১২. কালরাত

১২. কালরাত

খুব সুন্দর একটা ঘরে আমাকে আটকে রেখেছে। রাতে বিস্বাদ কিন্তু খুব সুন্দর করে সাজানো খাবার খেতে দিয়েছে! ঘরে কোনো জানালা নেই। ধবধবে সাদা দেয়াল, উপরে উজ্জ্বল আলো। ঘরে আর একটি জিনিসও নেই, আমি চুপচাপ বসে থেকেছি। আমাকে দিয়ে কী করবে জানি না। বুকের ভেতর চাপা কেমন জানি একটা ভয়। বসে থেকে অপেক্ষা করতে-করতে আমি একসময় নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কারণ যখন ঘুম ভাঙল আমি একেবারে চমকে জেগে উঠলাম।

বেশ কয়েকজন মানুষ আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই বিদেশি। আমাকে ধরে প্রায় শূন্যে ঝুলিয়ে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিল। চেয়ারটা খুব চমৎকার, মহাকাশচারীরা যেরকম চেয়ারে বসে রকেটে করে যায়, অনেকটা সেরকম। লোকগুলো চেয়ারের হাতলে আমার হাত দু’টি লাল রঙের নাইলনের ফিতা দিয়ে বেঁধে ফেলল। চেয়ার থেকে দুটি বড় বড় বেল্ট বের হয়ে এসেছে, সেটা বুকের উপর দিয়ে নিয়ে আমাকে শক্ত করে বেঁধে ফেলল। পা দুটি খোলা ছিল, এক জন সেগুলোও চেয়ারের নিচে। কোথায় জানি আটকে দিল। চেয়ারটাতে মাখা রাখারও একটা জায়গা আছে সেখানে মাথাটা রেখে কপালের উপর দিয়ে একটা বেস্ট টেনে এনে মাথাটাও আটকে ফেলল।

আমি প্রথমে একটা বাধা দেয়ার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু মানুষগুলো দৈত্যের মতো, তাদেরকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেও কোনো লাভ নেই, আমি কিছুক্ষণের মাঝে হাল ছেড়ে দিলাম। প্রচণ্ড আতঙ্কে আমি সেই আশ্চর্য চেয়ারে শক্ত হয়ে শুয়ে রইলাম।

চেয়ারটাতে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে নেয়ার পর এক জন কোথায় একটা সুইচ টিপে দিতেই চেয়ারটা আস্তে আস্তে উপরে উঠতে থাকে। আরেকটা সুইচ টিপে দিতেই চেয়ারটা কাত হয়ে লম্বা একটা বিছানার মতো হয়ে গেল। তখন আরেকজন লোক কপালের চারপাশে চুষনির মতো কী-একটা জিনিস লাগিয়ে দিতে থাকে, সেখান থেকে লম্বা ইলেকট্রিক তার বের হয়ে এসেছে। সেগুলো গিয়েছে পাশে রাখা নানারকম যন্ত্রপাতিতে কিছুক্ষণের মাঝে ঘরটা যন্ত্রপাতিতে বোঝাই হয়ে গেছে। সেগুলো থেকে নানারকম আলো বের হচ্ছে, নানারকম শব্দ। লোকগুলো গভীর মুখে যাওয়া-আসা করছে, যন্ত্রপাতি টানাটানি করছে, কথাবার্তা বলতে গেলে নেই, যেটুকু হচ্ছে খুব নিচু গলায়।

আমি কয়েকবার জিজ্ঞেস করার চেষ্টা করলাম, কী করছ তোমরা? কী করছ?

