গাড়িটার কাচ কালো রঙের। কাকাবাবুর চোখ বাঁধা, হাত বাঁধা। গাড়িটা কোন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে, তা কাকাবাবুর পক্ষে বোঝার কোনও উপায় নেই।
এটুকু বোঝা গেছে, পেছনের সিটে তাঁর পাশে বসে আছে একজন, আর সামনে ড্রাইভারের পাশে বসে আছে আর একজন। আর ওদের মাঝখানে টবি নামের কুকুরটা। এই লোক দুজনের একজন শঙ্খচূড় নিজে কিনা তা বোঝা যাচ্ছে না।
কাকাবাবু বসে আছেন শক্ত হয়ে কাঠের মতন। তাঁকে হেলান দিয়ে বসতে বারণ করা হয়েছে।
এরকম অস্বস্তিতে তিনি জীবনে কখনও পড়েননি। তিনি অন্যের হাতের পুতুল। মুক্তি পাওয়ার কোনও চেষ্টা করাও বৃথা।
একটু বাদে তাঁর পাশের লোকটি চেঁচিয়ে বলল, এই যে, ঢুলছেন নাকি? খবরদার ঘুমোতে পারবেন না। ঘুমোতে দেখলেই কিন্তু আমি কান ধরে টেনে জাগিয়ে দেব।
কাকাবাবু আপন মনে বললেন, সেই ইস্কুলে পড়বার সময় অঙ্কের মাস্টারমশাই একদিন আমার কান মলে দিয়েছিলেন। তারপর এত বছরে আর কেউ আমার কানে হাত দেয়নি।
লোকটি বলল, একবার কান মলে দিলেই তক্ষুনি একেবারে ঘুম ভেঙে যায়।
সামনে থেকে ড্রাইভারটি বলল, আমাদের মতন ড্রাইভারদের যখন গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎ ঘুম আসে, তখন আমরা নিজেরাই নিজেদের কান মলে দিই ভাল করে।
টবি হঠাৎ ঘেউ ঘেউ করে উঠল। নিশ্চয়ই রাস্তায় কোনও কুকুর দেখেছে।
পাশের লোকটি বলতে লাগল, টবি, টবি, নো, নো।
ঝনঝন শব্দ শুনে কাকাবাবু বুঝলেন, টবির গলায় চেন বাঁধা।
কুকুরটা তবু হিংস্রভাবে ডেকেই চলেছে। কাকাবাবুর ইচ্ছে হল, ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে। কিন্তু তাঁর হাত যে বাঁধা।
ড্রাইভার আর অন্য দুজন লোকের গলার আওয়াজ শুনে কাকাবাবু বুঝলেন, শঙ্খচূড় নিজে আসেনি।
এদের মধ্যে রিমোট কন্ট্রোলটা কার কাছে?
গাড়িটা চলছে, কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ।
একটু পরে ড্রাইভার বলল, এই রে, সামনের রাস্তায় জল জমে আছে। কাল সারারাত বৃষ্টি হয়েছে।
সামনের সিটের লোকটি বলল, থামাও, থামাও, গাড়ি থামাও!
ড্রাইভার বলল, বেশি জল নয়, ওপর দিয়ে চলে যেতে পারব।
সামনের লোকটি বলল, না, না, না, জলের ওপর দিয়ে গাড়ি চালানো নিষেধ। আছে। ব্যাক করো, ব্যাক করো।
ড্রাইভারটি বলল, অন্য গাড়ি তো যাচ্ছে, অসুবিধে হবে না।
এবারে সামনের লোকটি কঠোরভাবে বলল, বললাম না, জলের ওপর দিয়ে যাওয়ার অর্ডার নেই। খানিকটা ব্যাক করো, বাঁ দিক দিয়ে একটা সরু রাস্তা আছে।
এর মধ্যে পেছনে অন্য গাড়ি এসে গেছে। একজন লোক নেমে গিয়ে সেইসব গাড়ি সরিয়ে এ-গাড়িটাকে ব্যাক করানো হল। তারপর ঢুকে পড়ল একটা গলিতে।
যে নীচে নেমেছিল সে গাড়িতে উঠে পড়ে বলল, এই জ্যামের মধ্যে গাড়ি ব্যাক করানোর কত ঝামেলা। ওইটুকু জলের ওপর দিয়ে চলে গেলে কী হত?
