অতঃপর জিজ্ঞাসিলা রাজা জন্মেজয়।
পিতামহ-কথা কহ, শুনি মহাশয়।।
বলেন বৈশম্পায়ন, শুন নরপতে।
ভদ্রা-পার্থে স্বয়ম্বর হইবে যেমতে।।
বলিলেন যদি ইহা বীর ধনঞ্জয়।
সত্যভামা তাহারে কহেন সবিনয়।।
ঔষধ করিবে পার্থ স্ত্রীর এই বিধি।
পুরুষ হইয়া তুমি কৈলে কি ঔধধি।।
ভণ্ডতা করিয়া হইয়াছ ব্রহ্মচারী।
মহৌষধি শিখিয়াছ ভুলাইতে নারী।।
অর্জ্জুন বলেন, স্তুতি করি সত্যভামা।
নিশাশেষ, নিদ্রা যাই, কর আজি ক্ষমা।।
জিতেন্দ্রিয় সত্যবাদী ব্রহ্মচারী আমি।
তীর্থযাত্রা করি দেশ দেশান্তরে ভ্রমি।।
মিথা অপবাদ কেন দিতেছে আমারে।
শুনিলে আমারে নিন্দা করিবে সংসারে।।
বুঝিয়া পার্থের মন উঠেন ভারতী।
সুভদ্রা বলেন, কহ কোথা যাও সতী।।
সতী বলে, আইসহ করিব উপায়।
এত বলি ভদ্রা লৈয়া গেলেন আলয়।।
নার মায়া জানে মায়াবতী কামপ্রিয়।
সখি দিয়া শীঘ্র রতি আনেন ডাকিয়া।।
গুপ্তেতে কহেন সব ভদ্রার চরিত্র।
রতি বলে, ঠাকুরাণী এ কোন্ বিচিত্র।।
জিতেন্দ্রিয় ব্রহ্মচারী পার্থ গর্ব্ব করে।
পার্থের সে গর্ব্ব আজি দিব চূর্ণ করে।।
এত বলি সিন্দূর পড়িয়া দিল ভালে।
মন্ত্র পড়ি দিল দুই নয়ন কজ্জলে।।
যাত দেবি, এক্ষণে যাইতে পাবে বাট।
হস্ত দিলে ঘুচিবেক দ্বারের কপাট।।
শুনিয়া রতির বাক্য সানন্দ হইয়া।
পুনরপি ভদ্রা তথা উত্তরিল গিয়া।।
হস্ত দিতে কপাটের অর্গল ঘুচিল।
অর্জ্জুন-সম্মুখে গিয়া ভদ্রা দাঁড়াইল।।
বত্রিশ কলাতে যেন শোভিত চন্দ্রমা।
চিত্রকর-চিত্র যেন কনক প্রতিমা।।
কে তুমি বলিয়া ক্রোধে উঠিল ফাল্গুনি।
স্ত্রী নহিলে কাটিতাম খড়্গেতে এখনি।।
যাহ শীঘ্র হেথা হৈতে প্রাণ লৈয়া বেগে।
নহিলে নাসিকা কান কাটিব খড়্গেতে।।
এত বলি উঠিলেন হাতে লৈয়া ছুরি।
দেখিয়া সুভদ্রা অঙ্গ কাঁপে থরহরি।।
সিঁথায় সিন্দূর তার, নয়নে কজ্জল।
দেখিয়া পড়েন পার্থ হইয়া বিহ্বল।।
হরিল পার্থের জ্ঞান কামের বিভোলে।
তখনি উঠিয়া তারে করিলেন কোলে।।
আইস আইস বৈস ওহে প্রাণসখি।
তোমার বদন পূর্ণ চন্দ্রমা নিরখি।।
নাহি নাহি করি ভদ্রা বস্ত্রে মুখ ঢাকে।
জাতিনাশ কর কেন ছাড় ছাড় ডাকে।।
একি পার্থ এ তোমার কেমন বিচার।
অনূঢ়া কন্যার সহ একি ব্যবহার।।
বলেন বাহিরে থাকি সত্রাজিত-সুতা।
কহ পার্থ, গণ্ডগোল কি করিছ হেথা।।
সুভদ্রা বলেন, সখি দেখনা আসিয়া।
আমারে অর্জ্জুন বীর ধরে কি লাগিয়া।।
সত্যভামা বলে পার্থ, অনূঢ়া এ নারী।
কিমতে ধরহ বরে হয়ে ব্রহ্মচারী।।
বসুদেব সুতা হয় কৃষ্ণের ভগিনী।
কেন হেন কর্ম্ম কর, ধার্ম্মিক আপনি।।
বলেন বিনয় বাক্য পার্থ বীরবর।
অনন্ত নারীর মায়া বুঝিবে কি নর।।
তোমার অশেষ মায়া বিধি অগোচর।
আমি কি বুঝিব, নারিলেন দামোদর।।
না জানিয়া তব আজ্ঞা করিনু লঙ্ঘন।
ক্ষমহ, তোমার পায় লইনু শরণ।।
অর্জ্জুনের স্তবে তুষ্টা হইয়া ভারতী।
হাসিয়া বলিলেন ভীত নহ মহামতি।।
যে হইল অর্জ্জুন বুঝিনু তব কর্ম্ম।
গান্ধর্ব্ব বিবাহ কর আছে ক্ষত্র-ধর্ম্ম।।
পাঁচ সাত সখী মিলি দিয়া ছলাহুলি।
দোঁহাকার গলে দোঁহে মালা দিল তুলি।।
হেনমতে দোঁহার বিবাহ করাইয়া।
সত্যভামা গোবিন্দে বলেন সব গিয়া।।
সত্যভামা বলেন, যে আজ্ঞা কৈলে তুমি।
গান্ধর্ব্ব বিবাহ দিয়া আইলাম আমি।।
কালি প্রাতে কর তুমি বিবাহের কাজ।
দূত পাঠাইয়া আন কুটুম্ব-সমাজ।।
অতএব বলি যে বিলম্ব নাহি সয়।
গোবিন্দ বলেন, সতী এই মত হয়।।
কিন্তু বলভদ্রের অর্জ্জুনে নাহি প্রীত।
পার্থে দিতে তাঁহার নহিবে মনোনীত।।
সত্যভামা বলেন যে কি উপায় করি।
উপায় করিব, বলি বলেন শ্রীহরি।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীদাস কহে, সদা সাধু করে পান।।