১২৭তম অধ্যায়
ভীমের অর্জ্জুন-অনুসরণযাত্রা
সঞ্জয় কহিলেন, “ভীমসেন যুধিষ্ঠিরকে বলিলেন, ‘মহারাজ। পূর্ব্বে প্রজাপতি ব্রহ্মা, ইন্দ্র ও মহেশ্বর যে রথে আরোহণ করিতেন, মহাবীর অর্জ্জুন ও কৃষ্ণ সেই রথে আরোহণপূর্ব্বক গমন করিয়াছেন, অতএব তাঁহাদের আর কিছুই ভয় নাই। যাহা হউক, আমি আপনার আজ্ঞা শিরোধার্য্য করিয়া গমন করিতেছি। আপনি আর শোক করিবেন না। আমি তাঁহাদিগের নিকট উপস্থিত হইয়াই আপনাকে সংবাদ প্রদান করিব।’
‘হে কুরুরাজ! মহাবলপরাক্রান্ত ভীম এই কথা বলিয়া ধৃষ্টদ্যুম্ন ও অন্যান্য সুহৃদগণের হস্তে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে বারংবার সমর্পণ করিয়া প্রস্থানের উদ্যোগ করিতে লাগিলেন। পরে তিনি মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্নকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে মহাবাহো! মহারথ দ্রোণ ধর্ম্মরাজকে গ্রহণ করিবার নিমিত্ত যেরূপ উপায় করিতেছেন, তাহা কিছুই তোমার অবিদিত নাই। এক্ষণে ধর্ম্মরাজকে রক্ষা করা আমার যেরূপ আবশ্যক, অর্জ্জুনসমীপে গমন তদ্রূপ নহে; কিন্তু ধর্ম্মনন্দন যে সমস্ত কথা কহিলেন, আমি তাঁহার প্রত্যুত্তরপ্রদানে সমর্থ নহি, নিঃশঙ্কমনে তাঁহার বাক্য রক্ষা করাই আমার কর্ত্তব্য; এক্ষণে যে স্থানে আসন্নমৃত্যু সৈন্ধব অবস্থান করিতেছে, আমি মহাবীর অর্জ্জুন ও সাত্যকির অনুসরণক্রমে তথায় প্রস্থান করিব। তুমি সাবধানে ধর্ম্মরাজকে রক্ষা কর; তাঁহাকে রক্ষা করাই সর্ব্বাপেক্ষা মহৎ কার্য্য।’ মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন ভীমের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, ‘হে বীর! আমি তোমার অভিলাষ পূর্ণ করিব। তুমি কিছুমাত্র চিন্তা না করিয়া প্রস্থান কর। দ্রোণ ধৃষ্টদ্যুম্নকে বিনষ্ট করিয়া ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে গ্রহণ করিতে সমর্থ হইবেন না।’ কুণ্ডলযুগলালঙ্কৃত, অঙ্গদপরিশোভিত, তরবারিধারী মহাবীর ভীম এইরূপে ধৃষ্টদ্যুম্নের হস্তে পাণ্ডবরাজ যুধিষ্ঠিরকে সমর্পণ ও ধর্ম্মরাজের পাদবন্দনপূর্ব্বক প্রস্থানের উপক্ৰম করিলেন। ধর্ম্মরাজ তাঁহাকে আলিঙ্গন ও তাঁহার মস্তক আঘ্রাণ করিয়া শুভ আশীর্ব্বাদ করিতে লাগিলেন। ভীমসেন অর্চিত, সন্তুষ্টচিত্ত ব্রাহ্মণগণকে প্রদক্ষিণ ও অষ্টবিধ মাঙ্গল্যদ্রব্য স্পর্শপূর্ব্বক কৈরাতক মদ্য পান করিলেন। তখন তাঁহার লোচনযুগল রক্তবর্ণ ও তেজোরাশি দ্বিগুণ পরিবর্দ্ধিত হইয়া উঠিল। অনিল অনুকূলগামী হইয়া তাঁহার বিজয়লাভ সূচিত করিতে লাগিল। ব্রাহ্মণগণ তাঁহাকে আশীর্ব্বাদ করিলেন। তিনি মনে মনে জয়লাভজনিত আনন্দ অনুভব করিতে লাগিলেন। তাঁহার সুবর্ণখচিত মহামূল্য লৌহনির্মিত বর্ম্ম বিদ্যুদ্দামমণ্ডিত জলপটলের ন্যায় শোভা ধারণ করিল। তিনি শুক্ল, কৃষ্ণ, পীত ও রক্তবর্ণ বস্ত্র পরিধান এবং কণ্ঠত্রাণ ধারণপূর্ব্বক ইন্দ্রায়ুধবিভূষিত অম্বুদের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন।