কেউ আমার কথায় কোনো গুরুত্ব দিল না, এক জন শুধু দৈত্যের মতো হলুদ। দাঁত বের করে হাসার ভঙ্গি করে বলল, কুন বয় নায়।

কথাটির অর্থ নিশ্চয়ই কোনো ভয় নেই, কিন্তু ভয়ে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার মতো অবস্থা হল। আমি কুলকুল করে ঘামতে শুরু করেছি, বুকের মাঝে হৃৎপিণ্ড ঢাকের মতো শব্দ করছে। ইচ্ছে হচ্ছে চিৎকার করে কাঁদি, কিন্তু দৈত্যের মতো লোকগুলোর মুখে মায়াদয়ার কোনো চিহ্ন নেই। দেখে মনে হয় দরকার হলে খুব ঠাণ্ডা মাথায় হাসিমুখে আমাকে মেরে ফেলবে।

কিন্তু আমাকে নিশ্চয়ই মারবে না। টুকুনজিলের সাথে যোগাযোগ করার জন্যে আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে না। প্রচণ্ড আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে আমি অসহায়ভাবে শুয়ে কী হয় দেখার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকি।

বব কার্লোস এল একটু পরে, আমি তাকে কয়েকবার ডাকলাম, কিন্তু আমাকে সে পুরোপুরি উপেক্ষা করে যন্ত্রপাতির সামনে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন সুইচ টিপে পরীক্ষা করে দেখতে লাগল। আমি কান পেতে লোকগুলোর কথা শোনার চেষ্টা করতে লাগলাম, কি বলাবলি করছে বোঝার চেষ্টা করলাম। মনে হল আমার মস্তিষ্কের নানারকম তরঙ্গ বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছে। সেগুলোকে একটা খুব শক্তিশালী এমপ্লিফায়ার দিয়ে বাড়িয়ে নিয়ে বাসায় ছাদে লাগানো এস্টেনা দিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে দেবে। বব কার্লোসের দলবল আশা করছে টুকুনজিল আমার মস্তিষ্কের তরঙ্গের সাথে পরিচিত, কাজেই এই সংকেত পেয়ে বুঝতে পারবে আমি কোথায়, তখন ছুটে আমার সাথে দেখা করতে আসবে। এই ঘরে নানারকম যন্ত্রপাতি রাখা আছে, টুকুনজিল আসামাত্র তাকে ধরে ফেলা হবে।

টুকুনজিল আর যাই হোক, বোকা নয়। আমাকে অনেকবার বলেছে যে বিজ্ঞানীদের থেকে সে দূরে দূরে থাকতে চায়, কেন সেটা সে কখনো ঠিক করে বলে নি। এখন খানিকটা বুঝতে পারছি, সে নিশ্চয়ই ব্যাপারটা আগেই টের পেয়ে গিয়েছিল। টুকুনজিল নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে যে, এটা তাকে ধরার একটা কৌশল, তাহলে কেন সে জেনেশুনে এই ফাঁদে পা দিতে আসবে আমি বুঝতে পারছিলাম না। যখন পুরোপুরি প্রস্তুতি নেয়া হল, তখন হঠাৎ করে ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল।

দৈত্যের মতো এক জন মানুষ ছোট একটা সিরিঞ্জ নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এল, শার্টের হাতাটা একটু গুটিয়ে কিছু বোঝার আগে ঘঁাচ করে আমার হাতে সিরিঞ্জটা বসিয়ে লাল রঙের ওষুধটা শরীরে ঢুকিয়ে দিল। সেই ওষুধটায় কী ছিল জানি না, কিন্তু হঠাৎ করে মনে হল কেউ যেন গনগনে জ্বলন্ত সীসা আমার শরীরে ঢুকিয়ে দিয়েছে, সমস্ত শরীরে যেন আগুন ধরে গেছে। সমস্ত শরীর প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠে আমার মনে হতে থাকে, কেউ যেন আমার শরীরের চামড়া ছিলে নিচ্ছে টেনে টেনে। আমি ভয়ঙ্কর যন্ত্রণায় অমানুষের মতো চিৎকার করতে থাকি, মনে হতে থাকে আমার গলা দিয়ে বুঝি রক্ত বের হয়ে আসবে সেই চিৎকারে। লোকগুলো আমার চিৎকারে এতটুকু কান না দিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে যন্ত্রপাতিগুলো পরীক্ষা করতে থাকে। আমার মনে হতে থাকে সমস্ত শরীর যেন আগুনে ঝলসে দিচ্ছে কেউ, মনে হতে থাকে শরীরের এক-একটি অংশ যেন টেনে টেনে ছিঁড়ে নিচ্ছে শরীর থেকে।

প্রচণ্ড যন্ত্রণায় আমি প্রায় অচেতন হয়ে যাচ্ছিলাম, তার মাঝে শুনলাম বব কার্লোস বলল, ভেরি গুড! ভেরি ভেরি গুড!

