[একটি অসমাপ্ত প্রবন্ধ, মিস ওয়াল্ডোর কাগজপত্রের মধ্যে প্রাপ্ত]
পৃথিবীর প্রাচীন বা আধুনিক, লুপ্ত বা জীবন্ত ধর্মগুলি এই চারি প্রকার বিভাগের মধ্য দিয়া ভালরূপে ধারণা করিতে পারিঃ
- ১. প্রতীক—মানুষের ধর্মভাব বৃদ্ধি ও সংরক্ষণের জন্য বিবিধ বাহ্য সহায় অবলম্বন।
- ২. ইতিহাস—প্রত্যেক ধর্মের দার্শনিক তত্ত্ব যেভাবে দিব্য বা মানবীয় আচার্যগণের জীবনে রূপায়িত হইয়াছে। পুরাণাদি ইহার অন্তর্গত, কারণ এক জাতি বা এক যুগের পক্ষে যাহা পুরাণ, অন্য জাতি বা যুগের নিকট তাহাই ইতিহাস। আচার্যগণের সম্বন্ধেও বলা যায়, তাঁহাদের জীবনের অনেকটাই পরবর্তীকালের মানুষেরা পৌরাণিক কাহিনী বলিয়া গ্রহণ করে।
- ৩. দর্শন—প্রত্যেক ধর্মের যুক্তিসিদ্ধ ভিত্তিসমূহ।
- ৪. অতীন্দ্রিয়বাদ—ইন্দ্রিয়জ্ঞান ও যুক্তি অপেক্ষা মহত্তর এমন কিছু, যাহা কোন কোন বিশেষ অবস্থায় কোন কোন বিশেষ ব্যক্তি বা সকল ব্যক্তি লাভ করিয়া থাকেন। ধর্মের অন্যান্য বিভাগেও এই অতীন্দ্রিয়বাদের কথা আছে।
পৃথিবীর প্রাচীন বা আধুনিক সকল ধর্মেই এই মূলনীতিগুলির একটি, দুইটি বা তিনটি বর্তমান দেখা যায়; অতি উন্নত ধর্মগুলিতে চারিটি তত্ত্বই আছে। অতি উন্নত ধর্মগুলির মধ্যে কতকগুলির আবার কোন ধর্মগ্রন্থ বা পুস্তক ছিল না, বা সেগুলি লুপ্ত হইয়াছে; কিন্তু যে-সকল ধর্ম পবিত্র গ্রন্থের উপর প্রতিষ্ঠিত, সেগুলি আজও টিকিয়া আছে। সুতরাং পৃথিবীর আধুনিক সব ধর্মই পবিত্র গ্রন্থের উপর প্রতিষ্ঠিতঃ
- বৈদিক ধর্ম (ভুল করিয়া বলা হয়, হিন্দু বা ব্রাহ্মণ্যধর্ম) প্রতিষ্ঠিত বেদের উপর;
- পারসীক ধর্ম আবেস্তার উপর;
- মুশার ধর্ম ওল্ড টেষ্টামেণ্টের উপর;
- বৌদ্ধধর্ম ত্রিপিটকের উপর;
- খ্রীষ্টধর্ম নিউ টেষ্টামেণ্টের উপর;
- ইসলাম কোরানের উপর।
চীনের তাও এবং কনফুসিয়াস-মতাবলম্বীদেরও ধর্মগ্রন্থ আছে, কিন্তু ঐগুলি বৌদ্ধধর্মের সহিত এমন নিবিড়ভাবে মিশিয়া গিয়াছে যে, ঐগুলিকে বৌদ্ধধর্মের অন্তর্গত বলিয়া গণনা করা যায়।
আবার যদিও ঠিক ঠিক বলিতে গেলে সম্পূর্ণভাবে জাতিগত কোন ধর্ম নাই, তবু বলা যায়—ধর্মগোষ্ঠীর মধ্যে বৈদিক, য়াহুদী ও পারসীক ধর্মগুলি যে-সকল জাতির মধ্যে পূর্ব হইতে ছিল, সেই-সকল জাতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ হইয়া রহিয়াছে; আর বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান ও ইসলাম ধর্ম প্রথমাবধি প্রচারশীল।
বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান ও মুসলমানদের মধ্যে জগৎজয়ের সংগ্রাম চলিবে, এবং জাতিগত ধর্মগুলিকেও অনিবার্যভাবে এই সংগ্রামে যোগ দিতে হইবে। এই জাতিগত বা প্রচারশীল ধর্মগুলির প্রত্যেকটি ইতোমধ্যেই নানা শাখায় বিভক্ত হইয়াছে এবং নিজেকে পরিবর্তনশীল অবস্থার সহিত খাপ খাওয়াইবার জন্য জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হইয়াছে। ইহা