয়ে চুপ করে বসে রইলাম।
.
দুই দিন পর হঠাৎ করে দেয়ালটি স্বচ্ছ হয়ে গেল। আমি প্রায় লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম এবং দেখলাম অন্যপাশে বিজ্ঞানী লিংলি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি উত্তেজিতভাবে চিৎকার করে বললাম, “বিজ্ঞানী লিংলি! মহামান্য বিজ্ঞানী লিংলি। আমি রিহি। যাকে তুমি দস্যুদলের কাছ থেকে মুক্ত করেছ!”
বিজ্ঞানী লিংলি আমার কথা শুনতে পেয়েছে কি না বুঝতে পারলাম। সে এক ধরনের অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। হেঁটে পিছনে গেল, পেছনের একটা টেবিল থেকে একটা কাঁচের গ্লাসে কোনো এক ধরনের তরল পানীয় ঢেলে নিল, সেই পানীয়ে চুমুক দিয়ে আবার সামনে এগিয়ে এসে স্বচ্ছ দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে নিরাসক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমি আবার চিৎকার শুরু করলাম, শুধু চিকারের উপর ভরসা না করে আমি এবারে দুই হাত নেড়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতে লাগলাম। মনে হলো বিজ্ঞানী লিংলি প্রথমবার আমাকে দেখতে পেল এবং তার চোখে-মুখে এক ধরনের কৌতূহল ফুটে উঠল। সে এগিয়ে গিয়ে কোথায় একটা সুইচ টিপে দেবার পর সে আমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেল, আমিও তার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। বিজ্ঞানী লিংলি বলল, “ছেলে! তুমি এভাবে চিৎকার করছ কেন? তোমার কী হয়েছে?”
আমি বললাম, “মহামান্য লিংলি! তোমার মনে আছে, তুমি আমাকে আর আমার বন্ধু টিশাকে দস্যুদলের কাছ থেকে মুক্ত করেছ? দুই দিন আগে কমিউনের সভায় তোমার সাথে
কথার মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে লিংলি বলল, “মনে আছে। তোমার সমস্যা কী?”
“তুমি বলেছিলে তুমি আমাদের সব দুঃখ কষ্ট দূর করে একটা নতুন জীবন উপহার দেবে!”
“বলেছিলাম নাকি?”
“হ্যাঁ। তুমি কমিউনের মানুষের সামনে”
আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বিজ্ঞানী লিংলি হাত নেড়ে পুরো বিষয়টা উড়িয়ে দেবার মতো ভঙ্গি করে বলল, “কমিউনের সভায় অনেক কথা বলতে হয়। তোমাদের মুক্ত করতে অনেক মুক্তিপণ দিতে হয়েছে, সেটি কি শুধু শুধু দিয়েছি?”
আমি একটু হতবুদ্ধি হয়ে বললাম, “তাহলে আমাদের কী করবে?”
“তোমাদের আনা হয়েছে ক্রেনিপিউটার বানানোর জন্য। তোমাদের মাথায় ক্রেনিয়াল নেই–আমার এরকম মানুষই দরকার। ক্রেনিয়াল দিয়ে মাথায় শুধু তথ্য দেওয়া যায়, তথ্য বের করা যায় না। আমি নতুন ক্রেনিয়াল তৈরি করেছি, সেটা বাই-ক্রেনিয়াল। এটা দিয়ে তথ্য দেওয়া যায় আবার তথ্য বের করে আনা যায়। মাথায় এটা লাগালে–”
বিজ্ঞানী লিংলি হঠাৎ কথা থামিয়ে হা হা করে হাসতে লাগল। এখানে হাসির ব্যাপারটা কোথায় আমি ধরতে পারলাম না। বিজ্ঞানী লিংলি একসময় হাসি থামিয়ে তার পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিল, হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখটা মুছে বলল, “আমি তোমাদের কেন এই সব কথা বলছি? তোমাদের মাথায় কোনো ক্রেনিয়াল নেই, তোমরা কিছু শিখো নাই, তোমরা কিছু জানো না, বোঝো না! তোমাদের মানসিক বয়স ছয়-সাত বছরের বেশি নয়, আমি তোমাদের যেসব কথা বলছি সেগুলো তোমাদের বোঝা সম্ভব না! তোমরা হয়তো দুই আর দুই যোগ করলে কত হয় সেটাই জান না!”
