অতীন্দ্ৰিয়বাদী ও অধ্যাত্মবাদী প্রবণতা
এই স্তরে অতীন্দ্ৰিয়বাদী উপাদান তাত্ত্বিক দিক দিয়ে প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছিল–আনুষ্ঠানিক ক্রিয়া ও পুনর্জন্ম-বন্ধন থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় রূপে জ্ঞানের উপর সচেতন নির্ভরতা এসেছিল। উপনিষদের যুগে মানুষের জীবনের সমগ্ৰ দিগন্তকে পুনর্জন্মবাদ ও কর্মতত্ত্ব সম্পূর্ণ পরিবর্তিত করে দিয়েছিল; এইসব নতুন ভাবাদর্শের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে গিয়ে মানুষ তখন প্রবল সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিল–কেননা জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি, লক্ষ্য ও প্রাপ্তির উপায়সমূহের উপর এদের প্রচণ্ড প্রভাব তখন অনস্বীকার্য। ইন্দ্ৰজালের অজ্ঞাত ও অজ্ঞেয় উপাদানের ঐতিহ্য থেকে যজ্ঞধর্মে গৃহীত অতীন্দ্ৰিয়বাদী প্রবণতা ছিল সমাদৃত, ও নতুন বোধের সহায়ক; যেমন, সামমন্ত্র রচনার সৃষ্টিশীল প্রেরণারূপে সোম নির্দেশিত হয়েছে (বৃহদারণ্যক, ১ : ৩ : ২৪)। এমন কি, আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিনিষ্ঠ দ্বাম্বিক বিতর্কেও চুড়ান্ত পর্যায়ে অতীন্দ্ৰিয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট (যেমন, তদেব ৩ : ২ : ১ )। উত্তর লাভের চেয়ে প্রশ্ন উত্থাপনের তাৎপর্য অনেক বেশি; মৃত্যুবোধের পর্যাপ্ত অভিব্যক্তির মধ্যে সেই যুগের বিশিষ্ট চরিত্রলক্ষণ প্রকট হয়ে উঠেছে (তদেব, 8 : ৩ : ৬)। বহুস্থানে পরমাত্মার নিগুঢ় স্বভাব ও ক্রিয়াকলাপ অতীন্দ্রিয় ভাবনার পটভূমিকায় বর্ণিত হয়েছে, কারণ এই বিষয় বুদ্ধিগম্য নয়, কেবল অতীন্দ্ৰিয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে প্ৰাণিধান করা যেতে পারে (যেমন, তদেব, 8 : ৩ : ১৪; কঠ, ১ : ২ : ১২, মুণ্ডক ৩ : ২ : ৩; শ্বেতাশ্বেতর ৩ : ১৪, ১৯, ২০ ইত্যাদি)।
আত্মা ব্ৰহ্মের দুর্জ্ঞেয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করার অন্যতম পরিচিত পদ্ধতি হ’ল সমস্ত মহাভূত, সূর্য, প্ৰজাপতি, বর্ষ, দিবা, রাত্রি, অন্ন ইত্যাদির সঙ্গে তার একাত্মতা ঘোষণা (প্ৰশ্ন, ১ : ৩-১২)। আবেকটি সাধারণ পদ্ধতি হ’ল তাকে নিগুঢ় রহস্যপূর্ণ একাক্ষর ‘ওম’-এ (মুণ্ডক, ১ : ১ : ১; তৈত্তিরীয়, ১ : ৮) কিংবা তিনটি পবিত্র অক্ষর ‘ভু, ভুবঃ, স্বর’-এর পরিণত করা (তৈত্তিরীয় ১ : ৬ : ২)। এভাবে যজ্ঞের বিভিন্ন উপকরণকে বা মন্ত্রের বিভিন্ন উপাদানকে নানাবিধ অতীন্দ্ৰিয় তাৎপর্য মণ্ডিত করা হয়েছে। মৃত্যু সম্পর্কিত ভাবনাও অনুরূপ অতীন্দ্ৰিয় কল্পনাকে আশ্রয় করেছে। এভাবে অতীন্দ্ৰিয়বাদী ভাবনা যজ্ঞানুষ্ঠানের প্রতীকী ব্যাখ্যা উপস্থাপিত করার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়ে উঠেছে; এ ধরনের পুনর্বিশ্লেষণ উপনিষদের যথার্থ আধ্যাত্মিক মতবাদ নির্মাণের পূর্ববর্তী প্রয়োজনীয় স্তরটি