১২৮তম অধ্যায়
ব্যূহমধ্যে দ্রোণ ভীমযুদ্ধ
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! অনন্তর দ্রোণাচাৰ্য্য ভীমসেনকে রথসৈন্য অতিক্রম করিতে দেখিয়া তাঁহাকে নিবারণ করিবার মানসে তাঁহার উপর শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। মহাবীর ভীম দ্রোণনিক্ষিপ্ত সেই সমস্ত শর নিরাকরণ করিয়া মায়াবলে বলসমুদয়কে বিমোহিত করিয়া ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন মহীপালগণ আপনার আত্মজগণের আদেশানুসারে মহাবেগে গমন করিয়া ভীমকে বেষ্টন করিতে লাগিলেন। মহাবীর ভীম তদ্দর্শনে সিংহনাদ পরিত্যাগপূর্ব্বক হাস্যমুখে তাঁহাদের উপর মহাবেগে দেবরাজনির্মুক্ত অশনির ন্যায় এক শত্রুপক্ষবিনাশিনী গদা নিক্ষেপ করিলেন। সেই তেজঃপ্রজ্বলিত মহাগদা স্বীয় ভীষণ রবে ধরণীমণ্ডল পরিপূর্ণ করিয়া সৈন্যগণকে মথিত ও আপনার আত্মজদিগকে নিতান্ত ভীত করিতে লাগিল। আপনার পক্ষীয় বীরগণ সেই তেজঃপুঞ্জবিরাজিত গদা মহাবেগে নিপাতিত হইতে দেখিয়া ভৈরবরব পরিত্যাগপূর্ব্বক ইতস্ততঃ ধাবমান হইলেন। রথীসকল সেই গদার দুঃসহ শব্দশ্রবণে রথ হইতে নিপতিত হইতে লাগিল। অসংখ্য বীরগণ ভীমের গদাঘাতে আহত ও নিতান্ত ভীত হইয়া ব্যাঘ্রদর্শনে ভীত মৃগযুথের ন্যায় রণস্থল হইতে পলায়ন করিতে আরম্ভ করিলেন। এইরূপে মহাবীর ভীমসেন দুর্জ্জয় শত্রুগণকে বিদ্রাবিত করিয়া পতগরাজ গরুড়ের ন্যায় মহাবেগে সেই সেনা অতিক্রমপূর্ব্বক ধাবমান হইলেন।
“অনন্তর মহাবীর দ্রোণ ভীমসেনকে সৈন্যসংহারে প্রবৃত্ত দেখিয়া তাঁহার প্রতি গমন ও শরনিকরে তাঁহাকে নিবারণ করিয়া পাণ্ডবগণের অন্তঃকরণে ভয়সঞ্চারপূর্ব্বক সিংহনাদ করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন ভীমসেনের সহিত দ্রোণের দেবাসুরসংগ্রামসদৃশ ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হইতে লাগিল। দ্রোণাচাৰ্য্য সুতীক্ষ্ণ শরনিকরদ্বারা সহস্র সহস্র পাণ্ডবসৈন্যকে বিনাশ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। মহাবীর ভীম তদ্দর্শনে রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া নয়নযুগল নিমীলিত করিয়া মহাবেগে পাদচারে দ্রোণাভিমুখে গমন করিলেন এবং বৃষভ যেমন অবলীলাক্রমে বারিবর্ষণ সহ্য করিয়া থাকে, তদ্রূপ অনায়াসে দ্রোণের শরবৃষ্টি প্রতিরোধ করিতে লাগিলেন। তৎপরে দ্রোণাচার্য্যের রথের ঈষামুখ গ্রহণ করিয়া রথের সহিত তাঁহাকে অতিদূরে নিক্ষেপ করিলেন। দ্রোণাচাৰ্য্য এইরূপে ভীমকর্ত্তৃক নিক্ষিপ্ত হইয়া তৎক্ষণাৎ অন্য রথে আরোহণপূর্ব্বক বৃহদ্বারে সমুপস্থিত হইলেন। ঐ সময় ভীমের সারথি মহাবেগে অশ্বচালন করিতে আরম্ভ করিল; তদ্দর্শনে সকলেই বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন। তখন মহাবীর ভীম মহাবেগে কৌরবসৈন্য অতিক্রম করিলেন এবং যেমন উদ্ধত বায়ু পাদপদল বিমর্দ্দিত করে তদ্রূপ তিনি ক্ষত্রিয়গণকে মর্দ্দন ও নদীবেগ যেরূপ বৃক্ষসকল নিবারিত করে, তদ্রূপ সৈন্যগণকে নিবারিত করিয়া গমন করিতে লাগিলেন। তৎপরে তিনি হার্দ্দিক্যরক্ষিত ভোজসৈন্য প্রমথিত ও তলধ্বনিদ্বারা অন্যান্য সৈন্যগণকে বিত্রাসিত করিয়া শার্দুল যেমন বৃষভদিগকে পরাভব করে, তদ্রূপ সৈন্যগণকে পরাজয় করিলেন।
ব্যূহসমীপে ভীমাগমনে অর্জ্জুনের হর্ষ
