১২. জিমনাসিয়ামে স্কুলের বাস্কেটবল টিম

জিমনাসিয়ামে স্কুলের বাস্কেটবল টিম এ্যাকটিস করছে। দুই পাশের গ্যালারীতে কোনো দর্শক নেই, শুধু ডান দিকের গ্যালারীতে ঠিক মাঝখানে তিষা আর জন বসে আছে। দুদিন আগে একটা ভয়ংকর একসিডেন্টে মারা যেতে যেতে কোনোভাবে তারা বেঁচে গেছে, বিষয়টা সেভাবে কেউ জানে না। জন কিংবা তিষা দুজনের কেউই সেটা তাদের বাসাতে সেভাবে বলেনি।

জন এখন নিশ্চিতভাবে জানে যে তার গাড়ীটিতে কিছু একটা করা হয়েছিল। সে যেহেতু কানে শুনতে পায় না তাই গাড়ী চালানোর সময় প্রতি সেকেন্ডে কয়েকবার রিয়ারভিউ মিররে তাকায়। দুর্ঘটনার ঠিক আগে আগে সে রিয়ারভিউ মিররে একটা সিলভার রংয়ের ফোর্ড এস.ইউ.ভি দেখেছে, তাকে ওভারটেক করার সুযোগ পেয়েও সেটা ওভারটেক করেনি তার পিছনে রয়ে গেছে। ঠিক যখন তার ব্রেক ফেল করেছে তার আগে সে একটা ঝাঁকুনী অনুভব করেছে। এখন তার মনে হচ্ছে রিমোট কন্ট্রোলে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তার ব্রেক ফেল করিয়েছে। শুধু তাই না, সে দেখেছে তার পিছনের গাড়ীর ড্রাইভার হাতে কিছু একটা ধরে সেখানে চাপ দিচ্ছে আর তার গাড়ীর গতি বেড়ে গেছে। যখন সে গাড়ী থামিয়েছে তখন সে দেখেছে এই এস. ইউ. টি তার গাড়ীর পাশে থামিয়েছে। তখন অনেক মানুষের ভীড়, সেই ভীড়ের মাঝে মানুষটি জনের গাড়ীর হুড খুলে কিছু একটা খুলে নিয়েছে। গাড়ীর ফুয়েল ইনজেকশানে কিছু একটা লাগিয়েছিল, তার একটা ছেঁড়া তার পরেও সেখানে লাগানো ছিল, জন পরে দেখেছে। সে কাউকে কিছু বলেনি। বলেও লাভ নেই, পুলিশ তার এই আজগুবি কথা বিশ্বাস করবে না। তিষাকেও বলেনি, বললে মেয়েটি শুধু শুধু ভয় পাবে।

গ্যালারীতে বসে জন হাত নেড়ে সাইন ল্যাংগুয়েজে তিষাকে বলল,

“তিষা। তুমি খুব সাবধানে থেকো।”

তিষা একটু অবাক হয়ে বলল, “কেন আমাকে সাবধানে থাকতে হবে। কেন?”

“বিপদ যখন আসে একা আসে না। তিনবার আসে। তোমার দুইবার হয়েছে, একবার সাসকুয়ান লেক, দুইদিন আগে আমার গাড়ীতে। এখন তিন নাম্বারটা বাকী আছে। খুব সাবধান।”

তিষা কোনো কথা বলল না। জন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল “আর আমার কী মনে হয় জান?”

“কী?”

“তুমি যে ভেবেছিলে এনিম্যানের হাসিটা তার সত্যিকারের হাসি নয়, এটা কৃত্রিম, সেটা হয়তো সত্যি। এনিম্যান আসলে হাসি খুশী প্রাণী না, খুব দুঃখী একটা প্রাণী সেটাও হয়তো সত্যি।”

তিষা অবাক হয়ে বলল, “কেন? হঠাৎ করে তোমার এই কথা মনে হল কেন?”

“হঠাৎ করে না, আমি কয়েকদিন থেকেই এটা ভাবছি। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এটা সত্যি।”

জনের খুব ইচ্ছে করল সে তিষাকে তার আসল সন্দেহের কথাটা বলে দেয়। সেদিন তার গাড়ীর ব্রেকটি ফেল করিয়ে আসলে তিষাকেই মারতে চেয়েছিল। তার গাড়ীটি শুধু ব্যবহার করেছে। জন সেটা বলতে পারল না, এই সহজ সরল মেয়েটাকে সে ভয় দেখাতে চায় না, শুধু সাবধান করতে চায়।

জন বলল, “তিষা।”

“বল।”

“এনিম্যান নিয়ে তুমি যদি নতুন কিছু পাও সেটা কিন্তু ব্লগে লিখ না।”

“ব্লগে লিখব না?”

“না।”

“কেন?”

“এনিম্যান কোম্পানী খুব বড় কোম্পানী, যদি তাদের ব্যবসার ক্ষতি হয় তখন রেগে মেগে তোমার ক্ষতি করতে পারে।”

“আমার ক্ষতি? আমার আবার কী ক্ষতি করবে?”