গঠন করেছে। অতীন্দ্ৰিয়বাদী প্রবণতা ব্যতীত কোনো ধর্মতত্ত্ব বা ধর্মীয় অনুষ্ঠান সম্ভব নয়, কয়েক শতাব্দীর প্রত্নপৌরাণিক চিন্তাভাবনা ও যজ্ঞানুষ্ঠানের পরে বিমূর্ত ভাবনার অপেক্ষাকৃত অনিশ্চিত পরিমণ্ডলে আকস্মিক উল্লম্ফন প্রকৃতপক্ষে অসম্ভব। তাই, অব্যবহিত পরবর্তী স্তরে অতীন্দ্ৰিয়বাদী প্রবণতার ভূমিকা পরিবর্তিত হয়ে যায়; তখন প্রত্নকথাগুলিকে প্রতীকী অতিজাগতিক ও প্রত্ন-আধ্যাত্মিকভাবে ব্যাখ্যা করে আনুষ্ঠানিক ধর্মকে উচ্চতর স্তরে দীর্ঘস্থায়ী গ্রহণীয়তা দিতে চেয়েছে। এই পর্যায়ের পরেই শুধু পরবর্তী দুঃসাহসী পদক্ষেপ সম্ভব, অর্থাৎ আনুষ্ঠানিক ধর্মকে সম্পূর্ণ অ-পর্যাপ্ত, এবং ফলত, অপ্রয়োজনীয় বিবেচনায় পরিত্যাগ করে অপেক্ষাকৃত প্ৰত্নকথা-বর্জিত আধ্যাত্মিক চিন্তার স্তরে উপনীত হওয়া। ইন্দ্ৰজালে বিশ্বাস দুজ্ঞেয় রহস্যময় প্রবণতার সহগামী ও তার ভিত্তিভূমি; ক্রমশ তা আধ্যাত্মিক পরিশীলনের ফলে দুর্বলতর হ’ল, যেহেতু তা বুদ্ধিবৃত্তিকে উপযুক্ত উপকরণরূপে গ্ৰহণ করে ধীরে-বীরে তারই উপর অধিকতর নির্ভরশীল হয়ে উঠলো।
বাস্তবতার সম্বন্ধে উপনিষদের দৃষ্টিভঙ্গি কতকটা বিশ্লেষণী বুদ্ধি-প্ৰসূতী; বেশ কিছু প্রচলিত সাধারণ ভ্ৰান্তি এড়ানোর জন্য এই সত্যকে সম্পূর্ণভাবে অনুধাবন করতে হবে। এ-ধরনের ভুল ধারণাগুলির মধ্যে প্রধান হল শংকরাচার্যের উপনিষদ-ভাষ্যকে অভ্রান্ত পদ্ধতি ব’লে মনে করা। এটা অনৈতিহাসিক এবং সম্পূর্ণ ভুল; কারণ, উপনিষদ রচিত হওয়ার প্রায় পনেরো শ’ বছর পরে শংকর জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং এই অন্তর্বতী শতাব্দীগুলির মধ্যে উদ্ভূত পূর্ণাঙ্গ অধ্যাত্মবাদী চিন্তাধারা-প্রসূত দার্শনিক মতবাদ দ্বারা তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। তার নিজস্ব উদ্দেশ্যের উপযোগীরূপে ও আপন মতবাদের দৃষ্টান্ত হিসেবে উপনিষদগুলিকে তিনি ব্যবহার করেছিলেন। উপনিষদগুলি যখন যেভাবে রচিত হােক না কেন, নিজেরা কোনো সুস্পষ্ট প্ৰণালীবদ্ধ দার্শনিক লক্ষ্যযুক্ত পদ্ধতি তৈরি করার চেষ্টা করে নি। এর একটা কারণ এই যে, অতীন্দ্ৰিয়বাদী প্রবণতার আতিশয্য তখনো এদের সঙ্গে সংলগ্ন হয়ে রয়েছিল বলে সম্পূর্ণ বিধিবদ্ধ অ র স্পষ্ট রূপ পরিগ্রহ করা সম্ভব ছিল না; এ দৃষ্টিভঙ্গি শুধু আংশিকভাবেই গভীর চিন্তাপ্রসূত। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন ঋষি উপনিষদের ভিন্ন ভিন্ন অংশ রচনা করেছিলেন বলে তাদের মধ্যে পরস্পর-ভিন্ন, এমনকি কখনো-কখনো পরস্পরবিরোধী উপলব্ধিও প্রতিফলিত হয়েছে। এই রচনাংশগুলি যে একত্র সন্নিবিষ্ট হতে পেরেছিল, তার পেছনে রয়েছে একটি নেতিবাচক ও একটি ইতিবাচক কারণ। নেতিবাচক কারণটি হ’ল, আনুষ্ঠানিক ধর্মচর্য থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার মূল তাগিদ এবং ইতিবাচক কারণ হ’ল, তাদের অনুসন্ধানের প্রধান বিষয়বস্তু অর্থাৎ মানুষ, মন, বস্তু, আত্মা ও পরমাত্মার তাৎপর্য উপলব্ধি।
