একটা কথা জিজ্ঞাসা করব মিঃ রায়? সুশান্ত সহসা প্রশ্ন করে।
নিশ্চয়ই।
আপনার সন্দেহের তালিকার মধ্যে–
সুশান্তর কথাটা তাকে শেষ না করতে দিয়ে কিরীটী বলে ওঠে, শকুন্তলাও আছেন কিনা, এই তো আপনার প্রশ্ন সুশান্তবাবু? দুঃখের বিষয়, আছেন। কি জানেন সুশান্তবাবু, ক্রিমিন্যাল মাইনডেড়দের মুখের একটা-না-একটা বিশেষত্ব নিশ্চয়ই দেখতে পাবেন যদি সেই মুখগুলোর দিকে একটু ভাল করে চেয়ে দেখেন!
আপনার কথাটা কিন্তু ঠিক আমি বুঝতে পারলাম না মিঃ রায়!
পারলেন না? আচ্ছা আবার যখন ওদের মানে বৃন্দাবনবাবু, মধুসূদনবাবু ও শকুন্তলা দেবীকে দেখবেনওদের মুখের দিকে ভাল করে চেয়ে দেখবেন তো, তাদের কারও মুখের কোন বিশেষ পিকিউলিয়রিটি আপনার চোখে পড়ে কিনা?
দেখব। কিন্তু—
এটা তো বিশ্বাস করেন, মুখই হচ্ছে মানুষের মনের আয়না?
সর্বত্র না হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যে অ্যাপলিকেবল কথাটা কিছু অতিশয়োক্তি নয়। কিন্তু যাক যে কথা। একটা কাজ আপনাকে করতে হবে যে!
বলুন?
শকুন্তলা দেবীর সঙ্গে আপনাকে আলাপ জমাতে হবে।
তার মানে?
আপনার কণ্ঠস্বর শুনে মনে হচ্ছে, কাজটা যেন আপনার কাছে অত্যন্ত দুরূহ বলে ঠেকছে! কাজটা অবিশ্যি আমিই চেষ্টা করতাম কিন্তু সেটা কি যুক্তিসঙ্গত হবে, কারণ তিনিও যখন আপনার প্রতি মুগ্ধ–
মিঃ রায়, আমি মানে—
উঁহু, আপনি ভুল করছেন সুশান্তবাবু। স্রেফ আড্ডা দেওয়া বা শকুন্তলার সঙ্গে আপনাকে আমি সাধারণ আলাপ জমাতে বলছি না। উদ্দেশ্য আমার অন্য–
উদ্দেশ্য—
হ্যাঁ, তবে সেটা এখন বলব না, ক্রমশ জানতে পারবেন।
কিন্তু–
ভাবছেন সুযোগের কথা? বিমুগ্ধমনেরা পরস্পর সুযোগ আপনা থেকেই করে নেয়। সেজন্য আপনি চিন্তা করবেন না।
কিরীটী বৃন্দাবন সরকারকে বলে এসেছিল, বিকেলের দিকে আবার সে সরকার ভিলায় আসবে। কিন্তু ঐদিন বেরুতে বেশ দেরিই হয়ে গেল।
ফ্যাটি গুপ্তর জরুরী একটা চিঠি এসেছে কলকাতা থেকে, তাকে ঐদিনই বিকেলের ট্রেনে কলকাতা ফিরতে হবে, বিনয় ও সুশান্ত তাকে স্টেশনে পৌঁছে দিতে গেল, কাজেই ওদের স্টেশন থেকে না ফিরে আসা পর্যন্ত অনুরোধ জানিয়ে গেল কিরীটীকে সে যেন না বের হয়, অপেক্ষা করে।
ডাইনীর বাশী।
প্রায় সন্ধ্যার মুখোমুখি সুশান্ত ও বিনয় স্টেশন থেকে ফিরে এল।
কিরীটী বেরুবার জন্য প্রস্তুত হয়েই একটা সোফার উপর বসে ঐদিনকার সংবাদপত্রটা উল্টেপাল্টে দেখছিল। সুশান্ত ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললে, মিঃ রায়, বেরুনো যাক!