এতক্ষণ টিশা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিল। এই প্রথম সে কথা বলল, “দুই আর দুই যোগ করলে কত হয় আমরা জানি। শুধু দুই আর দুই নয় প্রাইমভিত্তিক সংখ্যা দিয়ে আমরা যে কোনো সংখ্যা প্রক্রিয়া করতে পারি। ক্রেনিয়াল কীভাবে কাজ করে আমরা সেটা জানি। শহরের মানুষের ক্রেনিয়ালে তথ্য দেবার জন্য তুমি নেটওয়ার্ক ব্যবহার কর, মূল সার্ভার ছাড়া সেখানে তথ্য দেওয়া যায় না কিন্তু দস্যুদলের কাছে অনেক দামে বিক্রি করার জন্য তুমি ক্রেনি-টিউব তৈরি করেছ আমরা সেটাও জানি। বেগুনি নীল তিন তিন দুই চার হচ্ছে এরকম একটা কোড। এই কোডের ক্রেনি-টিউব কী করে আমি সেটাও বলতে পারব।”
বিজ্ঞানী লিংলির চোখ দেখতে দেখতে বিস্ফারিত হয়ে যায়। কয়েক মুহূর্ত সে কোনো কথা বলতে পারে না, এমন কী হাতে ধরে রাখা পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিতেও সে ভুলে যায়। একটু পর বুক থেকে একটা নিঃশ্বাস বের করে দিয়ে বলল, “তুমি এগুলো কোথা থেকে জেনেছ?”
“প্রাচীন মানুষেরা যেভাবে জানত সেভাবে জেনেছি।”
“মানে?”
“ভিডি টিউবে বই পড়ে জেনেছি। আমি দেখতে চেয়েছিলাম মাথায় ক্রেনিয়াল টিউব না লাগিয়ে শেখা যায় কি না, জানা যায় কি না। আমি এখন জানি এটা সম্ভব। তোমাদের ক্রেনিয়াল প্রযুক্তির কোনো প্রয়োজন নেই। এটা আসলে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার একটা কৌশল।”
বিজ্ঞানী লিংলি কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে টিশার দিকে তাকিয়ে রইল তারপর কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “তোমার বয়স কত মেয়ে?”
“আমার নাম টিশা।”
বিজ্ঞানী লিংলি মনে হলো বিশ্বাস করতে পারল না যে কেউ তার সাথে এভাবে কথা বলতে পারে। টিশার সূক্ষ্ম খোঁচাটি সহ্য করে আবার জিজ্ঞেস করল, “টিশা, তোমার বয়স কত?”
“তুমি একটু আগে বলেছ আমাদের মানসিক বয়স ছয়-সাত বছরের বেশি না। আমার ধারণা আমার মানসিক বয়স আরো অনেক বেশি–তোমার সমান যদি নাও হয় তার কাছাকাছি হবে। জৈবিক বয়স পনের বছর। পনের বছর দুই মাস এগার দিন।”
বিজ্ঞানী লিংলির মুখে খুব ধীরে ধীরে একটা হাসি ফুটে উঠল। মানুষের মুখের হাসির মতো বিচিত্র আর কিছু পৃথিবীতে আছে কি না আমার জানা নেই। কোনো কথা না বলে শুধু মুখের হাসি দিয়ে কত কিছু প্রকাশ করে ফেলা যায়! লিংলি তার মুখের হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিল যে, এই পৃথিবীতে তার থেকে ভয়ংকর আর নিষ্ঠুর মানুষ আর একটিও নেই! তার কাছে পনের বছর দুই মাস এগার দিনের একটা মেয়ের কোনো মূল্য নেই। নিজের প্রয়োজনে সে টিশার মতো শত শত মানুষকে যেভাবে প্রয়োজন সেভাবে ব্যবহার করবে।
বিজ্ঞানী লিংলি তার মুখের ভয়ংকর হাসিটি ধরে রেখে বলল, “টিশা! আমি তোমাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছি! তুমি যদি আমার ল্যাবরেটরি কমপ্লেক্সের ক্রেনিপিউটার বিল্ডিংয়ের চোদ্দ তলায় আটকা না থাকতে, তাহলে তুমি সবার জন্য একটা বিপজ্জনক মানুষ হতে পারতে! কিন্তু তুমি এখন বিপজ্জনক নও। তুমি পুরোপুরি আমার হাতের মুঠোয়। তোমার শরীরের এক দশমিক তিন কেজি ওজনের মস্তিষ্কটুকু ছাড়া আর কোনো কিছুতে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। আমার ক্রেনিপিউটারের দুশ বায়ান্নটি মস্তিষ্কের মাঝে তোমারটাও যুক্ত হবে। শুধু তোমারটা না তোমাদের সাথে যারা আছে তাদের সবার! তোমার চমকার বুদ্ধিদীপ্ত তথ্যবহুল সৃজনশীল তেজস্বী মস্তিষ্কটিকে এক সেকেন্ডে আমি একশ বিলিয়ন নিউরনের একটা হার্ডওয়ারে পাল্টে দেব। তথ্য পাঠাব তোমার মস্তিষ্কে সেই তথ্য প্রক্রিয়া করে আমাকে ফেরত পাঠাবে। তুমি থাকবে না, শুধু তোমার মস্তিষ্কটা থাকবে! বুঝেছ?”
