১২৮. পাণ্ডুর ঔর্দ্ধদেহিক ক্রিয়া, সত্যবতীর গ্রহাশ্রমত্যাগ, কুরু-পাণ্ডব বালকদিগের ক্রীড়া, পাণ্ডবনিগ্রহে দুর্য্যোধনের দুরভিসন্ধি, দুর্য্যোধন কর্তৃক ভীমকে বিষদান, জলমগ্ন ভীমের নাগলোকে গমন
অষ্টাবিংশত্যধিকশততম অধ্যায়।
বৈশম্পায়ন কহিলেন,-তদনন্তর কুন্তী, রাজা ধৃতরাষ্ট্র ও ভীষ্ম, বন্ধুগণ সমবেত হইয়া বেদবিধানানুসারে পাণ্ডুর ঔদ্ধদেহিকক্রিয়া সম্পাদন করিয়া সহস্র সহস্র ব্রাহ্মণ ও জ্ঞাতিবর্গকে ভোজন করাইলেন এবং প্রধান প্রধান বিপ্রগণকে প্রভূত রত্ন ও উত্তমোত্তম গ্রামসকল প্রদান করিলেন। পরে কৃতশৌচ পাণ্ডবগণকে সমভিব্যাহারে লইয়া হস্তিনানগরে প্রবেশ করিলেন। পৌরবর্গ ও জানপদগণ পরলোকগত স্বকীয় বান্ধবের ন্যায় রাজর্ষি পাণ্ডকে স্মরণ করিয়া অনুক্ষণ পরিতাপ করিতে লাগিল।
মহারাজ পাণ্ডুর শ্রাদ্ধকাৰ্য্য সমাপনানন্তর মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন সেই সমস্ত লোকদিগকে দুঃখিত ও স্বীয় জননী সত্যবতীকে শোকসন্তপ্ত দেখিয়া তাঁহাকে কহিলেন, মাতঃ! সময় অতিশয় দারুণ হইয়া উঠিয়াছে, এক্ষণে। সুখের লেশমাত্রও নাই; দিন দিম পাপ বৃদ্ধি হইতেছে; পৃথিবী শস্যশূন্য। ও ফলবিহীনা হইতেছে। বোধ হয়, লোক সকল কালক্রমে নানাবিধ মায়জালে জড়িত ও নানাদোষসঙ্কীর্ণ হইয়া উঠিবে। প্রায় সকলেই কুকর্মানুষ্ঠানে নিরত হইবে। ধর্ম কর্ম একবারে বিলুপ্ত হইয়া যাইবে। কুরুদিগের দুর্নীতি প্রযুক্ত রাজশ্রী তাহাদিগকে পরিত্যাগ করিবেন। তাহারা অতি অল্পদিনের মধ্যেই সবংশে কৃতান্তসদনে গমন করিবে; অতএব আপনি স্বচক্ষে স্বীয় বংশের বিনাশ দেখিবার পরিবর্তে বনে গমনপূর্বক যোগানুষ্ঠানে যত্ন করুন।
সত্যবতী ব্যাসের বাক্যে অনুমোদন করিয়া অন্তঃপুরে প্রবেশপূর্বক স্বীয় পুত্রবধূ অম্বিকাকে কহিলেন,—অম্বিকে! শুনিতে পাইলাম, তোমার পৌত্রের অত্যাচারবশতঃ অল্প দিনের মধ্যেই আমাদিগের বংশ একবাবেই উচ্ছিন্ন হইবে, অতএব যদি তোমার মত হয়, তবে চল, আমরা পুত্রশোকার্তা কৌশল্যাকে সমভিব্যাহারে লইয়া কাননে প্রস্থান করি। অম্বিকা শ্বশ্রুর বাক্য শ্রবণ করিয়া “যে আজ্ঞা” বলিয়া স্বীকার করিলেন। তখন সত্যবতী ভীষ্মকে আমন্ত্রণপূর্বক সুষাদ্বয়কে সমভিব্যাহারে লইয়া বনে গমন করিলেন। তথায় কঠোর তপস্যা করিতে করিতে কলেবর পরিত্যাগ করিয়া স্ব স্ব অভিলষিত মার্গে প্রস্থান করিলেন।