এর পর ইংরেজিতে কী বলল আমি বুঝতে পারলাম না, কিন্তু মনে হল আমার প্রচণ্ড যন্ত্রণার ব্যাপারটি ঠিক তাদের মনের মতো হয়েছে, এবং সেই সংকেত নিখুঁতভাবে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। লোকগুলো খুব খুশিতে কথা বলতে থাকে, একজন কী-একটা বলল, অন্য সবাই তখন হো হো করে হেসে উঠল খুশিতে।

অসহায়ভাবে শুয়ে আমি প্রচণ্ড যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকি। আমার চোখের কোনা দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে, আমি তখন ভাঙা গলায় বাবাকে ডাকতে থাকি। বাবা–বাবা গো, তুমি কোথায়—

দ্বিতীয়বার ইনজেকশানটি দিল প্রায় আধা ঘন্টা পর। আবার আমি পাগলের মতো, চিৎকার করতে থাকি। মনে হতে থাকে যে মাথার মাঝে কিছু-একটা গোলমাল হয়ে গেছে, কিছুতেই আর চিৎকার থামাতে পারি না। সমস্ত শরীরটা থরথর করে কাঁপতে থাকে। যন্ত্রণা যেন শরীরের মাঝে সাপের মতো কিলবিল করে ছুটতে থাকে, উপর থেকে নিচে, নিচে থেকে উপরে–মনে হতে থাকে বিষাক্ত ছুরি দিয়ে কেউ যেন গেঁথে ফেলছে আমাকে। আমার চোখের সামনে লাল রঙের আলো খেলা করতে থাকে, আমি পাগলের মতো ভাবতে থাকি, হায় খোদা, আমি এখনো মরে যাচ্ছি না কেন? কেন মরে যাচ্ছি না? কেন মরে যাচ্ছি না?

হঠাৎ কে যেন আমার ভেতরে বলে উঠল, কিলু! কি হয়েছে তোমার বিলু?

কে? টুকুনজিল? তুমি এসেছ।

 

ঘরের মাঝে সব কয়জন মানুষ তখন মূর্তির মতো স্থির হয়ে গেল। বব কার্লোস চিৎকার করে কী-একটা বলল, ঘরে ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেল হঠাৎ, ঘড়ঘড় করে কোথায় একটা শব্দ হল। বিদ্যুৎ-ফুলিঙ্গ খেলা করতে থাকে আর বিচিত্র শব্দে যন্ত্রপাতিগুলো আর্তনাদ করতে থাকে। তীব্র একটা লাল আলো একপাশে একটা জায়গা আলোকিত করে দেয়। ঝাঁঝালো একটা গন্ধ পেলাম আমি। লোকজনের উত্তেজিত কথাবার্তা আর যন্ত্রপাতির গুঞ্জনে কানে তালা লেগে যায় হঠাৎ।

টুকুনজিল আবার বলল, বিলু, তোমার কী হয়েছে? তুমি এরকম করছ কেন?

কষ্ট। বড় কষ্ট টুকুনজিল।

কষ্ট? সেটা কি?

আমি কোনোমতে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে চিৎকার করে কেঁদে ফেললাম। হঠাৎ করে আমার কপালে একটু গরম লাগতে থাকে, নিশ্চয়ই টুকুনজিল নামার চেষ্টা করছে। শুনলাম সে বলল, চার শ’ তেরো মেগাসাইকেল। তিন মিলি সেকেন্ড পরপর। দুই তরঙ্গের অপবর্তন। অসম বন্টন। তোমার মস্তিষ্কের তরঙ্গে দেখি অনেক গোলমাল। দাঁড়াও, ঠিক করে দিই।

