১২. কালকেতু উপাখ্যান

বারো – কালকেতু উপাখ্যান

এদিকে দিনে দিনে বেড়েছে কালকেতু। সবার লোচনসুখের হেতু তো বটেই। ওই ঢলঢল অঙ্গলাবণ্য বড় জ্যোৎস্নাময়। মুসলমান সাধু ভরা গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে পূর্ণিমার চাঁদ দেখে সারাবেলা। মনে মনে ভাবে, এই আকাশ—রাঙানো সোনা কোথায় থুই? মাথায় থুলে উকুনে কাটে, মাটিতে থুলে পিঁপড়ে কুটুস করে কামড়ায়। ক্ষ্যাপা তান্ত্রিক দুহাত শূন্যে তুলে ধেই ধেই করে নাচে। একটু চোখের আড়াল হলেই বজ্রগর্ভ চিৎকার করে, ‘ইসমাইল! হেই—ই—ই—ই!’

ধুলো উড়িয়ে ধু ধু মাঠ একদিকে, অন্যদিকে কর্ণসুবর্ণ টিলা, আরদিকে জহ্নুকন্যার খোলা বুকের ওপর নখের আঁচড় কেটে ঘোরে সেই স্নেহভারাক্রান্ত বাজপাখি চিৎকার। ভাগলপুর—রাজমহল ধুলিয়ান—আজিমগঞ্জ থেকে কলকাতা যেতে যেতে বাণিজ্যযাত্রী নৌকার মাঝিমাল্লারা শোনে সেই তীব্র আবেগময় কণ্ঠস্বর। শোনে নিঃসঙ্গ উদ্ভিদের মতো মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা চাষা। বুড়ো সাধু ঝাঁকড়া জটা নাড়া দিয়ে ডাক ছাড়ে, হে—ই—ই—ই ইসমাইল!’

হেরুর ছেলে খাকি ঢোলঢাল হাফ পেনটুল পরে শ্মশানবটের কোটরে তখন অবিকল সাধুর মতন মড়ার মাথা নিয়ে খেলতে বসেছে, কানে নেয় না কোনো ডাক। কেউ বললে ঠোঁট কুঁচকে আধো—আধো বুলিতে বলে, ‘ডাকুক শালা! গাঁজা আনতে আমি পারব না।’…

কাছাকাছি আবগারি দোকান নেই এলাকায়। রাঙামাটির চরণ চৌকিদার আর কোদলার মতি তিওর গাঁজা সরবরাহ করে গাঁজাড়েদের। চরণের বাড়িতে আবার গাছও লালিতপালিত হয়। তার ফুল ফুটলে পাড়া মউমউ করে আইনবিরোধী গন্ধে। কিন্তু সে তো পুলিশের লোক। গঙ্গার পূর্ব পাড়ের লোকেরা পশ্চিমপাড়কে বলে ‘রাঢ়’। পূর্বপেড়েরা (পূর্বপাড়বাসীরা) ছড়া কেটে বলে,

মদ গাঁজা রাঁড়

এই তিনে রাঢ়।।

(মজার কথা, বিধবাকে রাঢ় অঞ্চলে ‘রাঁড়’ বলে! যেমন গোরাং ডাক্তারের মেয়ে বিধবা হয়ে এলে লোকে বলেছিল, ‘ডাক্তারবাবুর মেয়ের কপাল! সকালবেলায় রাঁড় হয়ে গেল!’ এখানে ‘রাঁড়’ একটি বেদনায় ভিজে, স্নিগ্ধ ও শুচিতাপূর্ণ শব্দ। অথচ এই বাক্য : ‘লেডিডাক্তোর স্বপ্নলতা? থুথু ফেলো! ও আজকাল গোরাসায়েবের রাঁড় হয়েছে, তা শোননি?’… ময়রাবুড়ির ইদানীং প্রচারিত এই কলঙ্কগর্ভ বাক্যটিকে সেই একই শব্দ তথাকথিত সমাজবিবেকের পক্ষে হৃদয়—বিদারক এবং নাশিকাকুঞ্চনকারী। অনেক অনেক বছর পরে কর্ণসুবর্ণের ঐতিহাসিক খননকার্যের সময় যে তরুণ অধ্যাপকটি এসেছিলেন, তাঁর ধারণা হয়েছিল—এতদঞ্চলে তরুণী বিধবারা সেকালে সম্ভবত রক্ষিতার জীবন গ্রহণে ব্রতী ছিলেন। কারণ, প্রধানত রক্ষিতাকেই ‘রাঁড়’ বলে উল্লেখ করা হত।)*

চার বছরের ছেলে ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে যখন পালক পিতা সাধুকে শালা বলে, ‘চমৎকার লাগে। তো ইয়াকুবের ইচ্ছে, ছেলে লিখবে পড়বে—রেলগাড়ির ‘আপসার’ হবে। সাধু বলে, ‘আমার ছেলে লিশান তুলবে গাড়ি ছুটবে, লিশান নাবাবে গাড়ি দাঁড়াবে। আমার ছেলে ফুড়ুৎ করে বাঁশি বাজাবে, গাড়ি ছাড়বে।’

কোদলার নিসিং পণ্ডিতের পাঠশালায় দেবে ওকে। সে নিয়ে কত জল্পনা, কত যাওয়া আসা। পণ্ডিত বলেছে, ‘আরেকটু বয়স হোক, বুদ্ধিসুদ্ধি হোক। তখন এনো।’ সেই দিন গুনছে ইয়াকুব। পাছে ছোটলোকদের ছেলেপুলের সঙ্গে মিশে বখে যায়, সবসময় সতর্ক থাকে। চোখে চোখে রাখে। কিন্তু একটু ফাঁক পেলেই ও অদৃশ্য। আশেপাশে ইয়াকুব চেঁচিয়ে ডেকে বেড়ায়। সে ডাকে খোঁজার চেয়ে পিতৃসুলভ গর্বই বেশি অবশ্য। কিন্তু ক্ষুদে দুষ্টুটি লুকিয়ে থাকে সাবধানে। সাড়া দেয় না।

