১২৪তম অধ্যায়
ব্যূহমধ্যে অর্জ্জুনসহ সাত্যকির মিলন
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! আমার সেনামধ্যে কি এমন কোন মহারথ ছিল না যে, সেই অর্জ্জুনসমীপগামী কৌরবসৈন্যসংহৰ্ত্তা সাত্যকিকে প্রহার বা নিবারণ করে? ইন্দ্রতুল্যপরাক্রম সত্যবিক্রম সাত্যকি দানবনিপাতন মহেন্দ্রের ন্যায় একাকী সমরস্থলে কিরূপে সেই মহল্কাৰ্য্য সম্পাদন করিল? অথবা সাত্যকি বহুল সেনা মর্দ্দনপূর্ব্বক পথশূন্য করিয়া গমন করিয়াছিল, তাহাকে তথায় আক্রমণ করে, এমন কেহই ছিল না? যাহা হউক, সাত্যকি একাকী কিরূপে সেই সংগ্রামে প্রবৃত্ত মহাত্মাগণকে অতিক্রম করিয়া গমন করিলেন, তাহা কীৰ্ত্তন কর।”
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! আপনার সৈন্যমধ্যে অসংখ্য রথ, নাগ, অশ্ব ও পদাতি বৰ্তমান ছিল। তাহাদের বিক্রম দর্শন ও কোলাহল শ্রবণে বোধ হইতে লাগিল যেন, যুগান্তকাল সমুপস্থিত হইয়াছে। প্রতিদিন আপনার সৈন্যগণের যেরূপ ব্যূহ হইত, বোধহয় সেরূপ ব্যূহ জগতীতলে আর কোথাও হয় নাই। সমরসন্দর্শনার্থ সমাগত দেবগণ ও চারণগণ সেই সমুদয় ব্যূহদর্শনে চমৎকৃত হইয়া কহিয়াছেন যে, এতাদৃশ ব্যূহ আর কখনই হইবে না। বিশেষতঃ, জয়দ্রথবধসময়ে দ্রোণাচাৰ্য্য যেরূপ ব্যূহ রচনা করিয়াছিলেন, তাদৃশ ব্যূহ আর কখনই দৃষ্টিগোচর হয় নাই। ঐ ব্যূহমধ্যে পরস্পর ধাবমান সৈন্যসমুদয়ের প্রচণ্ড বাতাহত সমুদ্রনিঃস্বনের ন্যায় শব্দ সমুত্থিত হইতে লাগিল। আপনার ও পাণ্ডবদিগের বলমধ্যে অসংখ্য ভূপালগণ সমবেত হইয়াছিলেন, তাঁহারা ক্রোধান্বিতচিত্তে মহানাদ করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন মহাবীর ভীমসেন, ধৃষ্টদ্যুম্ন, নকুল, সহদেব ও ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ইঁহারা সকলেই সৈন্যগণকে কহিতে লাগিলেন, ‘হে বীরগণ! তোমরা শীঘ্র আগমন কর, প্রহার কর, ধাবমান হও। মহাবীর অর্জ্জুন ও সাত্যকি অরিসৈন্যমধ্যে প্রবেশ করিয়াছেন, এক্ষণে যাহাতে তাঁহারা শীঘ্র জয়দ্রথের রথের প্রতি গমন করিতে পারেন, তাহার চেষ্টা কর। আজ ধনঞ্জয় ও সাত্যকি নিধনপ্রাপ্ত হইলে কৌরবেরা কৃতার্থ হইবে এবং আমরা পরাজিত হইব। অতএব সত্বর মিলিত হইয়া বেগবান পবন যেরূপ সমুদ্রকে বিক্ষোভিত করে, সেইরূপ কৌরবসৈন্যগণকে বিক্ষোভিত কর। ভীমসেন, ধৃষ্টদ্যুম্নপ্রমুখ এইরূপ কহিলে মহাতেজাঃ সৈনিকগণ প্রাণপণে কৌরবগণকে শরসমূহদ্বারা অত্যন্ত আহত করিতে লাগিল। সুহৃদের হিতসাধনার্থ অস্ত্রে নিহত হইয়া স্বর্গে গমন করিতে তাহাদের কিছুমাত্র শঙ্কা হইল না। কৌরবপক্ষীয় যোদ্ধারাও যশঃপ্রার্থনা করিয়া যুদ্ধার্থ অবস্থান করিল।
“হে মহারাজ! সেই ভয়বহ তুমুল সংগ্রামে মহাবীর সাত্যকি সমস্ত সৈন্য পরাজিত করিয়া অর্জ্জুনের নিকট গমন করিলেন। চতুর্দ্দিকে বিচিত্র প্রভাসম্পন্ন কবচসমুদয়ে দিবাকরকরপ্রতিফলতি হওয়াতে সৈনিকগণের দৃষ্টি প্রতিহত হইল। ঐ সময় মহাবীর দুৰ্য্যোধন বহুত্নশালী পাণ্ডবগণের সৈন্যমধ্যে প্রবেশ করিলেন। তথায় তাঁহার ঘোরতর সংগ্রাম হইতে লাগিল।”