অন্যজন বলল, শাট আপ! সারের অর্ডারের ওপর কোনও কথা নয়।
কাকাবাবু বললেন, আমাদের পৌঁছোতে কতক্ষণ লাগবে?
অন্য লোকটি আবার বলল, শাট আপ! কোনও প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হবে না!
গাড়িটা আস্তে চলছে, মাঝে মাঝে থেমে যাচ্ছে, মনে হয় রাস্তায় কিছুটা জ্যাম আছে। এক জায়গায় গাড়িটা কয়েক মিনিট থামার পর কাকাবাবু একটা ট্রেনের শব্দ শুনতে পেলেন। তার মানে, এ-জায়গাটা লেভেল ক্রসিং।
আবার কিছুক্ষণ চলার পর গাড়ি থামল। দরজা খুলে নেমে গেল ওদের একজন। টবিও আবার ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করেছে।
গাড়ির দরজা খোলা বন্ধের শব্দ পেয়ে কাকাবাবু বুঝলেন, লোকটি ফিরে এসেছে। তারপর ওরা কী যেন খেতে শুরু করল।
একজন বলল, টবিকে একটা দে। টবি মিষ্টি খেতে ভালবাসে।
অন্যজন বলল, রায়চৌধুরীকেও একটা দিবি নাকি?
তার সঙ্গী বলল, এ-ব্যাপারে কোনও অর্ডার নেই। তবে, সার তো নিজেই ওকে খাবার খাইয়েছেন।
অন্যজন কাকাবাবুকে একটু ঠেলা দিয়ে জিজ্ঞেস করল, এই যে, একটা মিষ্টি খাবেন?
কাকাবাবু মাথা নেড়ে বললেন, না।
সে বলল, খেয়ে দেখুন না, ভাল মিষ্টি।
সে জোর করে কাকাবাবুর মুখে কিছু একটা চেপে ধরল। কাকাবাবু বাধ্য হয়ে একটুখানি খেলেন। তাঁর ভালই লাগল, খেয়ে নিলেন সবটা।
এরপর গাড়ি চলতে লাগল অনেকক্ষণ ধরে, না থেমে।
কাকাবাবুর সত্যিই ঘুম এসে যাচ্ছে। কিন্তু হেলান দেওয়ার উপায় নেই। পিঠে যে জিনিসটা বাঁধা, সেটা মনে হচ্ছে ভারী হয়ে উঠছে ক্রমশ।
একবার তিনি সামনের দিকে ঢুলে পড়তেই পাশের লোকটি তার একটা কান চেপে ধরল।
কাকাবাবু বললেন, দাও, ভাল করে কানটা মলেই দাও, আমি ঘুমোতে চাই না।
সামনের লোকটি বলল, আর-একটা মিষ্টি খাবেন?
কাকাবাবু এবারে আর আপত্তি না করে বললেন, দাও।
সেটা খেয়ে তিনি একটু জল চাইলেন। লোকটি বলল, গাড়িতে জলের বোতল নেই, এখন আর থামাও যাবে না, দেরি হয়ে যাবে।
ক্রমশ রাস্তায় অন্য গাড়ির হর্নের আওয়াজ বাড়তে লাগল। তারপর ট্রামের আওয়াজ পেয়ে কাকাবাবু বুঝলেন, গাড়িটা কলকাতা শহরে এসে পড়েছে।
এবারে পাশের লোকটি তার চোখের বাঁধন আর হাতের শিকল খুলে দিল।
দুপাশে কালো কাচ, সামনের দিকে তাকিয়ে কাকাবাবু বুঝলেন, গাড়িটা ছুটছে ময়দানের মধ্য দিয়ে। পাশ দিয়ে যাচ্ছে আলিপুরের ট্রাম।
গাড়িটা লালদিঘি ঘুরে এসে থামল রাইটার্স বিল্ডিংসের সামনে।
পাশের লোকটি দরজা খুলে বলল, নামুন।
কাকাবাবু বললেন, আমার ক্রাচ কোথায়? ক্রাচ না পেলে আমি হাঁটতে পারব না।
লোকটি বলল, ক্রাচ আনা হয়েছে। আধঘণ্টার মধ্যে অবশ্যই ফিরবেন, আমি এখানে অপেক্ষা করব। আমাদের সার কী বলে দিয়েছেন শুনুন। আপনাকে শেষবারের মতন সাবধান করে দিচ্ছি। আপনি মুখে যা বলবেন, সব আমরা শুনতে পাব। আপনি লিখেলিখে কিছু জানাবার চেষ্টা করলেও কোনও লাভ হবে। আপনার পিঠ থেকে ওই জিনিসটা খোলার চেষ্টা করলে আপনি কিছুতেই বাঁচবেন না। সঙ্গে সঙ্গে রিমোট কন্ট্রোল চালু হয়ে যাবে। আপনি ছাতু হয়ে যাবেন! আধঘণ্টার বেশি দেরি হলেও তাই হবে।
কাকাবাবু বললেন, হোম সেক্রেটারি যদি এখন ঘরে না থাকেন?