আমার কপালে চিনচিনে একটা ব্যথা অনুভব করলাম, তারপর হঠাৎ করে একেবারে ম্যাজিকের মতো সমস্ত যন্ত্রণা দূর হয়ে গেল। আমার তখনো বিশ্বাস হচ্ছিল না, মনে হচ্ছিল একটু নড়লেই আবার যন্ত্রণা শুরু হয়ে যাবে, কিন্তু শুরু হল না। সমস্ত শরীর তখনো একটু একটু কাঁপছে, ঘামে ভিজে গেছে জামা-কাপড়। শরীরটা হালকা লাগছে হঠাৎ করে মনে হতে থাকে যে বাতাসে ভেসে যাব আমি। বুকের ভেতর কেমন যেন আনন্দ এসে ভর করে।

আমি কিন্তু তখন ভেউ ভেউ করে কেঁদে বললাম, টুকুনজিল, ভুমি না এলে এই রাক্ষসগুলো আমাকে মেরে ফেলত।

কেউ তোমাকে মারতে পারবে না, বিলু। আমি তোমাকে বাঁচাব।

এরা তোমাকে ধরতে চায়, টুকুনজিল।

আমাকে কেউ ধরতে পারবে না।

হঠাৎ বব কার্লোসের গলা শুনতে পেলাম আমি, ইংরেজিতে কী বলেছে ঠিক বুঝতে পারলাম না, এক মিনিট কথাটা শুধু ধরতে পারলাম। আমি টুকুনজিলকে জিজ্ঞেস করলাম, কি বলছে তুমি বুঝতে পারছ, টুকুনজিল?

হ্যাঁ। বলেছে এক মিনিটের মাঝে আমি যদি লেজার শিল্ডের মাঝে না ঢুকে যাই তাহলে তোমাকে মেরে ফেলবে। অত্যন্ত অর্থহীন অযৌক্তিক একটা কথা।

কেন?

লেজার শিল্ডটা তৈরি করেছে মেগাওয়াট পাওয়ার দিয়ে, ছোট একটা ফুটো রেখেছে ঢোকার জন্য, ঢোকার পর ফুটোটা বন্ধ করে দেবে। আমি লেজারলাইটের মাঝে আটকা পড়ে যাব। বের হতে চেষ্টা করলেই আমার মহাকাশযান মেগাওয়াট পাওয়ারে একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি কেন সেখানে ঢুকব? কখনো ঢুকব না।

আমি ঢোক গিলে বললাম, বলছে, তুমি না ঢুকলে আমাকে মেরে ফেলবে!

অত্যন্ত অযৌক্তিক ব্যাপার। দুটোর মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই। আর মরে গেলে ঠিক কী হয়, বিলু?

আমি ছটফট করে বললাম, মরে গেলে সব শেষ।

কেন, শেষ কেন? আবার ঠিক করা যায় না?

না। মরে গেলে কেউ বেঁচে আসে না।

এটা হতেই পারে না।

আমি ঢোক গিলে বললাম, পারে টুকুনজিল, পারে। আমি জানি। তুমি কিছু-একটা কর তাড়াতাড়ি, কতক্ষণ হয়েছে?

ত্রিশ সেকেন্ড।

সর্বনাশ টুকুনজিল, একেবারে তত সময় নেই!

মরে গেলে শেষ কেন হবে? আমি দেখতে চাই কেমন করে শেষ হয়।

আমি চিৎকার করে বললাম, না, তুমি দেখতে চেয়ো না, টুকুনজিল। দেখতে চেয়ো না। কিছু-একটা কর।

হা হা হা। টুকুনজিল হঠাৎ হাসির মতো শব্দ করে বলল, এটা কি হাসির ব্যাপার?

