পরদিন সকালে কিন্তু আকাশ একেবারে পরিষ্কার হয়ে গেলো। শান্ত শাদা মেঘের গা থেকে চুঁইয়ে পড়ছে রোদ, চারদিক আলোয় ভরা, সুন্দর মন্দ-মধুর হাওয়া দিচ্ছে। আবার চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে উঠলো নিচের পৃথিবী।
হাওয়া অনুকুল, উত্তর-পূর্ব দিকে ভেসে চললো ভিক্টরিয়া। ফার্গুসন হিশেব করে দেখলেন যে বিষুবরেখা থেকে তারা এখন প্রায় পৌনে দুশো মাইল দূর দিয়ে চলেছেন। পাহাড়ি এলাকার উপর দিয়ে যাচ্ছে এবার বেলুন, মস্ত বড়ো পাহাড়, নাম কারাওয়ে। আফ্রিকিদের মধ্যে চলতি একটা কথা আছে, যাতে একে বলা হয়েছে নীল-নদের দোলনা। এই পাহাড়ই উকেরিঙি নামক বিরাট জলাশয়ের একদিকে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই হ্রদের নতুন নাম দেয়া হয়েছে ভিক্টরিয়া—আর এরই কাছাকাছি, অল্প দূরের ব্যবধানে, দক্ষিণ-পশ্চিম মালভূমির প্রশস্ত উপত্যকাতে বিভিন্ন ধাপে নাইভাসা, বারিঙ্গো, মাগাদি প্রভৃতি কয়েকটা ছোটো হ্রদ। প্রথমে দূর থেকে একটা গ্রাম চোখে পড়েছিলো, তারপরেই হ্রদগুলো দেখা দিলে। ১৮৫৮ সালের আগস্ট মাসের তিন তারিখে ক্যাপ্টেন স্পেক এখানে পদার্পণ করেছিলেন। ফার্গুসন উল্লসিত হয়ে উঠলেন : যে-সব জায়গার ওপর দিয়ে তার যাবার ইচ্ছে ছিলো, বেলুন সত্যি-সত্যি সেইসব আকাঙিক্ষত দেশের ওপর দিয়েই চলেছে। দুরবিন হাতে তিনি অজানা দেশের প্রতিটি জিনিশ ভালো করে দেখতে লাগলেন।
কারাগুইব রাজ্যের রাজধানী চোখে পড়লো তারপর : গোটা পঞ্চাশেক বাঁশপাতার গোল কুটির, তাই দিয়েই আফ্রিকিরা এই রাজধানী গড়েছে।
দুপুরবেলা ভিক্টরিয়া হ্রদের ওপর দিয়ে উড়ে চললো বেলুন। এই বিশাল জলরাশিকে ক্যাপ্টেন স্পেকই ভিক্টরিয়া-নায়েঞ্জা নাম দিয়েছিলেন। ভিক্টরিয়া ইংরেজদের রানী, আর নায়েঞ্জা কথাটা এ-দেশি, তার মানে হলো হ্রদ।
এবার আমরা আসল পথ ধরেছি। এক্ষুনি হয়তো আমরা নীল নদকে দেখতে পাবো। এই হ্রদই যে নীল নদের উৎস, তাতে আমার কোনো সন্দেহই নেই।
ফাণ্ডসনের আন্দাজে যে মোটেই ভুল নেই একটু পরেই তার প্রমাণ পাওয়া গেলো। একপাশের গিরিমালার মধ্য দিয়ে সত্যিই দেখা গেলো প্রবল এক জলধারা অপর দিক দিয়ে ধেয়ে চলেছে।
ঐ দ্যাখো! ঐ দ্যাখো! উল্লসিত গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন ফার্গুসন, আরবেরা ঠিকই বলে—এই সেই জলধারা যার প্রতিটি জলকণা গিয়ে ভূমধ্যসাগরে মিশেছে। এরই নাম নীল নদ।