দুৰ্য্যোধনসহ যুধিষ্ঠিরাদির যুদ্ধ
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! মহাবীর দুৰ্য্যোধন সেই অসংখ্য সৈন্যমধ্যে প্রবিষ্ট ও বিপদ্গ্রস্ত হইয়া তোরণ পরিত্যাগ করেন নাই? একে অনেকের সহিত যুদ্ধ, তাহাতে আবার তিনি নরপতি, বিশেষতঃ চিরকাল সুখে সংবর্দ্ধিত হইয়াছেন; অতএব বোধ হয়, তাঁহার বিষম সঙ্কট উপস্থিত হইয়াছিল।”
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! আপনার পুত্র একাকী অনেকের সহিত অতি আশ্চৰ্য্য সংগ্রাম করিয়াছিলেন, শ্রবণ করুন। মত্তমাতঙ্গ যেরূপ নলিনীকুলকে আলোড়িত করে, তদ্রূপ মহাবীর দুৰ্য্যোধন পাণ্ডবসৈন্যকে মর্দ্দিত করিতে লাগিলেন। মহাবল ভীমসেন ও পাঞ্চালগণ সেনাগণকে নিহত দেখিয়া সকলেই রণস্থলে ধাবমান হইলেন। তখন মহাবীর দুর্য্যোধন ভীমসেনকে দশ, নকুল ও সহদেবকে তিন, ধর্ম্মরাজকে সাত, বিরাট ও দ্রুপদকে ছয়, শিখণ্ডীকে শত, ধৃষ্টদ্যুম্নকে বিংশতি এবং দ্রুপদপুত্রদিগকে তিন তিন শরে বিদ্ধ করিয়া অসংখ্য গজারোহী ও রথারোহী যোদ্ধাকে তীক্ষ্নশরাঘাতে প্রজান্তক [লোকসংহারকারী] অন্তকের ন্যায় সংহার করিয়া ফেলিলেন। তিনি কখন শরসন্ধান আর কখনই বা শরমোক্ষণ করিতে লাগিলেন, তাহা কিছুই দৃষ্টিগোচর হইল না। কেবল এইমাত্র দৃষ্ট হইল যে, তিনি শিক্ষা ও অস্ত্রবলে রিপুগণকে বিনাশ ও মণ্ডলীকৃত-কার্মুক [চারিদিকে ঘুরিয়া ঘুরিয়া ধনুকে বাণযোজন ও নিক্ষেপপরায়ণ] হইয়া অবস্থান করিতেছেন। অনন্তর, রাজা যুধিষ্ঠির দুইভল্লাস্ত্রে দুৰ্য্যোধনের সেই বৃহৎ কোদণ্ড ছেদনপূর্ব্বক তাঁহার উপর দশ বাণ নিক্ষেপ করিলেন। শরসমুদয় দুৰ্য্যোধনের বর্ম্মস্পর্শমাত্র ভগ্ন ও ধরাতলে নিপতিত হইল। দেবগণ বৃত্ৰবধকালে ইন্দ্রকে যেরূপ বেষ্টন করিয়াছিলেন, পাণ্ডবগণ তদ্রূপ যুধিষ্ঠিরকে বেষ্টন করিলেন। অনন্তর প্রবলপ্রতাপ দুৰ্য্যোধন অন্য এক শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক ‘থাক্ থাক্’ বলিয়া পাণ্ডবরাজের প্রতি ধাবমান হইলেন। জয়াভিলাষী পাঞ্চালেরা দুৰ্য্যোধনকে আগমন করিতে দেখিয়া হৃষ্টমনে তাঁহার সম্মুখীন হইলেন। সেই সময়ে দ্রোণ দুর্য্যোধনের রক্ষাৰ্থ যেরূপ পর্ব্বত প্রচণ্ড বায়ুবেগে সঞ্চালিত মেঘাবলীকে নিবারণ করে, তদ্রূপ পাঞ্চালগণকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। মহারাজ! সেই সময় কৌরব ও পাণ্ডবদিগের অতি ভীষণ লোমহর্ষণ সংগ্রাম উপস্থিত হইল। মৃতদেহে সমরভূমি শ্মশানসদৃশ হইয়া উঠিল। ঐ সময় মহাবীর ধনঞ্জয় যে দিকে অবস্থান করিতেছিলেন, সেই দিকে লোমহর্ষকর মহান শব্দ সমুত্থিত হইল। হে মহারাজ! এইরূপে মহাবাহু অর্জ্জুন ও সাত্যকি কৌরবপক্ষীয়সৈন্যের সহিত এবং ব্যূহদ্বারস্থিত দ্রোণাচার্য্য পাণ্ডবসৈন্যগণের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলে তাহাদের ক্রোধনিবন্ধন ঘোরতর জনসংক্ষয় সমুপস্থিত হইল।”