সেরাজুল হাজি বলেছে, ‘ইয়াকুব, ছেলের খৎনা দিচ্ছ না কেন? কলমা পড়াচ্ছ না কেন। জুহা মৌলবির কাছে নিয়ে এসো একদিন।’

ইয়াকুব বিনীত হেসে সায় দিয়েছে।…’আনব বইকি। বা রে বা! আমি যাই করি হাজিসায়েব,—আরে বাবা, আসলে তো আমি শালা মোছলমানের ওরসে জন্মা। ‘হই বাবা হাজিসায়েব, মলে তো গোরে যেয়ে শোব—না কী? হেঁদুরা কি আমাকে পোড়াবে, না গঙ্গায় ফেলে দেবে? কেউ ছোঁবে না এ শালোর লাশ।’…ইয়াকুব সকৌতুকে! চোখ নাচিয়ে আরও বলেছে, ‘ছোঁবে কেন? মাকালী ভজি আর আলিই ভজি, আমার যে মূলেই বাদ’। অর্থাৎ সে Circumcision—এর কথাই উল্লেখ করে।

ওদিকে ঘটকঠাকুর বলেছে, ‘অ্যাই ইয়াকুব! খবরদার বাবা, হেরুর ছেলের জাত মারিস না। হেরুর যাবজ্জীবন মানে তো কুড়িটা বছরের মেয়াদ। একদিন ফিরে আসবেই। তখন কী জবাব দিবি?

ইয়াকুব বলেছে, ‘অদ্দিন বাঁচবই না ঠাকুরমশাই!’

‘আরে! তুই বাঁচবি না—ছেলে তো বাঁচবে।’

‘বাঁচুক, বাঁচুক। আশীর্বাদ করো ঠাকুর। আমার ইসমাইল যেন ওই শ্মশানবটের পরমায় পায়।’

‘তোর বাবার ইসমাইল, বাঞ্চোৎ!’ ঘটকঠাকুর গালমন্দ করেছেন।

ইয়াকুবের মতলব কী বোঝা যায় না। সে নিজেও কি বোঝে? আসলে ওসব কিছু ভাবে না সে। তার স্বপ্ন, ছেলে হবে রেলের অফিসার। হুকুমদারি করবে রেলগাড়িকে।

কিন্তু ছেলের আচরণ দেখে তার দুঃখ হয়। মনে মনে বলে, হাজার হলেও বাউরির রক্ত! ও শালা গুগলি, শামুক, কাঁকড়া কুড়িয়ে জলেজঙ্গলে ধুলোকাদা মাখতেই সুখ পায়। অত যত্ন করে সাজিয়ে রাখি, পলকে নোংরা হয়ে যায়। বাঞ্চোৎ ধুলোবালিতে ঢিবি না গড়িয়ে পেচ্ছাপ করে না—আবার তাই দুহাতে ঘাঁটে। ছ্যা ছ্যা! আমি ওর ভালো করতে পারি? ওর রক্তের দোষ আছে, জন্মের দোষ আছে।…

ক্ষিপ্ত ইয়াকুব সাধু ঢ্যালা তুলে তাড়া করে, ‘বেরো শালা বেজম্মা আমার বাড়ি থেকে। তি—সীমানায় দেখলে তোর ঠ্যাঙ খোঁড়া করে দোব। তুই মলে গয়ায় পিণ্ডি দিয়ে আসব। হাড়ে বাতাস লাগবে আমার। হাসছে দেখ না দাঁত কেলিয়ে। তোমরা দেখ—শালা দুশমনের হাসিখানা দেখে যাও।’

লোক দেখার আগে নিজেই দেখে মজে যায় সাধু। মনে মনে আবার তারিফ করে, ‘জগন্ময়ী মা আমাকে কী অম্রিতি দিলেন গো! কোথায় থুতে কোথায় থুই, কী বলতে কী বলে ফেলি! এ গাঁজাখেকোর মুখের তো কোনো রাখঢাক নেই’!

এইরকম বকবক আর দাওয়ায় বসে কাঁথা সেলাই করে সে। উঠোনের রোদে ধান শুকোয়। লম্বা কঞ্চিটা মাঝে মাঝে নাড়া দেয় পাখি তাড়াতে। পায়রা আসে, শালিক আসে, চড়ুই আসে ঝাঁকে ঝাঁকে। লাফিয়ে লাফিয়ে ধান খায়। ইয়াকুব কঞ্চি দোলালে একটু সরে যায়, কিন্তু ওড়ে না। চোখের নজর কমে যাওয়ায় আবার হেঁট হয়ে কাঁথায় ফোঁড় দিলে পাখিরা আবার দৌড়ে আসে ধানের ওপর। মুখ তুলে হাসে ইয়াকুব। …তোরাও বুঝে গেছিস বাবাসকল, ‘সাধুর পায়ে গোদ। কই, কইরে সেই ব্যাধের ব্যাটা একলব্যি? এবার দেখা তোর অস্তরের মহিমে! ছিটকিনি (গুলতি) কই রে বাপ? কোথা তোর তিরধনুক?’

হেরুর ছেলে ছড়ালো দুটো অমল ধবল হাত দিয়ে গুলতি তাক করতেই সাধু লাফ দিয়ে সামনে আসে—’খবরদার বাপ! উঁ হু হু হু, পাখপাখালি মারে না। পাপ হয়।’

‘পাপ’ কথাটার অতিপ্রচারের দরুন কিংবা দুর্জ্ঞেয় কোনো কারণে বালকব্যাধ থমকায়। এবং সরলমুখে প্রশ্ন করে, ‘ক্যানে?’

তার রাঙা লালচে—কটা চুলগুলোয় হাত বুলিয়ে সাধু বলে, ‘এই সুন্দর কেশগুলো উড়ে যায় বেবাক।’

‘ক্যানে?’