মিশরের আশ্চর্য সভ্যতা যখন গড়ে উঠেছিলো, নীল নদ তখন অকৃপণ হাতে তার পেছনে তার প্রসাদকণা বিলিয়েছিলো। চারদিকে ধুলো, ধুলো, মরা ধুলোর মরুভূমি —আর তারই ওপর নীল নদের দু-কুল জুড়ে যেন একফালি সবুজের উদ্দাম সম্ভার। নীল নদের কোল ঘেঁসেই ঘনসবুজ ঘাস, স্নিগ্ধ শস্যের খেত, কিন্তু তারপরেই, মিশর থেকে বেরিয়ে এলেই, রুক্ষ ধুলো, মরুভূমির হলদে লোলুপ বাহু। প্রাণীর রাজ্য বলতে শুধু এই সবুজের ফালিটুকুই, কেননা বাঁচবার জন্যে যা-কিছু আয়োজন তার সবটুকুই এইখানটিতেই। আর সে-আয়োজন কী প্রচুর। যেন সবুজের কূল-ছাপা বন্যা। অথচ এই ফসলের ফালিটুকুর বাইরে এক পা বাড়ালেই দেখা যাবে বাঁচবার আয়োজন ছিটেফোঁটাও নেই, কেবল খাঁ-খাঁ করছে শুকনো, রক্তিম, তপ্ত মৃত্যুর দেশ।
জীবন আর মৃত্যুর মধ্যে এমন স্পষ্ট দাগ কেটে পৃথিবীর আর-কোথাও ভাগ করে দেয়া হয়নি। অনায়সেই মিশর দেশে এমন জায়গা বেছে দাঁড়ানো যায় যেখানে এক পা পড়েছে শস্যশ্যামল মাটির ওপর আর অন্য পা রুক্ষ মরুভূমির তপ্ত রক্তিমতায়–এক পা জীবনের দেশে আর আরেক পা মৃত্যুর দেশে।
অনেক, অনেক কাল আগে, আদি পৃথিবীতে, আশপাশের নানা দেশের যাযাবর মানুষেরা ধীরে-ধীরে নীল নদের খবর পেয়েছিলো। খবর পেয়েছিলো, কাছেই আছে এমন-এক দেশ, যেখানে প্রাণ তার সবুজ নিশান উড়িয়ে দিয়েছে দিগন্তের আকাশ লক্ষ্য করে, না-চাইতে যেখানে পৃথিবীর কাছ থেকে অনেককিছু পাওয়া যায়, তাই ওইসব বেদুইন মানুষের নানান দল এসে জমতে লাগলো নীল নদের এই কিনারায়। কেউ এলো আফ্রিকারই অন্য এলাকা থেকে, কোনোদল এলো আরব্য অঞ্চল থেকে, হয়তোবা সুদূর এশিয়া থেকেই এলো কেউ-কেউ। আর যতই দিন গেলো, ততই এইসব নানা দলের মানুষের মধ্যে মিশোল হতে লাগলো, আর তারাই হলো আদি মিশরের বাসিন্দা।
শেষকালে নিজেদের জন্যে একটা নামই তারা ঠিক করে ফেললো : সে-নামটা ভারি অদ্ভুত। তাদের ভাষায় তারা যে-নাম দিলে, তার মানে হলো, মানুষ-শুধু মানুষ। অর্থাৎ মানুষ নিজেকে মানুষ বলে ডাকতে শিখলো। তারা এইভাবে নিজেদের মানুষ বলে ডাকতে শিখে গেলো, তার মানে কিন্তু এই যে, পৃথিবীর তারাই হলো একমাত্র মানুষ, আর-কোথাও মানুষ নেই, আর-কেউ মানুষ নয়। মানুষ আর মিশরের লোক-দুইই তাদের কাছে এক কথা। তাহলে কি তারা জানতো না যে পৃথিবীতে আরো বহু রকমের মানুষ আছে? তা তারা ভালো করেই জানতো কেবল অন্যদের ওরা মানুষ বলে মানতো না, তাদের কাছে অন্যরা হলো বিদেশী, আর বিদেশী মানেই কিছুটা অন্য ধরনের, মানুষের চেয়ে কিছুটা খাটো, কিছুটা নিচু। মানুষ মানে কেবল মিশরের মানুষ, আর-কেউ নয়।
এমনতরো যে হলো, তা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। তার কারণটা খুবই স্বাভাবিক। রুক্ষ হলুদ মরুভূমির ভেতর একটুখানি জায়গায় প্রাণ তার সবুজ নিশান উড়িয়েছে, . আর এই একরত্তি জায়গাটুকুই তাদের কাছে পুরো জগৎ : তার বাইরে পৃথিবী বলতে যে আর-কিছু আছে বা থাকতে পারে, তা তাদের পক্ষে ভালো করে বুঝতে পারাই কঠিন ছিলো। মিশরই গোটা পৃথিবী, মিশরের অধিবাসীরাই কেবল মানুষ—শুধু যে এইসবই তারা ভাবতো