দ্বারাই প্রমাণিত হয় যে, ধর্মগুলির মধ্যে একটিও এককভাবে সমগ্র মানবজাতির ধর্ম হইবার উপযোগী নয়। যে-জাতি হইতে যে-ধর্ম উদ্ভূত হইয়াছে, সেই জাতির কতকগুলি বৈশিষ্ট্য লইয়াই যেহেতু ঐ ধর্ম গঠিত হইয়াছে এবং ঐ ধর্মই আবার ঐ বৈশিষ্ট্যগুলির সংরক্ষণ ও বৃদ্ধির কারণ হইয়া দাঁড়ায়, অতএব ঐ-সকলের কোনটিই সমগ্র মানবজাতির উপযোগী হইতে পারে না। শুধু তাহাই নয়, উহাদের প্রত্যেক ধর্মে একটি নেতিবাচক ভাব আছে। প্রত্যেক ধর্ম মানব-প্রকৃতির একটি অংশের বিকাশ সাধনে অবশ্যই সাহায্য করে, কিন্তু যাহা কিছু তাহার ধর্মে নাই, সেগুলি দমন করিবার চেষ্টা করে। এইরূপ একটি ধর্ম যদি বিশ্বজনীন হয়, তাহা হইলে তাহা মানবজাতির বিপদ ও অবনতির সূচনা করিবে।
পৃথিবীর ইতিহাস পড়িলে দেখা যায়, সার্বভৌম রাষ্ট্র ও বিশ্বব্যাপী ধর্মরাজ্য-বিষয়ক স্বপ্ন-দুইটি মানবজাতির মনে বহুকাল যাবৎ ক্রিয়া করিতেছে, কিন্তু পৃথিবীর সামান্য একটি অংশ বিজিত হইবার পূর্বেই অধিকৃত রাজ্যগুলি শতধা ছিন্নভিন্ন হইয়া মহান্ দিগ্বীজয়ীদের পরিকল্পনাগুলি ব্যর্থ করিয়া দেয়, সেরূপ প্রত্যেক ধর্মই তাহার শৈশব অবস্থা উত্তীর্ণ হইবার পূর্বেই ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত হইয়া পড়ে।
তথাপি ইহা সত্য বলিয়া মনে হয় যে, সমাজ ও ধর্মের ক্ষেত্রে মানবজাতির ঐক্যসাধনই প্রকৃতির উদ্দেশ্য, যদিও সে ঐক্যের মধ্যে বৈচিত্র্যের সম্ভাবনা থাকিবে। সর্বাপেক্ষা স্বল্প বাধার পথে চলাই যদি কার্যসিদ্ধির যথাযথ উপায় হয়, তাহা হইলে আমার মনে হয়, প্রত্যেক ধর্ম যে এইভাবে বিভক্ত হইয়া সম্প্রদায়ে পরিণত হয়, তাহা ধর্ম-সংরক্ষণেরই একটি উপায়, কারণ তাহার ফলে কঠিন একত্বের নিগড় চূর্ণ হয় এবং উহাতে আমরা যথার্থ পন্থার নির্দেশ পাই।
অতএব মনে হয়, উদ্দেশ্য—সম্প্রদায়গুলির ধ্বংস নয়, বরং উহাদের সংখ্যাবৃদ্ধি, যে পর্যন্ত না প্রত্যেক ব্যক্তি নিজেই একটি সম্প্রদায় হইয়া দাঁড়ায়। অন্যপক্ষে আবার সব ধর্ম মিলিত হইয়া একটি বিরাট দর্শনে পরিণত হইলেই ঐক্যের পটভূমিকা সৃষ্টি হয়। পৌরাণিক কাহিনী বা আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্ম দ্বারা কখনও ঐক্য সাধিত হয় না, কারণ সূক্ষ্ম ব্যাপার অপেক্ষা স্থূল বিষয়েই আমাদের মতদ্বৈধ হয়। একই মূলতত্ত্ব স্বীকার করিলেও মানুষ তাহার আদর্শস্থানীয় ধর্মগুরুর মহত্ত্ব সম্বন্ধে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করে।
সুতরাং এই মিলনের ফলে এমন একটি দার্শনিক ঐক্য আবিষ্কৃত হইবে, যাহা ঐক্যের ভিত্তি হইয়া দাঁড়াইবে, অথচ প্রত্যেকেই নিজ নিজ আচার্য বা সাধন-পদ্ধতি নির্বাচন করিবার স্বাধীনতা পাইবে। সহস্র সহস্র বৎসর ধরিয়া এইরূপ মিলন স্বাভাবিকভাবে চলিয়া আসিতেছে; শুধু পারস্পরিক বিরুদ্ধাচরণ দ্বারা এই মিলন মাঝে মাঝে শোচনীয়ভাবে প্রতিহত হইয়াছে।