সংহিতার সর্বেশ্বরবাদ থেকে ব্ৰাহ্মণ যুগের অন্ত্যপর্বের প্রজাপতিকেন্দ্ৰিক একেশ্বরবাদের মধ্য দিয়ে উপনিষদের ব্ৰহ্ম-ভাবনার অদ্বৈতবাদে চরম পরিণতি লাভের বঙ্কিম পথটি দীর্ঘ ও গ্ৰছিল। এর মধ্যে সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলনের উৎখান-পতন ও সংঘর্ষের বিবিধ স্তর প্রতিফলিত হয়েছে। কেনোপনিষদের একটি বিখ্যাত উপাখ্যানে দেবতারা রহস্যময় বস্তুর আবির্ভাবকে ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হওয়ার পরে উমা হৈমবতী জানালেন, ইনিই ব্ৰহ্মা। এখানে তাৎপর্যপূর্ণভাবে ঋষির দিব্যদর্শনকে ঐশ্বরিক প্রত্যাদেশ রূপে উপস্থাপিত করা হয়েছে, বুদ্ধিবৃত্তির প্রক্রিয়া হিসাবে করা হয় নি। কঠোপণিষদে আত্মাকে রথী, দেহকে রথ, ইন্দ্রিয়কে অশ্ব, বুদ্ধি সারথি এবং মনকে রথরশ্মিরূপে বর্ণনা করা হয়েছে (১ : ৩ : ৩-৪)। সাংখ্যাতত্ত্বের পূর্বসূরী হিসেবে শ্বেতাশ্বেতর মহেশ্বরকে অতিজাগতিক মায়ার নিয়ন্তা ও শ্রেষ্ঠ প্রভুরূপে বর্ণনা করেছে; প্রকৃতি হ’ল মায়া এবং মহেশ্বর থেকে উদ্ভূত সহায়ক শক্তিগুলি সমগ্ৰ বিশ্বজগৎকে আবৃত করেছে। (৫ : ৩)। পুরুষ ও প্রকৃতি সম্মিলিত হওয়ার পরে বিবর্তনময় সৃষ্টিপ্রক্রিয়া শুরু হয়। এই উপনিষদের দ্বিতীয় থেকে ষষ্ঠ অধ্যায়ে একেশ্বরবাদী প্রবণতা আত্মপ্ৰকাশ করেছে; ষষ্ঠে মহেশ্বর পরমাত্মা রূপে গৃহীত। তাছাড়া পরবর্তী বেদান্তদর্শনে প্রবল-প্রভাবে যে মায়াবাদ শ্বেতাশ্বেতরেই তার প্রথম দেখা মেলে।
ছান্দোগ্য ও বৃহদারণ্যক উপনিষদে আত্ম-ব্ৰহ্মা তত্ত্ব চুড়ান্ত ও সর্বাপেক্ষা বিস্তুত রূপ পরিগ্রহ করে। মানবিক সারাৎসার সম্পর্কে ভাববাদী বিশ্লেষণ অজার ও অমর আত্মা সম্পর্কিত ধারণার পর্যবসিত হয় (যেমন ছান্দোগ্য, ৬ : ১১ : ৩; ৮ : ১ : ৬ ইত্যাদি)। আত্মাকে দেহ থেকে পৃথক করে দেখানোর প্রবনতার ভাববাদী দর্শনের পূর্বাভাস সূচিত হয়েছে। পরবর্তী উপনিষদগুলিতে দেহ ও আত্মার পার্থক্য স্পষ্টতর হয়ে অবিসংবাদী ভাববাদী দর্শন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবু কিছু কিছু ক্ষেত্রে বস্তুবাদী চিন্তাধারার অবশেষও রয়ে গেছে (যেমন, ছান্দোগ্য, ১ : ২ : ২-৭; ৩ : ১৪ : ৩ ইত্যাদি)। দেহ ও আত্মার দ্বৈতবোধ এই উপনিষদে অভিব্যক্ত : ‘মৃত্যু গৃহীত এই শরীর মরণশীল হলেও এতেই অমর ও দেহহীন আত্মার অবস্থান’ (তদেব, ৮ : ১২ : ১)। ফলে এই শরীরের প্রতি বিদ্বিষ্ট মনোভাবের সূত্রপাত হ’ল; নানাবিধ পাপ ও অকল্যাণের অধিষ্ঠানরূপে দেহ বিভিন্ন উপনিষদে নিন্দিত হয়ে দেহবিচ্ছিন্ন নিরুপাধি নিরঞ্জন স্বয়ংসম্পূর্ণ আত্মার ধারণা বৃহদারণ্যকে চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করল। যাজ্ঞবল্ক্যের তত্ত্ব দার্শনিক চিন্তার ক্ষেত্রে একটি যুগের সমাপ্তি ও পরবর্তী আবির্ভাব সূচনা করেছে—যে-যুগ প্রকৃতপক্ষে এখনো পর্যন্ত অব্যাহত। (তুলনীয় বৃহদারণ্যক, ১ : ৪ : ১; ১ : ৪ : ৮; ২ : ৩; ৩ : ৪ : ২)। নতুন দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে আত্মা ও ব্রহ্মের ঐক্যবোধ দৃঢ় ও নিঃসংশয় প্রতিষ্ঠা লাভ করল।
