১২৭. পাণ্ডুর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া
সপ্তবিংশত্যধিকশততম অধ্যায়।
তদনন্তর ধৃতরাষ্ট্র বিদুরকে আহ্বান করিয়া কহিলেন,—পাণ্ডু ও মাদ্রীয় সমুদায় প্রেতকাৰ্য্য হাতে পরমসমারোহ পূর্বক সুচারুরূপে সম্পন্ন হয় তদ্বিষয়ে তুমি যত্নবান হও এবং আঁহাদের দুইজনের যাবতীয় পশু, বস্ত্র, রত্ন ও ধন আছে, আর্থিগণের প্রার্থনানুসারে তৎসমুদায় প্রদান কর। কুন্তী দ্বারা মাদ্রীর সৎকার করাও। মাদ্রীকে এরূপ সুসন্থত করিবে যে, অন্যের কথা দূরে থাকুক, যেন বায়ু বা সূৰ্য্যও তাহাকে দেখিতে না পান। মহারাজ পাণ্ডুর নিমিত্ত আর শোক করিবার আবশ্যকতা নাই, বরং তিনি অতিমাত্র প্রশংস নীয়। যেহেতু সেই মহাত্মা মহাবল পরাক্রান্ত পঞ্চপুত্র রাখিয়া স্বর্গে গমন করিয়াছেন।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে ভরতকুলতিলক জনমেজয়! বিদুর ধৃতরাষ্ট্রের বাক্য শ্রবণানন্তর “যে অজ্ঞা” বলিয়া ভীষ্মকে সমভিব্যাহারে লইয়া অতি পবিত্র প্রদেশে পাণ্ডুর অগ্নিসংস্কার করিতে চলিলেন। কুরুপুরোহিতগণ পাণ্ডু রাজের আজ্যগন্ধপরিপূত প্রদীপ্ত জাতাগ্নি লইয়া সত্বর গমন করিতে লাগিলেন। অমাত্য, জ্ঞাতি ওবান্ধঝাণ একত্র হইয়া বিবিধ গন্ধদ্রব্য ও নানাজাতীয় পুষ্পদ্বারা পাণ্ড ও মাদ্রীর মৃত কলেবর বিভূষিত করিলেন। পরে, মহার্ঘবস্ত্রাচ্ছাদিত শিবিকার মধ্যে সেই দুই মৃত শরীর সংস্থাপন করিয়া সকলে স্কন্ধে লইয়া চলিলেন। তৎকালে কেহ বা শ্বেতচ্ছত্র ধারণ, কেহ বা চামর ব্যজন করিতে আরম্ভ করিল। চতুর্দিকে নানাপ্রকার বাদ্যোদ্যম হইতে লাগিল। শত শত ব্যক্তি পাণ্ডর পূর্বসঞ্চিত বিবিধ ধনরত্ন লইয়া যাচকগণকে প্রদান করিতে লাগিল। শুক্লাম্বরধারী যাজকগণ প্রদীপ্ত হুতাশনে আহুতি প্রদান করিতে করিতে তাহাদের অগ্রে অগ্রে গমন করিতে লাগিল। সহস্র সহস্র ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র “হায়! কি হইল! মহারাজ! আমাদিগকে অপার দুঃখার্ণবে পরিত্যাগ করিয়া কোথায় চলিলেন” এই বলিয়া করুণস্বরে রোদন করিতে করিতে পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন। তদনন্তর পাণ্ডু ও মাদ্রীর শিবিকাবাহী পাণ্ডবগণ এবং ভীষ্ম ও বিদুর অপূর্ণনয়নে বনোদ্দেশে রমণীয় ভাগীরথীতীরে সমুপস্থিত হইয়া স্কন্ধস্থিত শিবিকা অবতরণ করিলেন এবং তন্মধ্য হইতে মহারাজের মৃত কলেবর বহিষ্কৃত করিয়া তাহাতে কালাগুরু ও চন্দন প্রভৃতি বিবিধ গন্ধদ্রব্য লেপনপূর্বক সুবর্ণ কলস দ্বারা জলসেচন করিতে লাগিলেন। তৎপরে সেই মৃতদেহে পুনৰ্বার নানাবিধ গন্ধদ্রব্য লেপন করিয়া স্বদেশীয় শুভ্র বস্ত্র পরিধান করাইলেন। মহারাজ পাণ্ডু শুভ্রবসনাচ্ছন্ন ও চন্দনাদি বিবিধ সুগন্ধ গন্ধদ্রব্যদ্বারা অনুলিপ্ত হওয়াতে জীবিতের ন্যায় পরম রমণীয় শোভা ধারণ করিলেন। তদনন্তর তাঁহারা যাজকদিগের আজ্ঞানুসারে সমস্ত প্রেতকাৰ্য্য সুসম্পন্ন করণানন্তর মাদ্রীর সহিত রাজাকে ঘৃতাভিষিক্ত করিয়া চন্দন প্রভৃতি বহুবিধ সুগন্ধি কাষ্ঠদ্বারা দাহ কাতে লাগিলেন। কৌশল্যা চিতাগ্নিস্থ পুত্র ও পুত্রবধূর মৃত কলেবর দর্শনে শোকে নিতান্ত অধীরা হইয়া হা পুত্র! হা পুত্র! বলিয়া উচ্চৈঃস্বরে নোদন করিতে করিতে ধরাতলে পতিত ও মূৰ্জিত হইলেন। তাঁহাকে ভূতলে পতিত দেখিয়া রাজভক্তিপরায়ণ প্রজাগণ হায়! কি হইল! বলিয়া করুণস্বরে বোদন করিতে লাগিল। কুন্তী ধূলিধূসরিতকলেবর হইয়া কাতরস্বরে আর্তনাদ করিতে লাগিলেন। তাঁহার, ক্রন্দনধ্বনি শ্রবণে মনুষ্যের কথা দূরে থাকুক, তির্য্যগযোনিগত পশুপক্ষীরাও রোদন করিতে লাগিল। শান্তনুনন্দন ভীষ্ম, মহামতি বিদুর ও কৌরবগণ সাতিশয় দুঃখিত হইয়া অশ্রুমোচন করিতে লাগিলেন। তদনন্তর ভীষ্ম, বিদুর,রাজা ধৃতরাষ্ট্র,যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চ ভ্রাতা ও অন্যান্য জ্ঞাতিবর্গ এবং সমূস্ত কৌরববণিতাগণ একত্র হইয়া ক্রন্দন করিতে করিতে মহারাজ পাণ্ডুর উদকক্রিয়া সম্পাদন করিলেন। উদককাৰ্য্য সমাপন হইলে রাজ্যস্থ প্রজাগণ পিতৃশোকবিমূঢ়চিত্ত পাণ্ডবগণকে অশেষপ্রকারে সান্ত্বনা করিতে লাগিল। পাণ্ডবগণ শোকে অধীর হইয়া সবান্ধবে ভূতলে শয়ন করিলেন, নগরবাসী ব্রাহ্মণাদি বর্ণেরাও ভূমিশয্যায় শয়ান হইলেন। নগরবাসী আবালবৃদ্ধবনিতা প্রভৃতি সকলেই সেই দিবসবিধি দশ দিন নিতান্ত নিরানন্দ ও শোকসাগরে নিমগ্ন রহিল।