অতএব পরস্পর বিরুদ্ধাচরণ না করিয়া প্রত্যেক জাতির আচার্যগণকে অন্য জাতির নিকট পাঠাইয়া সমগ্র মানবসমাজকে পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্ম শিক্ষা দেওয়া উচিত; ইহা দ্বারা বিভিন্ন জাতির মধ্যে পরস্পর ভাবের আদান-প্রদানের সহায়তা হইবে। কিন্তু খ্রীঃপূঃ দ্বিতীয় শতকে ভারতের মহামতি বৌদ্ধসম্রাট্ অশোক যেরূপ করিয়াছিলেন, আমরাও যেন সেইরূপ অন্যের নিন্দা হইতে বিরত হই, অপরের দোষানুসন্ধান না করিয়া তাহাকে সাহায্য করি এবং তাহার প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হইয়া তাহার জ্ঞানলাভের সহায় হই।
জড়বিজ্ঞানের বিপরীত অধ্যাত্ম বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে আজ সারা বিশ্বে এক মহা সোরগোল পড়িয়া গিয়াছে। আমাদের ঐহিক জীবন ও এই পরিদৃশ্যমান জগৎকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য আমাদের ইন্দ্রিয়জ্ঞানের সীমার বহির্ভূত সকল ভাবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা অতি দ্রুত একটি ফ্যাশনে পরিণত হইতেছে, এমন কি ধর্মপ্রচারকেরাও একের পর এক এই ফ্যাশনের নিকট আত্মসমর্পণ করিতেছেন। অবশ্য চিন্তাহীন জনসাধারণ সর্বদা সুখাবহ ভাবরাশিই অনুসরণ করে, কিন্তু যাঁহাদের নিকট অধিকতর জ্ঞান আশা করা যায়, তাঁহারা যখন নিজেদের দার্শনিক বলিয়া প্রচার করেন এবংঅর্থহীন ফ্যাশন অনুসরণ করেন, তখন উহা সত্যই শোচনীয়।
আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি যতক্ষণ স্বাভাবিক-শক্তিসম্পন্ন, ততক্ষণ তাহারা আমাদের সর্বাপেক্ষা বিশ্বাসযোগ্য পথপ্রদর্শক এবং সেগুলি যে-সব তথ্য সংগ্রহ করিয়া দেয়, সে-সব যে মানবীয় জ্ঞানসৌধের ভিত্তি—এ-কথা কেহ অস্বীকার করে না। কিন্তু যদি কেহ মনে করে, মানুষের সমগ্র জ্ঞান শুধু ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি—আর কিছু নয়, তবে আমরা ঐকথা অস্বীকার করিব। যদি প্রাকৃতিক বিজ্ঞান বলিতে ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানই বুঝায়—তার বেশী আর কিছু নয়, তবে আমরা বলিব, এরূপ বিজ্ঞান কোন দিন ছিল না, কোন দিন হইবেও না। উপরন্তু শুধু ইন্দ্রিয়জ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত কোন জ্ঞান কখনও বিজ্ঞান বলিয়া গৃহীত হইতে পারিবে না।
অবশ্য ইন্দ্রিয়গুলি জ্ঞানের উপাদান সংগ্রহ করে, এবং উহাদের সাদৃশ্য ও বৈষম্য অনুসন্ধান করে, কিন্তু ঐখানেই উহাদের থামিতে হয়।