এই অনুমান যুক্তিসঙ্গত যে, উপনিষদের প্রাগুক্ত প্ৰধান মতবাদে সমন্বিত হওয়ার পূর্বে দুটি স্বতন্ত্র দার্শনিক সন্ধানের ধারা প্রবাহিত ছিল। একদিকে, সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় আত্মা সম্পর্কে দীর্ঘায়িত অনুসন্ধান নিশ্চিতভাবে চলছিল, যেহেতু শরীরের ধ্বংস অনিবাৰ্য এবং মরণশীল মানুষ সাগ্রহে জানতে চাইছিল, মানুষের কোনো উপাদান মৃত্যুকে অতিক্রম করে কিনা। দেহাতিরিক্ত আত্মার স্বপ্নমায়া ও বিভ্রম এবং সেই সঙ্গে জীবনের নেতিবাদ বা বিনাশ অর্থাৎ মৃত্যুকে স্বীকার করার প্রতি স্বাভাবিক অনীহা থেকেই অমর আত্মার অস্তিত্ব-সম্পর্কিত বিশ্বাস জন্ম নেয়। বস্তুবিশ্বের সঙ্গে মানুষের একমাত্র যোগসূত্ৰ হ’ল আত্মা, কারণ বিভিন্ন ইন্দ্ৰিয় চিন্তা, অনুভব বা আকাঙ্ক্ষা করতে পারে না–তাদের অন্তরালে প্রচ্ছন্ন আত্মাই বিভিন্ন অভিজ্ঞতা অর্জন করতে সমর্থ। (বৃহদারণ্যক, ২ : ৪ : ১৪; ৩ : ৪ : ১-২)।
তত্ত্ব সন্ধানের ধারা শুরু হয়েছিল বস্তুবিশ্বের সারাৎসার এবং পরমাত্মার সঙ্গে তার যোগসূত্র অনুসন্ধানের মধ্যে দিয়ে। এই দীর্ঘায়িত তত্ত্ব সন্ধানের ধারার শুধু কিছু তাৎপৰ্যপূর্ণ কিছু কিছু তাৎপৰ্যপূর্ণ অংশ আমাদের নিকট উপনীত হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত সার্বভৌম চিরন্তন আত্মারূপে অবিহিত যে ব্ৰহ্মা তার সম্পর্কে ধারণার চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করেছে। বস্তুত তত্ত্ব সন্ধানের এই দুটি ধারার চিহ্ন দুটি শব্দের বুৎপত্তিতে নিহিত। কেননা একদিকে ‘আত্মা’ শব্দটি সম্ভবত প্ৰাণবায়ু থেকে নিষ্পন্ন (তুলনীয় জার্মান “আম্মেন’, অৰ্থ) নিঃশ্বাস নেওয়া এবং অন্যদিকে ‘ব্ৰহ্ম’ শব্দের মধ্যে বিপুলতার ধারণাটি প্রচ্ছন্ন যেহেতু ‘বৃহৎ’ শব্দের সঙ্গে তার বুৎপত্তিগত সম্পর্ক রয়েছে,–এতে বোঝা যাচ্ছে যে এ তত্ত্ব সন্ধানের প্রধান বিষয়বস্তু ছিল বিশ্বজগৎ।
অনুসন্ধানের প্রথম ধারাটি প্রসঙ্গক্রমে দৈহিক জীবনের ধারণা অর্থাৎ প্ৰাণ সম্পর্কেও গবেষণা করেছে। বহু রচনাতে প্রাণ ও আত্মা-শব্দ দুটি সহগামী ও পরম্পর বিনিময়সহ তত্ত্ব। শরীরের প্রতিটি প্রধান ক্রিয়াশীল অংশের একটি করে প্ৰাণ কল্পিত হয়েছে, সম্ভবত এই ধারণা থেকেই পরবর্তীকালে প্ৰাণ সম্পর্কিত অনেকত্ববাদী ধারণার সৃষ্টি হয়। তবে, সাধারণত উপনিষদে প্ৰাণ একক (তুলনীয় মুণ্ডক ৩ : ১ : ৪, তৈত্তিরীয় ২ : ২ : ৩)। বৃহদারণ্যক উপনিষদের একটি বিখ্যাত কাহিনীতে অন্যান্য ইন্দ্ৰিয়ের তুলনায় প্ৰাণের নিশ্চিত প্ৰাধান্য ও অপরিহার্যতা ব্যক্তি হয়েছে (১ : ৩ : ১১)। প্ৰাণের অতীন্দ্ৰিয়বাদী ও অধ্যাত্মবাদী ব্যাখ্যা বহুস্থানে যায়। আত্মানুসন্ধানের প্রক্রিয়ায় দেহ ও মনের প্রকৃতি, ক্রিয়াকলাপ, পরিধি, সীমা