তা-ই নয়, নদীর বেলাতেও এমনি। তাদের দেশের ওই-যে নীল নদ, ও ছাড়া পৃথিবীর আর-কোথাও যে নদী আছে বা থাকতে পারে, এমন কথা তারা যেন ভাবতেই পারতো না, তাই নদীটার ও-রকম নাম দিয়েছিলো তারা : নীল-বা নাইল; তাদের ভাষায় কথাটার মানেই হলো নদী, শুধু নদী। তার মানে, নদী আর তাদের ওই নীল—একই জিনিশ; কারণ ওই নীল নদ বয়ে চলেছে দক্ষিণ দিক থেকে উত্তর দিকে, আর সেই কারণে তাদের ভাষায় উত্তর দিকে এগুনো, আর নদীর স্রোত বরাবর এনো একই কথা আবার উজানে যাওয়া বা দক্ষিণ দিকে যাওয়াদুই-ই হলো এক। নীল ছাড়া আর-কোনো নদীর নাম তারা জানতো না, তাই তাদের ধারণায় নীল নদের স্রোত যেমন দক্ষিণ থেকে উত্তরে অন্য-সব নদীর স্রোতও তা-ই হতে বাধ্য। তাদের ওই ছোট্ট বিশ্বে এই একটি নদী ছাড়া আর-কোনো নদী ছিলো না, কাজেই পৃথিবী বলতে তারা কতটুকু জায়গা বুঝতো, তা সহজেই আন্দাজ করা যায়। আর তাই তারা মনে করতো, কালো রঙটাই ভালো, লাল মোটেই ভালো না। কেননা এই-যে তাদের একরত্তি পৃথিবী তার রঙটা কালো, আর তার পরেই শুরু হয়েছে মরুভূমি যার মাটি রুক্ষ, শুকনো, তপ্ত—লাল রঙের।
এই-ই নীলনদ! কেনেডি আশ্চর্য গলায় বললেন।
জোও চিৎকার করে উঠলো, আশ্চর্য তো! এই কিনা নীলনদ।
বড়ো-বড়ো পাহাড় আর পাথর পড়ে আছে নীল নদের গতিপথে। কোথাও জলপ্রপাত, আর কোথাও-বা ফেনিল জলধারার মত্ত উচ্ছ্বাস তীব্রবেগে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। নদীর দু-পাশ ধরে অনেক গ্রাম আর স্নিগ্ধ শ্যামল শস্যের সম্ভার। গ্রামের বাসিন্দারা বেলুনের দিকে তাকিয়ে নিষ্ফল আক্রোশে নানারকম অঙ্গভঙ্গি আর অস্ত্রশস্ত্র প্রদর্শন করে তাদের বিষম ক্রোধ প্রকাশ করতে লাগলো।
কেনেডি বললেন, কী সর্বনাশ! এখানে নামতে গেলে তো মস্ত বিপদ হবে দেখছি!
তা সত্ত্বেও আমাদের নামতেই হবে, ফার্গুসন দৃঢ় গলায় জানালেন। নয়তো আমার অভিযানের আসল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে। অন্তত সিকি ঘণ্টার জন্যে হলেও নামতে হবে—সবকিছু দেখে-শুনে নেবার জন্যে। উত্তর দিক থেকে যে-সব অভিযানকারী এসেছিলেন, তাঁদের মাইল পাঁচেকের মধ্যে পৌঁছেছি এখন। নামবোই, তবে, খুব সাবধানে।
ভিক্টরিয়া প্রায় হাজার-দেড়েক ফুট নেমে এলো। হঠাৎ ফার্গুসন চেঁচিয়ে বলে উঠলেন : আরে! ওই-যে নদীর ঠিক মধ্যিখানে একটা ছোটো দ্বীপের মতো রয়েছে। গোটা-চারেক গাছও তো রয়েছে দেখছি! ওটার নাম কী জানো? বেঙ্গা দ্বীপ। ভালোই হলো একদিক থেকে—এখানেই নামবো আমরা।
কিন্তু এখানে যে লোকজন থাকে বলে মনে হচ্ছে, জো জানালে।
তাইতো-ঠিকই তো! ওই-যে প্রায় জন-কুড়ি কালো মানুষ দেখা যাচ্ছে মাঠের ওপর। তাহলে তো ভারি মুশকিল হলো।
ওরা যাতে পালিয়ে যায় এমন কোনো ব্যবস্থা করলে হয় না?
