১২শ অধ্যায়
কৃষ্ণকর্ত্তৃক ভীমের জীবনাশঙ্কা—অস্ত্রবল প্রকাশ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! সমরদুর্দ্ধর্ষ মহাবীর ভীমসেন অশ্বত্থামার নিধনার্থ ধাবমান হইলে যদুকুলতিলক বাসুদেব যুধিষ্ঠিরকে কহিলেন, “মহারাজ! আপনার ভ্রাতা ভীমসেন পুত্রশোক সন্তপ্ত হইয়া একাকীই অশ্বত্থামার বিনাশবাসনায় গমন করিতেছেন। অন্যান্য ভ্রাতৃগণ অপেক্ষা ভীমসেন আপনার সমধিক প্রিয়। আপনি আজ তাঁহাকে বিপত্সাগরে পতনোন্মুখ দেখিয়া কিরূপে নিশ্চিন্ত রহিলেন? ধনুর্দ্ধরাগ্রগণ্য মহাত্মা দ্রোণাচাৰ্য্য স্বীয় পুত্রকে ব্রহ্মশির নামে যে অস্ত্র প্রদান করিয়াছেন, উহা সমুদয় পৃথিবী দগ্ধ করিতে সমর্থ। আচার্য্য প্রথমে ঐ অস্ত্র প্রিয়শিষ্য অর্জুনকে প্রদান করাতে তাঁহার একমাত্র পুত্র অশ্বত্থামা কোপাবিষ্ট হইয়া পিতার নিকট ঐ অস্ত্র প্রার্থনা করেন। সর্ব্বধর্ম্মবিশারদ দ্রোণাচাৰ্য্য পুত্রকে দুঃশীল ও চঞ্চল বলিয়া পরিজ্ঞাত ছিলেন, তন্নিমিত্ত অনতি-সন্তুষ্টচিত্তে তাঁহাকে সেই অস্ত্র প্রদানপূর্ব্বক কহিলেন, বৎস! ঘোরতর বিপাদ্কাও কাহারও, বিশেষতঃ মনুষ্যের প্রতি এই অস্ত্র পরিত্যাগ করিও না। আচাৰ্য্য পুত্রকে এইরূপে অস্ত্র ও উপদেশ প্রদানপূর্ব্বক পুনরায় কহিলেন, ‘পুত্র! তুমি কখনই সাধুজনাশ্রিত পথে অবস্থান করিতে পারিবে না।
তখন অশ্বত্থামা পিতার সেই অপ্রিয়বাক্যশ্রবণে এককালে মঙ্গললাভে হতাশ্বাস হইয়া শোকাকুলিতচিত্তে পৃথিবী পৰ্য্যটন করিতে লাগিলেন। হে ধর্ম্মরাজ! আপনি যৎকালে বনবাসী হইয়াছিলেন, অশ্বত্থামা তখন দ্বারকায় আগমনপূর্ব্বক কিয়দ্দিন তথায় অবস্থান করেন। বৃষ্ণিবংশীয় বীরগণ তাঁহাকে প্রতিনিয়ত পূজা করিতেন। একদিন আমি একাকী অবস্থান করিতেছি, এমন সময়ে দ্রোণকুমার আমার নিকট সমুপস্থিত হইয়া কহিলেন, ‘বাসুদেব! আমার পিতা অতি কঠোর তপস্যা করিয়া মহর্ষি অগস্ত্যের নিকট ব্রহ্মশির নামে যে দেবগন্ধর্ব্বপূজিত অস্ত্র লাভ করিয়াছিলেন, এক্ষণে আমার নিকট সেই অস্ত্র বিদ্যমান আছে। আপনি উহা গ্রহণ করিয়া আমাকে আপনার অরাতিঘাতন চক্র প্রদান করুন। অশ্বত্থামা এইরূপে অস্ত্র প্রার্থনাপূর্ব্বক কৃতাঞ্জলিপুটে বিবিধ অনুনয়-বিনয় করিলে আমি প্রীত হইয়া কহিলাম, “ব্ৰহ্ম! দানব, গন্ধর্ব্ব, মনুষ্য, উরগ ও পতগগণ একত্র মিলিত হইলেও বলবীর্য্যে আমার শতাংশের একাংশ হইবে না। অতএব তোমার অস্ত্রে আমার প্রয়োজন নাই। আমার এই শরাসন, শক্তি, চক্র ও গদা বিদ্যমান আছে। এই সমস্ত অস্ত্রের মধ্যে যাহা তুমি সমরে প্রয়োগ করিতে সমর্থ হইবে, তাহা প্রার্থনা কর; আমি অবশ্যই তোমাকে প্রদান করিব।