এদিকে যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চপাণ্ডব, পৈতৃক ভবনে থাকিয়া বিবিধ রাজভোগ উপভোগ দ্বারা দিন দিন বৃদ্ধি পাইতে লাগিলেন। ক্রমে ক্রমে তাহাদের বেদোক্ত সংস্কারসকল সম্পাদিত হইল। তাহারা দুৰ্য্যোধনাদি শত ভ্রাতার সহিত সতত পরমসুখে ক্রীড়া করিতেন। সমস্ত বাল্যক্রীড়াতেই তাহাদের বিশেষ তেজস্বিতা প্রকাশ পাইত। স্পৰ্দ্ধাপূর্বক সবেগ গমন, লক্ষ্যাভিহরণ ও অন্যান্য ক্রীড়ায় ভীমসেন যাবতীয় ধার্তরাষ্ট্রগণকে পরাভূত করিতেন। যখন ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রগণ পরমালাদে ক্রীড়া করিত, বৃকোদর তৎকালে তাহাদের পরস্পরের মস্তকে সংঘটন করিয়া দিতেন। ধার্তরাষ্ট্রের শত ভ্রাতা ও মহাবল পরাক্রান্ত ভীমসেন একাকী, তথাপি তাঁহাদের সকলকে অনায়াসে নিগ্রহ করিতেন। তিনি কখন কখন তাহাদিগকে ভূতলে নিক্ষেপ করিয়া, কেশধারণপূর্বক এমন বেগে আকর্ষণ করিতেন যে, তাহার কেহ ক্ষতজানু, কেহ ক্ষতমস্তক, কেহ বা ক্ষতস্কন্ধ হইয়া প্রাণনাশভয়ে পরিত্রাণাৰ্থ আৰ্তম্বরে চীৎকার করিতেন। জলক্রীড়ার সময়ে তিনি এককালে তাহাদের দশজনকে ধরিয়া জলে মগ্ন হইয়া থাকিতেন, পরিশেষে তাহারা মৃতকল্প হইলে ছাড়িয়া দিতেন। যংকালে তাঁহারা ফলচয়নার্থ বৃক্ষে আরোহণ করিতেন, ভীমসেন সেই সময়ে পাদাঘাতে সেই বৃক্ষ কম্পিত করিতেন; তাহারা প্রহারবেগ সহ করিতে না পারিয়া ফলের সহিত বৃক্ষ হইতে ভূতলে পতিত হইতেন। ফলতঃ ধার্তরাষ্ট্রে। কি বাহুযুদ্ধ, কি বেগ, কি শস্ত্রাভ্যাস, কিছুতেই ভীমকে পরাস্ত করি পারিতেন না। এইরূপে বৃকোদর সর্বদা সর্ববিষয়ে জয়ী হওয়াতে বাল্যকালবধি তাঁহাদের অত্যন্ত অপ্রিয় হইয়া উঠিলেন।
ধৃতরাষ্ট্রতনয়দিগের মধ্যে সর্বজ্যেষ্ঠ দুৰ্য্যোধন সর্বাপেক্ষা অধিকতর জুর, দুর্মতি, পাপাচার ও ঐশ্বৰ্য্যলুব্ধ ছিল। ঐ দুরাত্মা ভীমসেনের অপরিমিত পরাক্রম দর্শনে সাতিশয় উদ্বিগ্ন হইয়া মনে মনে চিন্তা করিল, কুন্তীর মধ্যমপুত্র বৃকোদর বলবা, বিক্রমশালী ও শৌর্যযুক্ত; এই দুরাত্মা একাকী আমাদিগের শত ভ্রাতাকে অবলীলাক্রমে পরাজয় করে; অতএব যখন ভীম পুরোদ্যানে নিদ্রিত থাকিবে, তখন ইহাকে ধরিয়া গঙ্গায় নিক্ষেপ করিব, তাহা হইলেই ইহার কনিষ্ঠ অর্জুন ও জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরকে বদ্ধ রাখিয়া অনায়াসেই সসাগরা পৃথিবী শাসন করিতে পারি। পাপাত্মা দুৰ্য্যোধন মনে মনে এইরূপ দুষ্ট অভিসন্ধি করিয়া মহাত্মা ভীমসেনের রন্বেষণে সর্বদা যত্ন করিতে লাগিল।
কিয়দ্দিনপরে দুর্মতি দুৰ্য্যোধন স্বীয় দুষ্টাভিসন্ধি সিদ্ধ করিবার আশয়ে জলবিহারার্থ গঙ্গাতীরে বসনবিরচিত ও কম্বলনির্মিত বিচিত্র গৃহসকল প্রস্তুত করাইল। ঐ সকল গৃহ অশেষবিধ ভোগ্যবস্তুদ্বারা পরিপূর্ণ ও অত্যুন্নত পতাকাসমুহে সুশোভিত করিল। তদনন্তর গঙ্গার পুলিনদেশে উদক ক্রীড়নক নামে একটী স্থান নির্দিষ্ট করিয়া পাপকাৰ্যনিপুণ ব্যক্তিদিগকে