“হে মহারাজ! এইরূপে মহাবীর ভীমসেন কৌরবপক্ষীয় ভোজসৈন্য, কাম্বোজসৈন্য ও অন্যান্য যুদ্ধবিশারদ বহুসংখ্যক স্লেচ্ছগণকে অতিক্রমপূর্ব্বক মহাবীর সাত্যকিকে সংগ্রামে প্রবৃত্ত দেখিয়া পরমযত্নসহকারে অর্জ্জুনদর্শনাভিলাষে বায়ুবেগে গমন করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে জয়দ্রথবধার্থ যুদ্ধে প্রবৃত্ত, মহাবলপরাক্রান্ত মহাবীর ধনঞ্জয় তাঁহার নেত্রপথে নিপতিত হইলেন। বর্ষাকালে জলপটল যেমন অতি গভীর গর্জ্জন করিয়া থাকে, তদ্রূপ মহাবীর বৃকোদর অর্জ্জুনকে অবলোকন করিয়া ভয়ঙ্কর সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর অর্জ্জুন ও বাসুদেব তেজস্বী ভীমের সেই ঘোরতর সিংহনাদশ্রবণে তাঁহাকে দর্শন করিবার নিমিত্ত বারংবার সিংহনাদ পরিত্যাগপূর্ব্বক গর্জ্জমান বৃষভদ্বয়ের ন্যায় রণস্থলে সঞ্চরণ করিতে আরম্ভ করিলেন।
অর্জ্জুনযুদ্ধক্ষেত্রে ভীমপ্রবেশে যুধিষ্ঠিরের হর্ষ
“এদিকে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ভীম ও অর্জ্জুনের সিংহনাদবণে নিতান্ত প্রীত, প্রসন্ন ও শোকশূন্য হইয়া বারংবার অর্জ্জুনের বিজয় প্রার্থনা করিতে লাগিলেন। অনন্তর তিনি মদমত্ত ভীমকে সিংহনাদে প্রবৃত্ত দেখিয়া হাস্যমুখে মনে মনে কহিতে লাগিলেন, ‘হে ভীম! তুমি গুরু-আজ্ঞা প্রতিপালন ও অর্জ্জুনের কুশলসংবাদ প্রদান করিলে। তুমি যাহাদের উপর বিদ্বেষভাব প্রদর্শন করিয়া থাক, তাঁহাদিগের কদাচ জয়লাভ হয় না। এক্ষণে বুঝিলাম, মহাবীর অর্জ্জুন ভাগ্যবলে জীবিত আছেন এবং সত্যবিক্রম সাত্যকিরও মঙ্গল। আমি ভাগ্যক্রমে বাসুদেব ও ধনঞ্জয়ের গর্জ্জনধ্বনি শ্রবণ করিতেছি। যিনি যুদ্ধে দেবরাজ ইন্দ্রকে পরাজয় করিয়া হুতাশনের তৃপ্তিসাধন করিয়াছেন এবং আমরা যাঁহার, বাহুবল অবলম্বন করিয়া প্রাণধারণ করিতেছি, সেই অরাতিবিজয়ী অর্জ্জুন ভাগ্যবলে জীবিত আছেন। যিনি একমাত্র শরাসন গ্রহণ করিয়া সুরগণকে ও দুর্দ্ধর্ষ নিবাতকবচগণকে জয় করিয়াছিলেন এবং যিনি বিরাটনগরে গোগ্ৰহণার্থ সমাগত কৌরবগণকে পরাজয় করেন, সেই অর্জ্জুন ভাগ্যবলে জীবিত রহিয়াছেন। যিনি নিজ ভুবলে চতুর্দ্দশসহস্র কালকেয়গণকে বিনাশ করিয়াছিলেন এবং দুৰ্য্যোধনের হিতসাধনার্থ গন্ধৰ্ব্বরাজ চিত্ররথকে অস্ত্রবলে পরাজয় করিয়াছিলেন, সেই কিরীটসমলঙ্কৃত শ্বেতবাহন কৃষ্ণসারথি প্রিয় ধনঞ্জয় ভাগ্যবলে এক্ষণে জীবিত রহিয়াছেন।
মহাবীর অর্জ্জুন পুত্রশোকে নিতান্ত সন্তপ্ত হইয়া জয়দ্রথের বধরূপ অতি দুষ্কর কাৰ্য্যসাধনার্থ প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন, তাঁহার সেই প্রতিজ্ঞা কি সফল হইবে? আজ কি দিনমণি অস্তাচলচূড়াবলম্বী হইতে হইতে বাসুদেবসুরক্ষিত অর্জ্জুন প্রতিজ্ঞা হইতে উত্তীর্ণ হইয়া আমার নিকট আগমন করিবেন? দুৰ্য্যোধন হিতানুষ্ঠাননিরত সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ কি অর্জ্জুনের শরে নিপতিত হইয়া আমাদিগকে আনন্দিত করিবে? মূঢ় রাজা দুৰ্য্যোধন সিন্ধুরাজকে নিহত ও ভীমসেনশরে ভ্রাতৃগণকে বিনষ্ট দেখিয়া কি আমাদিগের সহিত সন্ধিস্থাপন করিবেন এবং অন্যান্য যোদ্ধাদিগকে ভূতলে নিপতিত দেখিয়া কি অনুতপ্ত হইবেন? একমাত্র ভীষ্মের নিপাতে আমাদিগের কি বৈরানল নির্ব্বাণ হইবে? রাজা দুৰ্য্যোধন কি অবশিষ্ট বীরগণকে রক্ষা করিবার নিমিত্ত আমাদের সহিত সন্ধি করিবেন? হে মহারাজ! এইরূপে কৃপাপরতন্ত্র রাজা যুধিষ্ঠির যখন নানা প্রকার চিন্তা করিতেছিলেন, তৎকালে কুরুপাণ্ডবের ঘোরতর যুদ্ধ হইতেছিল।”