আমার গাড়িটা আজ ক’দিন হতে বিগড়ে আছে, অগত্যা বাসে চেপেই অরুণ করের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে চললাম। রাত্রি তখন সাড়ে আটটা হবে, গ্রে সন্টীটের মোড়ে বাস থেকে নামলাম। অরুণ করের দেওয়া ঠিকানা মত র্তার বাড়িটা খুঁজে নিতে আমার বিশেষ কোন বেগ পেতে হল না। ট্রাম রাস্তার পিছনে একটা গলির মধ্য দিয়ে একটু এগিয়ে গেলে অরুণ করের বাড়ি। চমৎকার আধুনিক প্যাটানের কংক্রীটের তৈরী মাঝারি গোছের একখানা দ্বিতল স্বাড়ি; লোহার গেট পার হলেই সামানেই একটা ‘লন’—লাল সুরকি ঢালা রাস্ত বরাবর দরজা পর্যন্ত গেছে; দু’পাশে কেয়ারী করা মেহেদির বেড়া ও নানাজাতীয় প্রচুর মরসুমী ফুলের সৌন্দর্যের সমারোহ। তারপরই সাদা ধবধবে বাড়িখানি একটা সুমিষ্ট ফুলের গন্ধ বাতাসে ভাসিয়ে আনে।
করিডোরের সামনেই বোধ করি ড্রয়িং রুম। সূক্ষ্ম সিঙ্কের নেটের সবুজ পর্দা ভেদ করে ঘরের আলোর আভাস এদিকে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
ড্রয়িং রুমে নিশ্চয় কারা বসে আছে মনে হল আমার, কারণ মৃদু কথা-বার্তার শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
সহসা একটা তীক্ষা গলার স্বর শোনা গেল, না, না—এ আমি সহ্য করব না। কিছুতেই সহ্য করব না। বুঝে দেখ অরুণ, ভেবে দেখ!
চমকে উঠলাম। প্রফেসর শর্মার গলা। থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম।
ম্রিয়মাণ কণ্ঠস্বরে অতি কষ্টে অরুণবাবু যেন জবাব দিলেন, কেন এই নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন মিঃ শৰ্মা? এর চাইতে একটুও বেশী আমি জানি না। আর জানতামও না।
তাহলে এই আমাকে বিশ্বাস করতে হবে, কর?
হ্যাঁ। কিন্তু প্রফেসার এবারে আপনাকে যেতে হবে। আমার একজন বন্ধুর এখানে আজ রাত্রে নিমন্ত্রণ আছে। হয়তো এখুনি তিনি এসে পৌঁছবেন।
আমি এগিয়ে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিলাম।
ভিতর থেকে আহ্বান এল, আসুন ভিতরে।
ভিতরে প্রবেশ করে দেখলাম, চমৎকার আধুনিক কেতায় সুসজ্জিত একখানি ড্রয়িং রুম, চারদিকে সোফা-কাউচ। মাঝখানে একটা শ্বেতপাথরের টেবিলে প্রকাণ্ড একটা জয়পুরী ফ্লাওয়ার ভাসে এক থোকা শুভ্র রজনীগন্ধা। বাতাসে তার মিষ্ট গন্ধ ছড়িয়ে দিচ্ছে।
আসুন, আসুন সুব্রতবাবু। অরুণবাবু বললেন, এঁকে চেনেন তো? প্রফেসার কালিদাস শৰ্মা—আমার বিশেষ বন্ধু।
হ্যাঁ, চিনি বৈকি।
নমস্কার সুব্রতবাবু। তারপর প্রফেসার নিঃশব্দে টুপিটা হাতে তুলে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, আচ্ছা শুভরাত্রি অরুণ, শুভরাত্রি সুব্রতবাবু! আমার গাড়ি গলির মুখেই আছে, আমি পিছনের দরজা দিয়েই চললাম।
প্রফেসার নিঃশব্দে বের হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ অরুণবাবু চুপচাপ বসে রইলেন, তারপর হঠাৎ একসময় বললেন, চা আনতে বলি সুব্রতবাবু?