না, এটা হাসির ব্যাপার না। ভয়ের ব্যাপার। ভয়ানক ভয়ের ব্যাপার। কিছু-একটা কর।

ঠিক আছে, তাহলে তোমাকে নিয়ে যাই এখান থেকে। হা হা হা।

পর মুহূর্তে কী হল ঠিক বুঝতে পারলাম না। প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণ হল, আগুনের একটা হলকা ছুটে এল আমার দিকে, আতঙ্কে চোখ বন্ধ করলাম আমি, আর হঠাৎ মনে হল আমি প্রচণ্ড বেগে আকাশের দিকে ছুটে যাচ্ছি। নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না আমি, হঠাৎ মনে হল আমি বুঝি মরে যাচ্ছি তারপর আর কিছু মনে নেই।

 

জ্ঞান হবার পর আমার বেশ কিছুক্ষণ লাগল বুঝতে আমি কোথায়। যেদিকে তাকাই সেদিকেই দেখি সাদা ধোঁয়ার মতো। সামনে-পিছনে উপরে-নিচে চারদিকে হালকা সাদা ধোঁয়া। আমার মনে হতে থাকে, সাদা ধোঁয়ার মাঝে শূন্যে ঝুলে আছি আমি। একবার মনে হল আমি বোধহয় মরে গেছি। বেশি পাপও করি নি, বেশি পুণ্যও করি নি, তাই মনে হয় দোজখ আর বেহেশতের মাঝখানে ঝুলে আছি আমি।

আমার হাত-পা সারা শরীর তখনো চেয়ারের সাথে বাঁধা। ভালো করে নড়তে পারছি না, ভয়ে ভয়ে ডাকলাম, টুকুনজিল। তুমি কোথায়?

এই যে এখানে।

এখানে কোথায়?

তোমার চেয়ারের নিচে।

কেন? নিচে কেন?

তোমাকে ধরে রেখেছি।

ধরে রাখার দরকার কী?

মাধ্যাকর্ষণ বল। ধরে না রাখলে তুমি পড়ে যাবে।

কোথায় পড়ে যাব?

নিচে।

নিচে কোথায়?

নিচে মাটিতে। প্রায় সাত হাজার ফুট নিচে।

আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল ভয়ে, ঢোক গিলে বললাম, আমি কোথায় টুকুনজিল?

আকাশে।

আকাশে? কী সর্বনাশ! তাড়াতাড়ি নিচে নামাও।

কেন?

আকাশে ঝুলে থাকবে কেমন করে? আকাশে কখনো কেউ ঝুলে থাকে নাকি?

তোমার শরীরে খুব ক্ষতিকর জিনিস ঢুকিয়ে দিয়েছিল। শরীর সেগুলো এখন পরিষ্কার করছে। সে জন্যে তোমার এখন ঘুমানো দরকার, মস্তিষ্কে এখন যেন কোনো অসম কম্পন না হয়, সেই জন্যে তোমাকে এখানে রেখেছি।

কোনোদিন শুনেছ কেউ আকাশে ঝুলে ঝুলে ঘুমায়?

এখানে কোনো শব্দ নেই, ধৈর্যচ্যুতি নেই, অসঙ্গতি নেই।

না থাকুক। আমাকে নিচে নামাও।

ঠিক আছে।

আমি হঠাৎ করে বুঝতে পারি চেয়ারটা ভাসতে-ভাসতে নিচে নামতে শুরু করেছে। ঠাণ্ডা বাতাসে শরীরটা মাঝে মাঝে শিউরে উঠছিল। চারদিকে তখনো সাদা। ধোঁয়ার মতো মেঘ। হঠাৎ করে মেঘ কেটে গেল, আমি অবাক হয়ে দেখলাম, নিচে রাস্তাঘাট বাড়িঘর গাছপালা পুকুর। মেঘের ফাঁকে আকাশে বড় চাঁদ, তার আলোতে সবকিছু কেমন যেন অবাস্তব মনে হতে থাকে। নিচে তাকিয়ে আমার হঠাৎ ভয়ে গা কাঁটা দিয়ে ওঠে। যদি টুকুনজিল হঠাৎ ছেড়ে দেয় আমাকে? ভয়ে ভয়ে ডাকলাম আবার, টুকুনজিল।

বল।

তুমি এত ছোট একটা প্রাণী, আমাকে উপরে ধরে রেখেছ, কষ্ট হচ্ছে না তো?