জনের একবার ইচ্ছে হল বলে, তোমাকে মেরে ফেলতে পারে। দুইদিন আগে যেরকম আমাকে সহ মেরে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু সে বলল না। শুধু হাসার ভঙ্গি করে বলল, “কী ক্ষতি করতে পারে আমি সেটা জানি না, কিন্তু বড় কর্পোরেশানকে কোনো বিশ্বাস নেই। দরকার কী ওদের চটিয়ে।”

“ঠিক আছে।”

“আমার কী মনে হয় জান?”

“কী?”

“ব্লগে তোমার যে লেখাটা আছে আপাতত তুমি সেটাও সরিয়ে ফেল।”

“সরিয়ে ফেলব?”

“হ্যাঁ।”

“ঠিক আছে।”

.

তিষা সেই রাতে ব্লগ থেকে তার লেখাটি সরিয়ে ফেলল।

তবে তিষা যতক্ষণ বাসায় থাকে ততক্ষণ সে তার এনিম্যান মিশকাকে লক্ষ্য করে। তার দিকে তাকিয়ে থাকে, মিশকাকে বোঝার চেষ্টা করে। আশে পাশে যখন কেউ নেই তখন একবার সে মিশকাকে তার কোলে নিয়ে বসল, মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “বল তো মিশকা, তুমি কী আমার কথা বুঝতে পারছ?”

মিশকা মাথা নাড়ল, তারপর ফিক করে হেসে ফেলল। তিষা বলল, “তুমি যদি আমার কথা বুঝে থাকো তাহলে বল দেখি আমার নাম কী?” মিশকা আবার একটু হেসে ফেলল। তিষা বলল, “ বল দেখি তোমার নাম কী?”

মিশকা একটু মাথা নাড়ল তারপর আবার হাসল। তিষা বলল, “বল মিশকা। মি-শ-কা। মি-শ-কা।”

মিশকা কিছু না বলে খিলখিল করে হাসল। ঠিক তখন বাইরে একটা গাড়ীর শব্দ শুনে তিষা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল জন তাদের বাসার সামনে তার গাড়ী পার্ক করছে। তিষা নিচে গিয়ে দরজা খুলে দেয়, জন তাকে দেখে মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “তুমি ঠিক আছ?”

তিষা বলল, “এখন পর্যন্ত।”

“কী করছিলে?”

“মিশকার সাথে কথা বলার চেষ্টা করছিলাম।”

“কথা বলতে পেরেছ?”

“শুধু এক দিক দিয়ে, আমি বলি আর সে শুনে। শুনে আর হাসে।”

“তোমার কথা কী বুঝতে পারে?”

“জানি না।”

তিষা দরজা বন্ধ করে বলল, “চল তুমি নিজেই দেখ।”

দুজনে সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে তিষার রুমে ঢুকল, মিশকা জনকে দেখে তার কাছে ছুটে এসে তার হাত ধরল। জন মিশকাকে কোলে তুলে নিয়ে তার মাথার চুল এলোমেলো করে দিল। মিশকা মনে হয় এই ব্যাপারটাতে খুব মজা পায়, সে খিলখিল করে হাসতে থাকে। জন আবার তাকে নিচে নামিয়ে দেয়, তিষা তখন মিশকাকে তার নিজের কোলে বসিয়ে তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করতে থাকে, “মিশকা, তুমি খুবই সুইট একটা এনিম্যান। তোমার মাথায় অনেক বুদ্ধি, তোমার একটাই সমস্যা তুমি শুধু হাসো, কথা বলার চেষ্টা কর না। এখন আমি তোমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করব। তুমি খুব মন দিয়ে শোনো আমি কী বলছি। মিশকা, তুমি বল তুমি কী আমার কথা বুঝতে পেরেছ?”

মিশকা মাথা নাড়ল, তারপর খিলখিল করে হাসতে থাকল। তিষা হতাশ ভাবে মাথা নেড়ে বলল, “না, না হাসলে হবে না। হাসি বন্ধ কর। কথা বলার চেষ্টা কর। বল, তোমার নাম কী? বল।”

মিশকা আবার খিল খিল করে হাসল। তিষা জনের দিকে তাকিয়ে বলল, “এটা হচ্ছে সমস্যা। কোনো কথার উত্তর দেয় না। শুধু হাসে।”

জন তার হাত নেড়ে সাইন ল্যাংগুয়েজ ব্যবহার করে বলল, “এনিম্যানদের কথা বলার ক্ষমতা নেই। মিশকা কী করবে? কেমন করে কথা বলবে?”

“আমি ভাবছিলাম যদি চেষ্টা করে তাহলে হয়তো একটু পারবে।”

জন বলল, “আমার কথা চিন্তা কর। আমি কী চেষ্টা করলে তোমার মত মুখ দিয়ে কথা বলতে পারব? পারব না। আমাকে হাত দিয়েই কথা বলতে হবে। সাইন ল্যাংগুয়েজে!”

