এই ভূমধ্যসাগর-প্রান্ত—যে ইওরোপী সভ্যতা এখন বিশ্বজয়ী, তার জন্মভূমি। এই তটভূমিতে মিশরী, বাবিলী, ফিনিক, য়াহুদী প্রভৃতি সেমিটিক জাতিবর্গ ও ইরানী, যবন, রোমক প্রভৃতি আর্যজাতির সংমিশ্রণে বর্তমান ইওরোপী সভ্যতা।
‘রোজেট্টা স্টোন’২৩ নামক একখণ্ড বৃহৎ শিলালেখ মিসরে পাওয়া যায়। তার উপর জীবজন্তুর লাঙ্গুল ইত্যাদি রূপ চিত্রলিপিতে২৪ লিখিত এক লেখ আছে, তার নীচে আর এক প্রকার লেখ, সকলের নিম্নে গ্রীক ভাষার অনুযায়ী লেখ। একজন পণ্ডিত ঐ তিন লেখ-কে এক অনুমান করেন। কপ্ত (Copts) নামক যে ক্রিশ্চান জাতি এখনও মিসরে বর্তমান এবং যারা প্রাচীন মিসরীদের বংশধর বলে বিদিত, তাদের লেখের সাহায্যে তিনি এই প্রাচীন মিসরী লিপির উদ্ধার করেন। ঐরূপ বাবিলদের ইঁট এবং টালিতে খোদিত ভল্লাগ্রের ন্যায় লিপিও ক্রমে উদ্ধার হয়। এদিকে ভারতবর্ষের লাঙ্গলাকৃতি কতকগুলি লেখ মহারাজা অশোকের সমসাময়িক লিপি বলে আবিষ্কৃত হয়। এতদপেক্ষা প্রাচীন লিপি ভারতবর্ষে পাওয়া যায় নাই। মিসরময় নানা প্রকার মন্দির, স্তম্ভ, শবাধার ইত্যাদিতে যে সকল চিত্রলিপি লিখিত ছিল, ক্রমে সেগুলি পঠিত হয়ে প্রাচীন মিসরতত্ত্ব বিশদ করে ফেলেছে।
মিসরীরা সমুদ্রপার ‘পুন্ট্’ (Punt) নামক দক্ষিণ দেশ হতে মিসরে প্রবেশ করেছিল। কেউ কেউ বলেন যে, ঐ ‘পুন্ট্’-ই বর্তমান মালাবার, এবং মিসরীরা ও দ্রাবিড়িরা এক জাতি। এদের প্রথম রাজার নাম ‘মেনুস’(Menes)। এদের প্রাচীন ধর্মও কোন কোন অংশে আমাদের পৌরাণিক কথার ন্যায়। ‘শিবু’ (Shibu) দেবতা ‘নুই’-কে (Nui) দেবীর দ্বারা আচ্ছাদিত হয়েছিলেন, পরে আর এক দেবতা ‘শু’ (Shu) এসে বলপূর্বক ‘নুই’-কে তুলে ফেললেন। ‘নুই’র শরীর আকাশ হল, দুহাত আর দুপা হল সেই আকাশের চার স্তম্ভ। আর ‘শিবু’ হলেন পৃথিবী। ‘নুই’র পুত্র-কন্যা ‘অসিরিস’ আর ‘ইসিস’—মিসরের প্রধান দেব-দেবী এবং তাঁদের পুত্র ‘হোরস্’ সর্বোপাস্য। এই তিনজন একসঙ্গে উপাসিত হতেন। ‘ইসিস’ আবার গো-মাতা রূপে পূজিত।
পৃথিবীতে ‘নীল’ নদের ন্যায়, আকাশে ঐ প্রকার নীলনদ আছেন—পৃথিবীর নীলনদ তাঁহার অংশ মাত্র। সূর্যদেব এদের মতে নৌকায় করে পৃথিবী পরিভ্রমণ করেন; মধ্যে মধ্যে ‘অহি’ নামক সর্প তাঁকে গ্রাস করে, তখন গ্রহণ হয়।
চন্দ্রদেবকে এক শূকর মধ্যে মধ্যে আক্রমণ করে এবং খণ্ড খণ্ড করে ফেলে, পরে পনর দিন তাঁর সরাতে লাগে। মিসরের দেবতাসকল কেউ শৃগালমুখ, কেউ বাজের মুখযুক্ত, কেউ গোমুখ ইত্যাদি।