না, থাক। এত রাত্রে আর চা খাব না।
আপনিও একজন ডিটেকটিভ, না সুব্রতবাবু?
না।
ভয়ঙ্কর চরিত্রের লোকগুলোকে আমার চিরকালই খুব ভাল লাগে, জানেন সুব্রতবাবু।
কেন বলুন তো?
আমার কথার কোন জবাব দিলেন না। অরুণবাবু, চুপচাপ বসে রইলেন, তারপর সহসা একসময় বললেন, চলুন, পিছনের বাগানে আমাদের খাবার আয়োজন করেছি। বাগানের মধ্যে টেবিল-চেয়ার পাতা, মাথার উপর চীনা-লণ্ঠনের পীতাভ আলো। চলুন। চমৎকার আইডিয়া, না?
আমরা দুজনেই উঠলাম।
বাড়ির পিছনে ছোটখাটো একটি ফুলের ও ফলের বাগান আছে। একটা কামিনী গাছের তলায় টেবিল-চেয়ার পেতে খাবার আয়োজন করা হয়েছে।
শীতের রাত্রে এই খোলা বাগানে বসে খাওয়া…হাসি পাচ্ছিল। মাথার ওপরে গাছের ডালে ঝুলছে গোটাচারেক চীনা-লণ্ঠন। একটা পীতাভ আলোয় চারিদিক যেন স্বপ্নাতুর হয়ে উঠেছে।
এও এক অভিজ্ঞতা।
বাবুর্চি এসে টেবিলে খাবার দিয়ে গেল। গল্প করতে করতে আমরা খাওয়া শুরু করলাম। কথায় কথায় সাহিত্য নিয়ে তর্ক উঠল।
অরুণবাবু বলতে লাগলেন, রূপকথা পড়তে আমার বড় ভাল লাগে সুব্রতবাবু, একজন বন্ধুর মুখে একদিন আমি ‘সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে, রূপকথাটা শুনেছিলাম, বন্ধু আমাকে বইখানা এনে দেবেও বলেছিল। এনেও দিয়েছিল, অথচ বইখানা হিন্দীতে অনুদিত। উঃ, কি বিচ্ছিরি ঐ হিন্দী ভাষাটা! আমি দুচক্ষে দেখতে পারি না। শেষটা আমি নিজেই একটা বাংলায় লেখা বই কিনি।
অরুণ করের কথায় আমার সহসা যেন তরতর করে দেহের সমস্ত রক্ত মাথায় গিয়ে উঠেছে বলে মনে হতে লাগল। তারপর আবার একসময় আত্মগতভাবেই তিনি বলতে লাগলেন, মানুষ মরেই, তার জন্য দুঃখ নেই। কিন্তু আমি গোলমাল ভালবাসি না। শান্তি চাই। সম্পূর্ণ শান্তি।
খাওয়া-দাওয়া শেষ হবার পর আমারা দুজনে বাগানে নানা গল্প করতে করতে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। মাথার উপরে নিঃশব্দ শীতের রাত্রি। রাতের চোরা হাওয়ায় বাগানের গাছপালার পাতায় পাতায় মাঝে মাঝে সিপি সিপ শব্দ জাগে। চারিদিকে একটা অদ্ভুত থমথমে ভাব।
বাগানের এক দিকে কৃত্রিম ফোয়ারা থেকে ঝিরঝির করে জল পড়ছে। ফোয়ারার চার পাশ শ্বেতপাথরে গোল করে বাধানো।
ক্ষীণ অষ্টমীর চীদ মৃদু আলো বিকীরণ করছে শীতের আকাশের গায়ে। একটা বড় শিশু গাছের তলায় আসতেই সহসা অরুণবাবু পায়ে কি বেধে হোঁচটি খেয়ে পড়ে যেতে যেতে উঃ বলে নিজেকে যেন কোনমতে সামলে নিলেন।
আমি শশব্যস্ত তাঁকে ধরে সামলাতে গিয়ে মৃদু চাঁদের আলোয় সামনের দিকে চেয়ে বিস্ময়ে আতঙ্কে নির্বক হয়ে গেলাম। রক্তাক্ত একটা মৃতদেহ বাগানের মধ্যে ঘাসের ওপর উপুর হয়ে পড়ে আছে। গলাটা ধড় থেকে প্রায় দু ভাগ হয়ে এসেছে সামান্যর জন্য একেবারে পৃথক হয়নি।
সেই অস্পষ্ট আলো আঁধারিতেও চিনতে আমাদের কষ্ট হয়নি মৃতদেহটি কার। মৃতদেহটি প্রফেসার কালিদাস শর্মার।
একটা আর্ত চিৎকার করে হঠাৎ অরুণবাবু অজ্ঞান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।
অদৃশ্য আততায়ীর মরণ পরশ আবার নিঃশব্দে একজনকে গ্রাস করল।
উঃ কী ভয়ানক দৃশ্য! কী নিষ্ঠুর হত্যা! কী দানবীয় কাণ্ড!