ইত্যাদি আলোচিত হওয়ার ফলে এর মধ্যে আমরা শরীরতত্ত্ব ও মনস্তত্ত্বের কিছু আভাস পাই। মানুষের মধ্যে যে অবিনশ্বর উপাদান দৈহিক মৃত্যুর ফলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় না, সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা গড়ে তুলতে গিয়ে নিদ্রা, স্বপ্ন ও স্বপ্নহীন সুষুপ্তির মৃত্যুতুল্য পর্যয়গুলি বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন অনুভূত হয়েছিল (বৃহদারণ্যক, ২ : ১১ : ১৫-২০, মাণ্ডুক্য, ৩ : ৭)। পরবর্তী স্তরে উদ্ভূত হ’ল এই বিশ্বাস-লালিত সিদ্ধান্ত যে, শরীরে প্রাণবায়ু-সঞ্চরণকারী ও ইন্দ্ৰিয়-প্রত্যক্ষকারয়িতা শক্তি মৃত্যুর পরেও বর্তমান থাকে। এই আত্মা জীবনদায়ী প্ৰাণবায়ুর প্রেরয়িতা, অন্তরতম এবং পুত্র, ধন ও অন্যান্য সমস্ত কিছু অপেক্ষা প্রিয়তর (বৃহদারণ্যক, ৩ : ৪ : ১; ৪ : ১৬, ১৭; ১ : ৪ : ৭)। জীবনীশক্তিকে যখন আত্মার সঙ্গে একাত্মীভূত করা হ’ল, আত্মানুসন্ধানের এই ধারা তখন তার সমাপ্তি-বিন্দুতে উপনীত হ’ল।
অনাত্মের রহস্যজনক জগতের জন্য অনুসন্ধানের অপর ধারাও ব্ৰহ্মতত্ত্বে উপনীত হওয়ার পূর্বে দীর্ঘ পথ পরিক্রম করেছিল। আমরা, দেখি যে, মধ্যপথে তা নিজেকে অতিজাগতিক উপাদানসমূহের সঙ্গে অস্থায়ীভাবে একাত্ম করে নিয়েছিল। মহাবিশ্বের বিস্ময়কর বিশালতা—বিশেষত আকাশমণ্ডল ও মহাশূন্যের ব্যাপ্তি খুব সম্ভবত ব্ৰহ্মবিষয়ক ধারণার প্রথম বস্তুগত ভিত্তিভূমি নির্মাণ করেছিল। বারংবার ব্যবহৃত আলো উজ্জ্বলতা, পুত্র, স্বর্ণ (অর্থাৎ সূর্য) নির্মল মহাশূন্য (বিরাজা) ধবলতা, অপ্ৰাপণীয় উচ্চতা সর্বব্যাপ্ত পরিসর যার পরে আর কিছু নেই–ইত্যাদি অনুষঙ্গ থেকে এই ব্ৰহ্ম ধারনার সমর্থন পাওয়া যায়। ব্রহ্মের এই সীমাহীনতা থাকে চূড়ান্তভাবে বোধ্যাতীত করে তুলেছে; কোনও সংজ্ঞার্থের মধ্যে তাকে আবদ্ধ করা যায় না। ব্ৰহ্ম সমগ্র সৃষ্টির চূড়ান্ত আশ্রেয়, সীমাহীন মহাবিশ্বের বিমূর্ত প্ৰকাশ, মৃত্যু ও বিনাশের অতীত এবং তাই বিশুদ্ধ আনন্দস্বরূপ।
উপনিষদীয় চিন্তাধারা তার শীর্ষবিন্দুতে উপনীত হয়েছিল, যখন সসীম আত্মার মৌল স্বরূপ এবং এই বস্তুগত জগতের পশ্চাদবর্তী বাস্তবত অথাৎ ব্ৰহ্ম সম্পর্কিত দুটি স্বতন্ত্র সিদ্ধান্ত এক ও অভিন্নরূপে উপলব্ধ ও ঘোষিত হ’ল। আমাদের বাহিরে ও ভিতরে একই বস্তু বিরাজমান; এই দুয়ের মধ্যে যারা ভিন্নতা দর্শন করে, তাদের দৃষ্টি বিকৃত এবং সেই ক্লিষ্ট ও ভীতিসকুল দৃষ্টির কাছে বাস্তবতা খণ্ডিত ও বহু ব’লে প্রতিপন্ন হয়। একমাত্র একত্বের উপলব্ধি মুক্তি-বিধান করতে সমর্থ যা বাক বা বুদ্ধি অনুধাবন করতে পারে না। আনন্দরূপে যখন তা উপলব্ধ হয়, কেবন তখনই ভয় ও উদ্বেগ থেকে নিশ্চিত মুক্তি পাওয়া সম্ভব। আত্মা ও ব্রহ্মের এই একত্ববোধের প্রক্রিয়া প্রাচীনতর উপনিষদগুলিতে শুরু হয়েছিল এবং এই প্রবণতা উপনিষদকে আরণ্যক থেকে পৃথক করেছে। খ্রিস্টপূর্ব প্ৰথম