একটা দড়ি জাহাজের রেলিংয়ে গলিয়ে সেই দড়ির সাহায্যেই ওরা একে একে যখন জাহাজের ডেকে উঠে এল-সেখানে ডেকের উপরে চার-পাঁচটি মৃতদেহ পড়ে আছে।
কিরীটী ও মিঃ রামিয়া চারিদিকে দৃষ্টিপাত করে দেখলে, জাহাজের ডেকে আর জনপ্রাণী নেই, ইতিমধ্যে গান-বোট থেকে দশ-বারোজন সৈনিক উঠে এসেছে জাহাজে।
তাদের পাঁচজনকে প্রহরা দিতে বলে বাকী সৈনিক নিয়ে কিরীটী এগিয়ে চলল সিঁড়ি বেয়ে নীচের দিকে।
জাহাজটা কিন্তু তখনও চলেছে।
সিঁড়ি যেখানে শেষ হয়েছে-সামনেই একটা সরু প্যাসেজের মত—প্যাসেজে আলো ছিল, সেই আলোতেই ওরা এগিয়ে চলল—সর্বাগ্রে একজন সৈনিক রাইফেল হাতে, তার পিছনে কিরীটী ও মিঃ রামিয়া পিস্তল হাতে এবং বাকী সব তাদের অনুসরণ করে। হঠাৎওদের নজরে পড়ল একটা কাঁচের দরজা-কাজের ভিতর দিয়ে দৃষ্টিপাত করতেই বোঝা গেল–ওটা একটা কেবিনের দরজা। বেশ প্রশস্ত কেবিন-কেবিনের মধ্যে আলো জ্বলছে, আর–
আর সেই আলোয় দেখা গেল-কালো রঙের আলখাল্লা পরিহিত দীর্ঘকায় এক ব্যক্তি পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে এবং তার সামনে একটা চেয়ারে বসে মিঃ ডিবরাজ-তার হাত-পা বাঁধা।
ঐ–ঐ তো মিঃ ডিবরাজ! কাঁপা উত্তেজিত কণ্ঠে মিঃ রামিয়া কথাটা বলে শেষ করবার আগেই কিরীটী তার মুখে হাত চাপা দিয়ে তাকে থামিয়ে দিল, hush! চুপ।
ও লোকটা কে? দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে মিঃ রামিযা বললেন।
ডাঃ ওয়াং সম্ভবত। কিরীটী চাপাগলায় জবাব দিল।
কোণের আর একটা চেয়ারে আর একজন বসে না? দেখতে পাচ্ছেন মিঃ রায়?
যা, উনি হয়ত মিঃ চিদাম্বরম।
এখন আমাদের কি কর্তব্য? : ডাঃ ওয়াং সম্ভবত এখনও জানতে পারেনি যে জাহাজ আমরা অধিকার করেছি—কিরীটীর কথা শেষ হল না, ওরা দেখতে পেল, কেবিনের এক কোণ থেকে একটা ছোট বাঁদর লাফাতে লাফাতে এগিয়ে এসে ডাক্তারের সামনে দাঁড়াল, ডাক্তার হাত বাড়াতেই বাঁদরটা তার হাত বেয়ে অবলীলাক্রমে ডাক্তারের কাধের উপর উঠে বসল।
ক্যাপ্টেন?