‘ইত্যবসরে পুনরায় পাঞ্চজন্যশঙ্খ ধ্বনিত হইল। ধর্ম্মনন্দন রাজা যুধিষ্ঠির সেই ত্রৈলোক্যত্রাসন [ত্রিলোকের ত্ৰাসজনক] ভয়ঙ্কর শঙ্খধ্বনি শ্রবণগোচর করিয়া পুনৰ্ব্বার ভীমকে কহিলেন, ‘হে ভীম! ঐ দেখ, শঙ্খোত্তম পাঞ্চজন্য বৃষ্ণিপ্রবীর কৃষ্ণের মুখমারুতে পরিপূরিত হইয়া পৃথিবী ও অন্তরীক্ষ অনুনাদিত করিতেছে। নিশ্চয়ই বোধ হয়, ধনঞ্জয় ঘোরতর বিপদে নিপতিত হওয়াতে চক্রগদাধর বাসুদেব কৌরবগণের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। আজ নিশ্চয়ই আৰ্য্যা কুন্তী, দ্রৌপদী ও সুভদ্রা বন্ধুবান্ধবগণসমভিব্যাহারে অশুভ নিমিত্ত সন্দর্শন করিতেছেন। অতএব হে ভীম! তুমি অবিলম্বে অর্জ্জুনের নিকট গমন কর। মহাবীর অর্জ্জুন ও সাত্যকিকে অবলোকন না করিয়া আমি দশদিক্ শূন্যময় দেখিতেছি।’
ব্যূহপথে ভীমসহ কৌরবগণের যুদ্ধ
“হে মহারাজ! প্রবলপ্রতাপশালী ভ্রাতৃহিতনিরত মহাবীর ভীম এইরূপে বারংবার জ্যেষ্ঠসহোদরকর্ত্তৃক অনুজ্ঞাত হইয়া গোধাঙ্গুলিত্রাণ বন্ধন ও শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক পুনঃ পুনঃ দুন্দুভিধ্বনি, শঙ্খনিনাদ ও সিংহনাদ পরিত্যাগপূর্ব্বক শত্রুগণকে ভয়প্রদর্শন করিয়া শরাসন আস্ফালন করিতে লাগিলেন। ঐ শব্দে বীরগণের অন্তঃকরণ অতিশয় বিচলিত হইয়া উঠিল। তখন তিনি জ্যেষ্ঠভ্রাতা যুধিষ্ঠিরের আদেশানুসারে যুদ্ধার্থ নির্গত হইলেন। বিশোকসারথিকর্ত্তৃক সংযোজিত, মনোমারুতগামী অশ্বসকল তাঁহাকে বহন করিতে লাগিল। মহাবীর বৃকোদর ধনুর্জ্যা আকর্ষণপূর্ব্বক বিপক্ষপক্ষীয় সেনাদিগকে অনুকর্ষণ [আলোড়িত] ও শস্ত্রদ্বারা ক্ষতবিক্ষত করিয়া বিমর্দ্দিত করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। অসুরগণ যেমন ইন্দ্রের অনুসরণ করিয়াছিল, তদ্রূপ পাঞ্চালেরা সোমকদিগের সহিত তাঁহার অনুগমন করিতে লাগিলেন। অনন্তর দুঃশল, চিত্রসেন, কুম্ভভেদী, বিবিংশতি, দুর্মুখ, দুঃসহ, বিকর্ণ, গল, বিন্দ, অনুবিন্দ, সুমুখ, দীর্ঘবাহু, সুদর্শন, বৃন্দারক, সুহস্ত, সুষেণ, দীর্ঘলোচন, অভয়, রৌদ্রকর্ম্মা, সুবর্ম্মা ও দুর্ব্বিমোচন, আপনার এই সমুদয় পুত্রেরা অসংখ্য সৈন্য ও পদাতিগণসমভিব্যাহারে পরমযত্নসহকারে ভীমসেনের প্রতি ধাবমান হইলেন। মহাবীর ভীম সেই সমস্ত বীরগণে পরিবৃত হইয়া তাঁহাদিগকে নিরীক্ষণপূর্ব্বক ক্ষুদ্র মৃগের প্রতি ধাবমান সিংহের ন্যায় তাঁহাদিগের প্রতি গমন করিতে লাগিলেন। ঘনমণ্ডল যেমন দিবাকরকে আচ্ছাদিত করে, তদ্রূপ সেই বীরগণ দিব্যাস্ত্রজাল বিস্তারপূর্ব্বক ভীমকে সমাচ্ছন্ন করিলেন। তখন