‘চোপরাও শালো। আবার ক্যানে? বলছি, ইটা বেদের বচন—তবু বল ক্যানে!’ ইয়াকুব লাল চোখে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।

পাখি দেখতে দেখতে উজ্জ্বল রোদে ছেলেটির ঠোঁটের ওপর বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে। বড় প্রসন্ন তার চোখ—সেখানে আগুনের কেন্দ্রবর্তী নীলাভ শিখার মতন কী ছটা জ্বলজ্বল করে। কী ভাবে সে, কেউ জানে না। সে আস্তে ডাকে, ‘সাধু!’

সাধু! এখনও অব্দি অত শিখিয়েও বাবা বলানো গেল না ওকে। বড়জোর বলে সাধুবাবা। দুঃখিত ইয়াকুব অবশ্য তখন ঠোঁটের সেই ঘামের ফোঁটা এবং দৃষ্টির নীল বিচ্ছুরণের কারণে ফেটে পড়তে পারে না। শুধু বলে, ‘কী রে সোনা?’

‘আমাকে একটা খাঁচা করে দেবে সাধু?’

‘দোব মাণিক, দোব।’

কাঁথা ফেলে রেখে ইয়াকুব বাঁশ এনে খাঁচা বানায়। কোত্থেকে শালিখের বাচ্চা এনে দেয়। খাঁচার মধ্যে পাখিও দিনে দিনে বাড়ে! খেজুর গাছের শাখা থেকে তৈরি ‘ঝাণ্ডাল’ মাঠের ঘাসে বুলিয়ে ঘাসফড়িং তাড়ায়, মারে, বাঁশের চোঙায় ভরে নিয়ে আসে পাখির জন্যে। দুটি মানুষ মুখোমুখি খাঁচা নিয়ে বসে পরম যত্নে পাখিকে খাওয়ায়।

হাটের দিন ইয়াকুব ছেলেকে কাঁধে নিয়ে গোকর্ণের হাটে যায়। ছেলের হাতে পাখির খাঁচা দুলতে দুলতে চলে। ময়রার দোকানে ছেলেকে পেট পুরে মিষ্টি খাওয়ায় সে। এবাড়ি—ওবাড়ি চেনা লোকের সঙ্গে দেখা করে আসে। ছেলের পরিচয় দিয়ে কিছু চায়। পায়ও। দাসজীমশাই হেরুর ছেলেকে নতুন পেন্টুল আর গেঞ্জি দিয়েছেন। চৌধুরীবাবুরা বলেছেন, ‘ও ইয়াকুব, এবার কালীপুজোয় তোমার ছেলেরও নেমন্তন্ন রইল।’

যাবে ইয়াকুব। প্রতিমার সামনে বলিদানের সময় রক্ততিলক পরে নাচবে—

ও মা দিগম্বরী নাচো গো।

যেমন নাচো বাবার ঘরে

তেমনি নাচো আমার ঘরে

 মা—আ গো।।

কবিয়াল বাঁড়ুয্যেমশাই তাকে গান দিয়েছেন—নতুন গান। ইয়াকুব বলে, ‘বড়ো খটোমটো পদ। কিন্তু স্বগগো—মত্ত—পাতাল মহাপ্রলয় করে দেয়।’

নাচে, পাগল ভোলা গলায় মালা

 হাতে লাগে শূল।

প্রমঘ, প্রমত্ত নাচে

 কানে, ধুতুরারই ফুল।।….

শেষ শরতে ড্যাডাং ডাং ঢাক বেজে ওঠে কোদলা, মধুপুর, যদুপুর, চাঁদপাড়া চতুর্দিকে। ঘগা বায়েন দুই ভাই, তাদের দুই ছেলে জগা আর লগা, জোড়া ঢাক, কাঁসি, সানাই নিয়ে গোকর্ণে চৌধুরীবাবুদের পুজোয় যায়। তার সঙ্গে চলে ইয়াকুব সাধু, ‘ইসমাইল’ আর তার পাখি ‘মনাই’।

সারারাত নেচে ক্লান্ত মুসলমান সাধু তার ছেলেকে খোঁজে। আঙিনার একধারে সিমেন্টের চত্বরে এক দঙ্গল ন্যাংটো নিম্নবর্ণের ছেলেমেয়ের মধ্যে ঘুমন্ত ছেলেকে দেখে তার কারণ কিংবা মহাকারণের ঝোঁক কেটে যায়। হু হু করে ওঠে বুক গভীরতর মায়াবী বাৎসল্যের চাপে। কী কারণে তার চোখে জল উপচে আসে। কিন্তু গামছার খুঁটে মুছে সে হাসিমুখে বলে, ‘আহা হা! তুই কি এখানে ঘুমোবার ধন, বাছা? আমার কপাল। ওঠ ওঠ, ঘরে যাই।’

এবং ঘুমন্ত ছেলেকে তুলে নিতেই সে প্রথমে চোখ পিটপিট করে বলে, ‘আমার মনাই কই?’

ইয়াকুব হাসে। তখন চারপাশে ভাঙা আসর এবং স্তব্ধতা। সে বলে, ‘নাও’ উঠেই ওই কথা। সেদিকে চাঁদ আমার ঠিক আছে। হ্যাঁ রে বাছা, তোর মানাইয়ের খবর আমি কী করে জানব? কোথায় রেখে শুয়েছিলি?

কান্নাভরা মুখে ছেলেটা আঙুল তোলে, ‘উইখানে।’

‘উখেনে। তা গেল কোথা? উড়ে তো পালায়নি।’…দুরুদুরু বুকে ব্যস্ত হয়ে খোঁজে ইয়াকুব। ঘুমন্ত মানুষগুলোর উদ্দেশ্যে হাঁকডাক করে বেড়ায় সারা আঙিনায়।…’কে লিয়েছ, এখনও বলো। কে লিলে আমার ছেলের পক্ষী’?