একটা অশরীরী আতঙ্ক যেন মৃদু পদবিক্ষেপে বাগানের গাছের আড়ালে আড়ালে অন্ধকারে এগিয়ে আসছে। প্রথমটায় বেশ একটু যেন হকচকিয়েই গিয়েছিলাম, তারপর ঝরনা থেকে জল এনে জ্ঞানহীন অরুণবাবুর চোখে-মুখে ঝাপটা দিতে লাগলাম; কিছুক্ষণ বাদে অরুণবাবুর জ্ঞান ফিরে এল। তারপর অরুণবাবু খানিকটা সময় গুম হয়ে বসে থেকে একসময় হঠাৎ পাগলের মতই হাঃ হাঃ করে অদ্ভুতভাবে হাসতে শুরু করলেন।
উঃ, সে কী তীব্ৰ হাসি! কবর ভেঙে যেন কোন অশরীরী প্রেতাত্মা এসে এখানে উন্মাদের মত হাসছে।
আমি অরুণবাবুর হাত ধরে প্রবল এক ঝাকুনি দিয়ে বললাম, কী হাসছেন পাগলের মত! থামুন, থামুন অরুণবাবু! অরুণবাবু, শুনছেন? আপনি কি পাগল হলেন? অরুণবাবু পূর্বের মতই উন্মাদ হাসি হাসতে হাসতে অদূরে একটা ঝোপের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলতে লাগলেন, আমি দেখেছি তাকে সন্ধ্যাবেলা ঐ ঝোপের ধারে। আমি দেখেছি। জানি সে কে। সে মরে গিয়েও আমাদের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছিল। প্ৰতিহিংসা! প্রতিহিংসা! হাঃ হাঃ হাঃ!
আঃ, অরুণবাবু! থামাবেন আপনার হাসি?
এবারে যেন অরুণ করা হঠাৎ হাসি থামিয়ে ফেললেন।
থেমেছি। আর হাসব না। কিন্তু আমি জানতাম যে সে মরবে। কিন্তু আমার বাড়িতেই বাগানের মধ্যে এমনি করে নিজেকে নিজে হত্যা করল!
কী পাগলের মত বকছেন যা-তা? আত্মহত্যা করলে মাথা ওরকম দেহ থেকে প্রায় পৃথক হয়ে আসতে পারে নাকি?
সহসা যেন অরুণবাবু আমার কথায় চমকে উঠলেন। কী বললেন সুব্রতবাবু…তবে সতি্যু কি সে আত্মহত্যা করেনি? তবে কে তাকে এত রাত্রে খুন করে গেল আমন করে? সে নিজে নিজেকে তবে হত্যা করেনি? খুন করেছে। ওকে! না, না, আত্মহত্যা করেছে ও; হ্যাঁ, আত্মহত্যাই করেছে, আপনি জানেন না।
না। আত্মহত্যা নয়, কেউ খুনই করেছে। ভাল করে দেখুন না।
তবে কে হত্যা করলে তাকে আমন করে? কে? কে?