টিশা বলল, “আমি এই সব কথা জানি। তুমি যদি সত্যিই আমাকে কিছু বলতে চাও তাহলে আমি যেগুলো জানি না সেগুলো আমাকে বলো।”
“তুমি কী জান না?”
“যেসব কথা বইয়ে লেখা হয়নি আমি সেগুলো জানি না। তোমার ক্রেনিপিউটার কীভাবে কাজ করে আমি জানি না। মানুষের মস্তিষ্ক ব্যবহার করতে হলে মানুষটিকে জীবিত থাকতে হয়। এতগুলো মানুষকে জীবিত রাখ কেমন করে সেটা আমি জানি না। তার শরীরের পুষ্টি দরকার–”
“টিশা, তোমার প্রশ্নটা খুবই সঠিক। কীভাবে ক্রেনিপিউটার বানাব আমি অনেক দিন থেকে জানি কিন্তু কীভাবে এতগুলো মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা যায়, আমি সেটা জানতাম না। টিশা, তুমি শুনে খুব খুশি হবে আমি সেই সমস্যাটা খুবই চমৎকারভাবে সমাধান করেছি। যেদিন তোমাকে ক্রেনিপিউটারে জুড়ে দেব সেদিন তুমি নিজের চোখে দেখবে! দেখে চমৎকৃত হবে!” কথা শেষ করে বিজ্ঞানী লিংলি আনন্দে আবার হা হা করে হাসল!
টিশা হাসি থেমে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করল। যখন হাসি থেমে গেল তখন জিজ্ঞেস করল, “মানুষগুলোর মস্তিষ্কের বাই-ক্রেনিয়াল থেকে যে সিগন্যাল আসে সেগুলো তুমি কোথায় প্রক্রিয়া করো?”
বিজ্ঞানী লিংলি বলল, “আমি সেটা কীভাবে করি পৃথিবীর কেউ জানে না! এটা আমার আবিষ্কার, আমি ছাড়া আর কেউ কখনো জানবে না!”
টিশা মুখ শক্ত করে বলল, “আমি সেটা জানতে চাই। তুমি আমাকে ক্রেনিপিউটারে জুড়ে দিয়ে শুধু আমার স্মৃতি নয়–আমার অস্তিত্বকেও ধ্বংস করে দেবে–আমাকে বলো, আমি জানা না জানায় এখন তোমার কিছু আসে যায় না!”
বিজ্ঞানী লিংলি মাথা নাড়ল, বলল, “না আমি তোমাকে বলব না। যদি বলিও তুমি বুঝবে না।”
“আমি বুঝব। তুমি চেষ্টা করে দেখো।”
“না, আমি বলব না।”
এবারে টিশা খিলখিল করে হেসে উঠল, তার হাসি থামতেই চায়। বিজ্ঞানী লিংলি অবাক হয়ে বলল, “এই মেয়ে, তুমি হাসছ কেন?”
টিশা হাসি থামিয়ে মুখ শক্ত করে বলল, “আমার নাম টিশা।”
বিজ্ঞানী লিংলি খোঁচাটি সহ্য করে বলল, “টিশা, তুমি কেন হাসছ?”
“সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী লিংলি পনের বছর দুই মাস এগার দিনের একটা মেয়ের বুদ্ধিমত্তাকে এত ভয় পায় যে তাকে দুই দিন পরে পুরোপুরি ধ্বংস করে ফেলবে জেনেও তাকে কিছু তথ্য জানাতে সাহস পায় না। এটা আমার জন্যে খুবই হাসির ব্যাপার।” টিশা তীব্র দৃষ্টিতে বিজ্ঞানী লিংলির দিকে তাকিয়ে হিংস্র গলায় বলল, “তুমি যত বড় বিজ্ঞানীই হও না কেন লিংলি, তোমার যত ক্ষমতাই থাকুক না কেন, আসলে তুমি একজন দুর্বল মানুষ। তুমি একজন ভীতু কাপুরুষ ছাড়া আর কিছু নও।”
টিশার কথাটা শেষ হওয়ার আগেই স্বচ্ছ দেয়ালটি হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে কালো দেয়াল হয়ে গেল। টিশা যখন মাথা ঘুরিয়ে ভেতরে তাকাল, দেখল, ঘরের ভেতরের সব কয়জন মানুষ স্থির চোখে টিশার দিকে তাকিয়ে আছে।
তাদের চোখে ভয় আতঙ্ক আর বিস্ময়। তবে চোখের দৃষ্টিতে সবচেয়ে যেটা বেশি, সেটা হচ্ছে অবিশ্বাস।