লোকটি বলল, তা হলে ফিরে আসবেন সঙ্গে সঙ্গে। পরে আবার চেষ্টা করা হবে।
কাকাবাবু বুঝতে পারলেন, এরা সবদিক ভেবে রেখেছে। হোম সেক্রেটারিকে লিখে জানাবার কথাটা তাঁরও মনে এসেছিল। জানালেও এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার সময় মিলবে না।
একতলার অভ্যর্থনাকক্ষে গিয়ে কাকাবাবু হোম সেক্রেটারির সঙ্গে দেখা করতে চাইলেন। সেখানকার একজন বলল, আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে? নেই? তা হলে আজ দেখা হবে না। উনি সারাদিন ব্যস্ত থাকবেন।
কাকাবাবু বললেন, হোম সেক্রেটারি মৃগাঙ্ক আমার ভাই। আমি বিশেষ দরকারে এসেছি। ওকে আমার নামটা শুধু বলুন, তাতেই কাজ হবে।
কর্মচারীটি টেলিফোনে হোম সেক্রেটারির সঙ্গে একটু কথা বলেই ফোন রেখে দিল। তারপর ব্যস্ত হয়ে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, উনি এক্ষুনি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। আপনি লিফটে উঠে চলে যান।
লিফটে অনেক লোক উঠে পড়েছে, কাকাবাবু প্রথমবার উঠলেন না। অন্যদের সঙ্গে যদি ধাক্কাধাক্কি হয়, তাতেও তিনি ভয় পাচ্ছেন।
লম্বা বারান্দা দিয়ে ক্রাচ নিয়ে হাঁটতে লাগলেন কাকাবাবু। দু-চারজন লোক তাঁকে চিনতে পেরে নমস্কার করল।
কাকাবাবু মনে মনে ভাবলেন, আমি যে একটি সাঙ্ঘাতিক মানব-বোমা, তা কেউ বুঝতে পারছে না।
হোম সেক্রেটারি মৃগাঙ্কমৌলী রায় ব্যস্ত হয়ে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়িয়ে আছেন। কাকাবাবুকে দেখেই বললেন, কী ব্যাপার রাজাদা, আপনি কোথায় ছিলেন? আপনাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মুখ্যমন্ত্রীও আপনার জন্য চিন্তিত।
কাকাবাবু বললেন, চলো, তোমার ঘরে বসে বলছি।
হোম সেক্রেটারির ঘরে আর একজন লোক বসে আছেন। পুরোদস্তুর পুলিশের পোশাক পরা।
হোম সেক্রেটারি কাকাবাবুকে বললেন, এঁর সামনে সব বলতে পারেন। ইনি ডি আই জি শামসুল আলম।
আলম হাতজোড় করে নমস্কার করে বললেন, আমি আপনাকে অনেকবার দেখেছি।
কাকাবাবুও নমস্কার করে বললেন, আগে এক গেলাস জল খাওয়াও। খুব তেষ্টা পেয়েছে।
ঢক ঢক করে পুরো গেলাস জল খেয়ে ফেলার পর কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আগে বলল, দেবলীনার কী খবর?
মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, তাকে তো মাঠের মধ্যে পাওয়া গেছে। গাড়িতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল। ড্রাইভারেরও একই অবস্থা। ওরা দুজনেই বলেছে, গাড়ির জানলা দিয়ে একজন ফুস ফুস করে কী একটা গ্যাস স্প্রে করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান। তারপর কী হয়েছে কিছু জানে না।
কাকাবাবু বললেন, কী আশ্চর্য, ওরা দেবলীনাকে কিছু করল না। শুধু আমাকে অজ্ঞান অবস্থায় ধরে নিয়ে গেল।
মৃগাঙ্কমৌলী জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় ধরে নিয়ে গেল?
কাকাবাবু বললেন, তা তো জানি না। বুঝতে পারিনি।
আলম বললেন, হঠাৎ এ-রাজ্যে অ্যাবডাকশানের কেস খুব বেড়ে গেছে। এই মুহূর্তে একত্রিশ জনকে পাওয়া যাচ্ছে না। এদের মধ্যে যেমন বয়স্ক লোক আছে, তেমনই অল্পবয়েসি ছেলেমেয়েও আছে। এক-একজনের জন্য পাঁচ লাখ, দশ লাখ মুক্তিপণ চাওয়া হয়েছে।
মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, এসব একই দলের কাজ না আলাদা আলাদা দল, তাও ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কোনও চিঠিতে লেখা শঙ্খচুড়, কোনওটাতে রুস্তম, কোনওটাতে ভ্যাম্পায়ার। তবে চিঠির ধরনগুলো একই রকম।
কাকাবাবু বললেন, আমার মতন একজন খোঁড়া লোককে ধরে নিয়ে গিয়ে ওরা ভুল করেছিল। আমি ওদের বললাম, আমার মুক্তিপণের দশ লাখ, পাঁচ লাখ দূরে থাক, কেউ এক টাকাও দেবে না!
আলম বললেন, এই শুনেই আপনাকে ওরা ছেড়ে দিল?
কাকাবাবু বললেন, তা কী আর দেয়! কিছু অত্যাচার টত্যাচার করবে ভেবেছিল।
মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, আপনাকে ওরা চিনতে পারেনি? আপনিই যে বিখ্যাত কাকাবাবু, রাজা রায়চৌধুরী।
কাকাবাবু বললেন, তা জানত বোধ হয়। তবে অনেকবার তো দেখলাম, আমাকে কেউ বেশিদিন আটকে রাখতে পারে না।
মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, আপনাকে আটকাবে কার সাধ্য!
মৃগাঙ্কমৌলীর সামনে টেবিলের ওপর একটা খাতার সাইজের চৌকো জিনিস রয়েছে।
সেটার দিকে তাকিয়ে কাকাবাবু বললেন, আমি কী করে পালালাম, সেসব কথা বিস্তারিতভাবে পরে বলব, এখন বাড়ি গিয়ে ভাল করে ঘুমোনো দরকার। দেবলীনার সঙ্গেও একবার দেখা করতে হবে। তোমার কাছে আগে এসেছি অন্য কারণে। এইটাই কি সেই জিনিস?
মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, সেই জিনিস মানে? আপনি এটার সম্পর্কে কিছু জানেন? আমরা এটার কথা যথাসম্ভব গোপন রাখার চেষ্টা করেছি।
কাকাবাবু বললেন, এটা যার কাছে পাওয়া গেছে, সে ধরা পড়েছিল নিউ জলপাইগুঁড়ি স্টেশনে। তারপর সে খুন হয় জেলের মধ্যে। এ-খবর তো বেরিয়েছে দিল্লির এক কাগজে।
আলম বললেন, তাই নাকি? দেখিনি তো। কলকাতার কাগজে কিছু বেরোয়নি। লোকটির কাছ থেকে কোনও কথাই বার করা যায়নি। কিন্তু তার মুখ-চোখ দেখে মনে হয়েছিল, এই জিনিসটা তার কাছে খুবই দামি।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, লোকটি খুন হল কী করে?