পরক্ষণে চকিতে মনে পড়ে যায় তার। ‘আমার মরণ! তুই যখন ঘুম পেয়েছে বললি, আমি তো টঙে ছিলাম। তবু ঠিক খ্যাল ছিল বাপ, আমার মন ছিল তোর কাছে। হ্যাঁ, পাখির খাঁচা তুলে এনে রেখে দিয়েছি—হুই, হুই দ্যাখ কোথা?’

আঙুল তুলে সে দালানের বারান্দায় কোণার দিকে একটা ঝাড়লন্ঠন দ্যাখায়। খাঁচা ঝুলছে নিরাপদে। তার নিচে শুয়ে আছে জনাকয় লোক—চেহারায় বাবুবাড়িরই বটে। নেশার ঘোরে বেদম ঘুমোচ্ছে। পাখির বিষ্ঠায় সকলেরই শরীর ইতিমধ্যে বিচিত্রিত। নিঃশব্দে হেসে ইয়াকুব ছেলেকে কাঁধে তুলে খাঁচা নামাতে ইশারা করে। তারপর সাবধানে সরে আসে। …

ইতিমধ্যে একদিন হঠাৎ সক্কালবেলা ইয়াকুবের বাড়ির দরজায় পরাক্রান্ত জুহা মৌলবির আবির্ভাব ঘটল।

ইয়াকুব সবে পান্তা খেয়ে রোদের উঠোনে বসেছে। ছেলেটা একগোছা বঁড়শিকাঠি গুছিয়ে কেঁচো তুলতে ব্যস্ত কোনার সারগাদায়—গঙ্গার পাড়ে পুঁতে অপেক্ষা করবে মাছ গাঁথার। অল্প অল্প শীতপড়েছে সদ্য। হেমন্তের কুয়াশা দূরের বস্তুগুলোকে অস্পষ্ট করে ফেলছে আজকাল। চবচবে শিশির জমে থাকছে অনেকটা বেলা অব্দি। সেই সময় জুহা মৌলবি এলেন আচমকা। হাতে ছড়ি, খালি পা, জোব্বা ও লুঙ্গি হাঁটু অব্দি গোটানো—ভিজে পায়ে ঘাসকুটো, ঘাসের ফুল এঁটে রয়েছে। এসে ‘হায়দরী’ (হতরত আলি হায়দর অর্থাৎ হজরত মহম্মদের জামাই যুদ্ধক্ষেত্রে যে রণহুঙ্কার দিতেন) হাঁক দিলেন, ‘ইয়াকুব!’

ইয়াকুব হকচকিয়ে যায়। হাঁ করে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে। তারপর লাফিয়ে ওঠে, ‘আসুন, আসুন হুজুর! কী সৌভাগ্যি, কী কপাল!’ দৌড়ে সে তার জীর্ণ কুঁড়েঘরের সবচেয়ে সম্মানিত আসন একটা চৌপায়া বের করে আনে। ছেলেটা ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখেই নিজের কাজে মন দেয়।

জুহা মৌলবি চড়া স্বরে বলেন, ‘বসব না ইয়াকুব। অনেকদিন থেকে জমাতে (সামাজিক মজলিসে) তোমার কথা ওঠে। একটা বিহিত করব, ভাবি। হয় না। কাল রাত্রে শোবার সময় তোমার কথা মনে পড়ল। ঠিক করলাম, ইনশাল্লা, কালই ফজরের নমাজ পড়ে তোমার বাড়ি নিজে যাব।’

ইয়াকুব উদ্বিগ্নমুখে হাসবার চেষ্টা করে।

‘ইয়াকুব! তোমার জন্যে আমি আসিনি। বুঝেছ? তুমি মহা জাহেল (মূর্খ গোঁয়ার), শয়তান তোমার রুহে (আত্মায়) ঢুকে গেছে—তাকে বের করার সাধ্য আমার নেই। তুমি যা খুশি করো, কিন্তু ওই দুধের বাচ্চার আখের নষ্ট করছ কেন?

ইয়াকুব চুপ। ফ্যালফ্যাল করে তাকায়।

ছেলেটার তারিফ করেন জুহা মৌলবি। ….’আহা হা! কী রূপ, কী ছুরত (শ্রী)! আল্লাতালা শয়তানের হাতে ওকে সঁপে দেবেন, কোন মূর্খ বলে একথা রে? ওকে নিতে এলাম ইয়াকুব। ওর খৎনা দেব। ওকে কলমা পড়াব। ওকে আরবি ফারসি উর্দু পড়িয়ে দেওবন্দ শরিফ পাঠাব। আল্লার দুনিয়ায় একজন ইমানদার বাড়বে। চাই কী, ওর নেকীতে (পুণ্যে) তোর গুনাহ (পাপ) আল্লা মাফ করে দেবেন।’

ইয়াকুব একবার ছেলের দিকে তাকায়।

জুহা মৌলবি বলেন, ‘আরে মূর্খ নাদান! ও ছেলে কি তোর? ও ছেলে এখন দুনিয়ার। ওরা মা নেই, বাবা নেই—’

ইয়াকুব অতিকষ্টে বলে, ‘আছে হুজুর। বাবা আছে।’

মৌলবি হাসেন। ‘হ্যাঁ—তা আছে। তবে—আর পনেরো ষোলো—কী বড় জোর সতেরো বছর পরে তার যাবজ্জীবন মেয়াদ খেটে ফিরে আসবে। এসে যখন দাবি করবে, তখন তুই কী দিয়ে আটকাবি ইয়াকুব? বল, পারবি?’

ইয়াকুব জোরে মাথা দোলায়।

‘তবে? তাই বলছি—তার আগে ওকে ইসলামে দীক্ষা দিই। ওকে আমার সঙ্গে পাঠিয়ে দে। ভালো খাবে পরবে। তোর ঘরে পড়ে ছেলেটার কী হাল হয়েছে দেখদিকি! অমন সুন্দর সুপুরুষ ছেলে!’….বলে জুহা মৌলবি কয়েক পা এগিয়ে ছেলেটির কাছে যান। সস্নেহে একটু হেসে বলেন, ‘ও বাবা ছেলে! শোন দিকি, এসো আমার দিকে তাকাও।’

অমনি ইয়াকুব ছেলের কাছে এসে দাঁড়ায়। তার মধ্যে আর সেই ভীরুতা কিংবা ভদ্রতার একটুও চিহ্ন নেই। তার লাল চোখ জ্বলছে, শরীর কাঁপছে। শিরাগুলো ফুলে উঠেছে। সে বলে, না ইসমাইল, তাকাসনে। জাদু করবে।’

প্রথমে বিস্মিত হন জুহা মৌলবি, পরক্ষণে জোরে হাসেন।…’বাঃ! ইসমাইল নাম রেখেছ ইয়াকুব? তবে তো হয়েই আছে!’

ইয়াকুব কাঁপতে কাঁপতে বলে, ‘আমার নিজের মরা ছেলেটার নামে নাম রেখেছি। ও নাম কারও বাপোত্তিসম্পতি লয়।’

জুহা মৌলবি তাকে আর ঘাটান না। খপ করে ছেলেটার হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে থাকেন। বিব্রত ছেলেটা একটানে বেশ খানিকটা গিয়ে কেঁদে ওঠে।

ইয়াকুব এবার ছেলের একটা হাত ধরে চেঁচিয়ে বলে, ‘খবরদার।’

পালটা জুহা মৌলবি গর্জে ওঠেন, ‘চোপরাও!’

ছেলেটা আরও জোরে কেঁদে ওঠে।

তারপর পরস্পর প্রচণ্ড লড়াই শুরু হয়ে যায় অনিবার্যভাবে। জায়গাটা গ্রাম থেকে একটু দূরে—বাইরে। আশেপাশে কোথাও কোনো লোক নেই। পিছনে গঙ্গায় বহমান নৌকো আছে, স্রোতে দ্রুতগামী। শ্মশানবটের কাছে শেষরাত্রে মড়া পুড়িয়ে যারা রোদের অপেক্ষায় আগুন পোহাচ্ছিল তারা চলে গেছে। সীতু ডোম আর তার বউ পিংলিও পাওনাকড়ি চুকিয়ে নিয়ে কেটে পড়েছে। এদিকে ইয়াকুব সাধুর উঠোনে এই প্রাণপণ যুদ্ধ চলতে থাকে।

জোব্বার মধ্যে ছেলেটাকে একহাতে ঠেসে জুহা মৌলবি এবার আবলুস কাঠের লাঠিটি আস্ফালন করেন। ইয়াকুব চেরা গলায় অকথ্য গালিগালাজ করে এবং বারবার ঝাঁপিয়ে পড়ে ছেলের ওপর। ছেলেটা ভাষাবিহীন আঁ আঁ চেঁচায় ক্রমাগত। মৌলবির জামার হাতা ফালাফালা হয়ে যায় ইয়াকুবের ধারালো নখে। তখন আচমকা মৌলবি তার মাথায় আবলুস কাঠের কারুকার্যময় ছড়ি কিংবা লাঠিটা দিয়ে আঘাত করেন। গলগল করে রক্ত বেরিয়ে কপাল চোখ গাল ভেসে যায় সাধুর।

এবং আশ্চর্য, যে রক্তপায়ী তান্ত্রিক, রক্ত যার শক্তির প্রতীক এবং আত্মনিবেদন এবং রক্তের হেতুই লাল রঙ যার পরম প্রিয়, সেই ইয়াকুব হাতে রক্ত দেখেই ক্রমে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে—”অ্যাই বাপ!”

ছেলেটাও দেখে সেই বীভৎস মুখচ্ছবি সাধুর। ত্রাসে সেও অবশ হয়। জুহা মৌলবি অমনি তাকে শিকারের মতন যেন কামড়ে নিয়ে দ্রুত হাঁটতে থাকেন। ছেলেটার একটা হাত তাঁর হাতে—ছেলেটা ধুকুর—ধুকুর দৌড়য় তাঁর সঙ্গে। শেয়ালছানার মতন মৃদু আর্তনাদ ক্রমশ নিশিন্দা—পলাশ—তাল ঘেরা গৌরীমাটির পথে মিলিয়ে যেতে থাকে।

কতক্ষণ পরে সম্বিৎ ফেরে ইয়াকুবের। লাল চোখে আচ্ছন্নদৃষ্টে তাকিয়ে হাঁচড় পাঁচড় করে ওঠে। এতক্ষণে মনে পড়ে যায় তার ‘থানের (সাধনপীঠ) কথা, মড়ার মাথাগুলোর কথা জড়িবুটি পেঁচার ঠোঁটে বাদুড়ের নথ তন্ত্রমন্ত্র শক্তিমান প্রেতদের কথা—এবং সবশেষে তার বীর্যবান খাঁড়াটির কথা। সবিক্রমে হুংকার ছাড়ে সে—’কালী—কালী—ক্কালী—ক্কালী! আ—উ—ম! (ঔং) আ—উ—ম!’

কিন্তু লাফ দিতে গিয়ে তক্ষুনি টের পায়, সে জড়দেহে পর্যবসিত। আকাশ—পাতাল বনবন করে ঘোরে। ক্ষতস্থানে দুহাত চেপে তবু সে গর্জায় বারবার—’আ—উ—ম!’

ওখানে ঘাটে খেয়ানৌকোর শম্ভু ঘেটেল তামাক খেতে খেতে একবার কান করে শোনে। তারপর আপনমনে বলে, ‘ক্ষ্যাপা আজ আবার ক্ষেপল ক্যানে?’

ঘরের ভিতর ‘থানে’ পৌঁছে ইয়াকুব খাঁড়াটার দিকে তাকায় কতক্ষণ। তারপর আস্তে আস্তে ঝুঁকে পড়ে। রক্তাক্ত জটাজুটওলা মাথাটা বেদিতে ঠেকিয়ে শিশুর মতন কাঁদে সে। …

সেবেলা আর ইয়াকুবকে বাইরে কেউ দেখতে পায় না।

থানের পাশে চিত হয়ে শুয়ে সে আরেক ইসমাইলের কথা ভাবছিল। তার নিজের ইসমাইল। মুখটা মনে পড়ে, কিংবা মনে পড়ে না। আবছা চেহারা এসে ঘুরে বেড়াচ্ছিল তার ঘরকন্না তন্ত্রমন্ত্রময় দুর্বোধ্য সংসারে—অনেকদিন পরে তার এই প্রত্যাবর্তন। একটি আধল্যাংটো ছেলে, গলায় বাহুতে অগুণতি কবচ।

ইয়াকুব তাকে বলে, ‘কোথায় ছিলি বাপ, এতদিন?’

‘মায়ের কাছে।’

তিনবার এই প্রশ্ন করে, তিনবার একই জবাব পায়। তখন ইয়াকুব সাধু তার স্ত্রীর চেহারা খোঁজে। মনে পড়ে, কিংবা মনে পড়ে না।

‘তুমি কি ইসমাইলের মা?’

প্রতিমূর্তি জবাব দেয় না। ঘরের কোণায় কিছু হাতড়ায়। খুটখুট শব্দ ওঠে।

ইয়াকুব জ্বলে যায়। ‘অ্যাই শালি হারামজাদি! খবরদার!’

আর, তখন একটা অন্ধকার আসে। বিশাল ভয়ঙ্কর নিঃশব্দ অন্ধকার। কার্তিক মাস, অমাবস্যা তিথি। ডাবকই গ্রামে ভূতগ্রস্তা মেয়েটির ভূত ছাড়িয়ে ফিরে আসছে সে। একটু পরেই কালীপুজোর প্রথম বালির ঢাক বেজে উঠবে চারিদিকে গ্রামগ্রামান্তরে। তার মধ্যে সেই ভূতটার কণ্ঠস্বর ক্রমশ জোরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে—’দেঁ সাঁধু, তোঁর সেঁরা জিনিসটি দেঁ। ইয়াকুবের কাঁধে গামছায় বাঁধা রয়েছে কলা সন্দেশ। পিছনে আওয়াজ উঠে, ‘দেঁ দেঁ দেঁ!’ ইয়াকুব হাঁফাতে হাঁফাতে দৌড়য়। আবার আওয়াজ আসে—দেঁ দেঁ দেঁ! চারিদিক থেকে স্তব্ধ কালো চরাচর ফাটিয়ে অঙ্কুরিত সেই আওয়াজ তাকে গিলে খেতে থাকে। ইয়াকুব গামছা থেকে খাবারগুলো খুলে ছড়িয়ে দেয়, চেঁচিয়ে ওঠে—’লে, লে! ক্ষান্ত হ।’ তবু আওয়াজ থামে না।…

তারপর কী একটা ঘটল। দরজা খুলে ক্ষীণ পিদিমের আলোয় ঘুমন্ত ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল সে। ঘরের চারপাশ থেকে বিশ্বপ্রকৃতি অন্ধকারে অবিশ্রান্ত একটা কী চাইছে তাকে। বেদির পাশের গর্ত থেকে মাটির হাঁড়িটা বের করল সে। মড়ার মাথায় ঢেলে মদ খেতে থাকল। তারপর আবার দেখল ছেলের মুখ। অন্ধকারে অদৃশ্য অলৌকিক সত্তা তার জন্যে আপেক্ষা করছে দরজায়। তিথি অমাবস্যা। মহালগ্ন উপস্থিত। খাঁড়াটা টেনে নিল সে। ছেলের বুকে বসল। ছেলে ঘুম ভেঙে গেঙিয়ে উঠল। তারপর ধারালো খাঁড়াটা দুহাতে ধরে গলায় ঠেকিয়ে চাপ দিল। অমনি চারদিকে হাজার হাজার ঢাক বাজাতে লাগল। …

ইয়াকুব লাফ দিয়ে ওঠে। পালানোর মতো দৌড়ে বেরিয়ে উঠোনে পৌঁছয়। হাফাতে থাকে, জিভ বেরিয়ে যায়। জমাট কালো রক্তে বিকৃত মুখটা জন্তুর মতন দেখায়। আস্তে আস্তে শ্মশানবটের দিকে এগিয়ে যায় সে। …

বিকেলে স্বর্ণলতা অবাক হয়েছে ইয়াকুব সাধুর মূর্তি দেখে।

‘কী হল সন্ন্যাসীচাচা? কে মারল তোমাকে?’ স্বর্ণ চঞ্চল হয়ে ওঠে।

‘জুহা মৌলুবি’।

‘মৌলবি? কেন, কেন?’…স্বর্ণ ব্যস্ত হয়ে বলে। …’মৌলুবিচাচা এসে কী যে সব করে বেড়াচ্ছেন, বুঝিনে। তোমাকে মারলেন কেন? গালটাল দিয়েছিলে নিশ্চয়। তোমার ক্ষ্যাপামি যে গেল না! বোস, ওখানটায় বোস। একটা ব্যান্ডেজ করে দিই।’

ইয়াকুব শান্তভাবে বসে থাকে। স্বর্ণলতা যত্ন করে তার সাফ করে দেয়। ব্যান্ডেজ বেঁধে দেয়। কপালে দু’ইঞ্চিটাকে ক্ষত হয়েছে। ওষুধ খাইয়ে দেয় এক ডোজ। ইয়াকুব মিঠে গুলিগুলো চিবোয়, চোষে। তারপর বলে, ‘একটা চিঠি লেখাতে এলাম মা ব্রহ্মময়ী।’

‘চিঠি লেখাবে? কাকে?’

‘হেরুকে, মা।’

‘কেন?’

‘ওর ছেলেটার জন্যে।’ …তারপর ইয়াকুব সবিস্তারে সব জানায়। ঘটক ঠাকুরের পরামর্শ নিয়ে সে এইমাত্র আসছে। ঘটকঠাকুর বলেছেন, ছেলে তো আসলে হেরুর। কাজেই থানা পুলিশে যেতে হলে সেটা তার কাজ। সে যদি গরমেন্টোকে দরখাস্ত করে, তাহলে মৌলবির কাছ থেকে ছেলে উদ্ধার করা যাবে। হেরুর নাবালক ছেলের দায়দায়িত্ব গরমেন্টো অবশ্য নিতে পারে। কিন্তু তাহলে ইয়াকুবের যে কোল খালি হয়ে যায়। তাই হেরু দরখাস্ত করুক—তবে বলুক যে ছেলে সাধুর কাছেই জিম্মা থাকবে।

স্বর্ণ চিঠি লেখে। পড়ে শোনায়। ইয়াকুব মাথা দোলায়, ‘ঠিক নেকেছ মা জগদম্বা।’

সেই চিঠি জর্জের মারফত সন্ধ্যায় গাড়িতে গার্ডের হাতে যায়। গার্ডসায়েব কাটোয়ায় পৌঁছে মেলব্যাগে চালান করে দেন।

দুটো দিন কেটে গেল। ইয়াকুব সাহস পায় না ডাবকই যেতে। লোকের কাছে খোঁজখবর নেয়। না, এখনও খৎনা দেয়নি মৌলবি। তবে ছেলেটা নাকি বশ মেনে গেছে। ভালো খাচ্ছে দাচ্ছে। মাথায় টুপি, পরনে লুঙি, গায়ে কুর্তা—মসজিদে আরবি পড়ছে ছেলেদের সঙ্গে। ইয়াকুব আফশোসে চুপিচুপি কাঁদে—’বাঃ রে শালা নেমকহারাম!’

শোকাচ্ছন্ন সাধু তবু মনাই পাখির পরিচর্যা ভোলে না।

তৃতীয় দিন বাইরে থেকে ঘুরে সে সবিস্ময়ে এবং আনন্দে দেখে, ছেলেটা পালিয়ে এসে ঘরের কোণায় চুপচাপ বসে রয়েছে—বুকে মনাইয়ের খাঁচা। লাফিয়ে পড়ে সাধু। বুকে তুলে চুমো খায়। জোরে চেঁচিয়ে আনন্দপ্রকাশ করতে ভয় হয়। বলে, ‘আমি জানতাম, আমি জানতাম!’

ছেলেটার পরনে ক্ষুদে লুঙি, গায়ে কুর্তা, পকেটে চুপি। সব খুলে ওকে ন্যাংটো করে ইয়াকুব। তারপর উনুনে ভরে আগুন জ্বেলে দেয়। ছেলেটা পাখি নিয়েই মত্ত।

কিন্তু ওকে লুকিয়ে রাখবার অস্বস্তিতে সে আক্রান্ত হয়। প্রতিমুহূর্তে ভয়, এই বুঝি মৌলবি কিংবা তার লোকজন এসে পড়ল!

রাতের অন্ধকারে সে ছেলেটাকে নিয়ে স্বর্ণলতার কাছে যায় চুপি চুপি। স্বর্ণলতা জর্জের সঙ্গে পরামর্শ করে আসে। জর্জ বলে, ‘হেরুর খবর না আশা পর্যন্ত ওকে ফাদারের কাছে রাখা যেতে পারে। সেটা খুবই নিরাপদ হবে।’

অগত্যা ইয়াকুব তাতেই রাজি হয়। শুধু বলে, ‘পাদরিবাবা ওকে আবার কেরেস্তান করবে না তো?’

জর্জ হাসতে—হাসতে বলে, ‘কুছু বয় নাই। আমি আছে।’

সেই রাতে ছেলে যায় পাদরি সাইমনের আখড়ায়। ফাদার দুটো হাত তুলে সোল্লাসে বলেন, ‘ঔ জেসাস!’…..

এক হপ্তা পরে একদিন ফাদার ডেকে পাঠালেন ইয়াকুবকে। কর্ণসুবর্ণর একটা টিলার গায়ে ফাদারের ছোট্ট হাসপাতাল, চার্চ, থাকবার ঘর। মাটির দেয়াল, খড়ের চাল আপাতত। তবে শিগগির পাকা বাড়ি হবে শোনা যাচ্ছে।

বারান্দায় মনাই পাখির খাঁচা ঝুলছে। হেরুর ছেলে হাফপেন্টুল—শার্ট পরেছে, পায়ে জুতোও রয়েছে, একেবারে গোরার বাচ্চা। পাদরি ইজি চেয়ারে বসে রয়েছেন—তাঁর কাছেই দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটি—অতি সজ্জন এবং অনুগত। ইয়াকুবের বুক আবেগে তোলপাড় করে। দুঃখে অভিমানে গলার ভিতর গোটা ওঠে। সামলে নিয়ে সে সেলাম দেয় পাদরিকে। একটু তফাতে বসে ছেলেটার দিকে আড়চোখে তাকায়। নেমকহারামটা যেন চিনতেই পারে না সাধুকে।

ফাদার বলেন, ‘বহট দুখের কতা আছে সাঢু। হেরু মারা গেছে!’

ইয়াকুব ফ্যালফ্যাল করে তাকায়।

‘হাঁ বহট বোকা লোক ছিল। তোমার পট্র পাইয়া একরাট্রে জেলের ডেয়ালে উঠেছিল—মটলব ছিল, পালাবে। টো কী হল সেন্ট্রি ঘোলি মার ডিলো। মরে গেল।’

আর কোনো আশাই রইল না, ইয়াকুব বুঝতে পারে। তাই করুণ চোখে ছেলেটার দিকে তাকায়। তারপর হঠাৎ খেপে গিয়ে বলে, ‘আপনি মিছে কথা বলছেন সাহেব। আপনি ছেলেটাকে খেরেস্তান করবেন—আপনার মতলব খারাপ।’

ফাদার হাসেন। ….’মিছা কটা? টো যাও, স্টেশনমাস্টারকে পুছো!’

ইয়াকুব রুদ্ধ আক্রোশে তক্ষুনি উঠে পড়ে। হন্তদন্ত স্টেশনে যায়। জর্জ বলে, ‘এসো সাঢু। ফাদার টোমাকে ডেকেসিলেন! যাও, ডেকা করো।’

ইয়াকুব আবার মুশড়ে পড়ে। করুণভাবে বলে, ‘যেয়েছিলাম সাহেব।’

‘হেরু মারা গেসে, বলে নাই?’

‘বলছে, সাহেব।’

‘তবে? কী করটে চাও এখন?’

ইয়াকুব মাথা দোলায়, তারপর আস্তে আস্তে ফেরে। স্বর্ণর কাছে যায় না। ধুলোউড়ির মাঠ পেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলতে থাকে।

এ ইয়াকুব অন্য মানুষ। শক্তিমান ভয়ঙ্কর অলৌকিক তাকে এবার পরিত্যাগ করেছে, সে টের পাচ্ছে।

আরও কয়েকটা দিন গেল। সবাই ভেবেছিল, হেরুর ছেলেকে নিয়ে মৌলবি বনাম পাদরি একটা লড়াই না হয়ে যায় না। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটল না। চার্চের কাছে পুলিশচৌকী বসিয়েছেন ফাদার সাইমন। ইতিমধ্যে কয়েকটি বাউরি পরিবার খ্রিস্টান হয়ে গেছে। ফাদারের বড় সুসময়।

শীত জাঁকিয়ে এসেছে। এক সকালে ইয়াকুব সাধু অদ্ভুত কাণ্ড করতে শুরু করল।

বেদিটা কোদাল চালিয়ে খুঁড়ে তছনছ করে ফেলেছিল সে। মড়ার মাথাগুলো ফেলে দিয়ে এল শ্মশানবটের কাছে। জড়িবুটি শেকড়—বাকড় সবকিছু ফেলে দিল। খাঁড়াটাও গঙ্গার জলে ফেলে দিয়ে এল। তারপর একটা পুঁটুলি মাত্র কাঁধে ঝুলিয়ে বেরোল!

আর এলাকায় কেউ জটাজুটধারী তান্ত্রিককে দেখতে পায় না। তার ঘর হাট করে খোলা। শেয়ালের আড্ডা। জীবজন্তুদের আস্তানা। নিশি রাতে ভূতপ্রেত এসে নাচে গায়। ভয়ে কেউ দিনদুপুরে এদিকে ঘেষে না।

কিন্তু এক বসন্তের বিকেলে দেখা গেল চুপিচুপি চলে এসেছে একটি ছেলে—নধর চেহারা, ফরসা রঙ, প্যান্ট শার্ট জুতো তার পরনে, এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে বিধ্বস্ত কুঁড়ে ঘরটার সামনে। পাশে শ্মশানবটের ডালপালায় পাখি ডাকছে, গঙ্গার পাড়ে শিমুল গাছটা লাল ফুলে ভরে উঠেছে। গৌরী পথের দুধারে মাদার পলাশও ফুল ফুটিয়েছে থরেবিথরে। সে দুঃখিত চোখে তাকিয়ে থাকে ঘরটার দিকে। এদিক—ওদিক কিছু খোঁজেও। তারপর আস্তে আস্তে ডাকে, ‘সাধু!’

কোনো সাড়া পায় না।

ফের সে ডাকে, ‘সাধু! সাধুবাবা!’

কোনো সাড়া নেই।

তখন সে বিষণ্ণমনে পা বাড়ায়। দূর চার্চের দিকে হাঁটতে থাকে—অতি ধীরে, অন্যমনস্ক।

পথে একজন তাকে দেখে প্রশ্ন করে, ‘তুমি হেরুর সেই ছেলেটা না?’

ছেলেটি মুখ তুলে মাথা দোলায়। কী জবাব দেয়, প্রশ্নকারী বুঝতে পারে না।

‘ওদিকে কোথায় গিয়েছিলে?’

কোনো জবাব না দিয়ে সে হাঁটতে থাকে। লোকটা কতক্ষণ তার চলে যাওয়া দেখে।

চার্চে গিয়ে ফাদার সাইমনের উগ্রমূর্তি দেখে সে থমকে দাঁড়ায়। ফাদার তেড়ে আসেন, ‘কোঠায় গিয়েছিলে টুমি? নটি বয়! হামি বলেছে না, না বলে কোঠাও যাবে না! বোলো, কোঠায় গিয়েছিলে?’

ছেলেটা ফ্যালফ্যাল করে তাকায় শুধু।

‘বডমাস! কাম হেয়া, কাম! আমি বারণ করেছি না? বলেছি না—আই প্রমিজড—পানিশমেন্ট করব!’

জবাব না দেওয়ার জন্যেই ফাদার আগুন হয়ে যান। কান ধরে সজোরে চাঁটি মারেন। পড়ে গিয়ে সশব্দে কেঁদে ওঠে সে। এবং এতদিন পরে এই প্রথম, আকাঙ্ক্ষিত সেই পবিত্র শব্দটি ছিটকে বেরিয়ে আসে তার মুখ থেকে, ‘বাবা গো।’

‘ডোন্ট ডোন্ট ক্রাই, ডেভিড! আবার মারব। গো, ব্রিং ইওর বুকস!’

হেরুর ছেলে ডেভিড ঝাপসা দৃষ্টির সামনে—অনেক দূরে একটা বিশাল স্নেহময় মুখ দেখতে পায়। জটাজুট গোঁফদাড়িতে ভরা, একটা ছায়া আর রহস্য মুখে—সেই মুখটা ইয়াকুব সাধুর। ….