প্রথমতঃ বাহিরের তথ্যসংগ্রহ-ব্যাপারও অন্তরের কতকগুলি ভাব এবং ধারণার উপর—যথা, দেশ ও কালের উপর—নির্ভর করে। দ্বিতীয়তঃ মানস পটভূমিকায় কিছুটা বিমূর্ত ভাব ব্যতীত তথ্যগুলির বর্গীকরণ বা সামান্যীকরণ অসম্ভব। সামান্যীকরণ যত উচ্চধরনের হইবে, বিমূর্ত পটভূমিকাও তত ইন্দ্রিয়ানুভূতির বাহিরে থাকিবে। সেইখানেই অসংলগ্ন তথ্যগুলি সাজান হয়। এখন জড়বস্তু, শক্তি, মন, নিয়ম, কারণ, দেশ, কাল প্রভৃতি ভাবগুলি অতি উচ্চ বিমূর্তনের ফল; কেহই কোনদিন এগুলি ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করে নাই; অথবা বলা যায়, এগুলি একেবারে অতিপ্রাকৃতিক বা অতীন্দ্রিয় অনুভূতি। অথচ এগুলি ছাড়া কোন প্রাকৃতিক তথ্য বোঝা যায় না। একটি গতিকে বোঝা যায়—একটি শক্তির সাহায্যে। কোন প্রকার ইন্দ্রিয়ের অনুভূতি হয় জড়বস্তুর মাধ্যমে। বাহ্য পরিবর্তনগুলি বোঝা যায় প্রাকৃতিক নিয়মের ভিতর দিয়া, মানসিক পরিবর্তনগুলি ধরা পড়ে চিন্তায় বা মনে, বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলি শুধু কার্য-কারণের শৃঙ্খল দ্বারাই বোঝা যায়। অথচ কেহই কখনও জড় বা শক্তি, নিয়ম বা কারণ, দেশ বা কাল—কিছুই দেখে নাই, এমন কি কল্পনাও করে নাই।
তর্কচ্ছলে বলা যাইতে পারে—বিমূর্তভাবরূপে এগুলির অস্তিত্ব নাই, এগুলি বর্গ বা শ্রেণী হইতে পৃথক্ কিছু নয়, উহা হইতে এগুলি পৃথক্ করা যায় না। ইহাদিগকে কেবল গুণ বলা যাইতে পারে।
এই বিমূর্তন (abstraction) সম্ভব কিনা বা সামান্যীকৃত বর্গ ব্যতীত উহাদের আর কিছু অস্তিত্ব আছে কিনা—এই প্রশ্ন ছাড়াও ইহা স্পষ্ট যে, জড় বা শক্তির ধারণা, কাল বা দেশের ধারণা, নিমিত্ত নিয়ম বা মনের ধারণা—এগুলির প্রত্যেকটিই স্ব স্ব বর্গমধ্যে নিরপেক্ষ স্বয়ংসম্পূর্ণ, এগুলিকে যখন শুধু এইভাবে—বিমূর্ত নিরপেক্ষভাবে চিন্তা করা যায়, তখনই ইহারা ইন্দ্রিয়ানুভূতিলব্ধ তথ্যগুলির ব্যাখ্যারূপে প্রতিভাত হয়। অর্থাৎ এই ভাব ও ধারণাগুলি শুধু যে সত্য তাহা নয়, উহা ব্যতীত ইহাদের বিষয়ে দুইটি তথ্য পাওয়া যায়ঃ প্রথমতঃ এগুলি অতিপ্রাকৃতিক, দ্বিতীয়তঃ অতিপ্রাকৃতিকরূপেই এগুলি প্রাকৃতিক ঘটনা ব্যাখ্যা করে, অন্যরূপে নয়।
* * *
বাহ্যজগৎ অন্তর্জগতের অনুরূপ বা অন্তর্জগৎ বাহ্যজগতের অনুরূপ, জড়বস্তু মনেরই প্রতিকৃতি বা মন জড়জগতের প্রতিকৃতি, পারিপার্শ্বিক অবস্থা মনকে নিয়ন্ত্রিত করে অথবা মনই পারিপার্শ্বিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে, ইহা অতি পুরাতন প্রাচীন প্রশ্ন, তবুও ইহা এখনও পূর্ববৎ নূতন ও সতেজ, ইহাদের কোন্টি পূর্বে বা কোন্টি পরে, কোন্টি কারণ ও কোন্টি কার্য—মনই জড়বস্তুর কারণ বা জড়বস্তুই মনের কারণ—এ-সমস্যা সমাধানের চেষ্টা না করিলেও ইহা স্বতঃসিদ্ধ যে, বাহ্যজগৎ অন্তর্জগতের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হইলেও উহা অন্তর্জগতের অনুরূপ হইতে বাধ্য, না হইলে উহাকে জানিবার আমাদের অন্য উপায় নাই। যদি ধরিয়াও লওয়া যায়, বাহ্যজগৎই আমাদের অন্তর্জগতের কারণ, তবুও বলিতে হইবে, এই বাহ্যজগৎ যাহাকে আমরা আমাদের মনের কারণ বলিতেছি, উহা আমাদের নিকট অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয়, কেন-না আমাদের মন উহার ততটুকু বা সেই ভাবটুকুই জানিতে পারে, যাহা উহার সহিত উহার প্রতিবিম্বরূপে মেলে। প্রতিবিম্ব কখনও বস্তুটির কারণ হইতে পারে না। সুতরাং বাহ্যজগতের যে অংশটুকু—আমরা উহার সমগ্র হইতে যেন কাটিয়া লইয়া আমাদের মনের দ্বারা জানিতে পারিতেছি, তাহা কখনও আমাদের মনের কারণ হইতে পারে না, কারণ উহার অস্তিত্ব আমাদের মনের দ্বারাই সীমাবদ্ধ (মনের দ্বারাই উহাকে জানা যায়)।
এইজন্যই মনকে জড়বস্তু হইতে উৎপন্ন বলা যাইতে পারে না। উহা বলাও অসঙ্গত, কেন-না আমরা জানি যে, এই বিশ্ব-অস্তিত্বের যে অংশটুকুতে চিন্তা বা জীবনীশক্তি নাই ও যাহাতে বাহ্য অস্তিত্ব আছে, তাহাকেই আমরা জড়বস্তু বলি, এবং যেখানে এই বাহ্য অস্তিত্ব নাই এবং যাহাতে চিন্তা বা জীবনীশক্তি রহিয়াছে, তাহাকেই আমরা মন বলি। সুতরাং এখন যদি আমরা জড় হইতে মন বা মন হইতে জড় প্রমাণ করিতে যাই, তাহা হইলে যে-সকল গুণ দ্বারা উহাদিগকে পৃথক্ করা হইয়াছিল, তাহাই অস্বীকার করিতে হইবে। অতএব মন হইতে জড় বা জড় হইতে মন উৎপন্ন হইয়াছে, বলা শুধু কথার কথা মাত্র।
আমরা আরও দেখিতে পাই যে, এই বিতর্কটি মন ও জড়ের বিভিন্ন সংজ্ঞা-ব্যবহার-রূপ ভ্রান্তির উপর অনেকটা নির্ভর করিতেছে। আমরা মনকে কখনও-বা জড়ের বিপরীত ও জড় হইতে পৃথক্ বলিয়া বর্ণনা করিতেছি, আবার কখনও বলিতেছি মন ও জড় উভয়ই মনের অন্তর্গত, অর্থাৎ জড়জগতের দৃষ্টিতে অন্তর্জগৎ ও বহির্জগৎ দুই-ই মনের অংশ-বিশেষ। জড়কেও সেরূপ কখনও-বা আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাহ্য জগৎরূপে আবার কখনও বা বাহ্য বা আন্তর উভয় জগতের কারণরূপে বর্ণনা করা হইতেছে। জড়বাদিগণ ভাববাদিগণকে আতঙ্কিত করিয়া যখন বলেন, তাঁহারা তাঁহাদের পরীক্ষাগারের মূল তত্ত্বগুলি হইতে মন প্রস্তুত করিবেন, তখন তাঁহারা কিন্তু এমন এক বস্তুকে প্রকাশ করিতে চাহিতেছেন, যাহা তাঁহাদের সকল মূলতত্ত্বের ঊর্ধ্বে—বাহ্য ও অন্তর্জগৎ যাহা হইতে উৎপন্ন, যাহাকে তিনি জড় প্রকৃতিরূপে আখ্যা দিতেছেন। ভাববাদীও সেইরূপ যখন জড়বাদীর মূলতত্ত্বগুলি তাঁহারই চিন্তাতত্ত্ব হইতে উৎপন্ন বলিয়া মনে করেন, তখন কিন্তু তিনি এমন এক বস্তুর ইঙ্গিত পাইতেছেন, যাহা হইতে জড় ও চেতন উভয় বস্তুই উৎপন্ন হইতেছে; তাঁহাকেই তিনি বহু সময়ে ‘ঈশ্বর’ আখ্যাও দিতেছেন। ইহার অর্থ এই যে, একদল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এক অংশ মাত্র জানিয়া উহাকে ‘বাহ্য’ বলিয়া বর্ণনা করিতেছেন এবং অন্যদল উহার অপর অংশ জানিয়া উহাকেই ‘আন্তর’ আখ্যা দিতেছেন। এই উভয় প্রয়াসই নিষ্ফল। মন বা জড় কোনটিই অপরটিকে ব্যাখ্যা করিতে পারে না। এমন আর একটি বস্তুর আবশ্যক, যাহা ইহাদের উভয়কেই ব্যাখ্যা করিতে পারে।