আলম বললেন, খুন না আত্মহত্যা, সেটাও ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।
মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, এটা একটা অর্গানাইজার। খুবই আধুনিক ধরনের। পার্সোনাল কম্পিউটারের সঙ্গে লিঙ্ক করা যায়। জলপাইগুঁড়ি থেকে এটা পুলিশের গাড়িতে আনবার সময় কোনও একটা দল এটা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। গাছের গুঁড়ি দিয়ে আটকে দিয়েছিল রাস্তা। তারপর বোমা ছুড়তে ছুড়তে এগোচ্ছিল। দৈবাৎ সেই সময় আর-একটা পুলিশের গাড়ি এসে যায় উলটো দিক থেকে। আমাদের পুলিশের গুলিতে ওদের একজন মারাও যায়। সেইজন্যই এটাকে এত সাবধানে রাখা হয়েছে।
আলম বললেন, এর মেমরিতে অনেক তথ্য ঠাসা আছে। তার কিছু বার করতেও পেরেছি। কিন্তু কিছুই মানে বোঝা যাচ্ছে না। শুধু কিছু অক্ষর আর সংখ্যা।
মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, এটা বোঝা যাচ্ছে, কোনও সাংকেতিক ভাষায় কিছু তথ্য রয়েছে। এটাকে দিল্লিতে পাঠাতেও ভরসা পাচ্ছি না। যদি মাঝপথে খোয়া যায়! তাই দিল্লি থেকে দুজন এক্সপার্ট আসছেন—
কাকাবাবু বললেন, দিল্লি থেকে এক্সপার্ট আনতে হবে? এখানে কেউ পারবে না?
মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, এখানে কয়েকজন তো অনেক চেষ্টা করে দেখল, কেউ,—। বলতে বলতে থেমে গেলেন মৃগাঙ্কমৌলী। তারপর লজ্জা পেয়ে গিয়ে বললেন, আপনিই তো রয়েছেন। আপনি এর আগে কত সাংকেতিক লিপি উদ্ধার করেছেন, এমনকী ইজিপ্টের পিরামিডের মধ্যে হিয়েরোগ্লিফিক্স পর্যন্ত আপনার কথা মনে পড়েনি।
আলম বললেন, উনি তো এখানে ছিলেন না।
কাকাবাবু বললেন, পারব কিনা জানি না, তবু একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি। দেখব?
মৃগাঙ্কমৌলী সেটা কাকাবাবুর হাতে তুলে গিয়ে ব্যগ্রভাবে বললেন, দেখুন, দেখুন না।
কাকাবাবু জিনিসটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে দেখতে আপনমনে বললেন, ২৫৬ কে বি মেমরি, প্রচুর জিনিস থাকতে পারে। কিন্তু এখানে তো হবে না। বাড়িতে গিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় দেখা দরকার। এটা আমি বাড়িতে নিয়ে যেতে পারি?
মৃগাঙ্কমৌলী আড়ষ্টভাবে বললেন, সেটা তো সম্ভব নয়, রাজাদা!
কাকাবাবু বললেন, সম্ভব নয়? কেন?
মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, টপ সিকিউরিটি। চিফ মিনিস্টারের অর্ডার ছাড়া এটা কোনওক্রমেই বাইরে নেওয়া যাবে না।
আলম বললেন, চিফ মিনিস্টার এখন দিল্লিতে।
কাকাবাবু বললেন, তোমরা কি আমাকে বিশ্বাস করতে পার না?
মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, বিশ্বাসের প্রশ্ন নয়। রাজাদা, আপনাকে আমি অবিশ্বাস করতে পারি? কিন্তু আমাদের ওপর যা অর্ডার আছে।
কাকাবাবু ঘড়ির দিকে তাকালেন। এর মধ্যেই প্রায় কুড়ি মিনিট কেটে গেছে। ওরা সময় দিয়েছে মাত্র আধঘণ্টা।
সেই আধঘণ্টা পার হয়ে গেলে ওরা কী করবে? রিমোট কন্ট্রোল চালু করে দেবে। তাতে কাকাবাবু শুধু নিজে মরবেন না, এই মৃগাঙ্কমৌলী আর আলমও খতম হয়ে যেতে পারে।
অন্তত ওদের বাঁচবার জন্যও কাকাবাবুকে এখানে থেকে বেরিয়ে যেতে হবে আর দশ মিনিটের মধ্যে।
মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, রাজাদা, আপনাকে দারুণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে। মুখোনা কালো হয়ে গেছে। শরীর খারাপ হয়নি তো?