তা কী করে জানিব? নিশ্চয়ই কেউ করেছে।
সহসা যেন অরুণবাবুর সমস্ত মুখখানা রক্তহীন পাংশু হয়ে গেল। অর্থহীন দৃষ্টিতে অদূরে অন্ধকার ঝোপের দিকে তাকিয়ে রইলেন। অদূরে ঝোপের অন্ধকারে হঠাৎ একটা যেন সিগারেটের লাল আগুন দেখা গেল। সঙ্গে সঙ্গে পায়ের শব্দও শুনতে পেলাম যেন। তারপরই পরিচিত গলার আওয়াজ কানো এল।
সুব্রত, এখানে উপস্থিত থেকেও তুমি এমন করে খুন হতে দিলে? একটু বাধা দিতে त्र्ङ्ग(ब्ल नां?
কালো সার্জের সুট পরা, সিগারেট ফুকতে ফুকতে ঝোপের আড়াল থেকে ধীরপদে কিরিটী বের হয়ে এসে আমাদের সামনে দাঁড়াল।
কিরীটী, তুমি এখানে! অস্ফুট কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম, হত্যাকারীকে তাহলে তুমি দেখতে পেয়েছ নিশ্চয়ই?
না, দেখিনি। কিন্তু অরুণবাবু অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, আগে ওঁকে ঘরে নিয়ে যাও। তারপর বলছি কেমন করে এখানে এলাম।
আমি অরুণবাবুকে তখন চাকরীদের সাহায্যে তীর শোবার ঘরে পৌঁছে দিলাম।
কিরীটীও পিছনে পিছনে এসে ঘরে ঢুকল।–বেচারী অত্যন্ত আঘাত পেয়েছেন এবং অসুস্থও হয়ে পড়েছেন। পাশের ঘরে ফোন আছে, একজন ডাক্তারকে ফোন করে দাও আগে সুব্রত। ইতিমধ্যে আমি একবার বাইরেটা ঘুরে আসি। ওঁর শ্বাসপ্রশ্বাস যে রকম ভাবে পড়ছে, এখুনি একজন ডাক্তার ডাকা দরকার!
কিরীটী ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল। আমি অরুণবাবুর পাশেই বসে রইলাম।
একসময়ে চেয়ে দেখি, অরুণবাবু ক্লান্তিভরে ঘুমিয়ে পড়েছেন।
পাশের ঘরেই টেলিফোন ছিল, গাইড দেখে একজন ডাক্তারকে কল দিলাম, তারপর কিরীটির খোঁজে বাইরে গেলাম।
বাগানে ঢুকে দেখি অন্ধকারে টর্চের আলো ফেলে কিরীটী বাগানের মধ্যে কিসের সন্ধানে যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে।
পদশব্দে কিরীটী আমার সামনে এসে দাঁড়াল। অস্থির অসংযত চাপা স্বরে বললে, উঃ সুব্রত, আমি একটা আস্ত গাধা! সত্যি বলছি, আমি একটা গাধা। আমি ভুল লোককে পাহারা দিচ্ছিলাম এতক্ষণ। সত্যি এ ভুলের প্রায়শ্চিত্ত নেই। কিন্তু কাল রাত্রেও আমি জানতাম না সত্যিকারের খুনী কে। আমি তোমার কাছে প্রতিজ্ঞা করছি সুব্রত, কাল রাত্রের আগেই খুনীকে আমি ধরিয়ে দেব। আর তা যদি না পারি, আমি কিরীটী রায়ই নই। এস। উত্তেজনায়। কিরীটীর কণ্ঠস্বর শেষের দিকে যেন কাঁপাছিল।
কিছু বুঝতে পারলে? আমি প্রশ্ন করলাম।
এস তোমাকে দেখাই।
চল।
আমরা দুজনে মৃতদেহের কাছে দাঁড়ালাম বাগানে।