এইরূপ যুক্তি দেওয়া যাইতে পারে যে, চিন্তাও কখনও মন ব্যতীত থাকিতে পারে না। কারণ যদি এমন এক সময় কল্পনা করা যায়, যখন চিন্তার অস্তিত্ব ছিল না, তখন জড়—যেরূপে উহাকে আমরা জানি—কি করিয়া থাকিবে? অপর পক্ষে ইহা বলা যাইতে পারে যে, ইন্দ্রিয়ানুভূতি ব্যতীত জ্ঞান সম্ভব নয় এবং যখন ঐ অনুভূতি বাহ্যজগতের উপর নির্ভর করে, তখন আমাদের মনের অস্তিত্বও বাহ্যজগতের অস্তিত্বের উপর নির্ভর করিতেছে।
ইহাও বলা যাইতে পারে না যে, ইহাদের (জড় ও মনের) একটি আরম্ভকাল (beginning) রহিয়াছে। সামান্যীকরণ ব্যতীত জ্ঞান সম্ভব নয়। সামান্যীকরণও আবার কতকগুলি সদৃশ বস্তুর পূর্বাস্তিত্বের উপর নির্ভর করে। পূর্ব অনুভূতি ব্যতীত একটির সহিত আর একটির তুলনাও সম্ভব নয়। জ্ঞান সেইজন্য পূর্বজ্ঞানের অপেক্ষা করে, সেইজন্যই উহা চিন্তা ও জড়ের পূর্বাস্তিত্বের উপর নির্ভর করিতেছে, উহাদের আরম্ভকাল সেইজন্য সম্ভব নয়।
ইন্দ্রিয়জ্ঞান যাহার উপর নির্ভর করে, সেই সামান্যীকরণের পশ্চাতেও আবার এমন একটি বস্তু থাকা আবশ্যক, যাহার উপর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংলগ্ন ইন্দ্রিয়ানুভূতিগুলি একত্র হইতে পারে, চিত্রাঙ্কনের জন্য যেমন চিত্রের পশ্চাতে একটি পটের একান্ত আবশ্যক, আমাদের বাহ্যানুভূতির জন্যও সেইরূপ একটি কিছুর একান্ত প্রয়োজন, যাহার উপর ইন্দ্রিয়ানুভূতিগুলি একত্র হইতে পারে, যদি চিন্তা বা মনকে ঐ বস্তু বলা যায়, তবে উহার একত্রীকরণের জন্য আবার আর একটি বস্তুর প্রয়োজন হইবে। মন একটি অনুভূতির প্রবাহ ব্যতীত অন্য কিছু নয়, সুতরাং উহাদের একত্রীকরণের জন্য ঐরূপ একটি পটভূমিকার একান্ত প্রয়োজন হইবে। এই পটভূমিকা পাইলেই আমাদের সকল বিশ্লেষণ থামিয়া যায়। এই অবিভাজ্য একত্বে না পৌঁছান পর্যন্ত আমরা থামিতে পারি না। ঐ একত্বই আমাদের জড় ও চিন্তার একমাত্র-পটভূমি।
* * *
যৌগিক পদার্থের বিশ্লেষণ ততক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব নয়, যতক্ষণ না কোন অখণ্ড অদ্বিতীয় সত্তা পাওয়া যায়। যে সত্তা আমাদের নিকট ‘জড়বস্তু’ ও ‘চিন্তা’ এই উভয়ের এই প্রকার একত্ব উপস্থাপিত করে উহাই সেই সঠিক অখণ্ড ভিত্তি, যাহার উপর নিখিল প্রপঞ্চও অধিষ্ঠিত; কারণ ইহার পরে আমরা আর কোন বিশ্লেষণের কথা চিন্তা করিতে পারি না। অধিকন্তু ইহার অধিক বিশ্লেষণের আর প্রয়োজনও থাকে না, কারণ বাহ্য ও আন্তর প্রত্যক্ষের সকল প্রকার বিশ্লেষণ ইহারই অন্তর্ভুক্ত হইয়া যায়।
এ পর্যন্ত আমরা এইটুকু দেখিতে পাইলাম যে, ‘মন’ ও জড়প্রপঞ্চ এবং তাহাদেরও ঊর্ধ্বে সেই অদ্বিতীয় বস্তু, যাহার উপর এই দুই-ই আপন আপন ক্রিয়া করিয়া যাইতেছে—এই সমস্তই আমাদের অনুসন্ধানের অন্তর্ভুক্ত।