কাকাবাবু বললেন, না। সেরকম কিছু না। ভাল করে ঘুম হয়নি।
মৃগাঙ্কমৌলি বললেন, আপনি বাড়িতে গিয়ে ভাল করে ঘুমিয়েটুমিয়ে নিন। আমি বরং সন্ধের পর আপনার সঙ্গে দেখা করতে যাব।
কাকাবাবু বললেন, আমরা আজকাল সব ব্যাপারেই দিল্লির ওপর নির্ভর করি। আমরা বাঙালিরা নিজেরা বুঝি কিছু পারি না? চিফ মিনিস্টার যদি এখানে উপস্থিত থাকতেন, তিনি কি ওটা একদিনের জন্য আমাকে দিতে আপত্তি করতেন?
মৃগাঙ্কমৌলী তাকালেন আলমের দিকে।
আলম বললেন, দিল্লির এক্সপার্ট দুজন আসবেন কাল মর্নিং ফ্লাইটে। এখানে পৌঁছোতে পৌঁছোতে দশটা সাড়ে দশটা বেজে যাবে। তার আগেই যদি কাকাবাবু এই কোডগুলো পড়ে দিতে পারেন, তা হলে কিন্তু আমাদের খুব ক্রেডিট হবে। আমাদের এখানেও কাকাবাবুর মতন এমন গুণী মানুষ রয়েছেন।
কাকাবাবু বললেন, আমি পারব কিনা জানি না। তবে, কাল সকাল দশটার মধ্যে আমি এটা ফেরত দিয়ে যাব, এই কথা দিতে পারি।
মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, এটা বাড়িতে নিয়ে যেতেই হবে? এখানে বসে চেষ্টা করতে পারেন না?
কাকাবাবু অধৈর্যভাবে বললেন, না, তা সম্ভব না।
তারপর আর একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক আছে, আমি উঠছি। তোমাদের ব্যাপার তোমরা বুঝবে।
মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, ঠিক আছে, আলমসাহেব এটা আপনার বাড়ি পৌঁছে। দিচ্ছেন।
কাকাবাবু বললেন, দিচ্ছ তা হলে? আলমসাহেবকে পৌঁছে দিতে হবে না, আমার সঙ্গে একটা গাড়ি আছে।
আলম বলল, সে-গাড়ি ছেড়ে দিন। আপনি আমার গাড়িতে যাবেন।
কাকাবাবু বললেন, বলছি তো, তার কোনও দরকার নেই।
আলম বলল, কাকাবাবু, এরকম একটা সাঙ্ঘাতিক জিনিস আপনি একলা নিয়ে যেতে চাইছেন? যদি রাস্তায় আপনার ওপর হামলা হয়?