মহাবীর বৃকোদর মহাবেগে তাঁহাদিগকে অতিক্রমপূর্ব্বক দ্রোণসৈন্যাভিমুখে ধাবমান হইয়া সম্মুখীন করিসৈন্যের প্রতি সুতীক্ষ্ণ শরনিকর বর্ষণপূর্ব্বক অবিলম্বে মাতঙ্গগণকে শরজালে ক্ষতবিক্ষত করিয়া চতুর্দ্দিকে বিদ্রাবিত করিলেন। মৃগকুল যেমন অরণ্যমধ্যে শরভগর্জ্জনে একান্ত বিত্রাসিত হয়, তদ্রূপ সেই দ্বিরদগণ নিতান্ত ভীত হইয়া ভৈরব রব পরিত্যাগপূর্ব্বক ইতস্ততঃ ধাবমান হইল। এইরূপে মহাবীর ভীম সেই করিসৈন্য অতিক্রম করিয়া মহাবেগে দ্রোণসৈন্যাভিমুখে ধাবমান হইলেন। তীরভূমি যেমন মহাসাগরকে অবরোধ করে, তদ্রূপ মহাবীর আচাৰ্য্য তাঁহাকে নিবারণ করিয়া হাস্যমুখে তাঁহার ললাটদেশে নারাচ প্রহার করিলেন। ভীমসেন দ্রোণের নারাচে বিদ্ধললাট হইয়া উৰ্দ্ধরশ্মি ভাস্করের ন্যায় অধিকতর শোভা পাইতে লাগিলেন।
দ্রোণভীমের সমরসম্ভাষণ
“অনন্তর আচাৰ্য্য দ্রোণ অর্জ্জুনের ন্যায় এই ভীমসেনও আমার সম্মান করিবেন, এইরূপ অবধারণ করিয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে ভীম! আমি তোমার বিপক্ষ; আজ আমাকে পরাজয় না করিয়া তুমি কোনক্রমেই শত্রুসৈন্যমধ্যে প্রবেশ করিতে পারিবে না। যদিও তোমার অনুজ অর্জ্জুন আমার আদেশানুসারে সেনামধ্যে প্রবেশ করিয়াছে, তথাচ তুমি তদ্বিষয়ে কোনক্রমেই কৃতকাৰ্য্য হইতে সমর্থ হইবে না। তখন নির্ভীক ভীমসেন গুরু দ্রোণের বাক্য শ্রবণ করিয়া ক্রুদ্ধমনে আরক্তলোচনে তৎক্ষণাৎ কহিলেন, ‘হে ব্রহ্মবন্ধো! নিতান্ত দুর্দ্ধর্ষ মহাবীর অর্জ্জুন বলনিসূদন ইন্দ্রের বল’মধ্যে প্রবেশ করিতে পারেন; তিনি যে তোমার আদেশানুসারে সমরসাগরে প্রবেশ করিয়াছেন, ইহা কখনই সম্ভবপর নহে। তিনি তোমাকে অর্চনা করিয়া সম্মান করিয়াছেন। কিন্তু আমি কৃপাপরবশ অর্জ্জুন নহি; আমি তোমার পরমশত্রু ভীমসেন। হে আচাৰ্য্য! তুমি আমাদের পিতা, গুরু ও বন্ধু এবং আমরা তোমার পুত্র। আমরা এইরূপ বিবেচনা করিয়াই তোমার নিকট প্রণতভাবে অবস্থান করিয়া থাকি, কিন্তু আজ তুমি আমাদিগের প্রতি বিপরীত বাক্য প্রয়োগ করিতেছ। এক্ষণে যদি তুমি আপনাকে আমাদের বিপক্ষ বোধ করিয়া থাক, তাহাতে কিছুমাত্র ক্ষতি নাই। আমি অবিলম্বেই তোমার শত্রুর ন্যায় কাৰ্যানুষ্ঠান করিব।’ মহাবীর ভীম এই বলিয়া অন্তক যেমন কালদণ্ড বিঘূর্ণিত করেন, তদ্রূপ গদা বিঘূর্ণনপূর্ব্বক দ্রোণের প্রতি পরিত্যাগ করিলেন। সমরবিশারদ দ্রোণ তৎক্ষণাৎ রথ হইতে অবতীর্ণ হইলেন। তখন ভীম তাঁহার অশ্ব, রথ, সারথি ও ধ্বজ বিপ্রোথিত করিয়া ফেলিলেন এবং সমীরণ যেমন প্রবলবেগে মহীরুহসমুদয় বিমর্পিত করে, তদ্রূপ তাঁহার সৈন্যগণকে মন্থন করিতে লাগিলেন। হে মহারাজ! ঐ সময় আপনার পুত্রগণ পুনরায় ভীমকে পরিবেষ্টন করিলেন। মহাবীর দ্রোণ অন্য রথে আরোহণ করিয়া যুদ্ধার্থ ব্যূহমুখে সমুপস্থিত