ইয়েস! কিরীটীর ডাকে সাড়া দিলেন ক্যাপ্টেন বালকৃষ্ণ, গান-বোটের কমাণ্ডার।
আপনার লোকদের বলুন জাহাজের ইঞ্জিন-ঘর দখল করতে—যান, চটপট অর্ডার দিয়ে আসুন।
ক্যাপ্টেন তখনি গিয়ে উপরের ডেকে অর্ডার দিয়ে মিনিট-তিনেকের মধ্যেই ফিরে এল, আর ঠিক সেই মুহূর্তে ডাঃ ওয়াং ঘুরে দাঁড়াল—
ওরা সকলে সঙ্গে সঙ্গে দরজার দুপাশে সরে দাঁড়াল।
দরজাটা খুলে ডাঃ ওয়াং বাইরে পা দিতেই কিরীটী ডাঃ ওয়াংয়ের উপরে ঝাপিয়ে পড়ল।
কিন্তু প্রচণ্ড শক্তি ডাঃ ওয়াংয়ের শরীরে। তাছাড়া জায়গাটা অপরিসর—দুজনে জড়াজড়ি করে কেবিনের মধ্যে গিয়ে পড়ল।
রাজুও কিরীটীর সাহায্যে এগিয়ে এল।
এদিকে আরেক বিপত্তি। জাহাজটা যেন একপাশে কাত হয়ে পড়তে শুরু করে, আর কেবিনের আলোটা হঠাৎ দপ করে নিভে গেল কিসের একটা শব্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে।
অন্ধকার। নিকষ আলো অন্ধকার। কিছু চোখে পড়ে না।
তারই মধ্যে কিরীটী লোকটাকে নিয়ে জাপটাজাপটি করছে-জাহাজটা আরও একটু যেন কাত হয়ে পড়েছে ততক্ষণে।
একটা কিসের আঁঝাল গন্ধ নাকে আসছে। মিষ্টি কিন্তু ঝাঁঝাল–
কিরীটী তাড়াতাড়ি অন্ধকারেই লোকটাকে ছেড়ে তাকে একটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, রাজু-মিঃ রামিয়া-quick! কেবিনের মধ্যে বিষাক্ত গ্যাস ছড়িয়ে যাচ্ছে–কেবিন থেকে বের হয়ে যান—যান–
কিরীটী ছুটে কেবিনের দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল। রাজুও। অন্ধকারে কিরীটী দেখতে পেল না মিঃ রামিয়া কেবিন থেকে বের হয়ে এসেছেন কিনা। কিরীটী ডাকে, রাজু-রাজু।
এই যে আমি-পাশ থেকে বলে রাজু!
দরজাটা কেবিনের তাড়াতাড়ি বন্ধ করে দেয়—গ্যাস ততক্ষণে বাইরের প্যাসেজেও আসতে শুরু করেছে।
শীগগির চল–ডেকে চল।
দুড়দাড় করে ওরা সিঁড়ি বেয়ে উপরের ডেকে চলে আসে।
সমুদ্রের হাওয়া এসে ওদের চোখেমুখে ঝাপটা মারে, আর ওরা প্রাণভরে শুদ্ধ হাওয়া টানতে টানতে হাঁপায়।
মিঃ রামিয়া-রামিয়া কোথায়? কিরীটী বললে?
মিঃ রামিয়া বোধ হয় মনে হচ্ছে কেবিন থেকে বেরুতে পারেননি।
প্রায় আধঘণ্টা পরে উপরের দিকে উঠে এসে গ্যাসটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। জাহাজ থেমে গিয়েছে অনেকক্ষণ। সৈন্যরা সম্পূর্ণ জাহাজটা অধিকার করেছে। ইঞ্জিনের ঘর তারা আগেই দখল করেছিল।
মুখের রুমাল দুভাঁজ করে বেঁধে কিরীটী আর রাজু নীচে নেমে এল-হাতে টর্চ-টর্চের আলো ফেলে ফেলে।
প্যাসেজে ঝাঁজালো মিষ্টি গন্ধটা আর নেই।
কেবিনের খোলা দরজাপথে ওরা ভিতরে প্রবেশ করল-মিঃ রামিয়ার মৃতদেহটা ঠিক কেবিনের দরজার কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে—আর চেয়ারের উপর উপবিষ্ট বদ্ধ অবস্থায় মিঃ চিদাম্বরণ ও মিঃ ডিবরাজ-দুজনেই মৃত।
তাঁদের মাথা বুকের উপর ঝুলছে। কিন্তু আর কোন দেহ দেখা গেল না।