সহস্রাব্দের মধ্যস্তরে ভারতবর্ষে ব্ৰহ্মা ও আত্মার এই আপাত-সরল সমীকরণের প্রবল প্রভাব অনুভূত হয়েছিল, কারণ তা একটি বিশাল ব্যাপ্তিযুক্ত সামাজিক সমস্যার ভাগবত অনুবন্ধ নিমাণ করতে চেয়েছিল। এই সমস্যা ছিল গোষ্ঠীগত সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সমন্বয়ের সমস্যা। প্রাগ্বৈদিক, সিন্ধু উপত্যকার সভ্যতা ও বিভিন্ন অনার্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে বহু শতাব্দীব্যাপী সংঘর্ষ ও আর্যীকরণের যুগে যে জটিল ও বহুস্তর-বিন্যস্ত সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সংশ্লেষণের প্রক্রিয়া চলছিল, তার অনিবাৰ্য ফলশ্রুতিরূপে এমন একটি আধ্যাত্মিক প্রত্নকথার সৃষ্টি হল, যা বিচ্ছিন্নতা বা বিভাজনের পরিবর্তে সংশ্লেষণী ও সর্বাত্মকতার প্রবনতাকে অভিব্যক্ত করেছে।
আত্মা ও ব্রহ্মের একাত্মবোধের ধারণায় সমাজের সর্বস্তরের মানুষ পরমাত্মার সঙ্গে ঐক্যবোধের সম্ভাবনায় সমুন্নতি লাভ করল; এতে শুধু অনার্য জনগোষ্ঠীর অহংবোধ যে তৃপ্ত হ’ল তা নয়, প্ৰাগাৰ্য প্রতিবেশীকে শ্রদ্ধা এবং এমনকি, ঘনিষ্ঠতার বোধ গ্রহণ করতে শিখল। বিকাশোম্মুখ মিশ্র জনগোষ্ঠী পরস্পরকে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্ৰহণ করে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সমর্থনে তাত্ত্বিক যুক্তি পেয়ে গেল। অবশ্য এর অর্থ এই যে, এ সমস্তই কোনো পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটেছিল; প্রকৃতপক্ষে সেযুগের আধ্যাত্মিক অভিভাবকরা একটি বিশাল ও বিকাশমান জনগোষ্ঠীর সামাজিক কল্যাণের জন্য উপযুক্ত তত্ত্বের সন্ধান পেয়েছিল। ‘বৃহৎ’ শব্দনিম্পন্ন ‘ব্ৰহ্ম’ স্বাভাবিকভাবেই ছিল একটি ব্যাপক ভাবাদর্শ,–কোনও ব্যক্তি যদি কাল্পনিকভাবেও নিজেকে তার মধ্যে স্থাপিত করতে পারে, সমগ্ৰ মানবজাতির জন্য সে এর মধ্যে আধ্যাত্মিক আশ্রয় খুঁজে পায়। অন্যদিকে আত্মতত্ত্ব আংশিকভাবে মানুষের অন্তিম ভয় অর্থাৎ মৃত্যুর ফলে বিনাশের ভয়কে একটি নৈর্ব্যক্তিক স্তরে সমাধান করেছিল।
ব্যক্তির মৃত্যু হলেও মানবজাতির মৃত্যু হয় না; যখন কোনো ব্যক্তি নিজের সীমাবদ্ধ মরণশীল অস্তিত্বকে ভাবাদর্শের ক্ষেত্রে মানবজাতির অমর আত্মার পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপন করতে পারে, যা মৃত্যুহীন অসীম আত্মা–তখন সেই ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত দেহাবসানের পরেও জীবনের নিরবচ্ছিন্নতার আশ্বাস পেয়ে নিরাপদ বোধ করে। সুতরাং এ-দুটি ভাবাদর্শের সম্মিলনের ফলে অন্তত ভাবাদর্শের ক্ষেত্রে বহু সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়েছিল। স্বভাবত, বিশেষভাবে বর্ণ-বিন্যস্ত ও শ্রেণীবিভক্ত সমসাময়িক সমাজ তখনো মন্দভাগ্যদের নিপীড়ন করছিল, নানাবিধ যজ্ঞ তখনো অনুষ্ঠিত হচ্ছিল, পুরোহিতরা পূর্ববৎ লোভী ছিল, যদিও জনসাধারণের একটি অংশ প্রচলিত ধর্ম সম্পর্কে