১২৮তম অধ্যায়
সোমাকনৃপতির শতপুত্ৰলাভ
“সোমক কহিলেন, “হে ব্ৰহ্মন! এই যজ্ঞে যেরূপ অনুষ্ঠান করা কর্ত্তব্য, তাহা সমুদয় কীর্ত্তন করুন, আমি পুত্ৰলাভার্থ আপনার বাক্যানুসারে কাৰ্য্য করিব।” তখন ঋত্বিক যজ্ঞ আরম্ভ করিয়া রাজমহিষীগণের নিকট হইতে জন্তুকে গ্ৰহণ করিবার উপক্রম করিলে, পুত্ৰবৎসলা রাজমহিষীগণ ঋত্বিকের হস্ত হইতে বলপূর্ব্বক তনয় গ্রহণ করিবার মানসে ‘হা হতোহস্মি’ বলিয়া রোদন করিতে করিতে বালকের দক্ষিণকর গ্রহণপূর্ব্বক আকর্ষণ করিতে লাগিলেন, ঋত্বিকও তাহার বামহস্ত ধারণ করিয়া বলপূর্ব্বক তাহাকে গ্রহণ করিলেন। তখন রাজমহিষীগণ উপায়ান্তর প্রাপ্ত না হইয়া কেবল কুররী [উৎক্রোশ পক্ষী] কুলের ন্যায় করুণস্বরে ক্ৰন্দন করিতে লাগিলেন। অনন্তর ঋত্বিক সেই বালককে সংহার করিয়া তাহার বসা গ্রহণপূর্ব্বক বিধিবৎ আহুতি প্ৰদান করিতে লাগিলেন। তখন রাজমহিষীগণ তাহার ধূম আঘ্রাণপূর্ব্বক শোকে একান্ত অভিভূত হইয়া সহসা বসুধাতলে নিপতিত হইলেন।
“কিয়দ্দিন পরে রাজমহিষীগণ সকলেই গর্ভবতী হইলেন। দশম মাস পূর্ণ হইলে তাঁহাদের সকলেরই এক এক পুত্ৰ সমুৎপন্ন হইল। জন্তু সর্ব্বাগ্রে স্বীয় পূর্ব্ব-গৰ্ভধারিণীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করিল। রাজমহিষীরা স্ব স্ব প্রসূত পুত্ৰগণ অপেক্ষা জন্তুকে সমধিক স্নেহ করিতেন। জন্তুর বামপার্শ্বে ঋত্বিকের বিচনানুরূপ সৌবর্ণ-চিহ্ন লক্ষিত হইল, সর্ব্বজ্যেষ্ঠ জন্তু গুণেও সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হইয়া উঠিল।
“অনন্তর মহারাজ সোমকের ঋত্বিক কালগ্রাসে নিপতিত হইলে, কিয়াৎকাল পরে মহীপতি সোমকও পরলোকযাত্ৰা করিলেন। তিনি শমনসদনে গমন করিয়া দেখিলেন, স্বীয় ঋত্বিক ঘোরতর নরকে নিপতিত রহিয়াছেন। তখন তিনি ঋত্বিকের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে দ্বিজবর! আপনি কি নিমিত্ত এই ঘোর নরকে নিপতিত রহিয়াছেন?” ঋত্বিক কহিলেন, “হে রাজন! আমি আপনাকে যে সেই যজ্ঞানুষ্ঠান করাইয়াছিলাম, তাহারই ফলভোগ করিতেছি।” মহাত্মা সোমক-মহীপতি ঋত্বিকের বচন-শ্রবণানন্তর যমকে কহিলেন, “হে ধর্ম্মরাজ! আমার যাজককে এই নরক হইতে বিমুক্ত করুন; আমি স্বয়ং এই নরকাগ্নিমধ্যে প্রবেশ করিব, ইনি আমার গুরু, আমারই নিমিত্ত এই নরকানলে দগ্ধ হইতেছেন।” যম কহিলেন, “হে রাজন! একজনের কর্ম্মফল অন্যে ভোগ করিতে পারে না। ঐ দেখ, তোমার সমুদয় সৎকর্ম্মের ফল বিদ্যমান রহিয়াছে।’ সোমক কহিলেন, “এ ব্ৰহ্মবাদী ব্যক্তি ব্যতিরেকে আমি পবিত্ৰ লোক ভোগ করিতে বাসনা করি না; স্বর্গেই হউক আর নরকেই হউক, আমি ইঁহার সহিত একত্র বাস করিতে বাসনা করি। ইঁহার ও আমার কর্ম্মসকল সমান, অতএব আমাদের দুইজনের পুণ্যাপুণ্যফল সমান হউক।” যম কহিলেন, “যদি তোমার এইরূপ অভিলাষ হইয়া থাকে, তবে উহার সহিত সমকাল নরক-ভোগ কর, পরিশেষে তোমরা উভয়েই সদগতিলাভ করিবে।”
পাণ্ডবগণের সোমকতীৰ্থ দৰ্শন
“গুরুপ্রিয় মহারাজ সোমক যমের বিচনানুসারে গুরুর সহিত কিয়ৎকাল নরক-ভোগ করিয়া ক্ষীণপাপ ও বিমুক্ত হইয়া পরিশেষে তাঁহার সহিত স্বকর্ম্ম-নির্জ্জিত চিরাভিলষিত শুভফলসমুদয় লাভ করিলেন। হে যুধিষ্ঠির! সেই মহাত্মা রাজর্ষির এই পরমপবিত্ৰ আশ্রম অগ্ৰে বিরাজিত রহিয়াছে। ক্ষমাশীল হইয়া এই আশ্রমে ছয় রাত্রি বাস করিলে সদগতিলাভ হয়। হে ধর্ম্মাত্মন! আমরা বিগতক্লম হইয়া সংযত-চিত্তে ছয় রাত্রি এখানে বাস করিব, আপনি সজ্জীভূত হউন!”