All of them are dead, রাজু! কিরীটী মৃদুকণ্ঠে বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল। কেবিনের চারপাশে আর একবার নজর করল, কিন্তু ডাঃ ওয়াং-ডাঃ ওয়াং কোথায়? He must be livingwe must find him out! এই জাহাজের মধ্যেই সে আছে কোথায়। নিশ্চয়ই পালাতে পারেনি। চল খুঁজে দেখি–
প্যাসেজ ধরে একটু এগুতেই আর একটা কেবিন চোখে পড়ল। ভিতরে অত্যন্ত মৃদু আলো জ্বলছে-ঐ কেবিনের দরজাটাও কাঁচের।
কাঁচের ভিতর দিয়ে কিরীটী ভিতরে দৃষ্টিপাত করল।
আলো বলে কিরীটী যেটাকে মনে করেছিল দেখলো সেটা আলো নয়—কেবিনের মধ্যে একটা কাঁচের পার্টিশান। তারই অপরদিকে সারা দেওয়াল থেকে ম্লান একটা আলোর জ্যোতি যেন ঠিক পড়ছে
আর-আর দীর্ঘকায় কালো আলখাল্লা পরিহিত সেই ব্যক্তি, যার সঙ্গে তার মল্লযুদ্ধ হয়েছিল-একটা চেয়ারে বসে–
কিরীটী সামান্য চেষ্টা করতেই কেবিনের কাঁচের দরজাটা খুলে গেল—দুজনে ভিতরে প্রবেশ করল।
সঙ্গে সঙ্গে কালো আলখাল্লা পরিহিত লোকটা মুখ তুলে তাকাল। মুখে একটা পাতলা রবারের মুখোশ আঁটা। পরিষ্কার ইংরাজীতে বললে, এস মিঃ কিরীটী রায়, তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম, একসঙ্গেই মরব বলে সবাই মৃত্যু-আসর পেতেছি। এই জাহাজটা ধীরে ধীরে জলের তলায় এবার তলিয়ে যাবে, তোমাদের সকলকে নিয়ে আর আমার মৃতদেহটা নিয়ে। কারণ আমি আমার শরীরে বিষ ইনজেকশন দিয়েছি, আর বিশ মিনিটের মধ্যেই আমার মৃত্যু হবে। ওদিকে চেয়ে দেখছ কি, ওপাশের দেওয়ালে রয়েছে ভাস্বর ছত্রাক–এ তারই আলো। নিজে কালচার করে আমি ঐ Empera ছত্রাকের জন্ম দিয়েছি- কেমন করে কালচার করেছি জান? মরা মাছির গায়ে একরকম সাদা বস্তু জড়িয়ে থাকে, তারই ডিম্বকোষের কালচার থেকে ঐ ভাস্বর ছত্রাকের জন্ম।
কিরীটী অবাক বিস্ময়ে শুনছিল ডাঃ ওয়াংয়ের কথা।
ডাঃ ওয়াংয়ের গলা আবার শোনা গেল, বাঁদিককার দেওয়ালে দেখ। ওগুলোও ছত্রাক, নীলবর্ণের অ্যামেনেশিয়া জাতীয় ছত্রাক-ওর এদিকে আর একটা চেম্বার আছে-বেশীমাত্রায় অক্সিজেনে ভরা চেম্বারটা, সেই অক্সিজেনের সাহায্যেই ঐ ছত্রাক কোটি কোটি সংখ্যায় জন্ম নেয়, আমার তৈরী সবুজ তরল মৃত্যু-বিষাক্ত ক্লোরিন গ্যাস—তার পরিচয় তো পেয়েছ ডিবরাজের বাড়িতে। আমার রক্তলোভী লাল মাকড়সা-যার দংশনে সঙ্গে সঙ্গে অবধারিত মৃত্যু-তারও পরিচয় পেয়েছ, Scolopindra গ্রুপের—
শেষের দিকে ক্রমশঃ গলার স্বরটা যেন নিজে অস্পষ্ট হয়ে আসছিল ডাঃ ওয়াংয়ের।
ওরা দুজনে মন্ত্রমুগ্ধের মত ডাঃ ওয়াংয়ের কথাগুলো শুনছিল—হঠাৎ পায়ের তলায় জলের স্পর্শ পেতেই ওরা চমকে উঠল।
রাজু, জল ঢুকতে শুরু করেছে জাহাজে! জাহাজ ড়ুবছে! চল, চল। দুজনে ছুটে কেবিন থেকে বের হয়ে এল।
হু-হু করে জল উঠছে। জল প্রায় একহাঁটু হয়ে যায়। কোনমতে ওরা দৌড়ে গিয়ে সিঁড়িতে ওঠে—তারপর ছুটে ডেকে।