ক্রমশ অধিকতর বিক্ষুদ্ধ ও হতাশ হয়ে উঠেছিল, সমাজের বিপুল সংখ্যাগুরু অংশ তখনও পর্যন্ত অভ্যস্ত আনুষ্ঠানিক ধর্মের মাধ্যমে তাদের বিক্ষুব্ধ ধমীয় বিবেকের সমাধান সন্ধান করছিল। সেই মুহুর্তে সামাজিক স্তরে খুব সামান্য বস্তুগত অভিজ্ঞতা লাভ সম্ভব ছিল, তবে ব্ৰহ্মাত্ম-তত্ত্বের মধ্যে এমন একটি যুক্তিসিদ্ধ সূত্রের সন্ধান পাওয়া গেল, যা সামাজিক বাস্তবতাকে নতুন পথের সন্ধান দিয়ে বহু সম্ভাব্য শক্রিতা ও রক্তপাতের আশঙ্কাকে প্ৰতিহত করেছিল। বিশ্বজগতের মৌল স্বরূপ ও উৎপত্তি, তার বিভিন্ন উপাদান এবং মানবিক অস্তিত্ব সম্পর্কে উৎসাহ এই যুগের বিশিষ্ট চরিত্রলক্ষণ, তবে ব্ৰাহ্মণ সাহিত্যের মতো এখানেও বিভিন্ন প্ৰত্বকথার মধ্যে কোনো সাযুজ্যবোধ নেই। মুণ্ডক উপনিষদের মতে অক্ষর থেকে সৃষ্টির উৎপত্তি হয়েছিল–একধরনের বিবর্তনের ক্ৰম-অনুযায়ী প্ৰাণ, মন, ইন্দ্ৰিয়সমূহ, আকাশ, বায়ু, আলো ও জল উদ্ভূত হয়েছিল। তৈত্তিরীয় উপনিষদে এই ক্রম সামান্য পরিবর্তিতভাবে আত্মা থেকে উদ্ভূত। বিভিন্ন প্রত্নকথায় দৃশ্যমান জগতের অন্তরালে প্রচ্ছন্ন তত্ত্বগত বাস্তবতার মূল উৎসরূপে বিভিন্ন সারবস্তুকে নির্দেশিত করা হয়েছে। সে সময় বহু আঞ্চলিক রূপভেদ ও আধ্যাত্মিক বিবর্তনের বহুস্তরযুক্ত অভিব্যক্তি-সহ যেসব সৃষ্টিতত্ত্ব জনমানসে ভেসে বেড়াচ্ছিল, সেগুলিকে সংহত করার উদগ্র আকাঙ্ক্ষাই ঐ প্রবণতার কারণ। এভাবে একটি বিবর্তন-নির্ভর ভাবনির্মাণে পরস্পর বিপরীত সৃষ্টিতত্ত্বগুলিকে সন্নিবেশিত করে তাদের চূড়ান্ত রূপদানের চেষ্টা হয়েছে। (যেমন তৈত্তিরীয় ২ : ৬, ৭; ঐতরেয় ১ : ১ ১-৪, ১২; ছান্দোগ্য ৩ : ২১ : ২, ৪ : ১৭ : ১৩; বৃহদারণ্যক ১ : ২ : ৫ ইত্যাদি) পরবর্তী উপনিষদগুলিতে সৃষ্টির আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্য স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে। পরমাত্মার সৃষ্টি-আকাঙ্ক্ষা ও সৃষ্টির প্রয়োজনে তপস্যায় নিরত হওয়ার বৃত্তান্ত বহু প্রত্ন-কথায় পাওয়া যায়। সৃষ্টিশীল শক্তি, সৃষ্টিপ্রক্রিয়া ও সৃষ্টির পশ্চাদবতী সক্রিয় মহাশক্তি সম্পর্কে বিভিন্ন প্রত্নকথায় ভিন্ন ভিন্ন বিবরণ রয়েছে। বৃহদারণ্যক উপনিষদের একটি কাহিনীতে মানবজীবনের একাকিত্বের অনুভূতি, সঙ্গিনীর আকাঙ্ক্ষা, নারীপুরুষের মিলন ও সন্তান উৎপাদনের অভিজ্ঞতার উপর নির্ভরশীল ভাবনাকাব্যিক অভিব্যক্তি পেয়েছে। লক্ষণীয় যে, মরণশীল মানুষকে সেখানে মৃত্যুহীন দেবতার স্রষ্টারূপে বর্ণনা করা হয়েছে (১ : ৪ : ৬), যাতে উপনিষদীয় ভাবনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত আছে।