এই যে ঊর্ধ্বে অবস্থিত বস্তুটি, ইহা ইন্দ্রিয়ের প্রত্যক্ষের বিষয় হয় না; যুক্তির অবর্জনীয় অঙ্গরূপে ইহা আসিয়া পড়ে, এবং এক ভাষাতীত অনুভব-স্বরূপে ইহা আমাদের প্রত্যেক ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নিকট উপস্থিত হয়। আমরা ইহাও দেখিতে পাই যে, যুক্তির সততা রক্ষা করিতে হইলে এবং আমাদের সামান্যীকরণের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি অনুসরণ করিতে হইলে আমরা বাধ্য হইয়াই এই অনির্বচনীয় বস্তুতে উপনীত হই।
এমন যুক্তিও উঠিতে পারে যে, মানসিক ও জড়-প্রাকৃতিক প্রপঞ্চের ঊর্ধ্বে অপর কোন সারবস্তু বা চেতন সত্তা আছে। ইহা মানিয়া লইবার কোন প্রয়োজন নাই। আমরা জানিতে পারি বা জানি শুধু এই নিখিল প্রপঞ্চকে; এবং এই প্রপঞ্চের ব্যাখ্যার জন্য প্রপঞ্চাতীত কোন অপর বস্তুর প্রয়োজন হয় না। বিশ্লেষণের ধারা ইন্দ্রিয়কে অতিক্রম করিয়া যাইতে পারে না। পরন্তু সর্ব বস্তুর সমন্বয়-ক্ষেত্ররূপে কোন সারবস্তু আছে, এইরূপ যে বোধ হইয়া থাকে, ইহা মানসিক ভ্রান্তি মাত্র।
আমরা দেখিতে পাই, অতি পুরাকাল হইতে চিন্তাশীল ব্যক্তিদের মধ্যে দুইটি শ্রেণী বিরাজমান। এক পক্ষের মতে মানুষের মনে বস্তু সম্বন্ধে প্রত্যয় রচনা করিবার এবং বস্তুনিরপেক্ষ সূক্ষ্ম ধারণায় উপস্থিত হইবার যে অনিবার্য প্রয়োজন রহিয়াছে, উহাই জ্ঞানার্জনের স্বাভাবিক পথ-নির্দেশক, এবং যতক্ষণ না আমরা সমস্ত প্রপঞ্চকে অতিক্রম করিয়া এমন এক বিশুদ্ধ প্রত্যয়ে উপস্থিত হইতেছি, যাহা সর্বপ্রকারে স্বতন্ত্র এবং দেশ-কাল-নিমিত্তের অতীত, ততক্ষণ পর্যন্ত ইহার বিরাম নাই। এক্ষণে যদি আমরা স্থূল হইতে আরম্ভ করিয়া ক্রমে উহাকে সূক্ষ্ম এবং সূক্ষ্মতরে বিলীন করিতে করিতে অগ্রসর হইয়া চলি, যতক্ষণ না এমন কিছুতে উপনীত হই যেখানে অপর সব কিছুর সমাধান পাই, এবং এই প্রণালী অবলম্বনে চিন্তা ও পদার্থের দ্বারা বিরচিত নিখিল প্রপঞ্চের বিশ্লেষণপূর্বক পূর্বোক্ত চরম ধারণায় উপস্থিত হই, তবে ইহা স্বতই প্রতিভাত হইবে যে, এই চরম ফল ব্যতীত যাহা কিছু আছে, সে সবই ইহার বিবিধ বিকাশমাত্র। কাজেই এই চরম ফলটিই একমাত্র সত্য বস্তু; অপর যাহা কিছু আছে, তাহা উহার ছায়ামাত্র। অতএব ইন্দ্রিয়ের গণ্ডীর মধ্যে সত্য নাই; সত্য উহার অতীত।
অপর দিকে অপর পক্ষ বলেন, আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি আমাদের নিকট যাহা উপস্থিত করে, জগতে কেবলমাত্র তাহাই সত্য এবং যদিও ইন্দ্রিয়লব্ধ অনুভূতির সহিত তাহারও ঊর্ধ্বে অবস্থিত কোন একটা বস্তুর আভাস অনুস্যূত রহিয়াছে বলিয়া বোধ হয়, তথাপি উহা মনের ছলনামাত্র, এবং তাই উহা মিথ্যা।
