গোবিন্দেরে লইয়া নারদ-মুনি যান।
বিষণ্ন বদন হৈয়া সত্যভামা চান।।
ঘন পড়ি উঠি ধায় বাতুল-সমান।
দুই হাতে আগুলিয়া মুনিরে রহান।।
বুঝিনু নারদ-মুনি চতুরালি তোর।
ভাড়াইয়া লেয়া যাও প্রাণপতি মোর।।
বালকে ভাঁড়ায় যেন হাতে দিয়া কলা।
কাঁচ দিয়া লৈয়া যাও কাঞ্চনের মালা।।
শিলা দিয়া লৈয়া যাও পরশ-রতন।
শুধু কায় দিয়া যাও লইয়া জীবন।।
না চাহি যে ব্রত, না চাহি যে ফল তার।
বাহুড়িয়া প্রাণনাথে দেহ ত আমার।।
মুনি বলে, সত্যভামা সত্যভ্রষ্টা হৈলা।
সবাকার সাক্ষাতে গোবিন্দে দান দিলা।।
এক্ষণে কহিছ ব্রতে নাহি প্রয়োজন।
দান লইয়াছি আমি, দিব কি কারণ।।
একক দেখিয়া চাহ বল করিবারে।
মোর ঠাঁই লইতে কাহার শক্তি পারে।।
এত বলি নারদ ঘুরান দুই আঁখি।
শরীর কম্পিত দেবী মুনি-মুখ দেখি।।
সত্যভামা বলে, তব ক্রোধ নাহি ডরি।
বড় ক্রোধ হইলে ফেলাবে ভস্ম করি।।
গোবিন্দ-বিচ্ছেদে মরি, সেই মোর সুখ।
না দেখিব কৃষ্ণে আর, এই বড় দুখ।।
এক কথা কহি, অবধান কর মুনি।
পূর্ব্বে যে বলিলা ব্রত করিল ইন্দ্রাণী।।
পার্ব্বতী করিল আর স্বাহা অগ্নি-প্রিয়া।
তারা পুনঃ স্বামী পেলে কেমন করিয়া।।
নারদ বলেন, সর্ব্বভক্ষ্য হুতাশন।
চারি মুখে ধরে তার প্রচণ্ড কিরণ।।
তাহারে লইয়া সতি কি করিব আমি।
সে কারণে স্বাহারে ফিরায়ে দিনু স্বামী।।
পার্ব্বতীর পতি রুদ্র বলদ-বাহন।
হাড়মালা, ভস্ম মাখে অঙ্গে ফণিগণ।।
নিরন্তর ভূত প্রেত লৈয়া তার মেলা।
না নিলাম তাহারে করিয়া অবহেলা।।
শচীপতি পুরন্দর সহস্রলোচন।
ত্রৈলোক্য পালিতে ধাতা কৈল নিয়োজন।।
কভু ঐরাবতে, কভু উচ্চৈঃশ্রবা রথে।
বিনা বাহনেতে ইন্দ্র না পারে চলিতে।।
তারে না নিলাম আমি ইহার লাগিয়া।
তথাপিহ স্বর্গে আছে আমার হইয়া।।
তোমার এ স্বামী কৃষ্ণ রূপে নাহি সীমা।
তিনলোক মধ্যে দিব কাহাতে উপমা।।
যথায় যাইব, তথা সঙ্গে করি লব।
অনুক্ষণ দিবানিশি নয়নে দেখিব।।
জনমে জনমে মোর এই বাঞ্ছা ছিল।
অনেক তপের ফলে বিধ মিলাইল।।
নয়ন মুদিয়া মুনি ধ্যান করে যাঁকে।
তাঁহাকে পাইয়া হাতে দিব কি তোমাকে।।
আসিতেছি যাঁর চিন্তা করি নিরবধি।
দরিদ্র কি ছেড়ে দেয় পেলে সেই নিধি।।
ব্রতের কারণ ছেড়ে দিলে কৃষ্ণধন।
ব্রতফল কিন্তু তাহা নাহি পারে।।
এ কথা শুনিয়া সতী হলেন মূর্চ্ছিতা।
নাহি জ্ঞান, সত্যভামা মৃতা কি জীবিতা।।
দেখিয়া সতীর কষ্ট কৃষ্ণে হৈল দয়া।
নারদেরে বলেন, ছাড়হ মুনি মায়া।।
নারদ বলেন, কর্ম্ম ভুঞ্জুক আপন।
তোমারে ত্যজিয়া দিল ব্রত-ফলে মন।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, অজ্ঞ সহজে স্ত্রীজাতি।
কোথা পাইবেক জ্ঞান তোমার যেমতি।।
শরীরে নাহিক প্রাণ, হেন লয় মনে।
যোগবলে আত্মা মুনি দেহ এইক্ষণে।।
দেখিয়া সতীর কষ্ট মুনি চমৎকার।
উঠহ বলিয়া ডাকিলেন বারেবার।।
মুনির আশ্বাসে দেবী পাইয়া চেতন।
উঠিয়া ধরেন পুনঃ মুনির চরণ।।