সঙ্গে সঙ্গেই ইউফ্রেটিস-তীরে আর এক সভ্যতার উত্থান হয়েছিল, তাদের মধ্যে ‘বাল’, ‘মোলখ’, ‘ইস্তারত’ ও ‘দমুজি’২৫প্রধান। ইস্তারত দমুজি-নামক মেষপালকের প্রণয়ে আবদ্ধ হলেন। এক বরাহ দমুজিকে মেরে ফেললে। পৃথিবীর নীচে পরলোকে ইস্তারত দমুজির অন্বেষণে গেলেন। সেথায় ‘আলাৎ’ নামক ভয়ঙ্করী দেবী তাঁকে বহু যন্ত্রণা দিলে। শেষে ইস্তারত বললেন যে, আমি দমুজিকে না পেলে মর্ত্যলোকে আর যাব না। মহা মুশকিল; উনি হলেন কামদেবী, উনি না এলে মানুষ, জন্তু, গাছপালা আর কিছুই জন্মাবে না। তখন দেবতারা সিদ্ধান্ত করলেন যে, প্রতি বৎসর দমুজি চার মাস থাকবেন পরলোকে—পাতালে, আর আট মাস থাকবেন মর্ত্যলোকে। তখন ইস্তারত ফিরে এলেন—বসন্তের আগমন হল, শস্যাদি জন্মাল।
এই ‘দমুজি’ আবার ‘আদুনোই’ বা ‘আদুনিস’২৬ নামে বিখ্যাত। সমস্ত সেমিটিক জাতিদের ধর্ম কিঞ্চিৎ অবান্তরভেদে প্রায় এক রকমই ছিল। বাবিলী, য়াহুদী, ফিনিক ও পরবর্তী আরবদের একই প্রকার উপাসনা ছিল। প্রায় সকল দেবতারই নাম ‘মোলখ’ (যে শব্দটি বাঙলা ভাষতে মালিক, মুল্লুক ইত্যাদি রূপে এখনও রয়েছে) অথবা ‘বাল’, তবে অবান্তরভেদ ছিল। কারও কারও মত—এ ‘আলাৎ’ দেবতা পরে আরবিদিগের আল্লা হলেন। এই সকল দেবতার পূজার মধ্যে কতকগুলি ভয়ানক ও জঘন্য ব্যাপারও ছিল। মোলখ বা বালের নিকট পুত্রকন্যাকে জীবন্ত পোড়ানো হত। ইস্তরতের মন্দিরে স্বাভাবিক ও অস্বাভাবিক কামসেবা প্রধান অঙ্গ ছিল।
য়াহুদী জাতির ইতিহাস বাবিল অপেক্ষা অনেক আধুনিক। পণ্ডিতদের মতে ‘বাইবেল’ নামক ধর্মগ্রন্থ খ্রীঃ পূঃ ৫০০ হতে আরম্ভ হয়ে খ্রীঃ পর পর্যন্ত লিখিত হয়। বাইবেলের অনেক অংশ যা পূর্বের বলে প্রথিত, তা অনেক পরের। এই বাইবেলের মধ্যে স্থূল কথাগুলি ‘বাবিল’ জাতির। বাবিলদের সৃষ্টিবর্ণনা, জলপ্লাবনবর্ণনা অনেক স্থলে বাইবেল গ্রন্থে সমগ্র গৃহীত। তার উপর পারসী বাদশারা যখন এশিয়া মাইনরের উপর রাজত্ব করতেন, সেই সময় অনেক ‘পারসী’ মত য়াহুদীদের মধ্যে প্রবেশ করে। বাইবেলের প্রাচীন ভাগের মতে এই জগৎই সব—আত্মা বা পরলোক নাই। নবীন ভাগে পারসীদের পরলোকবাদ, মৃতের পুনরুত্থান ইত্যাদি দৃষ্ট হয়; এবং শয়তানবাদটি একেবারে পারসীদের।
য়াহুদীদের ধর্মের প্রধান অঙ্গ ‘য়াভে’ নামক ‘মোলখের’২৭ পূজা। এই নামটি কিন্তু য়াহুদী ভাষার নয়, কারও কারও মতে ঐটি মিসরী শব্দ। কিন্তু কোথা থেকে এল, কেউ জানে না। বাইবেলে বর্ণনা আছে যে, য়াহুদীরা মিসরে আবদ্ধ হয়ে অনেকদিন ছিল—সে সব এখন কেউ বড় মানে না এবং ‘ইব্রাহিম’, ‘ইসহাক’, ‘ইয়ুসুফ’ প্রভৃতি গোত্রপিতাদের রূপক বলে প্রমাণ করে।
য়াহুদীরা ‘য়াভে’ এ নাম উচ্চারণ করত না, তার স্থানে ‘আদুনোই’ বলত। যখন য়াহুদীরা ইস্রেল আর ইফ্রেম২৮ দুই শাখায় বিভক্ত হল, তখন দুই দেশে দুটি প্রধান মন্দির নির্মিত হল। জেরুসালেমে ইস্রেলদের যে মন্দির নির্মিত হল, তাতে ‘য়াভে’ দেবতার একটি নরনারী সংযোগমূর্তি এক সিন্দুকের মধ্যে রক্ষিত হত। দ্বারদেশে একটি বৃহৎ পুংচিহ্ন স্তম্ভ ছিল। ইফ্রেমে ‘য়াভে’ দেবতা—সোনামোড়া বৃষের মূর্তিতে পূজিত হতেন।