কিরীটী বলতে লাগল, ভাল করে চেয়ে দেখ, অস্ত্ৰ দিয়ে গলা কেটে একে খুন করা হয়নি। প্রথমে কেউ প্রফেসারকে দুবার ছোরা মেরেছে, একবার পিছন দিকে পিঠে, আর একবার পাশের পাঁজরায়। তারপর কোন ধারালো অস্ত্ৰ দিয়ে দেহ থেকে মাথাটা পৃথক করে ফেলেছে। চেয়ে দেখ, দুটি কশেরুকার (vertibra) মধ্যবর্তী তরুণাস্থির (cartillage) মধ্য দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। সাধারণ লোক এভাবে আঘাত করতে পারে না। যে আঘাত করেছে, মানবদেহের গঠন-প্ৰণালী সম্পর্কে তার সম্পূর্ণ জ্ঞান আছে। অস্ত্রবিদ্যায় (surgery) সুপণ্ডিত না হলে এভাবে হত্যা করা একেবারেই অসম্ভব। আর wound দেখে মনে হয় এক ইঞ্চি পরিমাণ চওড়া কোন ভারী অস্ত্ৰ দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। অনেকটা বৰ্মার একপ্রকার অস্ত্রের মত। তারপর কিরীটী টর্চের আলো ফেলে দেখােল, ঐ যে সরু রাস্তাটা বরাবর বাগানের মধ্য দিয়ে বাগানের পিছনের দরজা পর্যন্ত গেছে, দেখ ওখানে রক্তের দাগ রয়েছে। খুব সম্ভব দরজার কাছাকাছি কোথাও দাঁড়িয়ে জানালা-পথে প্রফেসার তোমাদের লক্ষ্য করেছিলেন, এমন সময় হত্যাকারী পিছনের দরজা দিয়ে এসে পিছন থেকে প্রফেসারকে ছোরা বসায় পিঠে। ছোরার আঘাত খেয়ে প্রফেসার সামনের দিকে চলে আসেন। সেই সময় পিছন থেকে হত্যাকারী হতভাগ্যের গলা কেটে ফেলবার চেষ্টা করে।
উঃ আর কয়েক সেকেণ্ড আগেও যদি বাগানে আসতাম। কিরীটী, তবে হত্যাটা হত না। কিন্তু আশ্চর্য কোন চিৎকার বা শব্দও তো শুনতে পাইনি! দুঃখিত স্বরে বললাম।
পাওনি তার কারণ আহত ব্যক্তি চিৎকার করবারও সময় পায়নি—it was so sudden! কিন্তু সে কথা থাক। যা হয়ে গেছে তার জন্য দুঃখ করে লাভ নেই। চল আর একবার সব ঘুরে ভাল করে দেখা যাক।
বাগানের পিছনের দরজা দিয়ে গলিপথে এসে দাঁড়ালাম দুজনে।
সামনেই একটা পোড়ো মাঠ। তার ওদিকে কতকগুলো খোলার বস্তি।
অনেক দূরে দূরে এক-একটা কেরোসিনের বাতি জ্বলছে। সাধারণতঃ এই অপ্রশস্ত পথটা কুলি-কামিন ছাড়া আর কারও দ্বারা ব্যবহৃত হয় না।
গতরাত্রে বৃষ্টি হয়েছিল, তাই এই গলিপথের কাদা এখনও শুকোয়নি। ঐ দেখ অন্ধকারে এখনও প্রফেসারের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আমি জানতাম খুনী আজ এখানে আসবে, কিন্তু কেন? খুনী এখানে নিশ্চয়ই কোন ট্যাক্সিতে চেপে এসেছে, কিন্তু বাগানের দরজা পর্যন্ত আসেনি। পাছে তার ড্রাইভারের মনে কোনপ্রকার সন্দেহ জাগে। চল, এগিয়ে গিয়ে দেখা
কিছুদূর এগিয়ে যাবার পরই আমরা গাড়ির চাকার দাগ দেখতে পেলাম ভিজে রাস্তার ওপর। তাহলে কিরীটীর অনুমান মিথ্যা নয়!