চুড়ান্ত জ্ঞানের জন্য আধ্যাত্মিক সন্ধানের অন্য মেরুতে রয়েছে প্রেততত্ত্ব; সৃষ্টিতত্ত্ব ও প্ৰেমতত্ত্ব প্রকৃতপক্ষে পরস্পরের পরিপূরক। সংহিতা সাহিত্যে এই বিষয়ে ভাবনার সূত্রপাত হলেও পরবর্তী অধ্যায়েই তা নিজস্ব চরিত্র অর্জন করে। এই তত্ত্ব সন্ধানের সূচনা-বিন্দুতে রয়েছে মানুষ ও মানুষের মরণোত্তর ভাগ্য। জীবনের সর্বাপেক্ষা প্রধান শক্ৰ যে মৃত্যু, তার সম্পর্কে চেতনা অধিকাংশ আধ্যাত্মিক চিন্তাধারার সূচনা-বিন্দু এবং সেই সঙ্গে সর্বপ্রধান সমস্যার কেন্দ্র। তবে, মৃত্যুকে জয় করা অর্থাৎ দৈহিক মৃত্যুর পরেও জীবনের নিরবচ্ছিন্নতা স্থাপনই একধরনের ভাবনার প্রকৃত উদ্দেশ্যে। তাই গ্রিক, ইহুদী ইরাণীয় এবং অন্যান্য দেশের ধমীয় ও আধ্যাত্মিক চিন্তাবিদগণ এ-বিষয়ে বিশেষভাবে চিন্তাবিষ্ট হয়েছিলেন। প্রত্যেক উপনিষদ পৃথকভাবে এই সমস্যা আলোচনা করে নিজস্ব উপায়ে সমাধান উপনীত হতে চেয়েছে; এইসব সমাধান আবার একটি বিন্দুতে পরস্পরের সঙ্গে সম্মিলিত হয়েছে : তা হল ব্রহ্মের স্বরূপ সম্পর্কে জ্ঞানই পুনর্জন্ম থেকে মুক্তি দেয়। ঈশ ও কঠোপনিষদে নিরানন্দময় অন্ধকারে আবৃত মৃত্যুলোকের বর্ণনা আমাদের চোখে পড়ে। বিভিন্ন উপনিষদে এই মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছেঃ দেহ বিনষ্ট হওয়ার পর মানুষের কী অবশিষ্ট থাকে এই প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে যে আত্মা অবশিষ্ট থাকে (কাঠ ২ : ২ : ৪)। এই উপনিষদে পুনর্জন্মতত্ত্ব স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে। এধরনের প্রশ্ন ও মীমাংসা আমরা ‘কেন” এবং প্রশ্নোপনিষদেও লক্ষ্য করি। প্রেততত্ত্ব সম্বন্ধীয় বিখ্যাত দেবযান ও পিতৃযান তত্ত্বের প্রাথমিক আভাস রয়েছে মুণ্ডকোপনিষদে (১ : ২ : ১১)। ছান্দোগ্য উপনিষদে এই ধারণাকে আরও বিশদ করা হয়েছে। তৈত্তিরীয়, ঐতরেয় ও শ্বেতাশ্বেতর উপনিষদে প্রেততত্ত্ব সম্পর্কিত বিভিন্ন ধারণাকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করা হয়েছে। শেষোক্ত উপনিষদে বলা হয়েছে যে, মানুষের আপন কর্ম অনুযায়ী তারা আত্মা বিভিন্ন লোকে ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করে থাকে (৫ : ১১ : ১২)। স্পষ্ট বোঝা যায় যে, এই পর্যায়ে কর্মবাদ পুনর্জন্মতত্ত্বের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে রয়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, দেহান্তরবাদতত্ত্ব ক্রমশ একটি যুক্তিসিদ্ধ-ভাবসংগঠনের মধ্যে বিন্যস্ত হচ্ছিল।
অন্য উপনিষদগুলির তুলনায় ছান্দোগ্য উপনিষদ প্রেততত্ত্ব সম্পর্কে অধিক আলোচনা করে আমাদের কাছে অনেক বেশি তথ্য উপস্থাপিত করেছে। বলা হয়েছে যে, কোনও মানুষ তার প্রাক্তন জন্মে অজিত কর্মফল অনুযায়ী ব্ৰাহ্মণ, ক্ষত্ৰিয়,বৈশ্য, কুকুর, শূকর বা চণ্ডালরূপে পুনর্জন্ম গ্ৰহণ করে (৫ : ১০ : ৭); এমনকি, স্বৰ্গ ও চিরস্থায়ী সুখের নিকেতন নয়, কর্মফলের শক্তি ক্ষীণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বর্গ থেকে আত্মাকে নির্বাসিত হতে হয় (৮ : ১ : ৬)। মরণোত্তর আত্মার বিভিন্ন অবস্থান, ভিন্ন ভিন্ন লোক এবং তৎসংশ্লিষ্ট অন্যান্য বর্ণনা ছান্দোগ্য ও বৃহদারণ্যক উপনিষদে লক্ষ্য করা যায়।