আমি ধরে রাখি নি। আমার মহাকাশযান ধরে রেখেছে।

তোমার মহাকাশযানের যন্ত্রপাতি সব ঠিক আছে তো?

আছে।

হঠাৎ করে ছেড়ে দিলে কিন্তু সর্বনাশ হয়ে যাবে। নিচে পড়লে আমি কিন্তু একেবারে চ্যাপ্টা হয়ে যাব। আমাকে ছেড়ে দিও না।

আমি তোমাকে বেশি সময়ের জন্যে কখনো ছাড়ি নি।

আমি চমকে উঠে বললাম, বেশি সময়ের জন্যে হাড় নি মানে? কম সময়ের জন্যে ছেড়েছ কখনো?

হ্যাঁ। মাঝে মাঝে নিচে গিয়ে দেখে আসছি কি হচ্ছে।

আমি চিৎকার করে বললাম, সর্বনাশ! মাথা খারাপ হয়েছে তোমার?

টুকুনজিল কোনো কথা বলল না। আমি আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলাম, টুকুনজিল।

তবু কোনো সাড়া নেই। আমি নিচে পড়ে যাচ্ছি মার্বেলের মতো। গলা ছেড়ে ডাকলাম আমি, টু-কু-ন-জি-ল।

কি হল?

কোনোমতে নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম, কোথায় ছিলে তুমি?

নিচে গিয়েছিলাম দেখতে। ভারি মজা হচ্ছে নিচে। হা হা হা।

আমি ঢোক গিলে বললাম, আমাকে এভাবে ফেলে রেখে তুমি চলে যেও না আর, খবরদার! ফিরে আসতে একটু দেরি হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।

দেরি হবে না।

তবু তুমি যেয়ো না।

অনেক মজা হচ্ছে নিচে। হা হা হা। কেউ বুঝতে পারছে না কি হয়েছে।

হ্যাঁ, আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমিও তো বুঝতে পারছি না কি হয়েছে।

খুব সোজা। প্রথমে তোমার সাথে লাগানো সব ইলেকট্রিক তারগুলো কেটে দিলাম। তারপর তোমাকে তুলে নিয়ে এলাম ঘরের মাঝখানে, সেখান থেকে দেয়ালে আঘাত করলাম আমার ব্লাস্টার দিয়ে, তারপর ফুটো দিয়ে তোমাকে বের করে আনলাম। বেশি তাড়াতাড়ি বের করেছিলাম বলে তুমি সহ্য করতে পার নি, জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলে—

কী আশ্চর্য। আশ্চর্য কেন হবে? আমার ইঞ্জিনগুলো ফিউসান দিয়ে কাজ করে, অনেক শক্তি ইঞ্জিনে।

কথা বলতে বলতে আমরা ধীরে ধীরে নিচে নামছি। আস্তে আস্তে টুকুনজিলের উপর আমার বিশ্বাস ফিরে এসেছে। আমি বুঝতে পেরেছি যে আমার কোনো ভয় নেই, আমাকে সে কখনোই ভুল করে ফেলে দেবে না। সত্যি কথা বলতে কি, আকাশে উড়ে বেড়াতে আমার বেশ মজা লাগতে শুরু করেছে। বললাম, টুকুনজিল।

বল।

আরো খানিকক্ষণ উড়ে বেড়ালে কেমন হয়?

না।

কেন?

তোমার ঘুম প্রয়োজন। অবশ্যি অবশ্যি প্রয়োজন। শরীরের সব ক্ষতিকর প্রভাব দূর হবে তা হলে।

একটু দেরি হলে কোনো ক্ষতি নেই।

আছে। আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।

টুকুনজিলের কথা শেষ হবার আগেই হঠাৎ আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসে ঘুমে। কোনোমতে বললাম, কোথায় নিয়ে রাখবে আমাকে?

তোমার বাসায়?

না না না।

তোমার স্কুলে?

স্কুলে? হ্যাঁ, স্কুলের রাখতে পার।

ঠিক আছে, এখন তুমি ঘুমাও। তোমার আর কোনো ভয় নেই।

আমার মনে হল সত্যি আমার আর কোনো ভয় নেই।