কিরীটী আবার বলতে লাগল, আজ রাত্রে খুনী যখন এখানে আসে তখন সে প্রস্তুত হয়েই এসেছিল; কিন্তু যে অস্ত্ৰ দিয়ে সে হত্যা করেছে সেটা রক্তাক্ত অবস্থায় সঙ্গে নিয়ে যায়নি, পাছে ড্রাইভারের মনে সন্দেহ জাগে। ফেলে রেখে গেছে সে সেটা নিশ্চয়ই, কিন্তু কোথায়? চল বাগানটা খুঁজে দেখি। থানায় খোঁজ নিলেই ট্যাক্সি এসোসিয়েশন থেকে আজ এমন সময় কোন ট্যাক্সি ভাড়া করা হয়েছিল। কিনা অনায়াসেই জানতে পারব।
সত্যিই বাগানে খুঁজতে খুঁজতে একটা বকুল গাছের গোড়ায় ছুরিটা পাওয়া গেল।
কিরীটী বললে, থাক, ছুরিটা ধরো না; চল অরুণবাবুর ঘরে যাই। এখুনি থানায় গিয়ে আমি হরিচরণকে এখানে পাঠাব। ভিজে মাটির বুকে অপরাধীর পায়ের দাগ নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। কেননা ট্যাক্সি থেকে নেমে বাকি পথটা সে হেঁটেই বাগানে এসেছিল!..এবারে চল, ভিতরে যাওয়া যাক। ঘরে ঢুকে দেখি একজন ডাক্তার এসেছে; অরুণবাবুকে পরীক্ষা করে ওষুধের ব্যবস্থা দিয়ে তিনি বিদায় নিলে আমরা চলে এলাম।
***
পরের দিন সন্ধ্যার দিকে কিরীটী ফোনে আমায় একবার ডাকল, এখুনি তার ওখানে একবার যেতে হবে, খুব জরুরী। ডাঃ চট্টরাজও তার ওখানেই অপেক্ষা করছেন।
কিরীটীর ওখানে গিয়ে তার গাড়িতেই আমরা সোজা কুমারসাহেবের বাড়িতে গেলাম। দরজার গোড়াতেই ম্যানেজারবাবুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তিনি বললেন, কুমারসাহেব বাড়ি নেই, আজ দুপুরের ট্রেনে নাকি মধুপুর গেছেন কী একটা জরুরী কাজে। কাল রাত্রের ট্রেনে ফিরবেন।
একসময় কিরীটী বললে, শুনেছেন ম্যানেজারবাবু, প্রফেসার শর্মা কাল রাত্রে খুন হয়েছেন?
অ্যাঁ! সে কি—কেন? কেন খুন হলেন? লোক তো খারাপ ছিলেন না নেহাৎ, তবে—; তারপর হঠাৎ কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যাকুল স্বরে বললেন, খুনীকে নিশ্চয় ধরেছেন, মিঃ রায়!
হ্যাঁ আচ্ছা প্রফেসর শর্মা সম্পর্কে আপনাকে গোটাকতক কথা জিজ্ঞাসা করতে চাই–আশা করি সঠিক জবাব পাব।
মৃদু হেসে ম্যানেজারবাবু জবাব দিলেন, কিরীটীবাবু কি মনে করেন, প্রফেসার শর্মার হত্যা সম্পর্কে কোন কিছু আমি জানি!
না, সেজন্য নয়, তার সম্পর্কে কয়েকটা কথা জানা প্রয়োজন, তাই। আচ্ছা শুনেছি নাকি ভদ্রলোকের জন্ম ও জন্মাবার পর অনেক দিন তার কাশীতেই কেটেছিল? অথচ তিনি বলতেন, তিনি বহুকাল বাংলা দেশেই আছেন এবং জন্মও নাকি তার এই দেশেই! তাছাড়া অরুণবাবু যে সমস্ত চেক শর্মাকে দিতেন, আপনি নাকি সেগুলো আপনার অ্যাকাউন্টেই ব্যাঙ্ক থেকে ভাঙ্গিয়ে দিতেন? একথা কি সত্যি ম্যানেজারবাবু?
সম্পূর্ণ মিথ্যে কথা মশাই। আমার নিজের ব্যাঙ্ক-অ্যাকাউন্টে কারও চেক আমি কোনদিনই ভাঙাইনি।–
বেশ। শুনেছি। তিনি একটা নাটক লিখেছিলেন এবং সেই নাটক নিয়ে থিয়েটার খুলবোর
এ কথা কি সত্যি?