নানাবিধ চ্য, চোষ্য, লেহ, পেয় দ্বারা ঐ স্থান পরিপূর্ণ করিতে আদেশ করিল। তাহার। তাঁহার আদেশানুসারে সমস্ত কাৰ্য্য সুসম্পন্ন করিয়া সম্বাদ প্রদান করিলে দুর্মতি দুৰ্য্যোধন পাণ্ডবদিগের নিকটে গমনপূর্বক কহিল, চল আমরা সকল ভ্ৰাতায় একত্র হইয়া উদ্যানবনশোভিত গঙ্গায় জলক্রীড়া করি। সরলান্তঃকরণ যুধিষ্ঠির তৎক্ষণাৎ তাহার বাক্যে সম্মত হইলেন। তখন অপরিমিত শৌর্যশালী কৌরবগণ ও পাণ্ডবগণ কেহ নগরাকার রথে কেহ বা দেশজ অত্যুকৃষ্ট গজে আরোহণপূর্বক উদ্যানসমীপে সমুপস্থিত হইয়া, সিংহসমূহ যেমন গিরিগুহায় প্রবেশ করে, তদ্রূপ সেই উদ্যানবনমধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া উদ্যানশোভা নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। ঐ উদ্যান সুধাধবলিত রাজবোগ্য গৃহ, বলভী, গবাক্ষ ও জলযন্ত্রসমূহে ব্যাপ্ত; সৌধকারগণ গৃহসকল সম্মার্জিত ও চিত্রকরের। চিত্রিত করিয়াছে; সুশীতলজলপূর্ণ বৃহতী দীঘিক ও পুষ্করিণীসমূহ শোভা পাইতেছে। ঐ উদ্যানের সমুদায় জলভাগ সুকোমল কমলসমূহে ব্যাপ্ত এৰং স্থলভাগ বিবিধ স্থলজ পুষ্পে সমাকীর্ণ ছিল।
কৌরব ও পাণ্ডবগণ কিয়ৎক্ষণ সেই উদ্যানের শোভা নিরীক্ষণ করিয়া তথায় উপবেশনপূর্বক তত্রস্থ ভোগ্যবস্তুসকল ভক্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন। তাঁহারা সকৌতুকমনে আহার করিতে করিতে মিষ্টান্ন লইয়া পরস্পর পরস্পরের মুখে দিতে লাগিলেন। পাপাত্মা দুৰ্যোধন সেই অবসরে ভীমসেনকে বধ করিবার আশয়ে মিষ্টান্নে বিষমিশ্রিত করিয়া স্বয়ং গাত্রোত্থান পূর্বক ভাতার ন্যায় পরম সুহৃদের ন্যায় মিস্টবাক্য কহিতে কহিতে ভীমের বক্তে সেই বিষমিশ্রিত মিষ্টান্ন প্রদান করিল। সরলহৃদয় ভীমসেন, ঐ খাদ্য যে বিষমিশ্রিত,তাহা না জানিতে পারিয়া সাতিশয় প্রীতিপূর্বক সেই মিষ্টান্ন ভক্ষণ করিলেন। দুরাত্মা। দুৰ্য্যোধন তদ্দর্শনে আপনাকে কৃতকৃত্য জ্ঞান করিয়া মনে মনে হাসিতে লাগিল। তদনন্তর যাবতীয় ধার্তরাষ্ট্রগণ ও পাণ্ডবগণ একত্রিত হইয়া পরমাহলাদে জলক্রীড়া করিতে লাগিলেন। ক্রমে ভগবান্ ভাস্কর অস্তাচলচুড়াবলম্বী হইলে, তাঁহারা সকলে সাতিশয় পরিশ্রান্ত হইয়া জল হইতে গাত্রোত্থান করিলেন এবং বিহারগৃহে গমনপূর্বক ধৌতবস্ত্র পরিধান ও বিচিত্র অলঙ্কার ধারণ করিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিলেন। কেবল একাকী ভীমসেন বিষভক্ষণ ও ব্যায়ামধিক্য প্রযুক্ত একান্ত ক্লান্ত হইয়া গঙ্গার কচ্ছদেশে শয়ন করিবামাত্র নিদ্রায় অচেতন ও মৃতকল্প হইলেন। দুৰ্যোপন সেই অবসরে তাঁহাকে লতাপাশে বদ্ধ করিয়া স্থল হইতে জলে নিক্ষেপ করিল।
