১২৬. হস্তিনায় পাণ্ডুর শব আনয়ন
ষড়বিংশত্যধিকশততম অধ্যায়।
বৈশম্পায়ন কহিলেন,—এইরূপে রাজর্ষি পাণ্ড কলেবর পরিত্যাগপূর্বক লোকান্তর গমন করিলেদেবতুল্য মহর্ষিগণ ও মন্ত্রবিৎ ব্রাহ্মণগণ একত্র হইয়া মন্ত্রণা করিলেন যে, “মহাযশা মহাত্মা মহারাজ পাণ্ড রাজ্য পরিত্যাগ করিয়া এস্থানে আমাদের শরণাগত হইয়া বহুদিবস পোনুষ্ঠান করিয়াছিলেন, এক্ষণে তিনি শিশুপুত্রগণ ও ভাৰ্যাকে আমাদিগের নিকটে রাখিয়া সুরলোকে গমন করিয়াছেন, অতএব তাহার পুল, কলত্রও মৃতদেহ লইয়া ভীষ্ম ও ধৃতরাষ্ট্রের নিকটে সমর্পণ করা আমাদিগের অবশ্য কর্তব্য।” মহর্ষিগণ এইরূপ পরামর্শ করিয়া কুন্তী, যুধিষ্টিরাদি পঞ্চ বালক এবং পাণ্ডু ও মাদ্রীর মৃত কলেবর লইয়া হস্তিনানগরে গমন করিলেন। পুত্রবৎসল। কুন্তী পতিবিহীন হইয়াও পুত্রমুখ নিরীক্ষণে এবং স্বদেশগমনে নিতান্ত ঔৎসুক্য প্রযুক্ত সাতিশয় আনন্দিতা, হইয়া সর্বাগ্রে গমন করিতে লাগিলেন। তাঁহারা অতি অল্প দিনের মধ্যেই কুরুজাঙ্গলে উপনীত হইয়া রজনী প্রভাত হইবামাত্র রাজদ্বারে সমুপস্থিত হইলেন। তখন তাপসগণের বাক্যানুসারে দ্বারবান তৎক্ষণাৎ রাজসভায় গিয়া তাহাদের আগমনবার্তা নিবেদন করিল। হস্তিনাপুরনিবাসী যাবতীয় ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রগণ তাপসদিগের আগমনবার্তা শ্রবণে সাতিশয় বিস্ময়াপন্ন হইলেন এবং আপন আপন পুত্র ও কলত্রগণ সমভিব্যাহারে বিবিধ যানে আরোহণ করিয়া তাহাদিগকে দর্শন করিতে চলিলেন। তাপসদর্শনার্থিনী জনতা রাজমার্গ আচ্ছন্ন করিয়া চলিল। তৎকালে তাহাদের সকলেরই অন্তঃকরণ ঈর্ষাশূন্য ও ধর্মপ্রবণ হইল। শান্তনুনন্দন ভীষ্ম, সোমদত্ত, বাহ্নিক,রাজর্ষি ধৃতরাষ্ট্র, বিদুর, দেবী সত্যবতী, যশস্বিনী কৌশল্যা ও অন্যান্য রাজপত্নীগণে পরিবৃত গান্ধারী এবং বিচিত্রাভরণবিভূষিত দুৰ্য্যোধন প্রভৃতি ধৃতরাষ্ট্রের দায়দগণ তাপসদর্শনে ব্যগ্রচিত্ত হইয়া গমন করিতে লাগিলেন। তদনন্তর পুরোহিত সহিত কৌরবগণ ও অন্যান্য পৌর ও জানপদগণ তপস্বীদিগকে দর্শন করিয়া দণ্ডবৎ প্রণিপাত করিলেন। পরে সেই সকল লোক ঋষিদিগের আদেশানুসারে উপবেশন করিলে মহাত্মা ভীষ্ম সমস্ত দর্শনার্থিগণকে নিস্তব্ধ দেখিয়া