রহিলেন। তখন মহাবলপরাক্রান্ত ভীম নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া সম্মুখীন রথ সৈন্যকে লক্ষ্য করিয়া শরনিকর পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। আপনার আত্মজগণ ভীমশরে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়াও জয়লাভাভিলাষে তাঁহার সহিত ঘোরতর সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন।
ভীমকর্ত্তৃক দুৰ্য্যোধনভ্রাতা অভয়াদি বধ
“অনন্তর দুঃশাসন রোষপরবশ হইয়া ভীমসেনকে বিনাশ করিবার নিমিত্ত তাঁহার প্রতি এক যমদণ্ডোপম সুতীক্ষ্ণ শক্তি নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর ভীম সেই দুঃশাসনপ্রেরিত শক্তি সমাগত দেখিয়া দুইখণ্ডে ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তদ্দর্শনে সকলেই চমৎকৃত হইল। অনন্তর ভীমসেন কুম্ভভেদী, সুষেণ ও দীর্ঘনেত্রকে তিন তিন শরে বিদ্ধ করিলেন এবং তৎপর কুরুকুলকীৰ্ত্তিবৰ্ধন মহাবীর বৃন্দারককে শরবিদ্ধ করিয়া যুদ্ধে উদ্যত মহাবলপরাক্রান্ত আপনার পুত্র অভয়, রৌদ্রকর্ম্মা ও দুর্বিমোচন—এই তিনজনকে তিনশরে সংহার করিয়া ফেলিলেন। তখন আপনার অন্যান্য আত্মজগণ ভীমশরে প্রহৃত হইয়া তাঁহাকে চতুর্দ্দিকে বেষ্টন করিলেন এবং জলধর যেমন ধরণীধরের উপরিভাগে জলধারা বর্ষণ করে, তদ্রূপ ভীমের উপর শরনিকর বর্ষণ করিতে লাগিলেন। পর্ব্বতে প্রস্তরবর্ষণ করিলে যেমন পর্ব্বতের কিছুমাত্র ক্লেশ হয় না, তদ্রূপ সেই বীরগণের বাণবর্ষণে ভীমের কিছুমাত্র ব্যথা জন্মিল না। তিনি আপনার আত্মজ বিন্দ, অনুবিন্দ ও সুবর্ম্মার প্রতি শরজাল বর্ষণপূর্ব্বক হাস্যমুখে তাহাদিগকে যমালয়ে প্রেরণ করিলেন। আপনার পুত্র সুদর্শনও ঐ সময় ভীমশরে বিদ্ধ হইয়া অবিলম্বে ভূতলে নিপতিত ও পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইলেন। পরে মহাবীর ভীম ক্ষণকালমধ্যে সেই সমস্ত রথসৈন্যকে চতুর্দ্দিকে বিদ্রাবিত করিলেন। আপনার পুত্রগণ ভীমভয়ে একান্ত বিহ্বল হইয়া রথনির্ঘোষসহকারে সহসা মৃগযুথের ন্যায় চারিদিকে ধাবমান হইলেন। ভীম তাঁহাদের সৈন্যগণের পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমনপূর্ব্বক কৌরবগণকে শরনিকরে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। তখন আপনার আত্মজগণ ভীমশরে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া তাঁহাকে পরিত্যাগপূর্ব্বক মহাবেগে অশ্বগণকে সঞ্চালিত করিয়া রণস্থল হইতে পলায়ন করিতে আরম্ভ করিলেন। এইরূপে মহাবীর ভীম তাঁহাদিগকে পরাজয় করিয়া বাহ্বাস্ফোটন, সিংহনাদ ও তলশব্দ করিতে লাগিলেন এবং পরিশেষে রথসৈন্যগণকে ভীত ও শ্রেষ্ঠ যোদ্ধাদিগকে নিহত করিয়া রথীদিগকে অতিক্রমপূর্ব্বক দ্রোণসৈন্যাভিমুখে ধাবমান হইলেন।”