১২৫তম অধ্যায়
আশার আকর্ষণ—সুমিত্রের মৃগ-অনুসরণ
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! আপনি সদাচারই পুরুষের প্রধান ধন বলিয়া কীৰ্ত্তন করিলেন। এক্ষণে আশা কিরূপে সমুৎপন্ন হয় এবং উহা কি পদার্থ, তাহা কীৰ্ত্তন করুন। ঐ বিষয়ে আমার মহা সন্দেহ সমুপস্থিত হইয়াছে। আপনি ভিন্ন আমার সন্দেহ দূর করে, এমন আর কেহই নাই। যুদ্ধ উপস্থিত হইবার পূৰ্ব্বে আমার মনে এই আশা জন্মিয়াছিল যে, দুর্য্যোধন সংগ্রামে প্রবৃত্ত না হইয়া আমাকে রাজ্যার্ধ প্রদান করিবে, কিন্তু সেই দুরাত্মা আমার আশা পূর্ণ না করিয়া আমাকে একেবারে জ্ঞানশূন্য [হতজ্ঞান] করিয়াছে। যাহা হউক, মানবমাত্রেরই অন্তঃকরণে আশা জন্মিয়া থাকে এবং উহা বিফল হইলেই তাহার মহাদুঃখ উপস্থিত হয়, সন্দেহ নাই। আমার বোধ হয়, আশা পর্ব্বত, বৃক্ষ বা আকাশ হইতেও উন্নত, অথবা ঔন্নত্যের [উন্নতির] ইয়ত্তা নাই। উহা অতি দুর্ব্বোধ, উহা অপেক্ষা দুর্দ্ধরও আর কিছুই নাই। যাহা হউক, এক্ষণে উহার স্বরূপ কীৰ্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, “মহারাজ! আমি এই উপলক্ষে রাজর্ষি সুমিত্রের ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। একদা নরপতি সুমিত্র মৃগয়ার্থ অরণ্যে গমনপূৰ্ব্বক আনতপৰ্ব্ব শরদ্বারা এক মৃগকে বিদ্ধ করিলেন। অপরিমিত-বলশালী মৃগ ভূপতির শরে বিদ্ধ হইয়া সেই বাণ লইয়া মহাবেগে প্রস্থান করিতে লাগিল; নরপতিও বেগে সেই মৃগের অনুসরণে প্রবৃত্ত হইলেন। তখন মৃগ ক্ষণকাল সমতল প্রদেশে গমন করিয়া দ্রুতবেগে বন্ধুর ভূমিতে গমন করিতে আরম্ভ করিল। খড়্গ, বৰ্ম্ম ও শরাসনধারী নরপতিও তারুণ্যপ্রযুক্ত মহাবেগে তাহার অনুগমন করিতে লাগিলেন। এইরূপে মহারাজ সুমিত্র মৃগের অনুসরণক্রমে ক্রমে ক্রমে অসংখ্য নদ, নদী, পল্বল [অল্পজলযুক্ত জলাশয়] ও অরণ্য অতিক্রম করিয়া একাকী বনমধ্যে বিচরণ করিতে আরম্ভ করিলেন; মৃগও স্বেচ্ছানুসারে মধ্যে মধ্যে তাঁহাকে সন্দর্শন করিয়া পুনরায় পূৰ্ব্বাপেক্ষা অধিকতর বেগে ধাবমান হইতে লাগিল। ঐ সময় নরপতির ভূরি ভূরি শরনিপাত সহ্য করিয়াও বারংবার তাহার সমীপে আগমন করাতে বোধ হইতে লাগিল যেন, সে ভূপতির সহিত ক্রীড়া করিতেছে। এইরূপে মৃগ বারংবার ভূপতিকে অতিক্রম ও পুনঃ পুনঃ তাঁহার সমীপে আগমন করাতে সুমিত্র ক্রুদ্ধ হইয়া এক মর্ম্মভেদী ঘোরতর শর শরাসনে সংযোগ করিয়া নিক্ষেপ করিলেন। তখন মৃগ তাঁহার বাণপথের দুই ক্রোশ অন্তরে গমনপূৰ্ব্বক স্বচ্ছন্দে অবস্থান করিতে লাগিল। ভূপতির অনলতুল্য শরও ব্যর্থ হইয়া অচিরাৎ মহারণ্যে প্রবেশ করিল; রাজাও তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন।”