উভয় স্থানেই জ্যেষ্ঠ পুত্রকে দেবতার নিকট জীবন্ত অগ্নিতে আহুতি দেওয়া হত এবং একদল স্ত্রীলোক ঐ দুই মন্দিরে বাস করত; তারা মন্দিরের মধ্যেই বেশ্যাবৃত্তি করে যা উপার্যন করত, তা মন্দিরের ব্যয়ে লাগত।
ক্রমে য়াহুদীদের মধ্যে একদল লোকের প্রাদুর্ভাব হল; তাঁরা গীত বা নৃত্যের দ্বারা আপনাদের মধ্যে দেবতার আবেশ করতেন। এঁদের নাম নবী বা Prophet (ভাববাদী)। এদের মধ্যে অনেকে ইরানীদের সংসর্গে মূর্তিপূজা, পুত্রবলি, বেশ্যাবৃত্তি ইত্যাদির বিপক্ষ হয়ে পড়লেন। ক্রমে বলির জায়গায় হল ‘সুন্নত’; বেশ্যাবৃত্তি, মূর্তি আদি ক্রমে উঠে গেল; ক্রমে ঐ নবী-সম্প্রদায়ের মধ্য হতে ক্রিশ্চান ধর্মের সৃষ্টি হল।
‘ঈশা’ নামক কোন পুরুষ কখনও জন্মেছিলেন কিনা, এ নিয়ে বিষম বিতণ্ডা। ‘নিউ টেষ্টামেণ্টের’ যে চার পুস্তক, তার মধ্যে ‘সেণ্ট-জন’ নামক পুস্তক তো একেবারে অগ্রাহ্য হয়েছে। বাকী তিনখানি—কোন এক প্রাচীন পুস্তক দেখ লেখা, এই সিদ্ধান্ত; তাও ‘ঈশা’- হজরতের যে সময় নির্দিষ্ট আছে, তার অনেক পরে।
তার উপর যে সময় ঈশা জন্মেছিলেন বলে প্রসিদ্ধি, সে সময় ঐ য়াহুদীদের মধ্যে দুইজন ঐতিহাসিক জন্মেছিলেন—‘জোসিফুস্’ আর ‘ফিলো’২৯। এঁরা য়াহুদীদের মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সম্প্রদায়েরও উল্লেখ করেছেন, কিন্তু ঈশা বা ক্রিশ্চানদের নামও নাই; অথবা রোমান জজ তাঁকে ক্রুশে মারতে হুকুম দিয়েছিল, এর কোন কথাই নাই। জোসিফুসের পুস্তকে এক ছত্র ছিল, তা এখন প্রক্ষিপ্ত বলে প্রমাণ হয়েছে।
রোমকরা ঐ সময়ে য়াহুদীদের উপর রাজত্ব করত, গ্রীকরা সকল বিদ্যা শেখাত। এঁরা সকলেই য়াহুদীদের সম্বন্ধে অনেক কথাই লিখেছেন, কিন্তু ঈশা বা ক্রিশ্চানদের কোন কথাই নাই।
আবার মুশকিল যে, যে সকল কথা, উপদেশ বা মত নিউ টেষ্টামেণ্ট গ্রন্থে প্রচার আছে, ও-সমস্তই নানা দিগ্দেশ হতে এসে খ্রীষ্টাব্দের পূর্বেই য়াহুদীদের মধ্যে বর্তমান ছিল এবং ‘হিলেল্’৩০ প্রভৃতি রাব্বিগণ (উপদেশক) প্রচার করেছিলেন। পণ্ডিতরা তো এইসব বলছেন, তবে অন্যের ধর্ম সম্বন্ধে—যেমন সাঁ করে এক কথা বলে ফেলেন, নিজেদের দেশের ধর্ম সম্বন্ধে তা বললে কি আর জাঁক থাকে? কাজেই শনৈঃ শনৈঃ যাচ্ছেন। এর নাম ‘হায়ার ক্রিটিসিজম্’ (Higher Criticism)।
পাশ্চাত্য বুধমণ্ডলী এই প্রকার দেশ-দেশান্তরের ধর্ম, নীতি, জাতি ইত্যাদির আলোচনা করছেন। আমাদের বাঙলা ভাষায় কিছুই নাই। হবে কি করে?—এক বেচারা ১০ বৎসর হাড়গোড়ভাঙা পরিশ্রম করে যদি এই রকম একখানা বই তর্জমা করে তো সে নিজেই বা খায় কি, আর বই বা ছাপায় কি দিয়ে?