মহর্ষিদিগকে পাদ্য অর্ঘ দ্বারা যথাবিধি পূজা করত সমস্ত রাজ্য সমৰ্পণ করিলেন। তখন তাপসগণের মধ্যে পরিণতবয়স্ক এক মহর্ষি গাত্রোত্থান করিয়া অন্যান্য তপোধনের মত গ্রহণপূর্বক কহিতে লাগিলেন, হে মান্যবরগণ! যে কৌরবদায়াদ পাণ্ড নামক নরপতি সমস্ত ভোগসুখে জলাঞ্জলি প্রদানপূর্বক শতশৃঙ্গ পৰ্বতে গমন করিয়া ব্ৰহ্মচৰ্যব্রত অবলম্বন করিয়াছিলেন, তাঁহার জ্যেষ্ঠ ধর্মপত্নী কুন্তীর গর্ভে সাক্ষাৎ ধর্মের ঔরসে এই যুধিষ্ঠিরনাম পুত্র জন্মিয়াছেন, ভগবান বায় হইতে এই মহাবল পরাক্রান্ত ভীমসেন সমুৎপন্ন হইয়াছেন এবং দেবরাজ ইন্দ্রের ঔরসে এই ধনঞ্জয় নামে পুত্র জন্ম গ্রহণ করিয়াছেন। অর্জুনের যশোরাশি সমস্ত মেদিনীমগুলে বিস্তীর্ণ হইয়ং অন্যান্য মহাধনুর্দ্ধর বীরপুরুষগণের কীর্তি বিলুপ্ত করিবে। আর, এই যে দুই মহাধনুর্দ্ধর নরশ্রেষ্ঠকে দেখিতেছ, ইহারা সেই রাজর্ষির কনিষ্ঠা ধর্মপত্নী মাদ্রীর গর্ভে অশ্বিনীকুমারের ঔরসে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। হে কুরুকুলাগ্রগণ্যগণ! এইরূপে পরম ধর্মাত্মা মহাযশস্বী পাণ্ডু মহীপাল বনে বাস করিয়া নষ্টপ্ৰায় পৈতামহ, বংশের পুনরুদ্ধার করিয়াছেন। তোমরা এই পাণ্ডুপুত্রগণের বেদাধ্যয়নের বিষয় জ্ঞাত হইয়া পরম পরিতুষ্ট হইবে। সেই মনুজসত্তম রাজর্ষি পাণ্ডু অভিলষিত পুত্র লাভ করিয়া অদ্য, সপ্তদশ দিবস হইল, পরলোকে গমন করিয়াছেন। পতিব্রতা মাদ্ৰীও পতির লোকান্তরপ্রাপ্তি দর্শনে সাতিশয় দুঃখিত হইয়া তাহার মৃতদেহ আলিঙ্গন পূর্বক কলেবর পরিত্যাগ করিয়া পতিলোক প্রাপ্ত হইয়াছেন। তোমরা পাণ্ডু ও মাদ্রীর এই শবশরীরদ্বয় লইয়া কুন্তী ও যুধিষ্ঠিরাদি পঞ্চ ভ্রাতার সহিত তাঁহাদিগের অগ্নিকাৰ্য, প্রেতক্রিয়া এবং শ্রাদ্ধাদি সম্পাদন কর।” কুরুগণকে এই কথা বলিয়া তাপসগণ দেখিতে দেখিতে গুহকদিগের সহিত অন্তর্হিত হইলেন। তাহাদের সমাগমে হস্তিনাপুর গন্ধৰ্বাধিষ্ঠিতের ন্যায় অপূর্ব শোভা ধারণ করিয়াছিল। এক্ষণে তাঁহারা অন্তর্ধান করাতে পুরের আর সেরূপ শোভা রহিল না। সমাগত পৌর ও জানপদগণ সিদ্ধ মহর্ষিগণ দর্শনে বিস্ময়াপন্ন হইয়া স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিলেন।