মিনিট দশেক পরে কফির শূন্য কাপটা নামিয়ে রাখতেই কৃষ্ণা আবার প্রশ্ন করল, কোথায় গিয়েছিলে?
বল তো কোথায়?
মনে হয় সুভদ্রা-নিকেতনে!
বাঃ, চমৎকার কৃষ্ণা! তোমার দেখছি তৃতীয় নয়নটি রীতিমত খুলে গিয়েছে!
বাঃ, এত বড় একজন রহস্যভেদীর সঙ্গে এতকাল বাস করছি! কথায় বলে সাধুসঙ্গে স্বর্গবাস!
আর অসৎ সঙ্গে–বলতে বলতে কিরীটী হেসে ওঠে।
সত্যি বল না গো?
কি বলব?
আমার অনুমানটা কি মিথ্যে?
না, একেবারে মিথ্যে নয়। তবে—
তবে?
আর দুটো দিন অপেক্ষা কর দেবী, আশা করছি তারপরই হরিদাস সামন্ত হত্যারহস্যের উপরে যবনিকাপাত হয়ে যাবে। এখনও সামান্য বাকি, দুটি বা একটি দৃশ্য।
বিশ্বাস করি না। তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ কে হত্যাকারী!
সত্যের অপলাপ করা কর্তব্য নয়, তা বুঝতে পেরেছি বোধ হয়।
বোধ হয় না, বুঝতে তুমি পেরেছ ঠিকই।
কিরীটী মৃদু মৃদু হাসে।
উঃ, তোমার পেট থেকে কথা বের করা না—ঠিক আছে, বলো না। তবে আমিও বুঝতে পেরেছি হত্যাকারী কে?
বুঝতে যদি পেরে থাক তবে আবার প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ কেন, দেবী?
মিলিয়ে দেখতে চেয়েছিলাম, আমার অনুমান ঠিক কিনা।
ঠিক আছে, তাহলে এস আমরা দুজনেই হত্যাকারীর নাম দুটো আলাদা আলাদা কাগজে লিখে আমার ড্রয়ারে রেখে দিই চাবি বন্ধ করে, তারপর চাবিটা
ঐ সময় জংলী এসে ঘরে ঢোকে শূন্য কফির কাপ দুটো নিয়ে যেতে।
কিরীটী জংলীর দিকে তাকিয়ে বললে, ড্রয়ারের চাবিটা থাকবে শ্রীমান জংলীর হেপাজতে। পরশু রাত ঠিক এগারোটা দশ মিনিটে চাবি নিয়ে কাগজ খুলে মিলিয়ে দেখা যাবে কার অনুমান সত্য। কেমন, রাজী?
রাজী।
জংলী হাঁ করে ওদের মুখের দিকে চেয়ে থেকে কিছুক্ষণ পরে বলে, কি হল মাইজী!
কৃষ্ণা ততক্ষণে উঠে টেবিলের উপর থেকে দুটো কাগজ আর কলম এনে বললে, নাও, তুমি লেখো। আমিও লিখছি।
তথাস্তু দেবী।
জংলী তখনও বোকার মত ওদের দিকে তাকিয়ে।
দুজনের লেখা হলে, দুখানা কাগজ ভাঁজ করে চাবি দিয়ে ড্রয়ার খুলে সে দুটো ড্রয়ারের মধ্যে ফেলে চাবি বন্ধ করে, ড্রয়ারের চাবিটা জংলীর হাতে দিয়ে কৃষ্ণা বললে, এই চাবিটা রাখ তোর কাছে জংলী।
কেন মাইজী?
যা বলছি—রাখ। আমি চাইলেও দিবি না, বাবু চাইলেও দিবি না, বুঝলি? ঘুষ দিলেও নয়।
জংলী বুঝতে পারে কোন একটা মজার ব্যাপার ঘটেছে। সে মিটিমিটি হাসতে হাসতে চাবিটা পকেটে রাখতে রাখতে বললে, ঠিক হ্যায় কিসিকো এ কুঞ্জী নেহী দুংগা।
.
পরের দিন সকালে চা-পানের পর কিরীটী যেন কার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললে ফোনে।
কৃষ্ণা পাশেই সোফায় বসে একটা স্কার্ফ বুনছিল, কিরীটীর ফোন শেষ হলে বললে, সুব্রতর খবর কি বল তো?
কিরীটী একটা সোফায় বসে সামনের সুদৃশ্য একটি কাশ্মীরী কৌটো থেকে একটা সিগারেট নিয়ে ধরাতে ধরাতে বললে, মাসখানেক প্রায় দেখা নেই, তাই না!
হ্যাঁ ও যেন কেমন হয়ে গিয়েছে।
বিয়ে না করলে পুরুষমানুষ এমনই হয়ে যায়।
হঠাৎ ঐ সময় ঘরের ফোনটা বেজে উঠল। কিরীটী উঠে গিয়ে রিসিভারটা তুলে নিল।
মল্লিকের ফোন।
মণীশ কি করেছে শুনেছ!
কি? …তাই নাকি! ভালই তো। কিরীটী হাসতে লাগল।
কিছুক্ষণ পরে ফোন রেখে ফিরে এসে আবার বসল কৃষ্ণার মুখোমুখি। হ্যাঁ, কি যেন বলছিলে? বিয়ে না করলে কি হয়ে যায়, কৃষ্ণা—
কিরীটীর কথা শেষ হল না, ঐ সময় দরজা ঠেলে সুব্রত ঘরে ঢুকল, মুখে স্মিত হাসি।
আরে তুই-তোর পায়ের শব্দ পাইনি তো! কিরীটী বললে।
তাহলে দেখছি মণীশ চক্রবর্তী ঠিকই বলেছে—সুব্রত হাসতে হাসতে মুখোমুখি বসে বললে।
মণীশ চক্রবর্তী?
হ্যাঁ, চন্দননগর থানার ও সি।
তুই চিনিস নাকি ওকে?
আমরা যখন বাঁকুড়া কলেজে পড়তাম তখন ও বাঁকুড়া স্কুলে পড়ত, দুর্ধর্ষ ফুটবল প্লেয়ার ছিল।
গোলকীপার বুঝি? কিরীটী স্মিতহাস্যে বলল।
ঠিক বলেছিস। কিন্তু বুঝলি কি করে? বলতে বলতে হেসে ওঠে সুব্রত।
হাসলি যে?
সুব্রত বললে, সেই দৃশ্যটা মনে পড়ল তোর কথায়।
কোন্ দৃশ্য?
কলেজের মাঠে খেলা হচ্ছিল, ও ছিল গোলকীপার। বরাবরই ওর চেহারাটা ছিল। কুমড়োপটাসের মত, সেই চেহারা আর সাতটা গোল খেয়েছিল, তাইতেই মনে আছে ওকে। তারপর বহুকাল পরে চন্দননগরে একটা সাহিত্য-সভায় ওর সঙ্গে পরিচয় হল। এখন আবার একজন কবি।
ফুটবল থেকে কবিতা—অসাধারণ উত্তরণ! এ যে আরও দুর্ধর্ষ ব্যাপার!
তাই—তবে মাঝখানটা বাদ দিলি কেন? দারোগা। গত মোল বছর। ভদ্রলোকের এক কথা এক কাজ। ঐ দারোগাগরিতেই আটকে আছে, এক ধাপও অগ্রসর হয়নি। ভদ্রলোক দেখলাম তোর উপরে ভীষণ খাপ্পা।
কেন? আমি আবার কি করলাম?
কি একটা যাত্রাদলের লোকের খুনের ব্যাপারে নাকি তুই তার উপরওয়ালার সাহায্যে নাক। গলিয়ে ব্যাপারটাকে প্রায় ভণ্ডুল করে দিতে বসেছিস?
কেন, সে তো এইমাত্র শুনলাম—
কি শুনলি?
ফোনে মল্লিক বললে, রাধারমণ পালকে নাকি সে অ্যারেস্ট করেছে, তার মতে সে-ই নাকি খুনী।
কিন্তু ব্যাপারটা কি? শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে। সুব্রতর কণ্ঠে আগ্রহের সুর।
আমি ততক্ষণে স্নানটা সেরে আসি, তুই কৃষ্ণার কাছে সব শোন্।
কিরীটী উঠে গেল ঘর থেকে।
আধঘণ্টা পরে স্নান সেরে একবারে বেরুবার পোশাকে সজ্জিত হয়ে কিরীটী ঘরে এল।
কি রে, শুনলি?
শুনলাম, আর এও বুঝলাম মণীশ চক্রবর্তী আর একটা গোল খেয়ে বসে আছে।
বুঝলি কি করে? কৃষ্ণার সঙ্গে মত বিনিময় হল বুঝি? বলতে বলতে আড়চোখে কিরীটী স্ত্রীর দিকে তাকাল।
না, তোর গৃহিণী তো কবুল করল না কিছুতেই। সুব্রত হাসতে হাসতে বললে।
তাহলে তুই একটু বোস, আমি একটু ঘুরে আসি।
কতদূর যাবি? সুব্রত শুধায়।
বেশি দূর না–কাছাকাছি।
ঐ সময় ঘরের টেলিফোনটা আবার বেজে উঠল।
কিরীটী এগিয়ে গিয়ে রিসিভারটা তুলে নেয়, কিরীটী রায়—
আমি মণীশ চক্রবর্তী কথা বলছি।
কি খবর বলুন? অ্যাঁ! কেমিক্যাল অ্যানালিসিসের রিপোর্ট পাওয়া গিয়েছে বোতলে কিছু পাওয়া যায়নি? গ্লাসে এবং স্টমাক কনটেন্টে বিষ পাওয়া গিয়েছে?
কি বিষ?…অ্যাট্রোপিন সালফেট? ঠিক আছে। হ্যাঁ, ভাল কথা—সন্ধ্যার দিকে একবার ফোন করবেন। কিরীটী ফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রেখে দিল।
সুব্রত শুধাল, কি? অ্যাট্রোপিন সালফেট বিষ পাওয়া গিয়েছে?
হ্যাঁ, অ্যাট্রোপিনের লিথাল ডোজটা বোধ হয়—এক থেকে দুই গ্রেন–কৃষ্ণা, ঐ আলমারি থেকে ডাঃ ঘোষের ফারমাকোপিয়াটা বের কর তো, ঐ যে লাল মলাটের বইটা—একেবারে ডান দিকে শেষে, দ্বিতীয় থাকে—
কৃষ্ণা আলমারি থেকে বইটা বের করে এনে কিরীটীর হাতে দিল। কিছুক্ষণ ধরে পাতা উল্টে উল্টে এক জায়গায় এসে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হল। পড়তে লাগল।
একটু পরে বইটা বন্ধ করে কৃষ্ণার হাতে দিতে দিতে বললে, আশ্চর্য! লোকটা ঐ বিশেষ বিষটা যে এত দ্রুত এত অল্প ডোজে কার্যকরী, তা জানল কি করে?
কিরীটী পুনরায় বসে সোফার উপর, একটা সিগারেট ধরায়।
কৃষ্ণা, তোমাকে বলেছিলাম না দুদিন পরে মীমাংসা হবে?
হ্যাঁ!
তার আর দরকার হবে না বোধ হয়, মিসিং লিঙ্কটা পেয়ে গিয়েছি।
সত্যি!
বোস্ সুব্রত তুই, যাস নে। ঘণ্টা দেড়েক-দুয়েকের মধ্যে ঘুরে আসছি।
বলতে বলতে কিরীটী উঠে দাঁড়াল, চললাম।
কিরীটী ঘর থেকে বের হয়ে গেল।