দ্রোণপুত্র আমার বাক্য-শ্রবণে গর্ব্বপূর্ব্বক এই বজ্রতুল্য লৌহময় সহস্ৰকোটিসম্পন্ন চক্র প্রার্থনা করিল। আমিও তাহাকে অচিরাৎ চক্র গ্রহণ করিতে অনুজ্ঞা করিলাম। তখন দ্রোণকুমার সহসা উত্থিত হইয়া বামহস্তে চক্র ধারণ করিলেন, কিন্তু কোনক্রমেই স্থানান্তরিত করিতে পারিলেন না। তৎপরে তিনি উহা দক্ষিণকরে ধারণ করিলেন, কিন্তু তাহাতেও কৃতকাৰ্য্য হইলেন না। পরিশেষে তিনি সম্পূর্ণ আয়াস ও যত্ন সহকারে কোনক্রমে চক্র সঞ্চালিত করিতে না পারিয়া দুঃখিতমনে চক্রগ্রহণ-প্রত্যাশা পরিত্যাগ করিলেন। তখন আমি তাহাকে নিতান্ত উদ্বিগ্ন দেখিয়া কহিলাম, আচাৰ্য্যপুত্র! যে মহাবীর সমুদয় মনুষ্য অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, যে সাক্ষাৎ দেবাদিদেব মহাদেবকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে পরিতুষ্ট করিয়াছে, পৃথিবীমধ্যে যাহার তুল্য প্রিয়পাত্র আমার আর কেহই নাই, আমি যাহাকে পুত্র, কলত্র প্রভৃতি সমুদয়ই প্রদান করিতে পারি, সেই পরমসুহৃৎ শ্বেতাশ্ব, কপিধ্বজ অর্জুন কদাপি এই চক্র প্রার্থনা করে নাই। আমি হিমালয়ের পার্শ্বে দ্বাদশ বৎসর কঠোর ব্রহ্মচর্য্য অনুষ্ঠান করিয়া যাহাকে পুত্ৰত্বে লাভ করিয়াছি, যে বীর আমার তুল্য ব্রতচারিণী রুক্মিণীর গর্ভে সনৎকুমারের অংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছে, সেই প্রিয়পুত্র প্রদ্যুম্নও কখন এই দিব্য চক্র প্রার্থনা করে নাই। আর মহাবল-পরাক্রান্ত বলদেব, গদ ও শাম্ব প্রভৃতি দ্বারকানিবাসী বৃষ্ণিবংশীয় মহারথগণও কখন এই চক্র গ্রহণ করিবার বাসনা করেন নাই। তুমি কোন্ সাহসে ইহা প্রার্থনা, করিলে? তোমার পিতা ভরতবংশীয়দিগের আচার্য্য, তুমিও সমুদয় যাদবগণের মান্য। অতএব এরূপ গর্হিত প্রার্থনায় প্রবৃত্ত হওয়া তোমার নিতান্ত অকৰ্ত্তব্য হইয়াছে। যাহা হউক, এক্ষণে এই চক্র লইয়া কাহার সহিত সংগ্রাম করিতে বাসনা করিয়াছিলে?
তখন দ্রোণপুত্র কহিলেন, “হে প্রভো! আমি আপনাকে পূজা করিয়া আপনারই সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়া সর্ব্বভূতের অপরাজেয় হইব, এই অভিপ্রায়ে এই দেবদানবপূজিত চক্র প্রার্থনা করিয়াছিলাম। যাহা হউক, এক্ষণে আপনি অনুমতি করুন, আমি চক্রলাভে কৃতকাৰ্য্য না হইয়াও শিবের সহিত যুদ্ধে গমন করি। আপনি এই যে ভীষণ চক্র ধারণ করিয়াছেন, ইহা আর কাহারও ধারণ করিবার ক্ষমতা নাই।’ মহাবীর অশ্বত্থামা এই বলিয়া রথ, অশ্ব ও বিবিধ ধনরত্ন গ্রহণপূর্ব্বক যথাসময়ে তথা হইতে প্রস্থান করিলেন। হে মহারাজ! ঐ মহাবীর নিতান্ত রোষপরায়ণ ও বিশেষতঃ ব্রহ্মশির অস্ত্র অবগত আছেন; অতএব এক্ষণে তাঁহার হস্ত হইতে বৃকোদরকে রক্ষা করা অবশ্য কর্ত্তব্য।”