মিশকা খুব মনোযোগ দিয়ে একবার তিষার মুখের দিকে আরেকবার জনের দিকে তাকাচ্ছিল। হঠাৎ তার কী মনে হল কে জানে, সে হাত দিয়ে সাইন ল্যাংগুয়েজের মত একটা ভঙ্গী করল। জন চমকে উঠে মিশকার দিকে তাকাল তারপর তিষার দিকে তাকাল, উত্তেজিত ভঙ্গীতে বলল, “তুমি দেখলে তিষা, মিশকা কী করল?”

“কী করল?”

“সাইন ল্যাংগুয়েজে কিছু একটা বলার চেষ্টা করল।”

“সত্যি?”

“হ্যাঁ। তার মানে বুঝতে পারছ?”

তিষা উত্তেজিত গলায় বলল, “তার মানে মিশকা যদি মুখ দিয়ে কথা। নাও বলতে পারে সে সাইন ল্যাংগুয়েজে কথা বলতে পারবে?”

“হ্যাঁ। আমি স্পষ্ট দেখলাম সে এই মাত্র চেষ্টা করল।”

মিশকা তাদের দুজনের মুখের দিকে তাকিয়েছিল এবারে অকারণেই খিল খিল করে হেসে উঠল। জন মিশকাকে নিজের কাছে টেনে এনে হাত দিয়ে নিজেকে দেখিয়ে সাইন ল্যাংগুয়েজে বলল, “আমি জন।”

মিশকা মনোযোগ দিয়ে তাকে দেখল তারপর সেও সাইন ল্যাংগুয়েজ দিয়ে বলল, “আমি জন।”

তিষা চিৎকার করে উঠে, “দেখেছ? দেখেছ জন? মিশকা কথা বলছে। মিশকা কথা বলছে!”

জন মাথা নাড়ল, “এখনো নিজে কথা বলছে না। আমি যেটা বলেছি সেটা অনুকরণ করছে।”

“কিন্তু শিখিয়ে দিলে নিশ্চয়ই নিজে কথা বলবে। নিশ্চয়ই বলবে।” জন মাথা নাড়ল, বলল, “চেষ্টা করে দেখি।”

তারপর বেশ খানিকক্ষণ সময় নিয়ে সে মিশকাকে সাইন ল্যাংগুয়েজ দিয়ে তাদের তিনজনের নাম বুঝিয়ে দিল। তার নিজের নাম হচ্ছে মিশকা। আর তারা দুজনের একজন জন অন্যজন তিষা। যতবার তাকে শেখানো হল প্রত্যেকবারই মিশকা খুব মনোযোগ দিয়ে সেটা দেখল তারপর মাথা নাড়ল। যখন জন আর তিষার মনে হল মিশকাকে বেশ ভালোভাবে শেখানো গেছে তখন জন সাইন ল্যাংগুয়েজ দিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল, “আমি কে?”

মিশকা এক মুহূর্ত জনের দিকে তাকিয়ে রইল তারপর হাত দিয়ে বলল, “জন।”

জন তিষাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এটি কে?”

মিশকা জানাল, “তিষা।”

জন মিশকার দিকে আঙ্গুল দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কে?”

মিশকা জানাল, “আমি মিশকা।”

তিষা আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। জনও জোরে জোরে মাথা নাড়ল, তারপর বলল, “আমার মনে হয় মিশকাকে আমরা সাইন ল্যাংগুয়েজ শেখাতে পারব।”

তিষা উত্তেজিত গলায় বলল, “তার মানে বুঝতে পেরেছ? তার মানে আমরা মিশকার কাছ থেকে তার ভেতরের সব কথা জেনে যাব।”

জন বলল, “কিন্তু মনে আছে তো, এই কথাটা কাউকে বলতে পারবে না?”

“মনে আছে।”

“তোমার বাবা মাকেও না।”

তিষা মাথা নাড়ল, “ঠিক আছে, বলব না।”

“ব্লগে লিখতে পারবে না”

“ঠিক আছে, লিখব না।”

“সারা পৃথিবীতে এটা এখন শুধু তিনজন এটা জানবে। তুমি আমি আর মিশকা।”

তিষা গম্ভীর মুখে বলল, “ঠিক আছে। সারা পৃথিবীতে শুধু আমরা তিনজন এটা জানব।”

. জনের সাথে থাকতে থাকতে তিষাদের ক্লাশের সব ছেলে মেয়েই কম বেশী সাইন ল্যাংগুয়েজ শিখে গেছে। জনের সাথে একটু বেশী সময় কাটিয়েছে বলে তিষা অন্যদের থেকে সেটা অনেক ভালো জানে। তিষা তাই পরের কয়েকদিন মিশকাকে তার নিজের মতো করে সাইন ল্যাংগুয়েজ শেখাতে লাগল। যখনই সময় পেতো তখনই জনও চলে আসতো। খাতা কলম টেলিভিশন চেয়ার টেবিল এগুলো শেখানো গেল খুব সহজেই। ব্যথা, দুঃখ ভয় কষ্ট আনন্দ এগুলো শেখানো হল সবচেয়ে কঠিন। তারপরও মিশকা। দ্রুত শিখতে লাগল, কতো তাড়াতাড়ি মিশকা কতো সুন্দর করে কথা বলতে শিখে গেল দেখে তিষা নিজেই আবাক হয়ে যায়।