নারদ বলেন, দেবি এক কর্ম্ম কর।
দান দিয়া লৈতে চাহ, অধর্ম্ম দুস্তর।।
গোবিন্দে তৌলিয়া দেহ আমারে রতন।
পাইবা ব্রতের ফল শাস্ত্রেতে যেমন।।
শুনি সত্যভামা মনে হইয়া উল্লাস।
পুত্রগণে ডাকিয়া কহেন মৃদুভাষ।।
করহ তুলেন সজ্জা, যে আছে বিহিত।
মম গৃহ হৈতে রত্ন আনহ ত্বরিত।।
আজ্ঞা পেয়ে কামাদি যতেক পুত্রগণ।
কনকে নির্ম্মাণ তুল কৈল ততক্ষণ।।
এক ভিতে বসাইল দৈবকী-নন্দনে।
আর ভিতে বসাইল যত রত্নগণে।।
সত্যভামা-গৃহে রত্ন যতেক আছিল।
তুলে চড়াইল, তবু সমান নহিল।।
রুক্মিণী কালিন্দী নগ্নজিতা জাম্ববতী।
যে যাহার ঘর হৈতে আনে শীঘ্রগতি।।
চড়াইল তুলে, তবু সমতুল নহে।
ষোড়শ-সহস্র কন্যা নিজধন বহে।।
কৃষ্ণের ভাণ্ডারে ধন কুবের জিনিয়া।
ত্বরা করি চড়াইল তুলে সব লৈয়া।।
না হয় কৃষ্ণের সম, অপরূপ কথা।
দ্বারকাবাসীর দ্রব্য যার ছিল যথা।।
শকটে উটেতে বৃষ বহে অনুক্ষণ।
নহিল কৃষ্ণের সম, দেখে সর্ব্বজন।।
পর্ব্বত-আকার চড়াইল রত্নগণে।
ভূমি হৈতে তুলিতে নারিল নারায়ণে।।
দেখি সত্যভাম দেবী করেন রোদন।
ক্রোধমুখে বলেন, নারদ তপোধন।।
উপেন্দ্রাণী বলিয়া বলাও এই মুখে।
রত্নে জুখি উদ্ধারিতে নারিলি স্বামীকে।।
শিশু প্রায় পুনঃপুনঃ করহ রোদন।
এত দিনে জানিলাম তব বিবরণ।।
বক্র চক্ষু করিয়া কহয়ে তপোধন।
হেন জন হেন ব্রত করে কি কারণ।।
এবে জানিলাম ধন না পারিলি দিতে।
উঠ বলি নারদ ধরেন কৃষ্ণ-হাতে।।
শুনি সত্যভামা মুখে না সরিল বুলি।
ভূমে গড়াগড়ি যায় আউদর-চুলী।।
হেনমতে কান্দে সব যাদবী যাদব।
হৃদয়ে চিন্তিয়া তবে বলে উদ্ধব।।
আপন শ্রীমুখে কহিয়াছেন বার বার।
আমা হৈতে নাম বিনা বড় নাহি আর।।
চিন্তিয়া বলিয়া সবে মোর বোল ধর।
যত রত্ন আছে তুলে ফেলাহ সত্বর।।
একৈক ব্রহ্মাণ্ড যার এক লোমকূপে।
কোন্ দ্রব্য সম করি তোলিবা তাহাকে।।
এত বলি আনি এক তুলসীর দাম।
তাহে দুই অক্ষর লিখিল কৃষ্ণনাম।।
তুলের উপরে দিল তুলসীর পাত।
নীচে হৈল তুলসী ঊর্দ্ধেতে জগন্নাথ।।
দেখি উল্লাসিতা হৈলা সকল রমণী।
সাধু সাধু বলিয়া হইল মহাধ্বনি।।
কৃষ্ণ-নাম গুণের নাহিক বেদে সীমা।
বৈষ্ণবে সে জানে কৃষ্ণনামের মহিমা।।
শ্রীকৃষ্ণ হইতে কৃষ্ণনাম ধন বড়।
জপহ কৃষ্ণের নাম চিত্তে করি দৃঢ়।।
কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলিয়া পাইবা কৃষ্ণদেহ।
কৃষ্ণের মুখের বাক্য নাহিক সন্দেহ।।
নাম পত্র লৈয়া মুনি তুষ্ট হৈয়া যান।
সত্যভামা রত্ন ধন ব্রাহ্মণে বিলান।।
পারিজাত হরণের এই বিবরণ।
এক্ষণে কহিব তবে সুভদ্রা হরণ।।
মহাভারতের কথা অমৃতের ধার।
শুনিলে অধর্ম্মী হৈবে হেলে ভবপার।।
পারিজাত হরণে হরিষ রসকথা।
শ্রবণে শুনিলে ঘুচে সংসারের ব্যথা।।
পুরুষ শুনিলে হয় কৃষ্ণপদে মতি।
নারীজন শুনিলে সৌভাগ্য হয় পতি।।
আয়ুধন বংশ বাড়ে সর্ব্বত্র কল্যাণ।
কাশীদাস কহে, তাহা করিয়া প্রমাণ।।