একে দেশ অতি দরিদ্র, তাতে বিদ্যা একেবারে নেই বললেই হয়। এমন দিন কি হবে যে, আমরা নানাপ্রকার বিদ্যার চর্চা করব? ‘মূকং করোতি বাচালং পঙ্গুং লঙ্ঘয়তে গিরিম্, যৎ কৃপা … !’—মা জগদম্বাই জানেন।
জাহাজ নেপল্সে লাগল—আমরা ইতালীতে পৌঁছুলাম। এই ইতালীর রাজধানী রোম! এই রোম, সেই প্রাচীন মহাবীর্য রোম সাম্রাজ্যের রাজধানী—যার রাজনীতি, যুদ্ধবিদ্যা, উপনিবেশ-সংস্থাপন, পরদেশ-বিজয় এখনও সমগ্র পৃথিবীর আদর্শ!
নেপল্স ত্যাগ করে জাহাজ মার্সাইতে লেগেছিল, তারপর একেবারে লণ্ডন।
ইওরোপ সম্বন্ধে তোমাদের তো নানা কথা শোনা আছে—তারা কি খায়, কি পরে, কি রীতিনীতি আচার ইত্যাদি—তা আর আমি কি বলব! তবে ইওরোপী সভ্যতা কি, এর উৎপত্তি কোথায়, আমাদের সঙ্গে এর কি সম্বন্ধ, এ সভ্যতার কতটুকু আমাদের লওয়া উচিত—এসব সম্বন্ধে অনেক কথা বলবার রইল। শরীর কাউকে ছাড়ে না ভায়া, অতএব বারান্তরে সেসব কথা বলতে চেষ্টা করব। অথবা বলে কি হবে? বকাবকি বলা-কওয়াতে আমাদের (বিশেষ বাঙালীর) মত কে বা মজবুত? যদি পার তো করে দেখাও। কাজ কথা কউক, মুখকে বিরাম দাও। তবে একটা কথা বলে রাখি, গরীব নিম্নজাতিদের মধ্যে বিদ্যা ও শক্তির প্রবেশ যখন থেকে হতে লাগল, তখন থেকেই ইওরোপ উঠতে লাগল। রাশি রাশি অন্য দেশের আবর্জনার ন্যায় পরিত্যক্ত দুঃখী গরীব আমেরিকায় স্থান পায়, আশ্রয় পায়; এরাই আমেরিকার মেরুদণ্ড! বড়মানুষ, পণ্ডিত, ধনী—এরা শুনলে বা না শুনলে, বুঝলে বা না বুঝলে, তোমাদের গাল দিলে বা প্রশংসা করলে কিছুই এসে যায় না; এঁরা হচ্ছেন শোভামাত্র, দেশের বাহার। কোটি কোটি গরীব নীচ যারা, তারাই হচ্ছে প্রাণ। সংখ্যায় আসে যায় না, ধন বা দারিদ্র্যে আসে যায় না; কায়-মন-বাক্য যদি এক হয়, একমুষ্টি লোক পৃথিবী উল্টে দিতে পারে—এই বিশ্বাসটি ভুলো না। বাধা যত হবে, ততই ভাল। বাধা না পেলে কি নদীর বেগ হয়? যে জিনিষ যত নূতন হবে, যত উত্তম হবে, সে জিনিষ প্রথম তত অধিক বাধা পাবে। বাধাই তো সিদ্ধির পূর্ব লক্ষণ। বাধাও নাই, সিদ্ধিও নাই। অলমিতি।