হ্যাঁ, তা-ই করববা আমি।
সূর্য তখন ঠিক মাথার ওপরে রক্ত চক্ষু জ্বেলে জ্বলছে, এমন সময় ভিক্টরিয়া মাটির দিকে নেমে আসতে লাগলো। নানাভাবে হাত-পা ছুঁড়ে বিকট গলায় চাচামেচি করতে লাগলো নিচের অধিবাসীরা। একজন তার মাথার পাতার গোল টুপিটা আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিলে। অমনি কেনেডি ক্ষিপ্র হাতে বন্দুক তুলে নিলেন। পলকে লক্ষ্য স্থির করে সেই উড়ো টুপিটা তাগ করে গুলি ছুঁড়লেন তিনি, অমনি টুপিটা টুকরো-টুকরো হয়ে গেলো। তাতেই কিন্তু কাজ হলো। আফ্রিকিরা বিষম ভয় পেয়ে চো-চা দৌড়ে ঝপ-ঝপ নদীতে লাফিয়ে পড়লো, তারপর সাঁৎরে দু-পারে উঠে গেলো। দ্বীপ থেকে চলে গেলেও মোটেই তারা শান্ত হলো না কিন্তু—দু-পার থেকে অজস্র তীর ছুঁড়তে লাগলো তারা। তাতে অবশ্য গাছের নিরাপদ আড়ালে নোঙর করে রাখা ভিক্টরিয়ার গায়ে আঁচড়টুকুও পড়লো না। বিষের তীরের নাগলের বাইরে ভিক্টরিয়া হাওয়ায় কেবল আস্তে-আস্তে দুলতে লাগলো।
দড়ির মই বেয়ে প্রথমে জো নিচে নেমে এলো, তারপর কেনেডি আর ফার্গুসন ধীরে-ধীরে নামতে লাগলেন।
কেনেডি প্রথমটায় নামতে রাজি হননি। আমি আবার খামকা নিচে নেমে কী করবো?
আমার একজন সাক্ষী থাকা দরকার, না-হলে লোকে আমার কথা বিশ্বাস করবে কেন? স্মিত মুখে জানালেন ফার্গুসন।
বেশ, চলো তাহলে।
জো, তুমি কিন্তু খুব সাবধানে থেকো–ভালো করে পাহারা দেয়া চাই।
দ্বীপের একদিকে ছোটো একটি টিলা, দু-জনে চললেন সেদিকে। টিলার গায়ে ঝোপঝাড় গজিয়েছে, ফার্গুসন সোজা সেই ঝোঁপের মধ্যে গিয়ে ঢুকলেন। তারপর নিচু হয়ে কী যেন খুঁজতে লাগলেন তিনি। কাটাগাছের খোঁচা খেয়ে তার হাত-পা ছড়ে গেলো, রক্ত ঝরলো, কিন্তু তবু তিনি ক্ষান্ত হলেন না। ডিক কেনেডি অবাক হয়ে বন্ধুর রকম-শকম দেখতে লাগলেন। হঠাৎ ফার্গুসন উৎসাহী গলায় বলে উঠলেন, এই-যে, এই-যে, পেয়েছি! দ্যাখো, ডিক, দ্যাখো!
আরে! এ-যে ইংরেজি হরফ দেখতে পাচ্ছি।
ফার্গুসন কোনো সাতরাজার ধন বা গুপ্তধন খোঁজেননি, তিনি খুঁজছিলেন টিলার গায়ে বিশেষ একটি পাথরে স্পষ্ট হরফে দুটি ইংরেজি অক্ষরে খোদাই করা : এ. ডি.।
এ. ডি. হলো অ্যানড়িয়ে ডেবোনার নামের আদ্য অক্ষর। ফার্গুসন বললেন, ডোবোনা ছিলেন খার্তুমের একজন ব্যবসায়ী, হাতির দাঁতের খোঁজে ঘুরতে-ঘুরতে
ভদ্রলোক নীল নদের উৎসের কাছে এসে পৌঁছেছিলেন।
এই অক্ষরদুটি যে তারই নির্ভুল প্রমাণ, তা তো দেখতেই পাচ্ছি।
তাহলে এবার বিশ্বাস হলো তো?
নিশ্চয়ই! এটা যে নীল নদ, তা মানতেই হয়। এমন অকাট্য প্রমাণের পরে তা আর কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না। কেনেডি স্বীকার করলেন।
আরেকবার অক্ষরদুটির দিকে কেমন জ্বলজ্বলে চোখে তাকালেন ফার্গুসন। তারপর বললেন, চলো এবার, শিগগির চলো বেলুনের দিকে। খুব সাবধান কিন্তু আবার নদী পেরুবার চেষ্টা করছে আফ্রিকিরা।
এর প্রায় দশ মিনিট পরেই আবার ভিক্টরিয়া শূন্যে উঠলো, এবার তার গায়ে পৎপতিয়ে উড়ছে গ্রেটব্রিটেনের পতাকা, ইউনিয়ন জ্যাক।