কাকাবাবু বললেন, সেকথা কি আমি ভাবিনি? তোমাদের থেকে আমার অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। যদি কেউ সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে নজর রাখে, তা হলে পুলিশের পোশাকে তোমাকে আমার সঙ্গে দেখলেই সন্দেহ করবে। আর আমি যদি জিনিসটা পকেটে নিয়ে একলা এমনিই বেরিয়ে পড়ি, কেউ কিছুই ভাববে না।
মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, তা হলে আলমসাহেব আপনাকে একটু দূর থেকে ফলো করুক।
কাকাবাবু বললেন, সেটাও ঠিক হবে না। আমি চলে যাওয়ার পর আলম এখানে অন্তত পনেরো মিনিট অপেক্ষা করুক। তারপর সোজা চলে আসুক আমার বাড়িতে।
মৃগাঙ্কমৌলী বললেন, আমিও এক ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাব আপনার বাড়ি।
কাকাবাবু ঘড়িতে দেখলেন, আর সময় আছে মাত্র চার মিনিট। তিনি বললেন, বাইরে হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি আসছে। এটাতে যদি জল লেগে যায়— একটা পলিথিনের প্যাকেটে ভাল করে মুড়ে দাও তো।
পলিথিনের প্যাকেটে মোড়ার পর কাকাবাবু ইলেকট্রনিক নোট বুকটা পকেটে নিলেন না। পকেটে রাখার পক্ষে সেটা একটু বড়। জামার বোতাম খুলে তিনি
সেটাকে বুকের কাছে রেখে আবার বোতাম আটকে দিলেন।
ওঁদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, কেউ বুঝতে পারবে যে আমার কাছে কিছু আছে? তোমরা তা হলে আমার বাড়িতে চলে এসো, সেখানে আমাকে পাহারা দেবে, আমি কাজ করব।
আলম আর মৃগাঙ্কমৌলী কাকাবাবুকে এগিয়ে দিলেন লিট পর্যন্ত।
কাকাবাবু রাইটার্স বিল্ডিংস থেকে বেরোতেই দেখলেন, টবির গলায় চেন ধরে দাঁড়িয়ে আছে একজন লোক।
সে বলল, আর ঠিক দেড় মিনিট বাকি ছিল। কাজ উদ্ধার হয়েছে?
কাকাবাবু জামার বোতাম খুলে প্যাকেটটা দেখিয়ে বললেন, হ্যাঁ।
সে হাত বাড়িয়ে বলল, দিন।
কাকাবাবু বললেন, না তো। একেবারে তোমাদের সারের হাতে তুলে দেওয়ার কথা।
লোকটি বলল, ঠিক আছে। এখানে গাড়ি রাখা যায় না। গাড়িটা আছে ওই যে লালদিঘির পার্কিং লটে। ওখানে যেতে হবে।
কাকাবাবু বললেন, জানি।
লাল আলো জ্বলবার পর কাকাবাবু রাস্তা পার হলেন। পাশে পাশে টবি আর সেই লোকটি।
ভেতরে অনেক গাড়ি। অন্য লোকটি এগিয়ে এসে বলল, আমাদের গাড়ির পেছনে আর একটা গাড়ি রেখেছে। আপনি এখানে দাঁড়ান, আমি গাড়িটা বার করে আনছি।
যে লোকটি টবির গলায় চেন ধরে আছে, সেও মুখ ফিরিয়ে গাড়িটা বার করা দেখছে।
কাকাবাবু একবার টবির মাথায় মৃদু চাপড় মেরে আদর করলেন। তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলেন রেলিংয়ের কাছে। দেখতে লাগলেন পুকুরটা।
তারপর তিনি হঠাৎ এক কাণ্ড করলেন।
ক্রাচদুটো পাশে নামিয়ে রেখে তিনি প্রায় চোখের নিমেষে রেলিং ডিঙিয়ে চলে গেলেন ওপাশে। ঝাঁপ দিয়ে পড়লেন জলে।
টবি ঘাউ ঘাউ করে ডেকে উঠল।
একজন লোক ছুটে এল এদিকে। তার এক হাতে রিমোট কন্ট্রোল, অন্য হাতে রিভলভার।
ভরা বর্ষার লালদিঘিতে অনেক জল। কাকাবাবু ড়ুবতে ড়ুবতে নেমে গেলেন অনেক নীচে।
শঙ্খচূড়ের অনুচর দুজনই রেলিংয়ের কাছে এসে গেছে। কাকাবাবু জলের মধ্যে আছেন বলে সম্ভবত রিমোট কন্ট্রোলে কোনও কাজ হচ্ছে না। দিশেহারা হয়ে একজন গুলি চালাতে লাগল।
সেই গুলির শব্দে ভয় পেয়ে পালাতে লাগল অনেক লোক। আবার রাইটার্স বিল্ডিংসের সামনে থেকে পুলিশ ছুটে এল এদিকে।
কাকাবাবু শ্বাস নেওয়ার জন্য একবার সামান্য মাথা তুলেই আবার ড়ুব দিলেন। ড়ুব-সাঁতার দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলেন দিঘির মাঝখানে।