১২৭তম অধ্যায়
আশা-বিষয়ক আলোচনা—ঋষভ-সুমিত্র-সংবাদ
ভীষ্ম কহিলেন, “হে ধৰ্ম্মরাজ! মহাত্মা সুমিত্র মহর্ষিগণের নিকট এইরূপ প্রশ্ন করিলে পর তাঁহাদের মধ্যস্থলে উপবিষ্ট তপোধন ঋষভ ঈষৎ হাস্য করিয়া রাজাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, মহারাজ! পুৰ্ব্বে আমি তীর্থপর্য্যটনক্রমে নরনারায়ণের দিব্যাশ্রমে সমুপস্থিত হইয়া দেখিলাম, ঐ স্থানে রমণীয় বদরী এবং আকাশগামিনী মন্দাকিনীর উৎপত্তিকারণ মহান্ হ্রদ বিরাজিত রহিয়াছে, আর ভগবান্ অশ্বশিরাঃ নিরন্তর বেদপাঠ করিতেছেন। আমি সেই দিব্যাশ্রমদর্শনে যারপরনাই পরিতুষ্ট হইয়া, সেই হ্রদের সলিলে পিতৃগণ ও দেবগণের যথাবিধি তৰ্পণ করিয়া আশ্রমমণ্ডপে প্রবেশ করিলাম। আশ্রমের যে স্থানে মহর্ষি নর ও নারায়ণ অবস্থান করেন, তাহার অনতিদূরে আমার বাসস্থান নির্দিষ্ট হইল। আমি সেই স্থানে সুস্থচিত্তে উপবিষ্ট আছি, এমন সময়ে এক চীরাজিনধারী [ছিন্নবস্ত্রযুক্ত ও মৃগচর্ম্মধারী-দীনবেশ] কৃশকায় তপোধন তথায় সমুপস্থিত হইলেন। ঐ মহর্ষির শরীর অন্যান্য মনুষ্যের দেহ অপেক্ষা আটগুণ দীর্ঘ। উঁহার ন্যায় কৃশ ব্যক্তিও আর কখন আমার নয়নগোচর হয় নাই। তাঁহার শরীর কনিষ্ঠা অঙ্গুলির ন্যায় কৃশ। গ্রীবা, বাহু, চরণ ও কেশকলাপ অতি অদ্ভুতদর্শন; মস্তক, চক্ষু ও কর্ণ দেহের অনুরূপ এবং বাকশক্তি ও চেষ্টা অতি সামান্য। আমি সেই অলৌকিকদর্শন কৃশ তপোধনকে নিরীক্ষণপূৰ্ব্বক উদ্বিগ্ন ও ভীতচিত্তে তাঁহাকে অভিবাদন করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁহার সম্মুখে দণ্ডায়মান রহিলাম এবং পরিশেষে তাঁহার নিকটে আপনার নাম, গোত্র ও পিতার নাম নিবেদন করিয়া তাঁহার অনুমতিক্রমে আসনে উপবেশন করিলাম। আমি উপবিষ্ট হইলে সেই ধাৰ্ম্মিকাগ্রগণ্য মহর্ষি ঋষিসমাজে ধর্ম্মার্থযুক্ত বাক্য কীৰ্ত্তন করিতে লাগিলেন। ঐ সময়ে পুত্রশোকার্ত্ত ভূরিদ্যুম্নপিতা মহারাজ বীরদ্যুম্ন পুত্রের অন্বেষণার্থে বেগবান অশ্বে আরোহণপূৰ্ব্বক স্ত্রী ও সৈন্যসামন্তগণ সমভিব্যাহারে তথায় সমুপস্থিত হইয়া সেই মহর্ষিকে কহিলেন, ‘ভগবন্! আমি পূর্ব্বে এই স্থানে পুত্রকে দেখিতে পাইব, এই আশা করিয়া এই বনের সমুদয় স্থান পরিভ্রমণ করিয়াছিলাম; কিন্তু কুত্রাপি সেই ধার্ম্মিক তনয়কে দেখিতে পাই নাই। পুত্রকে দেখিতে না পাইয়া, “সে মহারণ্যে বিনষ্ট হইয়াছে, তাহার দর্শনলাভ নিতান্ত দুর্ল্লভ” বলিয়া বিবেচনা করিয়াছি; কিন্তু পুত্রপ্রাপ্তির আশা আমাকে পরিত্যাগ করিতেছে না। এক্ষণে আমি সেই আশায় নিতান্ত অভিভূত হইয়া মৃতকল্প হইয়াছি।’
“তখন সেই কৃশ তপোধন নরপতির বাক্য শ্রবণ করিয়া মুহূর্ত্তকাল অবাক্শিরা ও ধ্যাননিরত হইয়া রহিলেন। দুঃখসন্তপ্ত মহারাজ বীরদ্যুম্ন তাঁহাকে ধ্যানপরায়ণ দেখিয়া মৃদুস্বরে কহিলেন, ‘ভগবন্! যদি গোপনীয় না হয়, তাহা হইলে কোন্ বস্তু দুর্ল্লভ এবং আশা অপেক্ষা মহৎ কি, তাহা আমার নিকট কীৰ্ত্তন করুন।’
“তখন মহর্ষি কহিলেন, ‘মহারাজ! পূৰ্ব্বে এক মহর্ষি তোমার পুত্র ভূরিদ্যুম্নের নিকট কাঞ্চনকলস[মৃতপ্রায়] ও বল্কল প্রার্থনা করিলে সে স্বীয় দুর্ব্বুদ্ধি ও মন্দভাগ্যপ্রভাবে তাঁহাকে অবজ্ঞা করিয়া তাঁহার অভিলষিত দ্রব্য প্রদান করে নাই; এই নিমিত্তই বিষম বিপদে নিপতিত হইতে হইয়াছে।’
“নরপতি বীরদ্যুম্ন মহর্ষিকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া সেই লোকপূজিত তপোধনকে অভিবাদনপূর্ব্বক নিতান্ত অবসন্ন হইয়া রহিলেন। তখন সেই মহর্ষি আরণ্য বিধানানুসারে তাঁহাকে পাদ্য অর্ঘ্য প্রদানপূর্ব্বক অতিথিসৎকার করিলেন। অনন্তর অন্যান্য মহর্ষিগণ সপ্তর্ষিবেষ্টিত নক্ষত্রের ন্যায় সেই অপরাজিত [অজেয়] মহীপতি বীরদ্যুম্নকে পরিবেষ্টন করিয়া তাঁহার আশ্রমপ্রবেশের কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন।”