চলুন। কিরীটী উঠে দাঁড়ায়।
সরকার-ভিলার বাইরের ঘরে প্রবেশ করতেই ভৃত্য গোকুলের সঙ্গে ওদের দেখা হয়ে গেল।
এ বাড়িতেই তো তুমি কাজ কর? কিরীটী গোকুলকে শুধায়।
আজ্ঞে হ্যাঁ।
তোমার নাম কি?
কিরীটীর প্রশ্নে গোকুল জবাব দেয়, গোকুল।
বাবুদের কাউকে একবার খবর দিতে পার গোকুল, বলগে কিরীটীবাবু আর সুশান্তবাবু এসেছেন।
ছোটবাবু তো নেই, বড়বাবু আছেন। গোকুল বলে।
তাঁকেই তাহলে খবর দাও।
যান না, বড়বাবু তো বাগানেই আছেন। ঐ বারান্দার পশ্চিম দিক দিয়ে নেমে যান। গোকুল বাগানে যাবার পথটা দেখিয়ে দিল।
কিরীটী আর সুশান্ত নির্দিষ্ট পথে এগিয়ে যায়।
বারান্দার শেষপ্রান্তে পশ্চিম দিকে ছোটমত একটা গেট। গেট খুললেই তিন ধাপ সিঁড়ি নেমে গিয়েছে। এবং সিঁড়ি অতিক্রম করে পঞ্চাশ গজ গেলেই পুরোপুরি সমস্ত বাগানটা দৃষ্টির সামনে ভেসে ওঠে।
উদ্যানে যে কত প্রকারের ফল, ফুল ও পাতাবাহারের গাছ তার যেন কোন সংখ্যা নেই। ছোট বড় মাঝারি নানা আকারের সব গাছ। কোথাও গাছের নিবিড়তা ঝোপের সৃষ্টি করেছে, কোথাও দীর্ঘ ইউক্যালিপটাস গাছ, কোথাও আনারসের ঝাড়, কোথাও ক্রোটন ও পাতাবাহারের ঝোপ, কোথাও চীনা বাঁশের ঝাড়, কোথাও শুধু সারি সারি গোলাপ আর গোলাপ গাছ। লাল সাদা হলদে গোলাপী নানা রঙের নানা আকারের অজস্র গোলাপ ফুটে রয়েছে।
মুগ্ধ দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকাতে তাকাতে এগিয়ে গেল কিরীটী। আর তাকে ধীরপদে অনুসরণ করে চলে সুশান্ত।
মুগ্ধ দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে মৃদুকণ্ঠে একসময় কিরীটী বলে, অনেক সময় শ্রম ও অধ্যবসায়ই দিয়েছিলেন দেখছি মৃত সারদাবাবু তার এই উদ্যানের পিছনে, কি বলেন সুশান্তবাবু?