অপরিবর্তনীয় কোন কিছুর ধারণা না থাকিলে পরিবর্তনশীল কোন কিছুর ধারণা হয় না। এখন যদি বলা হয় যে, যে অপরিবর্তনীয়ের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তনশীল বস্তুটিকে দেখা হয়, তাহাও একটি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও পরিবর্তনশীল ঘটনামাত্র এবং উহার অপরিবর্তনীয়তা শুধু আপেক্ষিক এবং এইজন্য উহাকে বুঝিতে হইলে উহাকেও আর একটা কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে দেখিতে হইবে, এবং পর পর এইরূপই চলিতে থাকিবে, তাহা হইলে আমরা বলি, এই শৃঙ্খলা-পরম্পরাকে অনন্ত ধারায় যত দীর্ঘই করা হউক না কেন, পরিশেষে দেখা যাইবে, আমরা যেহেতু অপরিবর্তনীয়ের সহিত সম্বন্ধ ব্যতীত পরিবর্তনশীল বস্তুর ধারণা করিতে পারি না, অতএব বাধ্য হইয়াই আমাদিগকে এমন একটি সত্তার অস্তিত্ব মানিয়া লইতে হইতেছে, যাহা সকল পরিবর্তনশীল বস্তুর পশ্চাতে রহিয়াছে। বিভিন্ন অংশের মিলনে যাহা প্রস্তুত হয়, তাহার একাংশ গ্রহণ করিবার এবং অপরাংশ পরিত্যাগ করিবার অধিকার কাহারও নাই। কেহ যদি মুদ্রার প্রধান-নামাঙ্কিত দিকটি গ্রহণ করেন, তাহা হইলে তাঁহাকে উহার উল্টা দিকটাও গ্রহণ করিতে হয়, তা যতই তিনি উহা অপছন্দ করুন না কেন।
অধিকন্তু মানুষের প্রত্যেক ক্রিয়ার সঙ্গে ইহাই বিঘোষিত হয় যে, সে স্বাধীন। সর্বশ্রেষ্ঠ মনীষী হইতে সর্বাপেক্ষা অশিক্ষিত ব্যক্তি পর্যন্ত সকলেই জানে, সে স্বাধীন। অথচ প্রত্যেক মানুষ সেই সঙ্গে সামান্য চিন্তা করিলেই দেখিতে পায় যে, তাহার প্রতিটি কর্মের পশ্চাতে কতকগুলি অভিপ্রায় ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা রহিয়াছে। এবং সেই অবস্থা ও অভিপ্রায়গুলি যতক্ষণ আছে ততক্ষণ পর্যন্ত জাগতিক যে-কোন ঘটনাকে যেভাবে কার্য-কারণের নিয়মানুসারে নির্ণয় করা চলে, যে-কোন মানুষের জীবনের যে-কোন ঘটনাকেও তেমনি ঐ অভিপ্রায় ও অবস্থাগুলি হইতেই কার্য-কারণের সুনিশ্চিত ধারা অবলম্বনে নির্ণয় করা চলে।
এখানে আবার ঠিক পূর্বের অসুবিধারই সৃষ্টি হইতেছে। মানুষের ইচ্ছা একটি ক্ষুদ্র বৃক্ষের বৃদ্ধি কিংবা একটি প্রস্তরখণ্ডের পতনের মতই কার্যকারণের কঠিন নিগড়ে আবদ্ধ, এবং তথাপি এই-সকল বন্ধনের মধ্যেও মুক্তির অবিনশ্বর ধারণা অনুস্যূত রহিয়াছে। এস্থলেও যাঁহারা সম্পূর্ণ ঘটনার দিকে দৃষ্টি রাখেন, তাঁহারা ঘোষণা করিবেন যে, মুক্তির ধারণা ভ্রান্তিমাত্র, কারণ মানুষ সম্পূর্ণরূপে প্রয়োজনের দ্বারা পরিচালিত হয়।
এক্ষণে একদিকে ভ্রান্তি বলিয়া মুক্তিকে উড়াইয়া দিলে কোন ব্যাখ্যাই হইল না। অপরদিকে এরূপও তো বলা যাইতে পারে যে, প্রয়োজনের ধারণা বা বন্ধন বা কার্য-কারণ-সম্বন্ধের ধারণা অজ্ঞানপ্রসূত ভ্রান্তি। কোন মতবাদ যখন ঘটনাগুলিকে ব্যাখ্যা করিতে অগ্রসর হয়, তখন সে ঘটনাগুলির কোন-একটি ঐ মতবাদের অনুরূপ হইতেছে না দেখিয়া যদি ঐগুলিকে বাদ দিয়া বাকীগুলির সহিত নিজের সামঞ্জস্য স্থাপন করে, তবে সে মতটি গোড়াতেই ভ্রমাত্মক। এইটুকু পথ উন্মুক্ত রহিল যে আমাদিগকে প্রথমতঃ স্বীকার করিতে হইবে শরীর মুক্ত নহে, ইচ্ছাও মুক্ত নহে। কিন্তু শরীর মনের ঊর্ধ্বে এমন কিছু রহিয়াছে যাহা এবং
(অসমাপ্ত)