ভীমসেন কালকূটপ্রভাবে নিঃসংজ্ঞ হইয়াছিলেন। তিনি জলমগ্ন হইয়া ক্রমে ক্রমে নাৰ্গভবনে সমুপস্থিত ও নাগকুমারগণের উপর নিপতিত হইলেন। তদ্দর্শনে তত্রস্থ তীব্ৰবিষ বিষধরগণ ক্রোধপরতন্ত্র হইয়া সঁহাকে ভীষণদশনদ্বারা দংশন করিতে লাগিল। সৰ্পৰ্গণের জঙ্গমবিষদ্বারা ভীমশরীহ স্থাবর কালকূট বিষের তেজ একবারে বিলুপ্ত হইয়া গেল। সর্পগণের দংশনে ভীমের দৃঢ় কলেবর ক্ষত বিক্ষত হইয়াছিল, কিন্তু তাঁহার হৃদয়ের ত্বক এমন কঠিন যে, উহাতে বিন্দুমাত্রও দশনচিহ্ন হইল না।
এইরূপে ভীমপরাক্রম ভীমসেন সর্পগণ কর্তৃক দষ্ট হওয়াতে কালকূট বিষ হইতে মুক্ত হইয়া সংজ্ঞা লাভপূর্বক সর্পগণকে সংহার করিতে লাগিলেন। উহাদের মধ্যে যাহারা ভীমের হস্ত হইতে পলাইয়া আত্মরক্ষা করিতে পারিয়াছিল, তাহারা বাসবতুল্য প্রভাবশালী নাগরাজ বাসুকির নিকটে সত্বর গমন করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে নিবেদন করিল, হে নাগেন্দ্র! এক মহাবল পরাক্রান্ত মানব আমাদিগের পাতালপুরে আসিয়া মহা উপদ্রব করিতে আরম্ভ করিয়াছে; যখন ঐ ব্যক্তি এখানে সমুপস্থিত হয়, তখন হস্তপদে বদ্ধ ও অচেতন, বোধ হয় বিষপান করিয়াছিল, এখানে আসিয়া আমাদিগের শিশু সন্তানগণের উপর নিপতিত হওয়াতে আমরা ক্রুদ্ধ হইয়া উহাকে দংশন করিলাম, পরে সে চৈতন্যলাভ করিয়া স্বীয় হস্ত পদের বন্ধন চ্ছেদনপূর্বক আমাদিগকে বিনাশ করিতে আরম্ভ করিল; ঐ নর প্রায় আমাদের সকলকেই বিনাশ করিয়াছে, কেবল আমরা কয়েকজনমাত্র কৌশলক্রমে পলাইয়া আসিয়াছি,এক্ষণে আপনি গিয়া তাহার পরিচয় গ্রহণ করুন।”
নাগরাজ বাসুকি সর্পগণের বচনানুসারে তাহাদিগকে সমভিব্যাহারে লইয়া তথায় গমন পূর্বক মহাবাহু ভীমসেনকে দেখিতে পাইলেন। নাগরাজ দেখিবামাত্র তাঁহাকে স্বদৌহিত্র কুন্তিভোজের দৌহিত্র বলিয়া জানিতে পারিয়া প্রাতিপ্ৰসন্নচিত্তে সাদরসম্ভাষণপূর্বক আলিঙ্গন করিলেন এবং তাহার উপর সাতিশয় প্রসন্ন হইয়া প্রচুর ধন ও রত্ন প্রদান করিলেন। তখন কোন সর্প কহিল, হে নাগেন্দ্র! যদি ভীমের প্রতি অনুকূল হইয়া থাকেন, তবে যে কুণ্ড রক্ষার নিমিত্ত সহস্র নাগসৈন্য প্রতিষ্ঠিত আছে, সেই কুণ্ড হইতে তাহাকে উদরপূরণ করিয়া অমৃতপান করিতে অনুমতি করুন। নাগরাজ তথাস্তু বলিয়া সম্মতি প্রদান করিলেন। তখন ভীমসেন অন্যান্য নাগগণের আশীর্বাদগ্ৰহণপুরঃসর শুচি হইয়া পূৰ্বমুখে উপবেশনপূর্বক অমৃতপান করিতে আরম্ভ করিলেন। তিনি এক এক নিঃশ্বাসে এক এক কুণ্ড অমৃতপান করিতে লাগিলেন। এইরূপে ক্রমে ক্রমে আট কু পান করিয়া ফেলিলেন। অমৃতপান সমাপ্ত হইলে মহাভুজ বৃকোদর নাগদত্ত দিব্য শয্যায় শয়ন করিয়া পরমসুখে নিদ্রিত হইলেন।