তাই। সত্যিই চমৎকার। ওদিকটা একটু ঘুরে দেখে আসি, বলে ডানদিকে গোলাপ বাগিচার দিকে এগিয়ে গেল সুশান্ত।
সামনেই একটা চীনা বাঁশের ঝাড়।
নাতিদীর্ঘ সরু সরু বাঁশগুলো সামান্য একদিকে যেন গুচ্ছে গুচ্ছে হেলে পড়েছে। এবং সরু চিকন পাতাগুলো হাওয়ায় সিপ সিপ শব্দ করে চলেছে একটানা। দিনান্তের শেষ বিষণ্ণ আলোয় হঠাৎ বাঁশগুচ্ছের ফাঁকে ফাঁকে ঝাড়ের উল্টোদিকে বিশেষ একটি দৃশ্য কিরীটীর দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে।
সবুজ চিকন চিকন পাতাগুলোর ফাকে পাকে পর্যপ্ত কেশের একটি অগোছাল খোঁপা ও বাসন্তীরঙের শাড়ি জড়ানো একটি পৃষ্ঠের উর্ধাংশ চোখে পড়ে।
সামনে ওদের পায়ে চলার পথটা বাঁশের ঝাড়টাকে বাঁয়ে রেখে আরও সামান্য একটু এগিয়ে বাঁয়ে বাঁক নিয়েছে।
কিরীটী মুহূর্তকাল দাঁড়িয়ে যেন কি ভাবে, তারপরই পিছনে তাকিয়ে দেখতে পেল, দূরে হাত দশেক তফাতে সুশান্ত গোলাপ বাগিচার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, কিরীটী নিঃশব্দে বাঁয়ের পথ ধরে এগিয়ে চলল।
কিরীটীর অনুমান মিথ্যা নয়।
চীনা বাঁশঝাড়ের একেবারে কোল ঘেঁষে সবুজ ঘাসের উপর পা ছড়িয়ে সামনের দিকে একাকিনী বসে শকুন্তলা।
শকুন্তলা ত্রিবেদী।
পরিধানে বাসন্তীরঙের কালো চওড়াপাড় একটি শাড়ি।
গায়ে লাল ভেলভেটের কনুই পর্যন্ত হাতা একটি ব্লাউজ।
ঠিক যেন অরণ্য দেবী বনছায়াতলে আঁচল বিছিয়ে বসে বিশ্রাম করছেন অলস শিথিল ভঙ্গীতে।
একটা কড়া উগ্র তামাকের গন্ধ কিরীটীর অভ্যস্ত ও পরিচিত নাসারন্ধ্রে এসে প্রবেশ করে। সহসা যেন আত্মচিন্তায় নিমগ্ন উপবিষ্ট শকুন্তলার কাছে গিয়ে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এবং ঐদিকে আরও একটু অগ্রসর হতেই গন্ধটা আরও স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়।
বর্মা চুরুটের পরিচিত গন্ধ। কিরীটীর ভুল হবার নয়।
এদিক ওদিক তাকাতেই অল্প দূরে ঘাসের ওপর একটি নিঃশেষিত-প্রায় বর্মা চুরুট এবারে ওর নজর পড়ে।
মৃদু হেসে মুহূর্তকাল কিরীটী আপন মনে যেন কি ভাবে। তারপর মৃদুকণ্ঠে ডাকে, শকুন্তলা দেবী।
কে?
চমকে ফিরে তাকাতেই শকুন্তলা সামনেই দণ্ডায়মান কিরীটীকে দেখতে পেয়ে একটু যেন বিস্মিত হয়েই প্রশ্ন করে, এ কি, আপনি!
হ্যাঁ। সারদাবাবুর বাগানটা ঘুরে দেখতে দেখতে এদিকে আসতেই লক্ষ্য করলাম, আপনি চুপচাপ বসে আছেন।
হ্যাঁ, এই নির্জন জায়গাটি বাগানের মধ্যে আমার খুব ভাল লাগে, তাই বিকেলের দিকে এখানে এসে প্রায়ই বসি।
যা বলেছেন, সত্যই চমৎকার জায়গাটি! কিন্তু মধুসূদনবাবুকে দেখছি না যে? তিনি কোথায়?
কিরীটীর শেষের কথায় যেন একটু চমকেই শকুন্তলা কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল এবং অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে উচ্চারণ করল, মধুসুদনবাবু।
হ্যাঁ, ঐ যে গোকুল বলল, তিনি নাকি বাগানেই আছেন?
তা—তা হবে। আমি তো দেখিনি।
তাহলে বোধ হয় অন্যদিকে কোথাও আছেন! হা ভাল কথা, বৃন্দাবনবাবুর আজ কলকাতায় ফিরে যাবার কথা ছিল, গেছেন নাকি চলে তিনি কলকাতায়?
হ্যাঁ, বিকেলের ট্রেনেই চলে গেলেন।
আপনার নির্জন বিশ্রামে ব্যাঘাত করছি না তো শকুন্তলা দেবী?
না, না-ব্যাঘাত কিসের আবার! আপনি বুঝি একলাই এসেছেন?
কেন বলুন তো?
না—এমনিই জিজ্ঞাসা করছিলাম।