হ্যাঁ, আমিও তা শুনেছি বটে।
আমরা মার্বেল হাউস থেকে বের হয়ে গাড়িতে চেপে বিকাশ মল্লিকের বাসায় গিয়ে হাজির হলাম।
বিকাশবাবু তখন বের হবার আয়োজন করছেন, আমাদের দেখে বৈঠকখানায় নিয়ে গিয়ে বসালেন।
তারপর কিরীটীবাবু, কি মনে করে? আপনার ‘কেস’, কতদূর এগুলো?
আপনি প্রফেসর শর্মাকে চিনতেন, বিকাশবাবু? কিরীটী প্রশ্ন করল।
সামান্যই চেনা-পরিচয় ছিল। তার সম্পর্কে প্রায়ই আমি অনেক কথা শুনতাম। উনি বেশ চমৎকার ‘হিন্দী’ বলতে কইতে পারতেন। শুভঙ্করবাবুর বাড়িতেই ওঁর সঙ্গে আমার আলাপ হয়। নেহাৎ মন্দ লোক বলে তাঁকে আমার কোনদিন তো মনে হয়নি! তবে একটু যেন ‘হামবাড়া’ গোছের লোক ছিলেন। …এরপর আরো কিছুক্ষণ কথাবাতাঁর পর আমরা বিদায় নিলাম।
***
গাড়ি কীলীঘাট ব্রীজ পার হতেই কিরীটী হীরা সিংকে বললে, টালিগঞ্জে ব্যারিস্টার চৌধুরীর বাড়ি।
ময়নাঘরের সামনে এসে দাঁড়াল।
পুলিস সার্জেন ও একটা ডোম আমাদের জন্যে ঘরের মধ্যে অপেক্ষা করছিল।
পুলিস সার্জেন আমাদের আহ্বান জানালেন, শুভসন্ধ্যা, মিঃ রায়!
আপনার মৃতদেহগুলো কোন ঘরে থাকে? কিরীটী প্রশ্ন করল।
ঠাণ্ডি ঘরে।
শুভঙ্কর মিত্রের মৃতদেহটাও আছে বোধ হয় সেইখানেই।
হ্যাঁ, চলুন। এই কাল্লু, পরশুকার সেই গলাকাটা দেহটা ও মাথাটা স্ট্রেচারে করে বাইরে নামা!
কাল্লু চলে গেল।
সার্জেনের পিছু পিছু আমরা একটা অল্প পরিসর ঘরের মধ্যে এসে ঢুকলাম। একটা বিশ্ৰী উৎকট গন্ধে নাড়ি পাক দেয়। সামনেই একটা সেলফের মত আলমারিতে পার পর কতকগুলো মৃতদেহ সাজানো। কাল্প স্ট্রেচারে করে শুভঙ্কর মিত্রের মৃতদেটা সামনে এনে নামাল আর একজন ডোমের সাহায্যে।
কিরীটী মৃতদেহটার আপাদমস্তক বেশ ভাল করে দেখে নিয়ে মৃদু হেসে বললে, না ঠিক আছে। দেহটা lock up করে রাখুন। এই নিন পুলিস কমিশনারের অর্ডার। একটা বেলে রঙের ছাপানো কাগজ সার্জেনের হাতে কিরীটী এগিয়ে দিল।
***
ময়নাঘর থেকে বের হয়ে আমরা সকলে সোজা বরানগরে মিঃ মিত্রের বাড়িতে এসে হাজির হলাম।
কড়া নাড়তেই মাধব এসে দরজা খুলে দিল।
ভিতরে চল মাধব। একটা শাবল যোগাড় করে আনতে পার মাধব এখুনি? কিরীটী বললে।
হ্যাঁ, কেন পারব না বাবু! চলুন।
শাবল! শাবল দিয়ে কী হবে মশাই? বিস্মিত চৌধুরী প্রশ্ন করলেন।
দরকার আছে, চলুন না। এস সুব্রত। হ্যাঁ, আর একটা লণ্ঠন জ্বলিয়ে নিয়ে এস মাধব।